মুজফ্ফর আহ্মদ স্মরনে
সরোজ মুখোপাধ্যায়
কমরেড মুজফফর আহমদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গনশক্তি পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সেই বিশেষ সংখ্যায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র অনেক নেতৃত্বই মুজফ্ফর আহ্মদ স্মরনে লিখেছিলেন। সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষে সেই লেখাগুলির মধ্যে থেকে কয়েকটি আজ কাকাবাবুর ১৩৩তম জন্মদিবসে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত, শ্রমিক – কৃষক আন্দোলন ও কমিউনিস্ট সংগঠনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ এবং আজীবন বিপ্লবী মুজফ্ফর আহ্মদের জন্ম শতবর্ষ। মুজফফর আহমদের জন্মশতবর্ষ পূর্তির দিন ১৯৮৯ সালের ৫ই অগাস্ট।
মুজফ্ফর আহ্মদের বিপ্লবী জীবনের শিক্ষা ও প্রেরণা শ্রমজীবী আন্দোলন ও সংগঠনের শত সহস্র যুবক – যুবতী এবং কর্মী ও নেতাদের অগ্রগমনের পথে অমুল্য পাথেয়। তাঁর জন্মশতবর্ষে নতুন করে আমাদের – জনস্বার্থবাহী আন্দোলনকারীদের শপথ নিতে হবে – বিপ্লবের আঁকাবাঁকা পথে শত অত্যাচার ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হয়ে এগিয়ে যেতে হবে, পিছিয়ে থাকলে চলবে না। মুজফ্ফর আহ্মদ শিখিয়েছেন – ‘ এগিয়ে চলো, পিছিয়ে থেকো না। ‘ তিনি বলতেন, – সর্বহারা বিপ্লবের পথ মসৃণ নয়, এ পথে চলতে হলে অসীম ধৈর্য শুধু নয় অপরিসীম বৈপ্লবিক মনোবলের প্রয়োজন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদী তত্বেও সমৃদ্ধ হতে না পারলে এই বিপ্লবী মনোবল কখনোই সুদৃঢ় হতে পারে না।
তার জন্ম শতবর্ষে এই কথাগুলি স্মরণে আনতে হবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রামে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত করা ও পার্টি প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে মুজফফর আহমেদ লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ ও জনসাধারণের মধ্যে আজও অমর হয়ে আছেন। শ্রেণিসংগ্রাম সংগঠিত করা এবং সর্বহারা বিপ্লব সাধনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অবিচল। ৬০ বছর ধরে একনিষ্ঠ বিপ্লবী জীবন যাপন তাকে অমর করে রেখেছে।
মুজফ্ফর আহ্মদ বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপ সন্দ্বীপ ( অধুনা বাংলাদেশ ) শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮৯ সালের ৫ই আগস্ট। তার পিতা আইন ব্যবসায়ী মনসুর আলী। মার নাম চুনা বিবি। সন্দীপ কার্গিল হাইস্কুলে তিনি ভর্তি হন। ষোল বছর বয়সের সময় তার বাবা মারা যান। আবার তিনি কার্গিল হাই স্কুলে ভর্তি হন নিচের ক্লাসে। তার ইংরেজি ভাষা শেখার খুব ঝোঁক হয়। নোয়াখালী জেলা স্কুলে পড়ার সময় কলকাতায় আসেন।
হুগলি মহসিন কলেজ ও পরে বঙ্গবাসী কলেজে আই এ পড়তে পড়তে চাকরিতে প্রবেশ করেন কমরেড মুজফফর আহমদ। রাইটার্স বিল্ডিং-এর ছাপাখানা ও পরে হোম ডিপার্টমেন্টের অধীন বাংলা তর্জমা অফিসে কাজ করতে থাকেন। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত কোন না কোন লোকের বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাজও তিনি করেছেন। কলকাতার মুনশী আলিমুদ্দিনের চাঁদনীর বাড়িতে তিনি তিন বছর ছিলেন। বিখ্যাত মুনশী আলিমুদ্দিনের নামেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নামকরণ হয়েছে। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য দপ্তর বর্তমানে এই রাস্তার উপরেই অবস্থিত। এই সময়েই তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সহকারি সম্পাদক হয়ে সব সময় এর কর্মী ছিলেন। ১৯১৬ সাল থেকেই তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক মিছিল ও সভা-সমিতিতে যোগ দিতেন। “১৯১৮ সালের শেষাশেষিতে আমার যে সব সময়ের কর্মীর জীবন আরম্ভ হয়েছিল সেই জীবন আমার আজও পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে এই কয় ছত্র লেখার সময়ও চলেছে” – মুজফ্ফর আহ্মদের নিজেরই লেখা। তার পরেও মৃত্যুর দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি পার্টির সব সময়ের কর্মী ছিলেন।
সাহিত্য, না রাজনীতি এই নিয়ে তিনি ১৯১৯ সালে বেশ কিছুদিন চিন্তা করার পর ১৯২০ সালের শুরুতে স্থির করে ফেললেন যে, রাজনীতিই হবে তার জীবনের পেশা। ১৯২০ সালের ১২ই জুলাই এ কে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত সান্ধ্য দৈনিক “নবযুগ” এর সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই পত্রিকায় মুজফফর আহমদ শ্রমিকদের জীবন জীবিকার সমস্যা নিয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি “নবযুগ” ছেড়ে দেন।
১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে বঙ্গীয় খিলাফত কমিটির সদস্য মনোনীত হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি এই সময়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং বিদেশ থেকে অনেক পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করতে থাকেন। ১৯২২ সালের ১৫ই মে তারিখে পার্টির প্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নাম ছিল “দি ভ্যানগার্ড অফ দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স” । পুলিশের নজর পড়ায় নাম বদলে হয়, “অ্যাডভান্স গার্ড”। তারপর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসাবে “দি ভ্যানগার্ড” প্রকাশিত হয়। বোম্বে, কলকাতা, মাদ্রাজ লেখা থাকলেও এটি জার্মানিতেই ছাপা হতো। ১৯২২ সালের শেষের দিকে কমরেড আব্দুল হালিমের সঙ্গে কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের দেখা হয়। দুজনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম যুগে এদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুর রেজ্জাক খান। এর আগে ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে মাদ্রাজ, বোম্বাই ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপের সঙ্গে মুজফ্ফর আহ্মদ যোগাযোগ করার কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুদ্রিত ইশতেহার প্রচার করা হয়। আমেদাবাদে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের প্রতিনিধিদের সম্মোধন করে পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে এই ইশতেহার রচিত হয়। কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকের শাখা হিসেবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তখন পুরোদমে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ১৯২২ সালের গয়া কংগ্রেসে তারা পূর্ণ জাতীয় মুক্তির প্রোগ্রাম বিলি করেন। বোম্বেচ কলকাতা, মাদ্রাজ প্রভৃতি স্থানে শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও প্রত্যেক প্রদেশে কমিউনিস্ট গ্রুপ গঠনের কাজ শুরু হয়ে গেছে।
১৯২৩ সাল থেকে মুজফ্ফর আহ্মদ ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হন – বিভিন্নস্থানে শ্রমিক আন্দলনে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ১৯২৩ সালের ১৭ই মে ৩নং রেগুলেশন আইনে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আটক থাকেন। পরে ১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয় ও তাঁর চার বছর সশ্রম কারাদন্ড হয়। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি ১৯২৫ সালে মুক্তি পান।
১৯২৫ সালের ২৬শে ডিসেম্বর কানপুরে একটি কমিউনিস্ট কনফারেন্স হয়। এখানে সত্যভক্ত একটা জাতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই অপচেস্টা ব্যার্থ করা হয়। ১৯২৫ সালের পয়লা নভেম্বর “লেবার স্বরাজ পার্টি” গঠিত হয়। পরে নাম পরিবর্তন করে হয় “শ্রমিক-কৃষক” পার্টি। প্রথমে “লাঙল” নামে পার্টির পক্ষ থেকে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পরে ১৯২৬ সালের ১২ই অগাস্ট “গণবাণী” সাপ্তাহিক প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পড়ে মুজফ্ফর আহ্মদের উপর। ১৯২৭ সালের ৩১শে মে বোম্বেতে কমিউনিস্টদের এক সম্মেলনে মুজফ্ফর আহ্মদ যোগদান করেন। ঐ বছরই ডিসেম্বর মাসে মাদ্রাজে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি যোগদান করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, গয়া কংগ্রেস (১৯২২) থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত তিনি এ আই সি সি’র (নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি) সদস্য ছিলেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন। মাদ্রাজে এই সময় এই সময় কমিউনিস্ট পার্টি গঠন সংক্রান্ত সভাতেও যোগ দেন। ১৯২৮ সালে ২২-২৩ ডিসেম্বর কলকাতায় সর্বভারতীয় ওয়ার্কারস অ্যান্ড পেজান্টস পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। এর তিনদিন পূর্বে ঝরিয়ায় অনুষ্ঠিত এ আই টি ইউ সি’র অধিবেশনে মুজফফর আহমদ সহ তিনজন কমিউনিস্ট সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন প্রতিনিধিদের ভোটের জোরে।
১৯২৯ সালের ২০শে মার্চ মুজফ্ফর আহ্মদকে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে কলকাতায় গ্রেপ্তার করা হয়। মাঝে ১৯৩১ সালে কিছুদিনের জন্য জামিনে মুক্ত হয়ে কলকাতায় এসে পার্টির গোপন সংগঠনকার্যে সাহায্য করেন। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত গোপন সর্বভারতীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে জেলে থাকাকালে তিনি পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটিতে নির্বাচিত হন।
১৯৪৮ সালের দ্বিতীয় কংগ্রেস ছাড়া প্রত্যেকটি পার্টি কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রিয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
১৯২০ এর দশকে যেমন তিনি কিছু অসৎ ও সন্দেহভাজন ব্যক্তির হাত থেকে কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠনকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, ঠিক তেমনি আবার ত্রিশের দশকে জেল থেকে বেরিয়ে এসেই ( ১৯৩৬ সালের জুন ) পার্টিকে গোপন কায়দায় পুনঃ সংগঠিত করার কাজে হাত দেন। এ সময় নানা ধরনের লিগালিস্ট ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করে পার্টিকে বৈপ্লবিক কায়দায় গড়ে তোলার জন্য তিনি কর্মীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। শত শত বিপ্লবী কর্মী কারামুক্ত হয়ে আসছেন আর মুজফ্ফর আহ্মদ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন জেলায় পার্টি গঠনের জন্য সুনির্দিষ্ট কাজে তাদের নিযুক্ত করতে থাকেন। ১৯৩৮ – ৪০ সালে সারা বাংলায় পার্টি ছড়িয়ে পড়ল। যুক্তবঙ্গের ২৮ টি জেলাতেই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠলো। এই সমস্ত কর্মকান্ডের মধ্যমণি ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ। এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য সংখ্যা ২৫০ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে তিন হাজারের উপরে ওঠে।
১৯৪০ এর দশকের শেষ দিকে যখন পার্টি সংস্কারবাদী বিচ্যুতি কাটিয়ে সংকীর্ণতাবাদের পঙ্কে নিমজ্জিত হতে চলেছিলো ঠিক তখনই আবার কমরেড মুজফফর আহমেদকে কেন্দ্র করে পার্টিকে পুনঃসংগঠিত করার কাজ শুরু হয় । সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু সে ইতিহাসের প্রাণকেন্দ্র ছিলেন অতীতের মতোই সেই মুজফ্ফর আহ্মদ। পঞ্চাশের দশকে চলে পার্টির পুনর্গঠনের কাজ। পার্টি আইনসভার ভিতর ও বাহিরে একটা জাতীয় পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু এই দশকের শেষদিকে শুরু হয় পার্টির ভিতরে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই। এই লড়াইতেও কমরেড মুজফফর আহমেদকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে এক সাচ্চা মার্কসবাদী কর্মীবাহিনী। জেলায় জেলায় সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লড়াই চলে। এই সংগ্রামের পরিসমাপ্তিতে সপ্তম কংগ্রেসে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করে। পরে ১৯৬৭ সালে আবার তিনি অতি বামপন্থীদের (নকশালপন্থী) বিরুদ্ধে প্রচন্ড সংগ্রামে অবতীর্ণ হন।
মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মুজফ্ফর আহ্মদ পার্টিকে বারেবারে শ্রমিকশ্রেণী বিরোধী মতবাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, মার্কসবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষার সংগ্রামে প্রথম সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ শরীরেও তিনি কারালাঞ্ছনা ও আত্মগোপনের ক্লেশ স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি।
১৯৪০ সাল থেকে ‘৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক ছিলেন। পরে বামপন্থী বিচ্যুতির অবসানের পর কারামুক্তি পেয়ে তিনি আবার রাজ্য পার্টির সম্পাদক হন। পরে সম্পাদক হন জ্যোতি বসু এবং তারপর প্রমোদ দাশগুপ্ত। তিনি বিশের দশক থেকে ১৯৭৩ সালে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বাংলা কমিটির সদস্য ছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র প্রতিটি রাজ্য সম্মেলনে তিনি রাজ্য কমিটিতে ও তার সম্পাদকমন্ডলীতে নির্বাচিত হয়েছেন। সারা জীবন ধরে মুজফফর আহমেদ পার্টি নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টিকে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কায়দায় গড়ে তুলতে হলে, তাকে ব্যাপক জনমনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে, জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সাথে যুক্ত হয়ে গণসংগঠন মজবুত করতে হবে। তাই মুজফফর আহমেদ কর্মীদের বলতেন হয় ট্রেড ইউনিয়ন করো আর না হয় কৃষক সমিতি করো। যুবদের তিনি বলতেন, শ্রমিক-কৃষকদের সঙ্গে মিশে যাও। তিনি ৫৪ বছর আগে ২৫ শে আগস্ট “গণবানী”তে লিখেছিলেন: স্বাধীনতা যদি যুবকগণের আকাঙ্ক্ষিত হয় তাহলে তাদের ধন্যাভিজাত্য, জ্ঞানাভিজাত্য, ভূম্যাভিজাত্য ও বর্ণাভিজাত্য প্রভৃতি পরিহার করে কৃষক ও শ্রমিকদের ভিতরে তাঁদেরই লোক হয়ে কাজে লেগে যেতে হবে।
প্রতিটি কর্মীকে তিনি এই শিক্ষাই দিতেন – জনগনের মধ্যে থেকে কাজ না করলে কমিউনিস্ট পার্টিকে বিপ্লবের উপযোগী করে তোলা যাবে না।
গণ-সংযোগ ও গণ আন্দলনের উপরে গুরুত্ব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুজফফর আহমদ পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে আর একটি বষধয়ের উপর বিশেষ জোর দিতেন। তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে বিষয়টি কাজে পরিনত করার জন্য প্রানপণ চেষ্টা করতেন। সেই বিষয়টা হলঃ মার্কসবাদী সাহিত্য প্রচার ও পার্টির পত্রিকা প্রকাশ। ১৯২১ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৫২ বৎসর কমরেড মুমুজফ্ফর আহ্মদ কর্মীদের মার্কসবাদী সাহিত্য অধ্যয়ন, প্রকাশ এবং প্রচারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। পার্টি – পত্রিকার রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা এবং তার প্রকাশ ও প্রচার ব্যাতিত যে পার্টি সংগঠন গড়ে তোলা অসম্ভব এই লেনিনবাদী শিক্ষাকে তিনি নিজে আয়ত্ব করেছিলেন এবং কর্মীদের একথা উপলব্ধি করতে সাহায্য করতেন। তিনি যে এ বিষয়টির সমধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন তার প্রমান হল – মুজফ্ফর আহ্মদের বেশিরভাগ সময় ব্যয়িত হয়েছে মার্কসবাদী সাহিত্য প্রকাশ করা, ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা, মাসিক, সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করা ও সাহিত্য প্রকাশ ভবন প্রতিষ্ঠা করার কাজে। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি ও গনশক্তি প্রেস মুজফফর আহমদেরই অবদান। কারামুক্তির পর ১৯৩৬ সালে ‘গণশক্তির’ পুনঃপ্রকাশ, তারপরে ‘আগে চলো’ পত্রিকা প্রকাশ, ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক “স্বাধীনতা” প্রকাশ, হিন্দি “স্বাধীনতা”, সাপ্তাহিক “মতামত”, ১৯৬৬ সালে কারামুক্তির পর সাপ্তাহিক “গণশক্তি”র পুনঃপ্রকাশ ও পরবর্তী সময়ে দৈনিক “গনশক্তি” প্রকাশ – এই সমস্ত বিষয়ে মুজফ্ফর আহ্মদই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা।
১৯৩৯ সালে সুরেন দত্তের সহায়তায় ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রকাশ ভবনকে পার্টির আওতায় আনেন (ষাটের দশকে অবশ্য সুরেন দত্ত পার্টির বাইরে চলে যান)। পরে সুনীল বসু (কাটু) প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪৩ সাল থেকে ন্যাশনাল বুক এজেন্সিকে সুন্দর ও সুসঠভাবে গড়ে তোলার কাজে তাঁর নাম অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। গোপন ছাপাখানার কর্মী কালী চৌধুরী ও সমীর দাশগুপ্তকে নিয়ে তিনি ১৯৫২ সালে গণশক্তি প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠা করেন (পরবর্তীকালে কালী চৌধুরী পার্টির বাইরে চলে যান)। সংবাদপত্র প্রকাশ ও ছাপাখানা প্রতিস্ঠার ক্ষেত্রে তিনি সর্বদাই প্রমোদ দাশগুপ্তের সাহায্য ও পরামর্শের উপর নির্ভর করতেন। বারে বারে পুলিসী জুলুম, গ্রেপ্তার, নিসেধাজ্ঞা, জামানত দাবি প্রভৃতি সরকারি অন্তরায় উপেক্ষা করে তিনি সংবাদপত্র প্রকাশ করার কাজ কোন সময়েই বন্ধ করতে দেন নি।
প্রেস কাগজ ও বই-এর দোকান – এগুলিকে অপত্যস্নেহ দিয়ে রক্ষা ও পালন করতেন। তিনি নিজেই বলেছেনঃ মুরুব্বিরা আমার বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু বিয়ে আমায় ঘর-সংসারে বাঁধতে পারে নি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলতেন – ছাপাখানা, কাগজ আর বই-এর দোকান – এই তিনটি জিনিস ছেড়ে আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারিনা। এরা আমায় বেঁধে ফেলেছে।
অসুস্থ অবস্থাতেও শেষ জীবনের দিনগুলিতে তিনি এগুলির খবর নিতেন প্রায়ই। কর্মক্ষম অবস্থাতে তিনি প্রতিদিন এই তিনটি প্রতিষ্ঠানে একবার হাজিরা না দিয়ে পারতেন না।
পার্টি সংগঠন গড়তে হলে, মজবুত করতে হলে, পার্টিসভ্য ও দরদীদের মার্কসবাদী শিক্ষায় দীক্ষিত করতে হলে এবং সফল গণ-আন্দোলনের ক্যাডার তৈরি করতে হলে – কমিউনিস্ট পার্টি এই প্রচার-মাধ্যম সম্পর্কে কোনদিন উদাসীন থাকতেই পারে না; এগুলির জন্য সর্বস্তরের অবিরাম প্রয়াস চালাতে হয়, নেতা ও কর্মীদের উদ্যগ গ্রহণ করতে হয়। মুজফ্ফর আহ্মদের জীবন থেকে এই বড় শিক্ষাটা ভুললে চলবে না।
তিনি যেখানেই থাকতেন সেখানে তাঁর মার্কসবাদী সাহিত্যের একটি ছোটখাটো লাইব্রেরি থাকতো। সমস্ত রকমের মার্কসবাদী সাহিত্য, পত্র – পত্রিকা – জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় প্রকারের – তিনি সংগ্রহ করতেন। নিজে অধ্যয়ন করতেন, অপরকে পড়াতেন, পড়তে দিতেন। তিনি নিজেও কয়েকখানি পুস্তক – পুস্তিকা রচনা করেছেন। তিনি সাহিত্য ভালবাসতেন। তিনি সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন।
তার বহু বিষয়ে বহু প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আর কতগুলি প্রবন্ধ নিয়ে একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া, কৃষক সমস্যা সম্পর্কে কয়েকটি লেখা, কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা (কয়েকটি সংস্করণ), আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (দুই খন্ড – এই পুস্তকটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি), প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি করার প্রথম যুগ প্রভৃতি তার কয়েকখানি পুস্তক বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ব্রিটিশ সরকার ও কংগ্রেস সরকার – এই দুই সরকারের আমলে মুজফফর আহমেদকে মোট কুড়ি বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। গ্রেফতার ও কারানির্যাতন ছাড়াও তাকে দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে কাজ করতে হয়েছে। কারাগারে বন্দীদের মর্যাদার জন্য কারাগারের ভেতরে লড়াইয়ে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। আত্মগোপন করার নিয়ম কানুন, পুলিশের চোখ এড়িয়ে কাজ করা ও সর্তকতা অবলম্বনের বিধি নিষেধগুলি তিনি অন্যান্য কর্মীদের শিখিয়ে দিতেন। ১৯৪০ সালে গোপন আবাসে চলে যাবার পর আমিও তার কাছ থেকে এসব নিয়ম কানুন শিখেছিলাম। তখন নানা কায়দায় আমরা ফ্ল্যাট বা বাড়ি ভাড়া করতাম। একবার আমরা একটা বড় ফ্ল্যাট নিই। মুজফ্ফর আহ্মদকে আমিই কাকাবাবু নাম দিয়ে সমগ্র পরিবারটিকে সাজানো হয়। দুই একজন মহিলা কর্মীকে আনা হলো স্বাভাবিক পারিবারিক আবহাওয়া সৃষ্টির জন্য। বাড়ির মালিককে যা বলা হলো তা হচ্ছে এই রূপ: কাকাবাবু জমিদার, অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে এপার বাংলায় এসেছেন, ভাইপোদের নিয়ে থাকেন। ভাইপোরা সন্ধ্যেবেলায় ফুর্তি করতে বের হয় আর সারাদিন বাড়িতে ঘুমোয়। কারণ রাত্রেই আমাদের সব বিভিন্ন গোপন আস্তানায় গিয়ে যোগাযোগ ও বৈঠক করা হতো। পাঁচুগোপাল ভাদুড়িকে বড়দা ও সোমনাথ লাহিড়ীকে মেজদা করা হলো। আর আমি ছিলাম ছোড়দা। অবশ্য বোম্বাইতে পার্টির কেন্দ্রীয় গোপন আবাসে ভূপেশ গুপ্তকেও মেজদা বলা হত। যাইহোক, মুজফ্ফর আহ্মদকে সর্বমোট আট বছর আত্মগোপন করে কাজ করতে হয়েছিল। সেই থেকে মুজফ্ফর আহ্মদ পার্টি ও বাইরের লোকের কাছে ও কাকাবাবু বলে পরিচিত। তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আচার-আচরণ ও ব্যবহারেও সকলের কাছে প্রিয় শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। সেই হিসাবে কাকাবাবুর মতোই তাকে মনে হতো।
বিশেষ করে সকলকেই তিনি স্নেহের চোখে দেখতেন। তিনি নারীদের প্রতি বিশেষ সম্মান দেখাতেন এবং অপরকে সেই মতো ব্যবহার করতে শেখাতেন। নারীর সমান মর্যাদা, সমানাধিকার প্রভৃতির জন্য ও তিনি আন্দোলন করতে বলতেন।
সমস্ত দল-মতের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করতেন। কারণ তার ব্যবহার ছিল অতিশয় নম্র ও ভদ্র। তার স্নেহপূর্ণ দরদী মন সবাইকে আকৃষ্ট করত।
একটি কথা বলা প্রয়োজন। পার্টি, আন্দোলন, মতাদর্শ ও বিপ্লবের স্বার্থে তিনি ছিলেন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশ্নের খুবই কঠোর। বাইরের কারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব তাকে পার্টির আদর্শ থেকে কোনদিন বিচ্যুত করতে পারেনি। এমনকি পার্টির অভ্যন্তরে যখন আদর্শগত সংগ্রাম হয়েছে তখনও তিনি বলতেন, “বন্ধুর থেকে পার্টি ও তার আদর্শ বড়”। “মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শ রক্ষার ক্ষেত্রে কারোর বন্ধুত্ব যেন অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়”। শোষক শ্রেণী ও শাসকগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর ছিল অসীম ঘৃণা। মার্কসবাদ বিরোধী তত্ত্বের ও ক্রিয়া-কলাপ এর বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ছিল গৌরবোজ্জ্বল।
মুজফ্ফর আহ্মদের জন্মশতবর্ষ পালন উপলক্ষে এই মহান বিপ্লবীর বিশেষ গুণাবলীর প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।