Sunday 10 May 2020
১৯৩৫ সাল। জানুয়ারী মাসের শীতের রাত। নিউইয়র্ক শহরে ঠান্ডার রাতে নৈশবিচারসভায় শতচ্ছিন্ন পোশাকের একজন বয়স্ক মহিলাকে এনে উপস্থিত করলো নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ। বিবর্ণ চেহারা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অভুক্ত।
বিচারক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন – আপনি কি সত্যি রুটি চুরি করেছেন?
মাথা নীচু করে মহিলা বললেন – হ্যাঁ, আমি রুটি চুরি করেছি।
বিচারক – কেন আপনি রুটি চুরি করেছেন – ক্ষিদের জ্বালায়?
মহিলা এবার সরাসরি বিচারকের দিকে তাকালেন। মৃদু কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন – আমার মেয়েকে তার স্বামী পরিত্যাগ করেছে। আমার মেয়ে অসুস্থ। সে তার দুই ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে আমার কাছে থাকে। গত কয়েকদিন ধরে তারা অভুক্ত। আমি তাদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।
বিচার কক্ষে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। যে দোকানদার চুরির অভিযোগ এনেছিলেন, দাঁড়িয়ে বললেন, একে উদাহরণযোগ্য শাস্তি দিন, যাতে আর কেউ এই কাজ করার সাহস না পায়।
বিচারক তাঁর চেয়ারে গা এলিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে মহিলার উদ্দেশ্যে বললেন – দেখুন আমাকে আইন অনুযায়ী চলতে হবে। আইন অনুযায়ী আপনাকে ১০ ডলার ফাইন দিতে হবে, না পারলে ১০ দিনের জেল।
এই কথা বলেই নিজের পকেট থেকে ১০ ডলার বের করে নিজের টুপি খুলে তার মধ্যে রেখে বললেন – আমি ওনার জরিমানার অর্থ দিয়ে দিলাম। আর যতজন এই বিচার কক্ষে উপস্থিত আছেন, প্রত্যেকে ৫০ সেন্ট করে জরিমানা জমা করুন। আপনাদের এই জরিমানা দিতে হবে কারণ, আপনারা ওনার দুর্দশা সম্পর্কে জানতেন অথচ উদাসীন ছিলেন। অথচ ইনি আমাদের সমাজেরই অংশ। বেইলিফকে নির্দেশ দিলেন উপস্থিত সকলের কাছ থেকে, জরিমানা নিয়ে আসতে। এমনকি সেই দোকানদার, পুলিশকেও জরিমানা দিতে হ’লো।
পরেরদিন নিউইয়র্ক সিটি টাইমস সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল এই খবর বিচারকের মন্তব্যসহ – ‘৫০ সেন্ট জরিমানা করা হয়েছিল মানুষের সমস্যার প্রতি উদাসীনতাকে’।
আমাদের দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কি শুনছে?
৫ই মে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হওয়া এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছে – কেন্দ্র শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালাচ্ছে, এটা জানিয়েছে। কেন্দ্র ৮৫% এবং রাজ্য ১৫% দেবে কি না এটা তাদের বিচার্য বিষয়। তাই কোর্ট এই বিষয়ে কোনও নির্দেশ দেবে না।
৪৫/৫০ দিন ধরে মজুরি না পাওয়া শ্রমিকদের ফেরৎ আনার দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবেনা। রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা দায়িত্ব নেবে না। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমের বড় অংশই মুখ কুলুপ এঁটেছে।
৪ঠা মে সরকারি বিজেপি দলের মুখপাত্র শ্রী সম্বিত পাত্র তড়িঘড়ি ঘোষণা করছিলেন – কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের ৮৫% ভাড়া বহন করবে, বাকিটা রাজ্য সরকারগুলো দিক। আর সরকারি উকিল তুষার মেহেতা ৫ই মে সুপ্রিম কোর্টে বলছেন, সরকার বা রেল এইরকম কোন তথ্য আমাকে দেয়নি এবং কেন্দ্রীয় সরকার রেলের খরচ বহন সম্পর্কে কিছু জানাতে রাজি নয়।
কোনও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমকে, এই অসত্যবাদী দল এবং সরকারের উদাসীনতা সম্পর্কে কিছু বলতে শুনেছেন? বিচারব্যবস্থা কত বিষয় নিয়ে নিজে থেকে মামলা রুজু করে, আর কয়েক কোটি এই দেশের নাগরিক ৫০ দিন ধরে মজুরি না পেয়ে অভুক্ত/আধাপেটা হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই প্রশ্নে নীরবতাকেই বেছে নিল!! প্রধানমন্ত্রী উদাসীন – এটা দেখেও নিজে থেকে মামলা রুজু করে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার কড়া নির্দেশ দেওয়ার পরিবর্তে, দায়িত্ব ছাড়লো সেই উদাসীন-অসত্যবাদী সরকারের উপর!!!! বিনা ভাড়ায় এদের নিয়ে যেতে নির্দেশ দিতে পারলো না দেশের বিচার ব্যবস্থা!!!
১৬ টা লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকার বিভৎস দৃশ্য দেখে গোটা দেশ শোকে মুহ্যমান, আর রাষ্ট্র নিশ্চিন্তে জলখাবার খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন তুলছে – রেললাইন কি ঘুমাবার জায়গা!!!
এবার পাল্টা প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে – দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা কি প্রধানমন্ত্রীর বা রাষ্ট্রের কেষ্টুবিষ্টুদের পিতৃপুরুষের?
ধনীদের ফেরৎ আনার জন্য উড়োজাহাজ বিনি পয়সায় ওড়ে, আর ৫০ দিন মজুরি না পাওয়া আধপেটা সর্বহারা মানুষগুলো গুনে গুনে হাজার টাকা দিলে তবে ট্রেনে উঠতে পারবে। না পারলে রেললাইন ধরে ট্রেনের পিছু পিছু হাঁটো। কেউ লাইনে কাটা পড়বে, কেউ মাথা ঘুরে পড়ে মরবে, আর সরকার বাহাদুর, মাইবাপ বিচারক, মান্যবর আইনসভার সদস্যবৃন্দ, সমাজের প্রতিচ্ছবি সংবাদমাধ্যম গা এলিয়ে লকডাউনের ছুটি উপভোগ করবে??
সংবিধানের ৪৪৮টা ধারা যা ২৫টি অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা আছে ১২টি তপশীল সহ – এর কোথাও কি লেখা নেই, লকডাউনের বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশের কোটি কোটি ভুখা মানুষের বাড়ি ফেরার জন্য সরকারকে ট্রেন/বাস ভাড়া দিতে হবে! যদি নাই থাকে তাহলে বিনি পয়সায় ধনীদের উড়োজাহাজে উড়িয়ে আনার আইন কোন ধারায় লেখা আছে?
কি বলে রাষ্ট্র? কি বলছে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান অঙ্গ বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, সংসদ আর ৪র্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম? সবার বিবেক কি অর্থময় হয়ে গেল? ১৫৮ জন বিলিওনিয়ার কি কিনে নিল রাষ্ট্রের বিবেক? দেশটা কি শুধু ওদের বলেই মনে করছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও তার প্রধান অঙ্গগুলো??
এবার লড়াই বাঁধবে, গরীব নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের সাথে রাষ্ট্রের। দেশটা শুধু লুঠে খাওয়াদের জন্য নয়, দেশটা সবার। এদেরও সমান অধিকার আছে দেশের কোষাগারের উপর।
১৯৩৫ সালে নিউইয়র্ক আদালতের সেই বিচারক ফাওরেলো ল্যা গোয়ার্দুয়া আজকের ভারত দেখে বিস্মিত না স্তম্ভিত হতেন জানি না – তবে বিচারকের আসনে বসলে বিচারপতি, আমলা, প্রধানমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের থেকে নিঃসন্দেহে জরিমানা আদায় করে এদের ট্রেন ভাড়া মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতেন।