১৯ জুলাই ২০২৩ (বুধবার)
এই লড়াই ছিল জানকবুল লড়াই, রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে শুধু বামপন্থী, কংগ্রেস, আই.এস.এফ বা অন্যান্য তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী শক্তির লড়াই হয়নি। বহু ক্ষেত্রে ওদের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই হয়েছে। বহু প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে প্রার্থী হওয়ার লড়াই, হিংস্র অত্যাচারকে সহ্য করে প্রার্থীপদ টিকিয়ে রাখার লড়াই, নির্বাচনের দিনে ভোট লুটকে প্রতিহত করার লড়াই, কাউন্টিং হলকে দখল করে নেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই এই মুহূর্তে পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল-বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য এটাই এই নির্বাচনের প্রধান উপাদান। এই উপাদানকে সম্বল করেই আগামী দিনে লড়াইকে আরো তীব্রতর করে এই দানবীয় শক্তিকে পরাস্ত করার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
এই লড়াইতো শুধু একটি বা দুটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ছিল না। এই লড়াই ছিল কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া ভোট লুটের যে নীল নকশা তৈরি হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। এর জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে রাজ্যপালের ভুমিকা ও কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে যা ঘটানো হল এবং নির্বাচনের দিন রাজ্যপালের যে ভূমিকা ছিল তার বিরুদ্ধে। নিচের তলায় তৃণমূল ও বিজেপির বোঝাপড়া এবং এসবের মধ্যে দিয়ে দাদা ও দিদির সেটিং নিয়ে কোন সংশয় থাকতে পারে না। ওদের হয়ে সমস্ত পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের প্রধান দায়িত্বে ছিল কর্পোরেট এজেন্সি। শাসক দলের কাকে প্রার্থী করা হবে, কোন কোন বুথ দখল করা হবে, কত ছাপ্পা মারা হবে এবং ছাপ্পা মারার জন্য কত রকম পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় তার সমস্ত পরিকল্পনাই ছিল এজেন্সির। এই কাজকে সুচতুর ভাবে করার জন্য অবজারভার থেকে প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ, কাউন্টিং এর জন্য সুনির্দিষ্ট ভাবে কর্মচারী নিয়োগ সব করা হল। এরপরেও বুথ দখল ছাপ্পা করেও জিততে না পারলে কাউন্টিং হলটাকেই দখল করে নিয়ে পরাজিত প্রার্থীকে জিতিয়ে দেওয়া, জয়ী ঘোষণা করার পরেও সার্টিফিকেট না দেওয়া। কোন কোন পঞ্চায়েত কাউন্টিং হবে আর কোন পঞ্চায়েতে কাউন্টিং হবে না তার জন্য আগাম পরিকল্পনা করেই কাজ চলছিল।
কিন্তু একটা সময়ের পর আর সময় নষ্ট না করে মস্তান, গুন্ডা, সমাজ বিরোধী, পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী, সবাই মিলে মূলত বামপন্থী কংগ্রেস এবং আইএসএফ এজেন্টদের বের করে দেয় বা বেরিয়ে যেতে বাধ্য করে। অনেক পঞ্চায়েত সমিতি এবং ব্যাপক হারে জেলা পরিষদে কাউন্টিং এজেন্ট শূন্য করে নিজেদের ইচ্ছামত ফলাফল তৈরি করে। এই ফলাফলও ঠিকমত না মেলাতে পারার জন্য বহু ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটে যে তথ্য দেওয়া আছে আর সেই বুথের যে ভোটারের সংখ্যা ও বৈধ ভোটের সংখ্যার মধ্যে বিস্তর গরমিলের ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। জালিয়াতি চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাউন্টিং এর দিন একটা সময় পরে রাজ্য ও নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট ও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরকম নির্বাচন কেউ কোনদিন দেখেছেন যে নির্বাচনের আগের দিন, কাউন্টিং-এর আগের দিন এবং পরের দিন রাজ্যের বহু জায়গায় যত্রতত্র কোথাও প্রিসাইডিং অফিসারের স্বাক্ষর করা ব্যালট কোথাও তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া ব্যালট পড়ে আছে ? নির্বাচনের পর হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতিদের কাছে একাধিক পঞ্চায়েত রির্টানিং অফিসার বা বি.ডি.ও-কে এত প্রশ্নের সামনে এবং ধমক খেতে আজ পর্যন্ত এই বাংলায় কেউ দেখেছেন? এত প্রার্থীদের কোর্টের দ্বারস্থ হতে কেউ দেখেছেন ? ফলাফলের উপর আদালতের স্থগিতাদেশ এর আগে কেউ দেখেছেন ? এসব প্রমাণ করে ওদের জালিয়াতি কোন পর্যায়ে ছিল। এবার এসব ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন রাজ্যের মানুষ। তৃণমূলের কাছে জেতা মানে আগামী পাঁচ বছর লুটের গ্যারান্টি করা এবং নিজেদের কয়েক প্রজন্মের ভবিষ্যৎ তৈরি করা। যেখানে পঞ্চায়েতে আমরা জিতেছি সেখানে এখনও পঞ্চায়েত দখল করতে নানা প্রলোভন, হুমকি শুরু হয়েছে।
ওরা যে এত উন্নয়নের কথা বলে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কথা সারাদিন বিভিন্ন মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রচার করে, তাহলে তার পরেও জনগণের প্রতি আস্থা নেই কেন? এখানেই আছে পরিস্থিতির পরিবর্তনের ইঙ্গিত। মানুষের মধ্যে তৃণমূলের প্রতি সমর্থন ক্ষয়ের মনোভাব ছিল। কতটা ছিল, কোন এলাকায় বেশি ছিল, সবটা পরিমাপ না করা গেলেও ওরা বুঝতে পেরেছিল। আর এর থেকেও ওরা বেশি চিন্তায় ছিল বামপন্থীদের জনসমর্থন বৃদ্ধি নিয়ে। যেকোনো মূল্যে তৃণমূল এবং বিজেপি প্রথম থেকে সব কাজে প্রধান টার্গেট করেছে বামপন্থীদের। আর বিজেপিকে দ্বিতীয় করার লক্ষ্যে প্রার্থী মনোনয়ন, প্রত্যাহার, প্রচারে বামপন্থীরা যেখানে জেতার সম্ভাবনায় আছে সেখানে তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে যে জিততে পারে তাকে ছেড়ে দেওয়া- সবটা হয়েছে। কিন্তু এত ভোট লুট, এত ষড়যন্ত্র করে বামপন্থীদের অগ্রগতি কি রোখা গেছে? না ওরা রুখতে পারেনি। বামপন্থীদের অগ্রগতি হয়েছে। নিশ্চয়ই পশ্চিমবাংলার কোন মানুষ বামপন্থীরা এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সব পঞ্চায়েত জিতে যাবে, এমন ধারণা কেউ করেননি। কারণ বামপন্থীরা কোথায় আছে, কোথা থেকে লড়াই করছে এটা ধরেই মূল্যায়ন করতে হবে। বামপন্থী কর্মী, সমর্থক, দরদীরা এত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যে মরণপণ সংগ্রাম করেছেন তারা তো জেতার জন্যই লড়াই করেছেন, এতে ভুল তো কিছু নেই কিন্তু ২০১৮ ও ২০২১ সালে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে যে চরম বিপর্যয়কর ফলাফল হয়েছিল তাকে ধরেই আমাদের হিসেব করতে হবে। শূন্য থেকে শুরু করা।
বিধানসভা নির্বাচনের পর এত স্বল্প সময়ের মধ্যে চরম হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে সমগ্র বামপন্থী আন্দোলনের কর্মী সমর্থকদের উজ্জীবিত করে আন্দোলন সংগ্রামে নামানোর কাজটা ছিল প্রধানত সিপিআই(এম)-র কাছে চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে যেভাবে গ্রামে গ্রামে পদযাত্রা, জনসংযোগ ও গণঅর্থসংগ্রহ, রাজ্য জুড়ে সরকারের চরম দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, গ্রামে আবাস যোজনার কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে লড়াই, ১০০দিনের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ এবং চালু করার দাবি নিয়ে লড়াই, কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের পক্ষ থেকে পঞ্চায়েত ঘেরাও এবং সবশেষে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, এছাড়াও জেলায় জেলায় একাধিক বড় বড় সমাবেশের মধ্যে দিয়েই সিপিআইএম তথা বামপন্থী কর্মী সমর্থক দরদীদের মধ্যে লড়াই করার এবং মানুষের মধ্যেও বামপন্থীদের প্রতি আস্থা তৈরি হয়, আত্মবিশ্বাস এবং জেদ তৈরি হয় এবং লড়াইয়ের ফলে বামপন্থী শক্তি তার হারানো জনসমর্থন রাজ্যের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া কমবেশি উদ্ধার করতে পেরেছে, লুটের ভোটেও তথ্যের ভিত্তিতে একে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
এই ফলাফলের ভিত্তিতেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। রামের ভোট বামে ফিরেছে এটাই ওদের এখন প্রধান চিন্তার বিষয় এবং এজন্য ফলাফল ঘোষণার দিন থেকেই শুরু হয়ে গেছে কর্পোরেট মিডিয়ার তৃণমূল বিজেপির বাইনারি লাইন যা এবার জীবন জীবিকার জ্বলন্ত সমস্যা এবং দুর্নীতির ইস্যুতে সেভাবে মাথা তুলতে পারেনি। আগামী দিনেও বামপন্থীদের জীবন জীবিকার জ্বলন্ত ইস্যু, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে আরও তীব্র করে এই বাইনারি লাইনকে পরাস্ত করতে পারলেই বামপন্থী ও সহযোগী শক্তির জনসমর্থন আরও বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনাই গতিবেগ পাবে। এজন্য লড়াই আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি কতগুলি কাজ বামপন্থীদের ধারাবাহিকভাবে করে যেতে হবে। এক্ষেত্রে মোটা দাগের কয়েকটি বিষয় বলা যেতেই পারে- যেমন পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া নিচের তলায় প্রধানত গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে যেভাবে তৃণমূল এবং বিজেপি বিরোধী সমস্ত শক্তি ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করেছে তাকে সর্বস্তরের ঐক্যকে জোরদার করা, পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রহসনকে তথ্য সহ সর্বত্র ধারাবাহিক প্রচার করা এবং শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা, বুথে বুথে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলা। এবারের এই প্রহসনের নির্বাচনেও দেখা গেছে যেখানে শক্তিশালী সংগঠন বিশেষ করে বুথে সংগঠন গড়ে তোলা গেছে, প্রতিরোধ হয়েছে, সেখানে অন্যান্য এলাকা থেকে নানান ভাবে সাফল্য বেশি আছে। তাই এখন থেকেই আমাদের সংগঠনকে আরো নিবিড় এবং শক্তিশালী করে তুলতে হবে এবং এই কাজ করতে এবারের নির্বাচনে যে প্রার্থীরা লড়াই করলেন, যে বিপুল সংখ্যক সমর্থক, দরদীরা লড়াই করলেন তাদেরকে যুক্ত করেই এই কাজ করতে হবে।
এই লড়াইতে বহু প্রার্থীকে দৈহিক অত্যাচার করা হয়েছে, মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, ঘর ছাড়া করা হয়েছে, বাড়িঘর ভাঙ্গা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফসলের ক্ষেত নষ্ট করা হয়েছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে, কর্মস্থলেও আঘাত হানা হয়েছে, এমনকি খুনও হল।
এরপরেও গ্রামে গ্রামে বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের মনোবল অটুট আছে। লড়াই করার জেদ বজায় আছে, আগামী দিনে মানুষের জীবন জীবিকার উপর আক্রমণ আরো তীব্র হবে। ইতিমধ্যে বাজারে আগুন লেগেছে। আর যে টাকা ওরা জেতার জন্য বিনিয়োগ করেছে তার বহুগুণ লাভ পাওয়ার জন্য দুর্নীতি ও আরো চরম সীমায় যাবে, যেতে বাধ্য। আমাদের এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মজুরি, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের মতন মৌলিক চাহিদা যা চরম ভাবে আক্রান্ত সেই সব অধিকারের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। একই সাথে কেন্দ্রের আর.এস.এস.-বিজেপি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে হিন্দুতবাদের ফ্যাসিবাদী প্রকল্পের বিরুদ্ধেও প্রচার আন্দোলনকে তীব্র করতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় জেতার জন্য শাসক শ্রেণী যেভাবে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে কেড়ে নিল এবং এই কাজ করার জন্য মস্তান, গুন্ডা, পুলিশ, আমলাদের যে নগ্নতা ও হিস্রতার সাথে ব্যবহার করা হল, তা সাধারণ মানুষ সব মেনে নেবেন এটা কখনও হতে পারে না।
এর একটা প্রতিক্রিয়া থাকবেই এবং সেটা শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। তাই আবারও মানুষের ওপর ভরসা করেই আগামী লড়াই আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে। এবারের নির্বাচনেও শুধু কোনো পার্টি নয়, মানুষের সমর্থন না থাকলে এই লড়াই করা যেত না। এজন্য আরো বেশি বেশি করে আমাদের মানুষের কাছে যেতে হবে, তাদের পরামর্শ নিতে হবে, সাথে নিতে হবে।