দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত সরকার সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই ধনতান্ত্রিক বিকাশের রাস্তা নেয়। ফলে গ্রামে সামন্ততান্ত্রিক ভূমি সম্পর্ক অব্যাহত থেকে গেল। গ্রামে জমিদার ভুস্বামীদের আধিপত্যও থেকে গেল, তাই এদের সঙ্গে আপোষ করেই অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। রাজা-রাজড়া, জমিদার-মহাজন যারা ইংরেজ ভক্ত ছিলেন স্বাধীনতার পর তাদের বেশিরভাগ কংগ্রেস দলে যুক্ত হয়। জমির বেশির ভাগ অংশের মালিকানা এদেরই। রাজা-প্রজা বা মালিক- মজুরের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল জমি। আইনের সংস্থান থাকা সত্ত্বেও দেশব্যাপী ভূমি সংস্কারের কর্মসূচি উপেক্ষিত হয়েছে। সরকার প্রকৃত কৃষকের হাতে জমি দেওয়ার পক্ষপাতি ছিল না। দেশের অন্য অংশের মতো গ্রাম জীবনে আধিপত্যকারী শ্রেণী হিসেবে জমিদার-ভুস্বামীদের দাপট ছিল নিরঙ্কুশ। এর পরিনতি হল সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতা এবং গ্রামের গরীব মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশা বৃদ্ধি।
কংগ্রেসী শাসনের তিন দশক পর ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকারের পরিবর্তন হয়। জমি, মজুরি ও অধিকারের জন্য লড়াই তীব্র হয় । যাদের শ্রমে পতিত জমির মাটি কেটে সেই জমিকে চাষযোগ্য করা হয়েছে, জমি কেটে পুকুর বা জলাশয় তৈরি করা হয়েছে, সেই জমিতে ফসল ফলাতে যাদের ঘাম ঝরেছে তাদের অন্ন জোটেনা, তারা বাঁচার মতো মজুরি পায়না। অন্যদিকে অনেকেই স্বনামে বেনামে প্রয়োজনের বহুগুণ অতিরিক্ত জমির মালিক বনে গেছেন। এই বাস্তব পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে জমির মালিকানার অনেকটাই পুনর্বিন্যাস বা পরিবর্তন করে ভুমিহীন খেতমজুরদের হাতে জমি দেওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ।
গত শতাব্দীর আটের দশকে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার, গ্রামে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বামপন্থীদের পঞ্চায়েত গড়ে ওঠে। গ্রাম-গঞ্জে কৃষক আন্দোলনের প্রসারের ফলে পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কার কর্মসূচি বাড়তি মাত্রা পায়। রাজ্য সরকার জমির উর্ধ্বসীমা বহির্ভূত সমস্ত জমি সরকারের ন্যস্ত করার এবং ভাগচাষীদের স্বার্থেই তাদের নাম নথিভূক্তকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন কৃষক সংগঠন ও পঞ্চায়েত কে যুক্ত করা হয়। ১৫ মাসের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার একর কৃষি জমি সরকারের ন্যস্ত হয় এবং পাঁচ লক্ষ ভাগচাষির নাম নথিভূক্ত করা সম্ভব হয়। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ১১.৩ লক্ষ একর জমি ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মধ্যে বিলিবন্টন করা সম্ভব হয়েছে।উপকৃত হয়েছেন ৩০.৫ লক্ষ কৃষক পরিবার । এদের মধ্যে তপশিলি জাতি, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপকৃতরা হলেন ৬৬ শতাংশ। এছাড়া ১৫.১৬ লক্ষ বর্গাদারের নাম নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। উন্নত কৃষি প্রযুক্তি, উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার, সেচের এলাকা বৃদ্ধির ফলে কৃষির বিকাশে গতি সঞ্চারিত হয়। কৃষি উৎপাদনে পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে সামনের সারিতে উঠে আসে। কৃষি প্রযুক্তির সহায়তায় শস্য নিবিড়তা বাড়তে থাকে। গ্রামাঞ্চলে রাস্তা, স্কুল, বাজারের বিকাশ সহ গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছিল। এই প্রেক্ষাপটে দেখা গেল জমিদার বা বৃহৎ ভূস্বামীদের জায়গা নিচ্ছে নব্য ধনীরা। যদিও স্পষ্টতার জন্য একথা বলা দরকার যে ধনী মাত্রেই নব্য ধনী নয়। ধনীদের একটা ছোট অংশ যারা পুরানো ভূস্বামীদের উত্তরাধিকারী এবং যাদের আধুনিক রূপান্তর হয়েছে । কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ করার ক্ষমতা থাকায় এদের উৎপাদনশীলতা তুলনায় বেড়েছে। এরা কৃষি থেকে প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত অকৃষি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে চলেছে । সেচের জল বিক্রি , ট্রাক্টর ভাড়া দেওয়া , ফসলের আড়তদারি, সার, বীজ ও কীটনাশকের ব্যবসা, মহাজনি ব্যবসা এবং ফড়ে বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আয় ইত্যাদি থেকে চাষবাসের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করছে। ইদানিং বালি খাদান, পাথরের ব্যবসা এবং পঞ্চায়েতে ঠিকাদারি থেকে বিপুল সম্পদ ও অর্থের মালিকে পরিনত হয়েছে। পুলিশ, সমাজবিরোধী ও শাসক দলকে এরাই নিয়ন্ত্রণ করছে। আগে জমির উপর ভূস্বামীদের কেন্দ্রীভূত আধিপত্য ছিল। এখন সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি ছাড়াও অনান্য সম্পদে নব্য ধনীদের একাধিপত্য কায়েম হয়েছে। উদারনীতির পরবর্তি সময়ে কেন্দ্রীভবনের মাত্রা বেড়েছে। যার ফলস্বরূপ গ্রামীণ সমাজে বৈষম্য ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। গরিব কৃষক, খেতমজুর ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীরা এই বৈষম্যের শিকার। গ্রামে মুল লড়াই এই নব্যধনীদের বিরুদ্ধে গ্রামের গরীবের। এই গরীবদের মধ্যে শ্রেণীর পৃথক বিভাজন করা খুবই কঠিন। যে খেতমজুর কিছু সময়ে মাঠে কাজ করে, তাকেই অন্য সময় অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে হচ্ছে। গরীব চাষি জমি হারিয়ে খেতমজুর বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকে পরিনত হচ্ছে। এরাই গ্রামের গরীব, এদের মিলিত সংখ্যা গ্রামীণ জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ ।
২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর রাজ্যে ভূমিসংস্কারের কাজ বন্ধ হয়েছে এবং গরীব মানুষের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সরকারি নথী থেকে বর্গাদার, পাট্টাদারদের নাম মুছে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ এবং গুন্ডাদের ব্যবহার করে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হচ্ছে। বি.এল.এল.আর.ও. অফিস থেকে নবান্ন পর্যন্ত সরকারি দপ্তর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। নির্বিচারে জমির চরিত্র এমনকি মালিকানা পরিবর্তন করা হচ্ছে। চাষের জমিতে ভেড়ি তৈরি, পুকুর কাটানো, বাগান তৈরি, বালি মজুত করা, আবাসন নির্মাণসহ নানা ধরনের অকৃষি খাতে চাষের জমি সরকারি মদতেই ব্যবহার করা হচ্ছে। ভূমি সংস্কার আইনের সর্বশেষ সংশোধনী (২০২৩)-তে সরকার জমি লীজ দেওয়ার অধিকারকে জমি বিক্রি করার (freehold) অধিকারে পরিণত করেছে। কোন জমির মালিকানা কে পাচ্ছেন এবং কি উদ্দেশ্যে ঐ জমি ব্যবহার করা হবে, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে তার কি প্রভাব পড়বে সেসব বিবেচনা করা হচ্ছে না। খাদ্য নিরাপত্তা বা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্নটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আদিবাসীদের জঙ্গলের জমিতে অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে। বনাঞ্চলের জমিতে বাম আমলে পাট্টা দেওয়ার কাজ শুরু হয়। বর্তমান রাজ্য সরকার এই প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধ শিল্প কারখানার জমি, ট্রাম ডিপোর জমি, ল্যান্ড ব্যাংকের জমি,রেলের জমি, চা বাগান এলাকার সরকারি খাস জমি প্রমোটার, রিয়াল এস্টেট সংস্থা, কর্পোরেট এবং বৃহৎ ব্যবসায়ীদের বিক্রি করা হচ্ছে। রাজ্যজুড়ে ভূমিসংস্কারের বিপরীত প্রক্রিয়া চলছে।
এই পর্যায়ের লড়াই মূলত নব্য ধনীদের আধিপত্য থেকে গ্রামকে মুক্ত করা। তাই গ্রামে জনগণের এই ৭০শতাংশ মানুষকে অর্থাৎ গ্রামের গরীবকে ঐক্যবদ্ধ করা, এবং শ্রেণী হিসেবে সংগঠিত করার কাজকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। গ্রাম-শহরে সর্বত্র মানুষের মধ্যে জাতপাত বা ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনীতি চলছে। কাজ, মজুরি, খাদ্য, শিক্ষা, বাসগৃহ এসব মৌলিক চাহিদা পুরণের জন্য লড়াইকে সরিয়ে রেখে জাত এবং ধর্মকে সামনে আনার অপচেষ্টা চলছে। গরীবদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করাই আর এস এস বা তৃণমূল কংগ্রেসের উদ্দেশ্য। এর বিরুদ্ধে লড়তে হলে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় করতে হবে। আরও একটি বহুচর্চিত প্রসঙ্গ হল লুটপাট ও দুর্নীতির রমরমা। সরকার, পঞ্চায়েত , পুরসভা, সমবায়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, উচ্চ মাধ্যমিক কাউন্সিল, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ ইত্যাদি যেখানে তৃণমূল সেখানেই দুর্নীতি। তাই এই তৃণমূল কংগ্রেসেকে ক্ষমতাচ্যুত করার লড়াইয়ের মধ্যদিয়েই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রকৃত লড়াই সম্ভব। তৃণমূল কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে।বিজেপি কে উৎখাত করার জন্য আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। গ্রামে তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম থেকে এই লড়াইকে আলাদা করে দেখা চলে না। জনজীবনের আশু ও আদায়যোগ্য দাবির সমর্থনে গ্রামের গরীবকে যুক্ত করে এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হতে হবে। নভেম্বর ও ডিসেম্বর – এই দুমাস পার্টির সবস্তরের নেতা কর্মীদের একমুখী কাজ হবে প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে নিবিড় ও আন্তরিক সংযোগ গড়ে তোলা।