Viva la Commune- Long Live Paris Commune

দীধিতি রায়

১৮ ই মার্চ।
আজ থেকে ১৫২ টি বসন্ত আগে ১৮৭১ সালে প্যারিসে ১৮ ই মার্চ থেকে শুরু করে ২৮ শে মে অবধি টানা ৭২ দিন শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্বে সর্বহারা শ্রেণীর সরকার চলেছিল বুর্জোয়া শ্রেণীকে উচ্ছেদ করে।


ইতিহাসের পাতায় ফ্রান্স বরাবরই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। ১৭৮৯ সালে পৃথিবীর প্রথম বুর্জোয়া বিপ্লব- ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের বিলোপ এবং প্রজাতন্ত্রের সূচনা হয়। ১৮৪৮ সালে ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের সময় ফরাসী রাজা লুই ফিলিপের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় । তিনি বাধ্য হন পদত্যাগ করতে। তৃতীয় নেপোলিয়ন রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন।

Louis Philippe I বা Louis Bonaparte


১৭৮৯ সালের বিপ্লবের উত্তরাধিকার এবং ১৮৪৮ সালের বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা থেকে ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ,খেটে খাওয়া শ্রমিক বুঝতে পেরেছিলেন তাদের বিদ্রোহকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে মুষ্টিমেয় বুর্জোয়াশ্রেণী। এই অল্প সংখ্যক “শাসক” এর কাছে দুবার পরাজিত হয়েছিল বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী জনতা।


১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো – প্রুশিয়ার যুদ্ধে তৃতীয় নেপোলিয়ান পরাজিত হন। ফ্রান্সে থায়ার্সের নেতৃত্বে একটা বুর্জোয়া সরকার ক্ষমতায় আসে। এই বুর্জোয়া সরকার শ্রমিকশ্রেণীকে অত্যাচার করতে শুরু করলে বুর্জোয়া শ্রেণী ও সর্বহারা শ্রেণীর সরাসরি সংঘাত শুরু হয় ১৮ ই মার্চ ১৮৭১-এ। এবং টানা ৯ দিন প্রবল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।২৬ শে মার্চ নির্বাচন হয় এবং ২৮ শে মার্চ ফল ঘোষনার মধ্য দিয়ে এর কাজ শুরু- যা ইতিহাসে প্যারী কমিউন নামে পরিচিত। ফরাসী “কমিউন” শব্দটির অর্থ শহর বা জেলা। বিপ্লবীরা ফরাসী বিপ্লবের সময় থেকেই তাদের প্রশাসনিক অঞ্চলগুলিকে কমিউন বলে উল্লেখ করেন । স্থানীয় স্বায়ত্ত্ব শাসনের নীতির সূত্রপাতের ঐতিহ্যকে স্মরণে রেখেই বিপ্লবীরা ১৮৭১ সালে তাদের নির্বাচিত সরকারের নাম দেয় “প্যারী কমিউন”।


রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে এর শোচনীয় অবসান ঘটলেও প্যারী কমিউনের তাৎপর্য এতখানিই গুরুত্বপূর্ণ যে এর মূল শিক্ষাকে মার্কস ও এঙ্গেলস সংশোধন করে “কমিউনিস্ট ইশতেহারে” সংযোজিত করেন।

১৮৭১ সালের ১২ এপ্রিল কার্ল মার্কস তাঁর বন্ধু কুগেলম্যানকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘‘প্যারিসের এই সকল জনতার মধ্যে কী নমনীয়তা, কী ঐতিহাসিক উদ্যম, আত্মবলিদানের কী ক্ষমতা! ছ’মাস ধরে প্রুশিয়ার বেয়নেটের তলায় অবদমিত হয়েও, ছ’মাস ধরে ক্ষুধা আর ধ্বংসের মধ্যে থেকেও তাঁরা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের সেই ক্ষুধা আর ধ্বংসের কারণ যতটা না বহির্শত্রুরা ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল ভেতরের বিশ্বাসঘাতকতা। তারপরেও তাঁরা এমনভাবে রুখে দাঁড়িয়েছেন যেন ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে কখনও কোনো যুদ্ধই হয়নি, যেন প্যারিসের দুয়ারে কোনো শত্রু এসে হানা দেয়নি। মহত্বের এই নজির ইতিহাসে আর নেই।’’ [লেটারস টু কুগেলম্যান, মার্কস]


মার্কস যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কমিউনার্ডদের ভূমিকাকে প্রশংসা করে বলেছিলেন , “স্বর্গ অধিকারের অসমসাহসী অভিযান” যেন!
প্যারী কমিউনের কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। যা তাকে অনন্য করে তুলেছিল। যেমন প্যারিসের প্রতিটি কমিউনে ছিল কমিটি অফ ভিজিলেন্স,তা থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই গেছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে। এবং এরা প্রত্যেকেই শ্রমিকশ্রেনীর প্রতিনিধি ছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটির দাবী ছিল দেশের সকল নাগরিক সংস্থাগুলোর আধিকারিক হবেন নির্বাচিত। পুলিশ থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনী সকলেই নির্বাচিত সংস্থার অধীন। বিচারব্যবস্থাও হবে নির্বাচিত। সংবাদমাধ্যমের উপর থাকবে না কোনো নিয়ন্ত্রন ,তা হবে স্বাধীন। অবাধ গণজমায়েত পেল বৈধতা। শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মীয় অধীনতা থেকে মুক্ত করা হল। রাষ্ট্র ও ধর্মের যোগাযোগ ছিন্ন হল।


এই কমিউনের সূত্রপাত দেশ বাঁচানোর তাগিদ থেকে বা জাতীয়তাবাদী ধারণা থেকে শুরু হলেও বিপ্লবী সংগঠন ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা একে গণতান্ত্রিক বৈপ্লবিক চরিত্র প্রদান করে।


কমিউন সদস্য প্রসপর অলিভর লিসাগারায়-এর বর্ণনায় উঠে আসে এর স্মৃতি। “হোটেল ডি ভিলার মাথায় লাল পতাকা উড়ল। ভোরের কুয়াশার সাথে, একই সঙ্গে উবে গেল সেনাবাহিনী, সরকার ও প্রশাসন। বাস্তিলের গহ্বর থেকে, বাসফ্রোইয়ের অজ্ঞাত ঠিকানা থেকে তুলে এনে কেন্দ্রীয় কমিটিকে বসানো হল প্যারিসের সর্বোচ্চ আসনে, এবং সেটা করা হলো সমগ্র বিশ্বের চোখের সামনে,সাধারণ মানুষের নামে শপথ নিয়ে কমিউন ঘোষিত হয়। বেয়নেটের ডগায় টুপিগুলোকে গেঁথে দিয়ে ওড়ানো হচ্ছিল, বাতাসে পৎ পৎ করে উড়ছিল পতাকা। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল সকলের হৃদয়; চোখ ভরে গিয়েছিল বাঁধ-না-মানা কান্নায়’’।
সোল্লাসে সাধারণ মানুষ চিৎকার করে উঠেছিল, “ভিভা লা কমিউন। “


এখান থেকেই পরিষ্কার যে কমিউনার্ডস অর্থাৎ কমিউনের কমরেডদের সর্বহারা চরিত্র,কমিউন গুলো ছিল সর্বজনীন ও ক্ষমতাশালী। একাধিক শ্রমিককল্যানমূলক কাজ করে এই কমিউন। বেকারত্ব ঘোচানোর জন্য লড়াই করে। নারীদের প্রশ্নেও ভূমিকা ছিল উল্লেখ্য। কমিউনের ভেঙ্গে পড়ার কারণগুলো গোটা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের কাছে একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা।


মার্কস সোচ্চারে বলছেন শ্রমিক শ্রেনীর কেবল রাষ্ট্রযন্ত্রটা দখল করে থেমে থাকলে চলবে না বরং তার আগের রূপ কে ভেঙে ফেলতে হবে। অথচ এক্ষেত্রে শ্রমিকরা প্যারিসের দখল নিল, কিন্তু সেখানকার ব্যাঙ্ক দখল করেনি। তাঁদের নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে বুর্জোয়াশ্রেণীর সরকারকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেনি। অ্যাডলফ থায়ার্সের সরকারকে ক্ষমতায় বসে থাকার সুযোগ দিয়ে প্যারি কমিউন নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে নিয়ে এসেছিল।


১৮৫২ সালে ‘লুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার’ রচনায় মার্কস বলেছিলেন আমলাতান্ত্রিক মিলিটারি ব্যবস্থার হাতবদল না করে তাকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। প্যারি কমিউনে ৭২ দিনে তা করা যায়নি বরং মার্কসের উদ্বেগ যা ছিল তাই হল ! এগুলোই প্রতিবিপ্লবের উৎস হয়ে উঠল। অর্থাৎ সহজ ভাষায় প্যারী কমিউন রাষ্ট্র যন্ত্রের পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটিয়ে গুনগত মানের পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হল। এবং তাই টিঁকে থাকতে পারল না। নৃশংস ভাবে প্যারী কমিউনের পতন ঘটালো বুর্জোয়া শ্রেনী।


প্যারি কমিউনের পতনের দু’দিন পরে ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেনস্ অ্যাসোসিয়েশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘‘মর্মবস্তুর দিক থেকে এটা ছিল একটা শ্রমিকশ্রেণীর সরকার, আত্মসাৎকারী শ্রেণীর বিরুদ্ধে উৎপাদনকারী শ্রেণীর সংগ্রামের ফলাফল, অবশেষে খুঁজে পাওয়া এমন একটা রাজনৈতিক অবয়ব যার মধ্যে দাঁড়িয়ে শ্রমের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের কাজ করতে হবে।’’
অ্যাডলফ থায়ার্স কমিউনার্ডদের মৃতদেহের উপর গির্জা বানিয়ে তার নাম দিয়েছিল ‘স্যাক্রে কোয়ের’ যার অর্থ ‘পবিত্র হৃদয়’ – এবং এটি নির্মাণের দ্বারা তারা শ্রমিকশ্রেণীর “রাজদ্রোহের পাপ ” মুছতে চেয়েছিল।


আর এখানেই কমিউনের সাফল্য !


বুর্জোয়াদের স্বার্থে যা আঘাত হানে তাকে তারা “পাপ” বলে চিহ্নিত করে। এই প্যারী কমিউন প্রসঙ্গে উল্লেখ করে লেনিন ১৯১১ সালে বলছেন সামাজিক বিপ্লবের প্রেরণা এই প্যারী কমিউন। এবং অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ভাবে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির লড়াই হল এই কমিউন । তাই চেতনার দিক থেকে বিচার করলে প্যারী কমিউনের মৃত্যু নেই ,প্যারী কমিউন অমর।
আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ের শিক্ষা হিসাবে এটাই এর স্বার্থকতা।

Spread the word

Leave a Reply