Valentina Tereshkova Cover 2025

Valentina Tereshkova: The History

আদিত্য নারায়ণ হাজরা

ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে কাঞ্চন এলডোরাডো খুঁজতে কলকাতা গিয়েছিলো ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’- তা কল্পনাপ্রসূত হলেও, সেই ছবিমুক্তির পাঁচ বছর পর সারা পৃথিবীকে চমকে দিল এক দস্যি মেয়ের সত্যি গল্প- বাড়ি থেকে পালিয়ে এক্কেবারে মহাকাশে।

১৬ই, জুন ১৯৬৩- যখন টেক্সটাইল মিলের কর্মী ইয়েলিনাকে তাঁর আত্মীয়রা বলছেন, তাঁর মেয়ের মহাকাশ যাত্রার কথা, তখনও তিনি সে বিষয়ে কিছুই জানেন না। যতক্ষণ না পর্যন্ত টেলিভিশনের পর্দায় দেখলেন নিজের মেয়েকে- ভ্যালেন্তিনা  টেরেসকোভা। ভস্তক-৬ এর দুঃসাহসিক মহাকাশ অভিযানে ততক্ষণে ইতিহাস তৈরি করেছেন ভ্যালেন্তিনা- বিশ্বের প্রথম মহিলা নভশ্চর হিসেবে। তার ছয় দশক পর, এমন কী আজ অবধি তিনিই বিশ্বের একমাত্র মহিলা যিনি একাকী নভোগামী হয়েছেন। স্বপ্নের উড়ানে ভ্যালেন্তিনার নাম ছিলো ‘চাইকা’- ইংরাজী অনুবাদে সিগাল। মাধ্যাকর্ষণ অতিক্রম করে তিনি যখন মহাকাশ থেকে দেখছেন অপাপবিদ্ধ পৃথিবীকে, ভস্তক ৬ থেকে সরাসরি তখন তাঁর কথা শুনছে পুরো সোভিয়েত ও বিশ্বের অজস্র মানুষ – It is I, Seagull! Everything is fine. I see the horizon, it’s a sky blue with a dark strip. How beautiful the earth is… everything is going well.

যদিও আসলে কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক চলেনি। উড়ানের কিছুক্ষণের মধ্যেই এলেন ভ্যালেন্তিনা  বুঝতে পারেন মহাকাশযানের বিশেষ একটি যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়ে – যার ফলে দিকনির্দেশের সমস্যায় ফেরার সময়ে ভস্তক-৬ পৃথিবীর দিকে আসার বদলে আরো দূরে সরে যেতে পারে। হিমশীতল মস্তিষ্কে তিনি গ্রাউন্ড সাপোর্ট স্টাফেদের জানান সে কথা এবং মুখ্য প্রকৌশলী সের্গেই কারালোভের নেতৃত্বে বাকি সদস্যরা দ্রুত সেটি সারিয়ে তোলেন। 

এ যদি সবকিছু ঠিকঠাক না চলার এক আখ্যান হয়। অপর আখ্যান লুকিয়ে আছে  ভ্যালেন্তিনা র শৈশব ও বেড়ে ওঠার সময়। ১৯৩৭ এর ৬ই মার্চ ট্র্যাক্টর চালক ভ্লাদিমির ও বুননশ্রমিক ইয়েলিনা ঘরে ভলগা নদীর ধারে মাসলোকিনোভো গ্রামে জন্মানোর বছর তিনেকের মধ্যেই রুশ-ফিনিশ যুদ্ধে ভ্যালেন্তিনা  হারায় তার বাবাকে।স্বভাবতই বাকিদের মত সচ্ছল শৈশব থেকে বঞ্চিত হয় ভ্যালেন্তিনা । ১০ থেকে ১৬ মাত্র ছ’ বছর স্কুলে পড়ার পরই স্কুলছুট কিশোরী যোগ দেয় ইয়েরোস্লাভের এক টায়ার ফ্যাক্টরিতে, তারপর কাপড়ের মিলে। কাজের পাশাপাশি দূরশিক্ষার সুযোগে পড়াশোনাও চলতে থাকে সমান্তরালে। কিন্তু পেশা ও শিক্ষার পাশাপাশি তৃতীয় অক্ষ তৈরি হয় এলেন ভ্যালেন্তিনা র জন্য – যখন ২২ বছর বয়সে সে ইয়েরোস্লাভের এরোক্লাবে যোগ দেয় এবং অচিরেই স্কাইডাইভার ও প্যারাশুটার হয়ে ওঠে। এই দক্ষতাই যে তাঁকে মাত্র চার বছরের মধ্যে ইতিহাসের পাতায় উন্নীত করবে তার নির্দেশ তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।

জীবন যখন সংগ্রামের, স্বাভাবিক ভাবেই সংগ্রামী ভাবধারায় প্রাণিত হয় ভ্যালেন্তিনা  এবং অল ইউনিয়ন লেনিনিস্ট ইয়ং কমিউনিস্ট লীগ বা কমসমোলে যোগ দেয় কিশোরী ভ্যালেন্তিনা ।

এদিকে পৃথিবী তখন রাজনীতি, সমরনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি এবং আদর্শের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। ১৯৪৫ থেকে ১৯৯১ এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত এর মধ্যে সেই শীতল যুদ্ধের মধ্যপর্যায়  তখন ১৯৬৩ তে। এই শীতলযুদ্ধের এক অন্যতম প্রধান বিস্তার ছিল বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মহাকাশ গবেষণায়। মহাকাশ গবেষণার এই প্রতিদ্বন্দ ‘স্পেস রেস’ হিসাবে ইতিহাসের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ১৯৫৫ তে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত দুই শিবিরই মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা ঘোষণা ইতিমধ্যেই করে দিয়েছে। কিন্তু ১৯৫৭ তে সোভিয়েত প্রথম তা করেও দেখালো। স্পুটনিক-১ প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ হিসাবে নিক্ষিপ্ত হল মহাকাশে। সেই বছরেই সোভিয়েত লাইকা  নামের কুকুরকেও মহাকাশে পাঠিয়ে এই যুদ্ধে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ক্রমশ এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- য়ুরি গ্যাগারিন বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশে পাড়ি জমালেন। গ্যাগারিন তখন বার্তা পাঠাচ্ছেন – Allow me, comrades, to inform our Soviet government, our communist party and all the Soviet people that I accept with honour the task assigned to me to open the first path into space, and if during the execution of this assignment I encounter any difficulties, I shall overcome them, as Communists do. 

গ্যাগারিনের মহাকাশ যাত্রার এক মাসের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র অ্যালান শেপার্ড কে মহাকাশে পাঠাতে সমর্থ হল। মহাকাশযাত্রার এই তীব্র প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত প্রথম মহিলা নভোশ্চরের সফল অভিযানের জন্য তখন উন্মুখ হয়ে আছে – যাতে কোনওভাবেই তাদের তদাবধি অপরাজেয় দৌড়ে যুক্তরাষ্ট্র আঘাত না হানতে পারে। সেখান থেকেই সারা দেশজুড়ে সঠিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এবং প্রায় ৪০০ আবেদনকারীর মধ্যে একজন ছিলেন – নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের, জীবন সংগ্রাম করে নিজের পৃথিবী নিজের গড়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখা, রাজনৈতিক ভাবে সচেতন, বছর পঁচিশের যুবতী  – ভ্যালেন্তিনা  তেরেস্কোভা। কঠিন নির্বাচন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে শেষ অবধি পাঁচজন মহিলাকে উপযুক্ত বিবেচনা করা হয় এবং তাদের কঠোর প্রশিক্ষণ শুরু হয় মস্কোর অদূরে নভোশ্চর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, এবং সর্বশেষে কাজাখাস্তানের বাইকোনুর উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে। এই পুরো প্রশিক্ষণের বিষয়টি ভ্যালেন্তিনা  গোপন রেখেছিলেন – মা জানতেন মেয়ে আগের মতোই প্যারাস্যুট জাম্পিংই করছে। কিন্তু আসলে সে লাফ ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের স্বপ্নের লাফ। একসঙ্গে প্রমাণ করার লাফও যে সমাজতন্ত্রের পথে নারী বৈষম্য দূরীকরণের প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজাত ও জৈবিক। 

মহিলা নভোশ্চরের ধারণাটি যে কেবলমাত্র শুষ্ক মহাকাশ প্রতিযোগিতার একটি লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে উঠে এসেছিল তা কিন্তু নয়, এর পিছনে ছিল বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য। নারীশরীরে মহাকাশের বাস্তুতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া যে পুরুষশরীরের মতোই আচরণ করবে, এই বিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এই অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। আর সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভ্যালেন্তিনা  বলছেন – এক রাশিয়ান নারী যদি রেলপথ তৈরির শ্রমিক হতে পারেন, তাহলে মহাকাশের উড়ান কেন নয়? এবং এখানে লক্ষণীয় বিষয় এটাই যে – এই কথা বলছেন এমন একজন মানুষ, যিনি সেরকমই এক শ্রমিক পরিবার থেকে এক লাফে পৌঁছে গিয়েছে মহাকাশে এবং জীবন ও কাজ দিয়ে প্রমাণ করে দিচ্ছেন এহেন ধারণার বাস্তবগ্রাহ্যতা।

ভস্তক৬ এর উড়ানচালক হিসেবে ভ্যালেন্তিনা  তিনদিনে ৪৮ বার প্রদক্ষিণ করলেন পৃথিবীতে। অবতরণের সময় তাঁর প্যারাশ্যুট ভূমিষ্ঠ হল কাজাকাস্থানের জমিতে। কৃষকরা সেই মাঠে কাজ করছিলেন এবং তারা দ্রুত সাহায্য করেন ভ্যালেন্তিনাকে। সেই কৃষকদের পরিবার ভ্যালেন্তিনাকে দুধ ও খাবার দেন এবং ভ্যালেন্তিনার পরিবর্তে কিছু স্পেস ফুড খেতে দেন তাদের। পরে সায়েন্স মিউজিয়ামের এক সাক্ষাৎকারে এই বিষয়ে তিনি যা বলেন, তা থেকে এটাই পুনর্বার প্রতীয়মান হয় যে, সাধারণ খেটেখাওয়া, মাঠে চাষ করা মানুষদের সামাজিক স্তরে ভ্যালেন্তিনা  অবিচল ছিলেন আছেন – এবং সর্বোপরি তা অত্যন্ত সহজাত ভাবেই।

পৃথিবীতে অবতরণের পরই শুরু হয় ভ্যালেন্তিনা র জীবনের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। উদ্বেল জনতা পরম সম্মান ও ভালবাসায় বরণ করে নেন তাদের ঘরের মেয়েকে। মস্কোর রেড স্কোয়ারে ২২শে জুন ১৯৬৩, অবতরণের ৩ দিন পরে ভ্যালেন্তিনা  মুখোমুখি হন দেশবাসীর- তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে জোরালো আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ের সরল প্রকাশ। নির্দ্বিধায় তিনি যুদ্ধবিরোধিতার কথা বলেন; এবং হয়তো তাঁর থেকে ভালো আর কেউ বলতে পারতেন না – কারণ তিনি বাবাকে যুদ্ধে হারিয়েছেন মাত্র তিন বছর বয়সে। সোভিয়েত তখন ক্রমশ ভ্যালেন্তিনা র মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে সোভিয়েতের রাজনৈতিক ভাষ্যের মূর্ত প্রতীক যাঁকে সারা পৃথিবীর কাছে উপস্থাপন করা যায়। এক দিকে দেশের অভ্যন্তরে ভ্যালেন্তিনা  সম্মানিত হচ্ছেন ‘হিরো অফ সোভিয়েত ইউনিয়ন’, ‘অর্ডার অফ লেনিন’ সম্মানে – অপরদিকে সোভিয়েত তাঁকে পাঠাচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমাবেশে। শ্রমিক শ্রেণির মানুষের মহাকাশ বিজয়ের আখ্যান, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে সারা বিশ্ব। ১৯৬৩র ২৪ শে জুনের ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অফ উইমেন্স এ পারমাণবিক সমরসজ্জার বিরুদ্ধে কথা বলছেন।বলছেন, বিশ্বশান্তির কথা – I looked at our wonderful earth and thought we must not let this shiny blue planet to be covered in atomic dust.As I flew on, I thought how good it would be if my Vostok- 6, the ‘female’ spacecraft would make an invisible but powerful bridge between the hearts of all the women on Earth. 

এই বিশ্ববোধে যখন ভ্যালেন্তিনা  হয়ে উঠছেন সারা পৃথিবীর কাছে সোভিয়েটের পোস্টারগার্ল, সেই সময়েই সোভিয়েটের রাষ্ট্রশক্তিতে ও কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএসএউ – ক্ম্যুনিস্ট পার্টি অফ সোভিয়েত ইউনিয়ন) মধ্যে ধীরে ধীরে গুরুদায়িত্ব অর্পিত হচ্ছে তার উপর। ১৯৬৬ সালে তিনি সর্বোচ্চ আইনসভা সুপ্রিম সোভিয়েতে নির্বাচিত হন এবং পরপর পাঁচবার অর্থাৎ ১৯৮৯ অবধি সেই দায়িত্ব পালন করেন। ইতিমধ্যে ৭০ এর দশকের শেষভাগে তিনি সিপিএসইউ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেছেন।

এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা নেহাতই একজন জীবন্ত কিংবদন্তি মাত্র নন বরং শ্রেণিহীন ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী ক্ষমতায়নের ও লিঙ্গসাম্যের উজ্জ্বলতম বিশ্বজোড়া নিশান। আর তাঁর জীবন সারা পৃথিবীতে হতদরিদ্র, নিপীড়িত, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অসংখ্য শিশুর কাছে স্বপ্নের রুশদেশের উপকথা। 

Spread the word

Leave a Reply