২০ জানুযারি ২০২১ , বুধবার
সিঙ্গুর: ষড়যন্ত্র আর স্বপ্নভঙ্গের আখ্যান
১৯৯১সালের পর কেন্দ্রীয় সরকারের উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ নীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রেক্ষাপটে বৃহৎ শিল্প ও তার অনুসারী শিল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা ছিল সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। স্বাভাবিক ভাবেই ২০০৬সালে টাটা শিল্প গোষ্ঠী এরাজ্যে তাদের ছোট গাড়ির কারখানা করার প্রস্তাব দিলে তাকে সানন্দে গ্রহণ করে বামফ্রন্ট সরকার। সারা দেশ তথা বিশ্ব দেখেছে কিভাবে এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে রাজ্য থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছিল বামবিরোধী চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি।
সিঙ্গুরে ইতিহাসের চাকা সাময়িকভাবে ঘুরিয়ে দিতে পেরেছিল তৃণমূল কংগ্রেস ও তার সহযোগীরা। বিকৃত উল্লাসে ধ্বংস করেছিল একটি নির্মীয়মান শিল্প কারখানা আর ধুলিস্যাৎ করেছিল বেকার যুবর আশা-আকাঙ্ক্ষা।ক্ষমতা দখলের লালসায় বামবিরোধী শক্তি কুৎসাকে হাতিয়ার করে যে ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল মানুষের মনে তার জেরে বামপন্থীদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন অনেক মানুষ।তবু সিঙ্গুরে শিল্প গড়ার প্রয়োজনীয়তা ও বামফ্রন্ট সরকারের যুক্তিপূর্ণ অবস্থান সম্পর্কে তখনও সন্দেহের অবকাশ ছিল না,এখনও নেই।

দেশের জনসংখ্যার ৮% আমাদের রাজ্যে, অথচ জমির পরিমাণ দেশের মাত্র ৩%। এই অবস্থায় রাজ্যে শিল্প স্থাপনের জন্য কৃষিজমিকে কোন অবস্থাতেই ব্যবহার না করার দাবি অবাস্তব ও আত্মঘাতী। তবু আমাদের রাজ্যে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব অনুর্বর জমিই ব্যবহার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বাঁকুড়ার বড়জোড়া, পুরুলিয়া,খড়গপুর ইত্যাদি নানা জায়গার কথা বলা যায়। পশ্চিমবঙ্গে গাড়ি কারখানা নির্মাণের জন্য যখন টাটা মোটর্স্ আগ্রহ দেখায় তখন সরকার দু’তিনটি জায়গায় কারখানা গড়ার প্রস্তাব দেয় যার মধ্যে খড়গপুরে টেলকোর কারখানার সন্নিহিত অঞ্চলও ছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের কাছাকাছি ও কলকাতা মহানগরীর নিকটবর্তী এলাকা সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা তৈরি করায় আগ্রহী ছিল টাটা গোষ্ঠী।

সিঙ্গুরে বেসরকারি শিল্পের জন্য সরকার কেন জমি অধিগ্রহণ করল এই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। সরকার এই কাজ করেছিল জমির মালিক ও বর্গাদারদের স্বার্থে। কেননা বেসরকারি কোম্পানির বদলে সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে জমির অনেক বেশি লাভজনক দাম পাবেন কৃষকরা। বর্গাদারদের কথা বেসরকারি কোম্পানি চিন্তাই করতোনা, কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষায় দায়বদ্ধ বলে সে কাজ করেছিল।

একথা সকলের জানা যে
সিঙ্গুরে অধিগৃহীত ৯৯৭.১১ একর জমির মালিকানা ছিল ১৩ হাজার ১০৩জনের। তাঁদের মধ্যে জমির দাম বাবদ চেক নিয়েছিলেন ১০হাজার ৮৫২জন , অর্থাৎ মোট জমির মালিকের ৮২.৮২ শতাংশ। চেক নেননি ২হাজার ২৫১জন। তাঁদের মধ্যে একাংশ, প্রায় ৫১.১১একর জমির মালিক চেক নিতে পারেননি আইনি জটিলতা, মালিকানা নিয়ে সমস্যার কারণে।
প্রকৃতই অনিচ্ছুক এইরকম কৃষকের সংখ্যা খুবই কম। অনিচ্ছুক কৃষকদের শিখণ্ডী হিসেবে দাঁড় করিয়ে একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এবং কর্মসংস্থানমুখী শিল্প প্রকল্পকে বানচাল করে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস ও তার সঙ্গী সাথীরা।
সিঙ্গুরে তৎকালীন জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী যে ৯৯৭.১১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল তার মধ্যে একফসলী জমিই প্রধান হলেও কিছু উর্বর জমিও ছিল,যার জন্য তৎকালীন বাজার দর একর পিছু ২লক্ষ টাকার বেশী ছিলনা।অথচ রাজ্য সরকার সেই জমির দাম দেয় একর পিছু ১২লক্ষ টাকা।আর অন্যান্য জমির ক্ষেত্রে ৮.৫ লক্ষ টাকা। জমির মালিক ও বর্গাদারদের যাতে আর্থিক ক্ষতি না হয় তার জন্য বামফ্রন্ট সরকার ক্ষতিপূরণের বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিল। জমির দামের ২৫ শতাংশ বর্গাদারদের দেওয়া হয়।সিঙ্গুরে নির্মীয়মাণ মোটর গাড়ি কারখানাকে কেন্দ্র করে পরোক্ষ কর্মসংস্থানের এক বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেয়।এই পরোক্ষ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ক্ষেতমজুরদের পরিকল্পিতভাবে যুক্ত করবার ভাবনা রাজ্য সরকারের ছিল। অধিগৃহীত জমির মধ্যে থেকেই ১০০ একর নির্দিষ্ট করা হয়েছিল যেখানে সেই সব স্থানীয় মানুষ যারা তাদের কৃষির সাথে যুক্ত জীবিকা হারিয়েছিলেন তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। স্থানীয় যুবক-যুবতীদের অনেকেই প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন এবং যারা প্রথাগত শিক্ষায় যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন না তারাও নানারকম পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পান। গাড়ি কারখানার নির্মাণ শুরু হলে এলাকায় পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হয়, নতুন হোটেল ইত্যাদি চালু হয়ে যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংকের ছ’টি এটিএম এই অঞ্চলে খোলা হয়েছিল। সব মিলিয়ে সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানাকে কেন্দ্র করে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের আয়ের নতুন পথ প্রশস্ত হয়েছিল। শেষপর্যন্ত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গাড়ি কারখানা না হওয়ায় এক বিরাট সংখ্যক মানুষ তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন।
টাটা মোটরস্ এর যে গাড়ি কারখানা সিঙ্গুরে তৈরি হওয়ার কথা ছিল তার সাথে পঞ্চান্নটি ছোট-বড়-মাঝারি কারখানা তৈরি হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কেবল টাটা মোটরসের কারখানাতেই কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ পেতেন আর যন্ত্রাংশ তৈরীর কারখানা গুলিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হতো আরো বেশি। তাই সিঙ্গুরে কেবল একটি কারখানা তৈরি করার লড়াই ছিল না, ছিল অনেক কারখানার তৈরীর লড়াই। বাম বিরোধীদের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির জন্য এই সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেল।
যে বিষয়টি অবশ্যই মনে রাখা দরকার সেটি এই যে সিঙ্গুরে যেহেতু অত্যন্ত সস্তায় গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা ছিল তাই এখানে প্রযুক্তি গত বিষয়টি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।অনুসারী শিল্পগুলি প্রকল্প এলাকাতেই অবস্থিত না হলে এত কম খরচে গাড়ি তৈরি করা যেত না। সেক্ষেত্রে প্রকল্পের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হত।বামবিরোধীরা ৪০০একর জমি ফেরৎ দেওয়ার ধুয়ো তুলে এই কারখানার মূল পরিকল্পনা কেই বানচাল করে দেয়। এই ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের মাশুল আজও দিচ্ছে আমাদের রাজ্য।
সিঙ্গুরের শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য কি বামফ্রন্ট সরকার তাড়াহুড়ো করেছিল? কারুর সাথে আলোচনা না করেই জমি অধিগ্রহণ করা হয়? বিরোধীদেরকে কি এ বিষয়ে পুরোটাই অন্ধকারে রাখা হয়েছিল? এই সবকটি প্রশ্নের উত্তরই ,না। ২০০৭ সালের জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হয়। তার এক বছরেরও বেশি আগে২০০৬ সালের ২৭ শে মে হুগলির জেলাশাসক প্রথম সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন। দ্বিতীয় সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হয় ২০০৬ সালের ১৭ জুন এবং তৃতীয় বার সব রাজনৈতিক দলের বৈঠক ডাকা হয় ঐ বছরের ৪জুলাই। কিন্তু এই এই বৈঠক গুলির একটিতেও তৃণমূল কংগ্রেসের কোন প্রতিনিধি উপস্থিত হননি। ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারের সঙ্গেও অসহযোগিতা করে শুরু থেকেই তারা যে গাড়ি তৈরির প্রকল্প ভেস্তে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল তা এই ধরনের আচরণ থেকে স্পষ্ট।
টাটা মোটরসের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল রাজ্য সরকারের তার কি কোন অংশ গোপন করা হয়েছিল? এনিয়ে বিরোধীরা ব্যাপক অপপ্রচার করলেও ২০০৭সালের ১৫ই মার্চ রাজ্যপালের ভাষণের ওপর বিতর্কে অংশ নিয়ে রাজ্যের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন রাজ্য সরকার কি কি সুবিধা টাটা মোটরস কে এই কারখানা স্থাপনের জন্য দিয়েছে তার বিস্তৃত বিবরণ বিধানসভায় পেশ করেন।
টাটা মোটরস্ কে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি দেওয়া হয়েছিল বলে অপপ্রচার হয়েছিল।অথচ বাস্তব ছিল এর বিপরীত। মারুতি গাড়ি নির্মাণের কারখানায় যেখানে সাড়ে তিন লক্ষ গাড়ি তৈরির জন্য মোট জমি লেগেছিল ১২৫০ একর সেখানে সিঙ্গুরে একই সংখ্যক গাড়ি নির্মাণের জন্য ৯৯৭.১১একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। যদিও টাটা মোটরস সিঙ্গুরে ১৩৫৩ থেকে১১০০ একর জমি চেয়েছিল,তবু বাস্তু ও উন্নতমানের জমি বাঁচাতে ৯৯৭.১১একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তাছাড়া এই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল কেবলমাত্র মূল কারখানার জন্য নয়, মূল কারখানার পাশাপাশি প্রায় ৫৫ টি ছোট মাঝারি যন্ত্রাংশ নির্মান কারখানার জমি ছিল এর অন্তর্ভুক্ত।তাই টাটা কে বেশি জমি পাইয়ে দেওয়া হয়েছে এই অভিযোগ আদৌ ধোপে টেকে না।
সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন এই প্রসঙ্গ বারেবারে উত্থাপিত হয়েছিল যে সরকার কেন বন্ধ কারখানার জমি উদ্ধার করে নতুন শিল্পের জন্য জমি দিচ্ছে না। রাজ্যের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী প্রয়াত নিরুপম সেন স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন যে বন্ধ কল কারখানাগুলির জমি নানা আইনি জটিলতায় জড়িয়ে রয়েছে।কোন শিল্পোদ্যোগী আইনি জটিলতা যুক্ত জমিতে শিল্প স্থাপনে উদ্যোগী হতে চান না। তা ছাড়াও এই সব কারখানার জমি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে,ফলে এক লপ্তে অনেকটা জমি পাওয়া দুষ্কর। পশ্চিমবঙ্গে নানা কারখানা বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তাকে মোকাবিলা করার জন্য নতুন শিল্প গড়ে না তুললে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ফলে একদিকে বন্ধ বা রুগ্ন কারখানা খোলার চেষ্টা করে যেতে হবে এবং আটকে থাকা জমি উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে, অন্যদিকে নতুন শিল্প করার যেটুকু সুযোগ আছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে।
আসলে কোন যুক্তি তর্কের ধার না ধেরে শুরু থেকেই সংঘাতের পথে হেঁটেছে বামবিরোধী শক্তি। প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস সমস্ত সর্বদলীয় বৈঠক বয়কট করেছে,জনগনের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে,বিধানসভা ভাঙচুর করেছে,কারখানার পাঁচিল ভেঙেছে,তিন সপ্তাহ ধরে সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ করেছে।আবার এখন যে বিজেপি ‘সিঙ্গুরে শিল্প চাই’ বলে নাটক করছে তারা সেসময় তৃণমূলনেত্রীর যাবতীয় ধ্বংসাত্মক কাজে সহায়তা করেছে,বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং এসে মমতা ব্যানার্জিকে ফলের রস খাইয়ে গেছেন।
সিঙ্গুর থেকে শিল্প বিদায় নেওয়ার ১২বছর পরে শিল্প ধ্বংসের কান্ডারী এখন ঘোষণা করছেন যে সিঙ্গুরে নাকি শিল্প-কারখানা গঠন করা হবে। ইতিহাসের একি প্রহসন নাকি প্রতিশোধ?
