Tribute to Muzaffar Ahmad on His Birth Anniversary


সাধারণভাবে কমিউনিস্টরা কোনো নেতার জন্মদিন পালন করে না, সারা দেশে একমাত্র কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ, যাঁর জন্মদিন পালন করা হয় ৷ আর এই জন্মদিন পালনের কর্মসূচি শুরু হয় তাঁর জীবদ্দশাতেই ৷ ঐতিহাসিক কারণে, এক বিশেষ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে পার্টিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ৷ যখন একদিকে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর মতাদর্শগত আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে অন্যদিকে দেশের শাসকশ্রেণির পক্ষ থেকে আক্রমণ তীব্র থেকে তীব্রতর করা হচ্ছে, দেশের মাটিতে মার্কসবাদের প্রয়োগের ক্ষেত্রে মতামত প্রকাশ করা নিষিদ্ধ, কমিউনিস্ট নেতাদের অধিকাংশ নেতা হয় জেলে না হয় আত্মগোপনে — কাকাবাবু নিজেও তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী, পার্টি নেতৃত্ব কাকাবাবুর তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও তাঁর জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাইরে যে সমস্ত নেতৃত্ব ছিলেন, তাঁরাও এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত হয়েই কর্মসূচি গ্রহণ করেন ৷ এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, কাকাবাবুর জন্মদিন ৫ আগস্টকে উপলক্ষ করেই কমিউনিস্টদের কথা মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে ৷ এই লক্ষ্যেই ১৯৬৩ সালের ৫ আগস্ট আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে এবং কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরি হলে কাকাবাবুর ৭৪তম জন্মদিবস পালিত হয় ৷ গোটা দেশে কমিউনিস্ট পার্টি যখন আক্রান্ত তখন এক বিশেষ রাজনৈতিক বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে কোন্ পথে এগিয়ে যেতে হবে কমিউনিস্টদের, এই প্রশ্নকে সামনে রেখে পালিত হয় ৫ আগস্ট, কাকাবাবুর জন্মদিন ৷


সেবার কাকাবাবুর জন্মদিন পালনকে সামনে রেখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি যেসব শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিল তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৷
‘ভারতরাষ্ট্র সম্পর্কে কমিউনিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গি, নেহেরু সরকার সম্পর্কে মূল্যায়ন, রাশিয়া ও চিনা পার্টির মতাদর্শগত প্রশ্নে আমাদের অবস্থান, ভারতীয় বিপ্লবের প্রকৃতি কি হবে, এ নিয়ে পার্টির অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম চলছিল ৷ সংশোধনবাদী নেতৃত্ব পার্টিকে কার্যত নেহেরু সরকারের লেজুড়ে পরিণত করা এবং ভারতীয় বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকাকে অবমূল্যায়নের অবস্থান নেয়, তখন নতুন পার্টি গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ৷ একদিকে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে অন্যদিকে শাসকশ্রেণির আক্রমণের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলার মঞ্চ হিসেবেই সেদিন কাকাবাবুর জন্মদিনকে ব্যবহার করা হয়েছিল ৷

kakababu

১৮৮৯ সালে বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালির সন্দ্বীপে মুজফ্ফর আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন ৷ পরিবারের দারিদ্র এমনই ভয়ঙ্কর ছিল যে, প্রতিদিন খাবারও জুটতো না ৷ ভয়াবহ অর্থাভাবে প্রথাগত পড়াশুনাতে ছেদ পড়েছে বেশ কয়েকবার ৷ তিনি নোয়াখালি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করে এখানে এসে প্রথমে হুগলি মহসিন কলেজে পরে বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন ৷ অর্থাভাবে কলেজের পাট চুকিয়ে তিনি চাকরি নিতে বাধ্য হন রাইটার্স বিল্ডিংসের ছাপাখানায় ৷ স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অনুবাদকের কাজ ৷ কিন্তু বেশিদিন ইংরেজ সরকারের দপ্তরে তিনি কাজ করতে পারেন নি ৷ এরপর একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় যোগ দেন ৷ সেখানেও টিকতে পারেননি ৷ মাদ্রাসার চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে গৃহশিক্ষকতা শুরু করেন ৷ ১৯১৮ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলেন তিনি ৷
এর আগে, ১৯১৩ সালে তিনি যোগ দেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে ৷ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ ভূমিকা ছিল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ৷ এই সমিতির সহ সম্পাদক ছিলেন তিনি ৷ ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক সভা-সংগঠনে যোগ দিতে শুরু করেন মুজফ্ফর আহমেদ ৷ চটকল শ্রমিকদের, বন্দর শ্রমিকদের মিছিল-সংগ্রামে অংশ নিতেন নিয়মিত ৷ এই অবস্থায় ১৯২০ সালে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে যৌথ সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ সান্ধ্য পত্রিকার প্রকাশ শুরু করেন ৷ ‘নবযুগ’ এর মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শ, দুনিয়াব্যাপী শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি নিজে লিখে বাংলার মানুষের কাছে প্রচার শুরু করেন ৷ এসবের মধ্যেই তাঁর মনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় --- কোন্ পেশা তিনি গ্রহণ করবেন, সাহিত্য না রাজনীতি ৷ তাঁর নিজের ভাষাতেই উল্লেখ্য "গোটা ১৯ সালটা এ নিয়ে ভেবেছি, এবং অবশেষে রাজনীতিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিই৷" 

১৯২০ সাল থেকেই সারাক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খিদিরপুর ডক-শ্রমিকদের সংগঠনের মধ্যে দিয়ে যাঁর যাত্রা শুরু, ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন সংগ্রামী জনগণের লড়াই-এর প্রতিটি স্পন্দনে ৷
১৯২৮ সালে প্রথম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গোপন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৷ তাঁর সদস্য নির্বাচিত হন মুজফ্ফর আহমেদ ৷ ১৯৪৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম যে পার্টি কংগ্রেস হয় সেখানেও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন এবং মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ৷
১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় ৷ তারপর থেকেই ব্রিটিশ শাসকেরা বুঝেছিল যে ভবিষ্যতে এরাই তাদের উৎপাটিত করবে ৷ তাই কমিউনিস্ট পার্টিকে খতম করতে একটার পর একটা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে ৷ পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা, কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা, মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা — এসব সকলেরই জানা ৷
১৯২৯ সালে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা গোটা দেশের কাছে পার্টির কথা পৌঁছে দিয়েছিল ৷ মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় মুজফ্ফর আহমেদকে ৷ গোটা দেশের মানুষের কাছে এমনকি গোটা দুনিয়ার মানুষের কাছে কমিউনিস্ট মতাদর্শ পৌঁছে দেওয়ার জন্য আদালতের কাঠগড়াকে ব্যবহার করেছিলেন তিনি ৷ তিনি জানতেন মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে দেশে-বিদেশের সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে ৷
১৯৩৩ সালে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মুজফ্ফর আহমেদ নিজে সওয়াল করেছিলেন ৷ বলেছিলেন, ‘আমি একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট ৷ এই মামলাতে গ্রেপ্তার হওয়ার দিন পর্যন্ত এই পার্টির সদস্য ছিলাম ৷ আমাদের পার্টি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচিতে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করে এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তাকে কার্যকর করার চেষ্টা করে ৷ আমি গর্বিত যে, আমি ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির অগ্রদূত ৷ যে কোন বিপ্লবের মূল কথা হলো ক্ষমতার দখল ৷ বর্তমানে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দখলে, সেই কারণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সমূলে উৎপাটিত করাই আমাদের লক্ষ্য ৷’
এই মামলায় তাঁর কঠোরতম সাজা হতে পারে জেনেও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নির্ভীক কণ্ঠে কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রচারে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন ৷
কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ-এর ছিল আদর্শের প্রতি গভীর নিষ্ঠা ৷ অশেষ দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন ছিল তাঁর নিত্যসহচর ৷ এর মধ্যেও তিনি ছিলেন ইস্পাতের মতো আদর্শদৃঢ় ৷
কাকাবাবুর জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে ৷ সংশোধনবাদ ও সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপোসহীন যোদ্ধা ৷ সংশোধনবাদ বলতে বোঝায় জনগণ থেকে পিছিয়ে পড়া, আর সংকীর্ণতাবাদ হল জনগণকে সাথে না নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ৷
সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে সংহত করতে ও মার্কসবাদ লেনিনবাদের তত্ত্বকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৬৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কলকাতার মনুমেন্ট (শহিদ মিনার) ময়দানে এক সমাবেশের ডাক দেওয়া হয় ৷ মুজফ্ফর আহমেদ তখন জেলে ছিলেন ৷ গুরুতর অসুস্থ অবস্থাতে জেলখানা থেকে এক বার্তা পাঠান তিনি যা দেশহিতৈষী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং পঠিত হয় ঐ সমাবেশে ৷ বার্তায় তিনি লেখেন, ‘আমি একান্তভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি, কলকাতা ও আশপাশের জেলাগুলি থেকে হাজারে হাজারে মানুষ ২৮ সেপ্ঢেম্বরের সমাবেশে যোগদান করুন ৷ ওখানেই হবে কাজের শুরু ৷ রবীন্দ্রনাথ ‘সবুজপত্রে’ যে একটি কবিতা লিখেছিলেন তার দুটি পংক্তি আজ আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমরা চলি সমুখপানে কে আমাদের বাঁধবে, রইলো যারা পিছুর টানে কাঁদবে তারা কাঁদবে ৷’

Merrut Conspiracy Convicts


রক্তপতাকার আদর্শে অটুট থেকে সমুখপানে চলার নির্দেশই দিয়েছিলেন মুজফ্ফর আহমেদ ৷ প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে এই কথা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন ৷
সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপোসহীন ৷ এ প্রসঙ্গে দেশহিতৈষী পত্রিকায় তিনি লেখেন — ‘পথের শেষে পৌঁছাতে গেলে সমস্ত পথ পার হয়ে যেতে হবে ৷ মধ্যপথে পথ সংক্ষেপ করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো অসম্ভব ৷ হঠকারিতার পথ বিপ্লবের পথ নয়, ক্ষমতা দখলেরও পথ নয় ৷ হঠকারিতা জনগণকে দুঃখ-দুর্ভোগের অতল সাগরে ডুবিয়ে দেয় ৷ যত দুঃখ হোক, যত কষ্ট হোক, যত কাঁটা বিছানোই হোক না, আমরা আমাদের পথ বিপ্লবের পথ ধরেই চলবো ৷’
পার্টির শৃঙ্খলার প্রশ্নে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর ৷ তিনি বলেছেন — ‘শৃঙ্খলা আমাদের পায়ের শৃঙ্খল নয় ৷ শৃঙ্খলাই পার্টির জীবন ৷ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পার্টি থেকে শত্রুদের বহিষ্কার করা প্রয়োজন ৷’ তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তির চেয়ে পার্টি বড়। নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে, বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কাকাবাবু ছিলেন এক আপোশহীন সেনাপতি ৷ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রশ্নে তাঁর অত্যন্ত পরিচিত একজন, যিনি পার্টির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন — তিনি কাকাবাবুকে একটি চিঠি লেখেন ৷ কাকাবাবু সে চিঠির উত্তরে তাঁকে লিখেছিলেন, ‘এর পরে আপনি আর চিঠি লিখবেন না, কারণ আমি এটা মনে করি, বন্ধুর চেয়ে পার্টি বড় ৷ তাই, এখানেই সম্পর্কের পরিসমাপ্তি হোক ৷’
কাকাবাবুর জন্মদিনের পার্টি শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে প্রতিটি কর্মীকে যত্নবান প্রয়াস জারি রাখতে হবে ৷

বর্তমানে আমাদের দেশ, আমাদের রাজ্য ভয়ঙ্কর বিপদের মুখোমুখি ৷ আবার নতুন সম্ভাবনার পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে ৷ বিপদকে মোকাবিলা করেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমাদের ভূমিকা নিতে হবে ৷ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এমন একটি দল, যে দল কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িকতা মিতালি করে দেশকে পরিচালিত করছে ৷ বিজেপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যাদের প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করে আর এস এস, যাদের লক্ষ্য হলো ভারতবর্ষে হিন্দু রাজত্ব কায়েম করা ৷
আর এস এস প্রতিষ্ঠার দুবছর আগে সাভারকার একটি পুস্তিকায় যা লেখেন তা হল, ‘হিন্দুত্ব’ একটি রাজনৈতিক প্রকল্প এবং এর সঙ্গে হিন্দুধর্মের কোন সম্পর্ক নেই ৷ স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি ‘হিন্দুত্ব’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তাদের নীতিকে পরিচালিত করছে ৷


অন্যদিকে, দেশের সম্পদ কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে লুট করার অবাধ সুযোগ করে দিচ্ছে মোদি সরকার ৷ ফলে দেশের অর্থনীতিতে লাগামছাড়া সংকট তৈরি হচ্ছে, প্রতিদিন তা বাড়ছে ৷ মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং যে কোনো বিরুদ্ধ মতকে স্তব্ধ করতে দানবীয় আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে ৷ সমাজের কোনো অংশের মানুষই এই আক্রমণের বাইরে নয় ৷ দেশের সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধবংস করা হচ্ছে ৷ দেশকে রক্ষা করতে, দেশের মানুষকে রক্ষা করতে, দেশকে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প থেকে বাঁচাতে এই সরকারকে পরাস্ত করতেই হবে ৷ আর সেই লক্ষ্যে পার্টির শক্তিবৃদ্ধি, বামফ্রন্টকে সংহত করা, বামফ্রন্টের বাইরে বামপন্থী দলগুলিকে টেনে আনা সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সমবেত করতে হবে ৷


আমাদের রাজ্যে এমন একটা সরকার চলছে, যারা ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিরোধীদের বিশেষ করে সিপিআই(এম)কে খতম করতে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে ধবংস করে চলেছে ৷ এই সরকারের আমলে আমাদের হাজার হাজার কর্মীকে ঘরছাড়া করা, বাড়ি ভাঙচুর, মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো, কোটি কোটি টাকার জরিমানা আদায় করা, কয়েকশো কর্মীকে খুন করা হয়েছে ৷ সাম্প্রতিক সময়ে এই সরকারের এবং শাসক দলের কর্মী-নেতা-মন্ত্রীদের বহুবিধ দুর্নীতি প্রকাশিত হয়েছে শুধু তাই নয়, মন্ত্রী, বিধায়ক, সরকারি আমলাসহ দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে সরাসরি এবং অনেককে কারাবাসও করতে হচ্ছে ৷ আমাদের পার্টির নেতৃত্বে এই সময়কালের আন্দোলন এবং তাদের দুর্নীতি বিশেষ করে নিয়োগ দুর্নীতি শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসকে জনবিচ্ছিন্ন করছে প্রতিদিন ৷ এদের বিরুদ্ধে মানুষের ঘৃণা, ক্ষোভ, অনাস্থা প্রতিদিন বাড়ছে ৷ তাই শাসকদল ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে হত্যা করতে সমস্ত অপচেষ্টা গ্রহণ করেছে ৷

সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাদের গণতন্ত্র হত্যার নিকৃষ্টতম প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করেছি ৷ মনোনয়ন বাধা, জোর করে মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো, নির্বাচনের দিন ভোট লুট এবং সর্বশেষ ভোটগণনায় ডাকাতির ঘটনা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন ৷ আর এই গণতন্ত্র হত্যার কাজে শুধু সর্বস্তরের পুলিশ প্রশাসন নয়, এস ডি ও, বি ডি ও, জেলা শাসকদের এবং সমগ্র নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করার নির্লজ্জ প্রয়াস সারা দেশে বিরলতম ঘটনা ৷ তাই, আমাদের রাজ্যে দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি, গণতন্ত্র হত্যায় সাহায্যকারী পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ সহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে জোরদার করার দায়িত্ব আমাদের সামনে হাজির হয়েছে ৷ মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার দ্বিমেরু তত্ত্বকে ভেঙে পশ্চিমবাংলায় আমাদের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধিকে কেউ অস্বীকার করতে পারছে না ৷ তাই, আবার পুরোদমে ‘হয় বিজেপি নয় তৃণমূল’ এই প্রচার তারস্বরে শুরু হয়েছে ৷ বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস যতই রাজনৈতিক মঞ্চে একে অপরের বিরুদ্ধে লাফাক না কেন, তাদের বোঝাপড়া মানুষের কাছে ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে ৷ তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল নাগপুরে আর এস এস-এর পরিকল্পনায় ৷ তাই আর এস এস প্রধান মোহন ভাগবত বলেন, বিজেপি ক্ষমতায় না আসলে তৃণমূলই থাকুক — বামপন্থীদের শক্তি কিছুতেই বাড়তে দেওয়া যাবে না ৷


এই পরিস্থিতিতে কাকাবাবুকে শ্রদ্ধা জানানো তখনই সার্থক হবে, যদি তাঁর শিক্ষাকে আয়ত্ত করে আমরা সামনে এগোতে পারি ৷ দেশ জুড়ে যে বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ ও সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিমন্ডল, তার বিরুদ্ধে মানুষকে জোটবদ্ধ করতে হবে ৷ দেশের সামনে প্রধান বিপদ বিজেপি। বিজেপিকে পরাস্ত করা, জনবিচ্ছিন্ন করা এবং রাজ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত, গণতন্ত্র হত্যাকারী তৃণমূল কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম — বর্তমান সময়ে আমাদের সামনে সেই দায়িত্বই হাজির হয়েছে ৷ কাকাবাবুর সমুখপানে চলার নির্দেশকে কার্যকরী করতে, এ রাজ্যে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই-এ আমাদের জিততে হবে, মুজফ্ফর আহমেদ-এর জন্মদিনে এই অঙ্গীকার আমাদের গ্রহণ করতে হবে ৷

Spread the word

Leave a Reply