1May 2020, Friday
শীতের দেশে শীতের পর আসত বসন্ত। সেই সময়ে হত মে-রানির উৎসব। আর শীতের শেষে বসন্ত আশা মানেই গাছে নতুন পাতা। অজস্র ফুলের সমারোহ। কিন্তু এবারে বসন্তকে বলা যায়, এবার আসনি তুমি বসন্তের আবেশ হিল্লোলে পুষ্পদল চুমি। করোনাময় পৃথিবীতে মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে, কর্মহীনতার আর্তনাদ নিয়ে, অনাহারে যন্ত্রনা নিত্যসঙ্গী করে তাই মে দিবসের তাৎপর্য এবার অপরিসীম।
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের যন্ত্রনা এতদিন পর্যন্ত সংবাদমাধ্যম এবং ধনীদের অজানা থাকত। তারা যে মানুষ, তাদের যে চাহিদা আছে, ক্ষিদে আছে, শিশুদের পড়াশোনা সেখানোর চাহিদা আছে, কাজ পাবার অধিকার আছে এ সবই রাষ্ট্রনেতাদের বা সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের কাছে সজ্ঞানে অজ্ঞাত থাকত। কিন্ত এবারে এত যন্ত্রনা, এত অনাহারের মধ্যেও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কথা বারবার উঠে এসেছে। এরাই হল শ্রমজীবী মানুষের ৯৪ শতাংশ, যার মধ্যে ৫২ ভাগ কাজ করে গ্রামে, ৪২ ভাগ শহরে। দেশের জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ এদেরই অবদান। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘’এর উপর ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার’’। রবীন্দ্রনাথেরই ভাষায় ”এরা হল সভ্যতার পিলসুজ।” এরা মানুষকে আলো দেয়। এদের গা দিয়েই তেল গড়িয়ে পড়ে, কিন্ত তার আলো নিচে পৌঁছায় না। প্রদীপের নিচে থাকে অন্ধকারে।
এখন লকডাউনের সময় রাষ্ট্রনেতা এবং ধনীদের সেবাদাস রাজনৈতিক নেতাদের মুখে তাদেরই কথা। কারন ওই শ্রমিকদের কাজ না থাকাটাই অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে।
করোনার এই আক্রমন শ্রেনীর কথাটা নুতন করে ব্যাপক ভাবে তুলে নিয়ে এসেছে। করোনার আক্রমন ধনী বা গরীব কাউকে রেয়াত করে না। কিন্ত পার্থক্য হচ্ছে এই যে ধনে প্রানে মারা যায় গরীবরা। কারন তাদের কোনও সঞ্চয় নেই, দিন আনে দিন খায়। এরা শারীরিক দুরত্ব বজায় রেখে চলতে পারে না, কারন এরা থাকে বস্তিতে। যেখানে একটি বাড়ির মধ্যে ৫-৬টি পরিবার থাকে। একটি ঘরের মধ্যেও ৪-৫ জন থাকে। এরা যেটুকু ক্রয় করে সামান্য তাতেই বাজারে একটি চাহিদা তৈরী হয়। কিন্ত কাজ নেই যখন তখন নগদ টাকা কে দেবে? সদ্য নোবেলপ্রাপ্ত অর্থনীতিবীদ অভিজিত বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় ও বলেছেন,‘ দরকার হলে টাকা ছাপিয়ে গরীব মানুষের হাতে পৌছে দিতে.. ‘ ।
কিন্ত সে কথায় কান দেবে কে? সরকার বাহাদুর অর্থসংগ্রহের জন্য ধনীদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। কিন্ত ১ কোটি ১০ লক্ষ সরকারী কর্মচারীদের আগামী এক বছরের মধ্যে ১২ দিনের মাইনে কেটে নিচ্ছে। কর্মরত এবং পেনশনভোগীদের মহার্ঘভাতা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে নাকি ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। অথচ এ বছর বড় কর্পোরেটদের ছাড় দেওয়া হয়েছে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর গত পাঁচ বছরে তাদের ঋণ মুকুব করা হয়েছে ৭ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও এদের কাছেই অনাদায়ী রয়ে গেছে ১০ লক্ষ কোটি টাকা। গত জানুয়ারি মাসে অক্সফ্যাম জানিয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৭৫ ভাগ দেশের শতকরা ১০ শতাংশ মানুষের হাতে। এর উপরে যদি শতকরা ২ ভাগ সম্পদ কর বসানো যায় তাহলে সরকারী কোষাগাড়ে ১৩ লক্ষ কোটি টাকার বেশী আসবে। সি আই টি ইউ এবং এ আই টি ইউ সি সরকারের কাছে চিঠিতে দাবী জানিয়েছে যে ৬৩ জন কোটিপতির কাছে যে অর্থ মজুত আছে তাতে দেশের বাজেট হয়ে যাবে।
অথচ এই সেবাদাসত্বের একমাত্র যথাযত পরিনতি হল মৃত্য মিছিল। এই লেখাটি ওয়েবসাইটে যাওয়া পর্যন্ত সারা দেশে মৃতের সংখ্যা ১২১৮ জন। আর আমাদের রাজ্যে এই সংখ্যাটি ১০৫ (৩৩ + ৭২) জন। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী এক অভিনব জালিয়াতি করছিলেন। মৃত্যুর সংখ্যা ধামাচাপা দিচ্ছিলেন। এমনিতেই কিট নেই, পরীক্ষা কম করা হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যাও গোপন করা হচ্ছে। এই গোপন করাটা মানুষের আত্মসন্তুষ্টির সৃষ্ঠি করতে পারে, সতর্কতা শিথিল করতে পারে, ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করতে পারে।
শিল্পপতিরা এই অবস্থাকে পুরদস্তর কাজে লাগাতে চাইছে। লকডাউন পিরিয়ডের বেতন দেওয়া হচ্ছে না, কাজের সময় ৮ ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করে দেওয়া হচ্ছে, ওই বাড়তি ৪ ঘন্টার জন্য নিয়মমাফিক ঘন্টাপ্রতি দিগুন টাকা দেওয়া হচ্ছে না। মাত্র ৪টি কোডের মধ্যে শ্রেম আইনগুলি বেঁধে ফেলা হচ্ছে। আইন হয়ে যাচ্ছে মালিকদের স্বার্থে। বিভিন্ন রাজ্যে আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্য একমাত্র কেরালা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সি আই টি ইউ কর্মী এবং অন্যান্য বেসরকারী সহযোগিতায় তাও কিছুটা খাবার পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তাদের চাহিদা আছে কিছু নগদ টাকার। কারন লবন, সাবান ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ কিনতে গেলেও টাকা লাগে। এই সবের মধ্যেও উজ্জল ব্যাতিক্রম হচ্ছে কেরালার বামপন্থী সরকার। অন্য রাজ্যের শ্রমিকদের তারা পরিযায়ী শ্রমিক বলছে না, তাদের ‘অতিথি শ্রমিক‘ বলছে। তাদের সমস্ত দায়ভার নিয়েছে কেরালা সরকার। পিনারাই বিজয়নের সরকার ভিনরাজ্যে থাকা কেরালার ২৫ লক্ষ মানুষের জন্য ওষুধ সরবরাহ করছে।
প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা অভিনব, তিনি মাঝে মাঝে ভাষন দিচ্ছেন জনগনের কি করা উচিত। কিন্তু তিনি জনগনের জন্য কি করবেন সেকথা ভুলেও উচ্চারণ করছেন না। এই সুযোগে তিনি জনগনের সম্মতি নির্মানের জন্য একবার বলছেন হাততালি দাও, থালা বাসন – কাসর ঘন্টা বাজাও, একি করোনা দেবীর পুজো হচ্ছে নাকি? আবার কোনো সময় বলছেন বাড়ির সব আলো নিভিয়ে মোমবাতি জালাও। এই সুযোগে বাজি, ঢোল, করতাল নিয়ে কারোনা উৎসবে মেতে উঠল চেলা চামুন্ডারা। ‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে করে, তার শতগুন।‘ এই সম্মতি নির্মান এক ধরনের ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি। অন্যদিকে ট্রাম্পের ধমক খেয়ে বুকের পাঁটা ৫৬ ইঞ্চি থেকে ৫.৬ ইঞ্চি হয়ে গেল। সারা পৃথিবী বলছে কেরালা মডেলই হল সেরা মডেল। এমনকি ভারত সরকারও কেরালা মডেলকে অনুসরণ করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় নেমে গোল দাগ দিয়ে এবং রোজ ভাষন দিয়ে দাবী করছেন তিনিই সারা বিশ্বে প্রথম করোনা দামিনী। মুশকিল হল এই যে ”পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি, মুর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী।” শেষ পর্যন্ত মমতার সরকার হাত তুলে দিয়েছে। তারা করোনা রোগী ভর্তি করতে পারবে না। করোনা রোগী যে যার বাড়ীতে থাকবে। রাস্তায় নেমে গোল দাগ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই যিনি করেন নি তার রাজত্বে করোনা রুখবে কে?
এই পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। চিন ভারতসহ বহু দেশে চিকিৎসা সামগ্রী পাঠিয়েছে। ভিয়েতনামও বিভিন্ন দেশে মাস্ক ও কিট পাঠাচ্ছে। আর সেলাম জানাতে হয় কিউবা কে। ছোট্ট দেশ, ছোট্ট দ্বীপ। অর্থনৈতিক অবরোধ চলছে। অথচ তার মধ্যেই ডাক্তারদের বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছে চিকিৎসার জন্য।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের লড়াই মানুষ জন্মের সেই উষালগ্ন থেকেই। যত দিন গেছে মানুষের সংখ্যা যত বেড়েছে, মানুষকে ততই প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে হয়েছে, নষ্ট করতে হয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই দ্বন্দ্বের মৌলিক দ্বন্দ্ব হিসেবেই পরিচিত হয়ে এসেছে। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব কোনোদিনই কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব হিসেবে অতীতে সামনে আসেনি।
এঙ্গেলস আমাদের শিখিয়েছেন, সাম্যবাদী সমাজে মৌলিক দ্বন্দ্ব হিসেবে সামনে চলে আসে গ্রাম বনাম শহর, শারীরিক শ্রম বনাম মানষিক শ্রম এবং প্রকৃতি বা পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এঙ্গেলস ,এটাও বলেছিলেন এটা মৌলিক দ্বন্দ্ব তো বটেই, এই দ্বন্দ্বের নিয়ম হচ্ছে এই যে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো মৌলিক দ্বন্দ্ব কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব হিসেবে সামনে চলে আস্তে পারে। বর্তমান সময়ে কেন্দ্রীয় মৌলিক দ্বন্দ্ব হিসেবে সারা দুনিয়ার সামনে আত্মপ্রকাশ করেছে প্রকৃতি পরিবেশ বনাম মানুষ। এই পরিবেশ বা প্রকৃতির সংগ্রামের মধ্যেও শ্রেনী দৃষ্টিভঙ্গি আছে।
পৃথিবীতে সবথেকে বেশি বায়ুদুষণ করেছে শিল্পোন্নত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি। এখন উন্নয়নশীল দেশগুলি শিল্পোন্নত দেশ হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে তারাও বায়ুদুষণ করছে। পরিবেশ দুষণ নিয়ন্ত্রন করার জন্য বারবার আলোচনা করা হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলি জানিয়েছে উৎপাদনের জন্য তাদের একটি মাত্রা পর্যন্ত পরিবেশ দুষণ হবে। আমেরিকা সহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলিকে পরিবেশ দুষণের মাত্রা অনেক বেশি কমাতে হবে। কিন্তু আমেরিকা তাতে রাজি নয়। তাদের বক্তব্য সকলকেই সমান অনুপাতে দুষণের মাত্রা কমাতে হবে। এর একটাই অর্থ, উন্নয়নশীল দেশগুলি কোনোদিন শিল্পন্নত হবে না এবং পরিবেশ দুষণ চলছে চলবে। ইতিমধ্যেই গ্রিনল্যান্ড, হিমালয়ের হিমবাহ আন্টার্কটিকার বরফ দ্রুত গতিতে গলছে। সমুদ্রের জল বাড়ছে। ১০ হাজার বছর আগে যখন উষনযুগ শুরু হয়েছিল তখন পৃথিবীর বিশাল অংশে জলপ্লাবন হয়ে ছিল। যার থেকে অনেক উপকথার জন্ম নিয়েছিল। এখন মনুষ্যবসতি বেড়েছে। বিপর্যস্ত হবে গোটা পৃথিবী। উষনায়নের বিরুদ্ধে একটা নতুন ধরনের তীব্র লড়াই শুরু হবে।
শ্রমিকশ্রেনীর সামনে আরও একটি ভয়ঙ্কর আক্রমন আসছে। এর পরেই শুরু হবে মহামন্দা। ২০০৮, ২০১৯ এর মন্দার থেকেও যা হবে অনেক তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী। আক্রান্ত হবে সেই শ্রমিকশ্রেনী।
এবারে মে দিবসের লড়াই তাই শ্রমিকশ্রেনীর কাছে জীবনমরনের লড়াই। খাদ্যের দাবীতে, কাজ পাওয়ার দাবীতে, সামাজিক নিরাপত্তার দাবীতে, একচেটিয়া শোষনের অবসানের দাবীতে, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার দাবীতে একটি নতুন ধরনের সংগ্রামের রণসাজে সজ্জিত হয়েই দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের ময়দানে আমরা উপস্থিত হয়েছি। এ লড়াই আপোষবিহীন।