কেমন আছেন প্রতিবেশি?
গৌতম রায়
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে এই রাজ্যে সংখ্যালঘু উন্নয়ন বলে আদৌ কোনো দপ্তর ই ছিল না।ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তি (‘৪৭) অনুয়ায়ী দেশের সংবিধানে সংখ্যালঘুর সার্বিক অধিকারের যে স্বীকৃতি আছে, তার প্রথম বাস্তব প্রতিফলন এই রাজ্যে হয় ‘৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর।দেশের ভিতর সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তর প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই হয়।
মাদ্রাসা শিক্ষার সার্বিক উন্নতি বামফ্রন্টের ধারাবাহিক কর্মকান্ডের ফসল। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরন, বিশেষ মাদ্রাসা শিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার সমতুল করা- সার্বিক ভাবে বামফ্রন্ট সরকারের কৃতিত্ব। কেবলমাত্র জাতীয় স্তরেই নয়, আরব দেশ গুলিতে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের আমলের মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ, শিক্ষক, শিক্ষা সহায়ক কর্মী দের আর্থিক নিরাপত্তা সব ই ধাপে ধাপে বামফ্রন্টের আমলে হয়েছে।তৃণমূল কংগ্রেসের গত দশ বছরের শাসন কালে বামফ্রন্টের আমলের মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন কে অকেজো করা হয়েছে।কমিশনের পরীক্ষায় সফল হাজার হাজার ছেলেমেয়ে র আজ পর্যন্ত নিয়োগ হয় নি।
মমতা ক্ষমতায় এসে দশ হাজার মাদ্রাসা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ পর্যন্ত কেবলমাত্র ২৩৫ টি আন এইডেড মাদ্রাসা অনুমোদন পেয়েছে।বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার সময়ে (‘৭৭) মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষক- শিক্ষিকার সংখ্যাছিল ২০১০ সালে তার সংখ্যা হয়েছিল ১৯৯৯২ জন।
আর এখন অ-অনুমোদিত যে সমস্ত আন এইডেড মাদ্রাসা আছে, সেগুলির তালেবর এলেমরা আজ পর্যন্ত সরকারী মিড ডে মিল পায় না।গরিব ছেলেমেয়েদের মুসলমান সমাজের ধনী মানুষদের জাকাত, ফেরেতের টাকা তেই পড়াশুনা করতে হয়।এইসব অঅনুমোদিত মাদ্রাসার তালবেলেমরা সমাজের শরিফ মানুষদের বদান্যতায় দুপুরে কিছু খেতে পায়। এইসব মাদ্রাসায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪০০০০ । সেখানে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ২৫০০। শিক্ষকরা সরকার থেকে কোনো সাহায্য পান না।এঁরা এইমুহূর্তে অনশনে বসেছেন।তাঁদের অনশন মঞ্চে যাতে কোনো ডেকরেটার ত্রিপল, মাইক ইত্যাদি না দেয় সে জন্যে মমতা ব্যানার্জীর প্রশাসন এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে।অথচ প্রবল শীতে অনশনরত মাদ্রাসার শিক্ষক, শিক্ষিকাদের জন্যে সামান্য শৌচালয় ব্যবহারের অনুমতি পর্যন্ত মমতার সরকার দেয় নি।
মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন কে অকেজো করে দিতে যিনি মাদ্রাসা পরিচালন সমিতির হয়ে মামলা লড়েছিলেন, সেই ব্যক্তিকে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের সদস্য করেছে তৃণমূলের সরকার।
মাদ্রাসার শিক্ষক , শিক্ষাকর্মীদের জন্যে বেতন সহ মহার্ঘ্য ভাতার যে ব্যবস্থা বামফ্রন্ট করেছিল, দেশের ভিতরে মাদ্রাসা শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের জন্যে তেমন ব্যবস্থা বামফ্রন্ট সরকার প্রচলন করবার আগে ছিল না।
বামফ্রন্টের আমলে যে মাদ্রাসা বোর্ড তৈরি হয়েছিল, সেই বোর্ডটিকে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে গত দশ বছরে প্রায় পরিচালিত ই করে নি মমতার সরকার।বামফ্রন্টের আমলের সব কাজ কেবলমাত্র নামবদলে নিজেদের বলে চালিয়েছে।উদাহরণ,সপ্তম শ্রেণীর দ্রুত পঠন , রোকেয়া জীবনী কেবলমাত্র লেখকের নামটি না ছেপে পুনর্মুদ্রণ করে চলেছে মমতার সরকার।
বামফ্রন্টের আমলে মাদ্রাসার জন্যে যে বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানের ব্যবস্থা ছিল, ধীরে ধীরে সেটিকে কার্যত অবলুপ্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে তৃণমূলের সরকার।
বামফ্রন্ট সরকার ‘৭৮ সালে যে উর্দু আকাদেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন , গত দশ বছরে তার কার্যকারিতাকে ধীরে ধীরে লুপ্ত করেছে মমতার সরকার।
পৃথক মাদ্রাসা শিক্ষা ডাইরক্টরেট বামফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করলেও গত দশ বছরে এই বিভাগে নোতুন নিয়োগ প্রায় হয় ই নি।ফলে কর্মী, পরিকাঠামো ইত্যাদির অভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে মাদ্রাসা ডাইরক্টরেট কার্যত কোমায় চলে গেছে।
ভুলে গেলে চলবে না বামফ্রন্ট সরকার যখন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বিল আনে তখন সেই বিলের পক্ষে ভোট দেয় নি মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস।আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ভোকেশনাল স্টাডিজ সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের ভিতরে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসারে যে ভূমিকা পালন করেছিল , সেই ভূমিকা একাংশ ও কেন গত দশ বছরে দেখতে পাওয়া গেল না?
পশ্চিমবঙ্গ ওয়াকফ বোর্ডকে সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার।সেই সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের অর্থ কি ভাবে ইমাম , মোয়াজ্জিনদের ভাতা হিশেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে? ওয়াকফ বোর্ডের অর্থ খরচের অধিকার কি সরকারের আছে? সরকারের পক্ষ থেকে এই অর্থ খরচ কি সংবিধান মোতাবেক স্বীকৃত একটি সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারের উপর রাজ্য সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপ হিশেবে বিবেচিত হবে না? এভাবে কি সংবিধান অবমাননা করে নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন? বামফ্রন্ট সরকার কিন্তু দুস্থ ইমাম , মোয়াজ্জিনদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা বাবদ বৃত্তি দিতো,সেটি সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের বিশিষ্ট্য ব্যক্তিত্বদের সহযোগিতা নিয়েই ওয়াকফ বোর্ডের মাধ্যমে।গত দশ বছরে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ভাতা দেওয়ার কথা সকলে শুনেছেন।কিন্তু তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা প্রসারে বামফ্রন্ট সরকারের আমলের সেই বৃত্তির কি হল, তার খোঁজ কি একবার ও হয়েছে?ওয়াকফ সম্পত্তি জরিপের যে কাজ টি বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শুরু হয়েছিল, তাকে কেন আর ত্বরান্বিত করলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? বামফ্রন্ট সরকার জেলা গুলিতে ১২ টি ইংরেজি মাধ্যম মাদ্রাসার কাজ শুরু করেছিল তাঁদের শেষ পর্যায়ের শাসনকালে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই এই জেলাগুলির ইংরেজি মাধ্যম মাদ্রাসার কাজ বন্ধ করে দেন।যাঁরা প্রাথমিকে ইংরেজি ঘিরে বামফ্রন্ট সরকারকে দোষারোপ করতে অভ্যস্থ, তাঁরা কিন্তু সংখ্যালঘু মুসলমানদের ইংরেজি শেখার সুযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক বন্ধ করে দেওয়া ঘিরে একদম নীরব।