৬ আগস্ট ২০২৩ (রবিবার)
দ্বিতীয় পর্ব
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার তৈরি হওয়ার পর দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার একটা আশঙ্কা ছিলই। গুজরাটে দাঙ্গার নামে ঘটানো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রধান দুই কারিগর যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন এই আশঙ্কা হওয়া আদৌ অমূলক নয়। গত ন’বছরে আশংকা সত্যি হয়েছে শুধু তাই নয় বিপদের মাত্রা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মুহূর্তে হরিয়ানা হিন্দুত্ববাদীদের আগুনে জ্বলছে। আগুন ছড়িয়েছে গুরগাঁও শহর দিল্লির উপকণ্ঠে। কিছুদিন আগে দিল্লির একটা বড় অংশজুড়ে ঘটানো হিন্দুত্ববাদীদের এই তাণ্ডবে ঘর, জীবিকা, পরিবার-পরিজন হারিয়েছেন বহু অসহায় হতদরিদ্র মানুষ যাদের একমাত্র অপরাধ হল তারা সংখ্যালঘু ইসলাম ধর্মাবলম্বী। হরিয়ানাতেও একই কায়দায় আক্রমণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নূহ অঃসহ অন্যান্য অঞ্চলগুলিকে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভারতবর্ষের মতো এক ঐতিহ্যশালী বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি প্রকাশ্য রাজপথে সংখ্যালঘুদের দেশের গদ্দার হিসেবে চিহ্নিত করে গুলি করে মারার নিধান জারি করেন। গোরক্ষার নামে, লাভ জিহাদের নামে প্রকাশ্যে পিটিয়ে খুন করা হচ্ছে সংখ্যালঘু মানুষদের। কে কি খাবে, কি পরবে তা নিয়ে সরকারি মদতে নীতি পুলিশের কাজ করছে হিন্দুত্ববাদীরা। ধর্মের জিগির তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনার ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড কে ম্লান করে দিয়েছে। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে এ লজ্জা আমাদের সবার।
ট্রাস্টের আড়ালে কার্যত সরকারি উদ্যোগে অযোধ্যায় চলছে রাম মন্দির গড়ে তোলার কাজ যাকে ঘিরে লোকসভা নির্বাচনের আগে হিন্দুত্ববাদীরা গণ হিস্টিরিয়া তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। কেবল বিশ্বাসের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ আদালতে অযোধ্যার রায় ঘোষণা হওয়ার পর, হিন্দুত্ববাদীরা হুংকার দিয়েছিল, এরপর কাশী, মথুরা প্রকল্প শুরু করার। বাবরি মসজিদ যাদের নেতৃত্বে ভাঙ্গা হলো তারা কোনো শাস্তি পেল না। উল্টে বীরের খেতাব পেল তারা, ঠিক যেমনটা এখন পাচ্ছে গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসে। যথারীতি নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে বেনারসে জ্ঞানব্যাপি মসজিদকে ঘিরে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের নামে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির পরিকল্পনা। এরপর লাইনে আছে মথুরা, তাজমহল, কুতুব মিনার, লালকেল্লার মত ঐতিহাসিক সৌধগুলি। এসবের মধ্য দিয়ে নিছক একটি মসজিদ বা একটি মিনার ধ্বংস হচ্ছে ভাবলে ভুল হবে, ধ্বংস হচ্ছে এদেশের দীর্ঘদিনের লালিত বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় উত্তরপ্রদেশ হরিয়ানা সহ দেশের বহু জায়গায় ধর্মসভার নামে চলছে হিন্দুত্ববাদীদের সংখ্যালঘু নিকেশ করার প্রকাশ্য হুংকার। আদালতের নিষেধাজ্ঞাকেও তোয়াক্কা করছে না এইসব হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী। এদের কীর্তিকলাপ প্রকারান্তরে উৎসাহ জোগাচ্ছে মুসলিম মৌলবাদী সহ অন্যান্য গোষ্ঠীকে। আমরা তো জানি, মৌলবাদ– সে যে ধর্মের আবরণেই আসুক না কেন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ শ্রমজীবী জনগণের জীবনকে তা দুর্বিষহ করে তোলে। এদেশে এখন তাই ঘটছে। এমনকি কর্পোরেট মালিকরাও এই মৌলবাদী শক্তির পেছনে ইন্ধন যোগাচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলনকে দুর্বল করবার তাগিদে। স্বাধীন দেশে এই প্রথম একটা সরকারকে আমরা দেখলাম যারা সি এ এ, এন আর সির মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের নতুন সংজ্ঞা দিতে চায়। সঙ্গত কারণে দেশ জুড়ে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সর্বস্তরের মানুষ এর প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। বিজেপি সরকার ফ্যাসিস্ট কায়দায় এই প্রতিবাদী জনতাকেও দমিয়ে রাখতে দমন পীড়ন নামিয়ে এনেছে। বিনা অপরাধে আজও জেলের অন্ধকারে দিন গুজরান করছে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী গবেষক ওমর খালিদ। তার অপরাধ দুটি– এক সে মুসলমান, দুই সে নাগরিকত্বের এই নতুন সংজ্ঞার বিরোধী। অথচ,রাজস্থানে নিরপরাধ দুই সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে গাড়ির মধ্যে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ফেরার আসামি স্বঘোষিত গো রক্ষক মনু মানেসর দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে দিল্লি হরিয়ানায়, নতুন নতুন সন্ত্রাসের ব্লু প্রিন্ট নিয়ে। এটাই মোদীর ভারত যেখানে সংখ্যালঘু মানুষেরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন।
অভিন্ন দেওয়ানী বিধি চালু করার নামে নতুন করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি শুরু হয়েছে যা আগামী লোকসভা নির্বাচনে হাতিয়ার করতে চায় বিজেপি দল। রাম মন্দির তো আছেই, সঙ্গে যোগ হলো এই অভিন্ন বিধি চালু করার নতুন উদ্যোগ যা ২১ তম আইন কমিশন কার্যকর না করার পক্ষে সরাসরি মত দিয়েছিল। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের এই ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আদৌ জরুরী এজেন্ডা হতে পারে না। প্রয়োজন হল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমতাবিধানের মাধ্যমে জীবনধারণের ন্যূনতম সাধন প্রাপ্তির প্রশ্নে বৈষম্য দূর করা। কোন নির্দিষ্ট ধর্মের আওতায় থাকা বিধিতে সমস্যা থাকলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করা। ফৌজদারি আইন তো সবার জন্য এক। দেওয়ানী বিধি জোর করে এক নাইবা হল। আমাদের সংবিধানেও এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি জোর করে চালু করার কথা বলা নেই। যারা এটা জোর করে করতে চাইছে, সেই নরেন্দ্র মোদির দল আসলে এই ইস্যুতে ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করে আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার ফন্দি এঁটেছে। এছাড়া গতবারের পুলুয়ামার ঘটনার মতো নির্বাচনের আগে আরো কোথায় কি বিপদ ঘটবে কেউ জানিনা আমরা। জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সৎপাল মালিক মুখ না খুললে আমরা জানতেও পারতাম না সংকীর্ণ রাজনীতিকে হাতিয়ার করে নির্বাচনে যেতার জন্য কিভাবে পুলুয়ামার স্ক্রিপ্ট তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনের আগে এত শহীদ সেনাদের রক্ত কি আদৌ দরকার ছিল– এ প্রশ্ন এখন সঙ্গত কারণেই উঠে এসেছে। এই বিপজ্জনক প্রবণতাকে রুখতে না পারলে বিপদ আরো বাড়বে।
নজরদারিমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা
সংবিধানকে নস্যাৎ করে দেশ জুড়ে এক নজরদারিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছে বর্তমান বিজেপি সরকার। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি এখন সরাসরি সঙ্ঘ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। দেশের সেনাবাহিনী, নির্বাচন কমিশন, কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল (সি এ জি), সেন্ট্রাল ইনফরমেশন কমিশন, সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ইউনিভারসিটি গ্রান্টস কমিশন (ইউজিসি), এন সি ই আর টি সহ বহু প্রতিষ্ঠান এখন সরাসরি সঙ্ঘ পরিবারের দখলে যা তারা তাদের হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কার্যকর করবার লক্ষ্যে কাজে লাগাতে শুরু করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রের ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণ ও সর্বস্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা তথা পাঠ্যসূচিকে হিন্দুত্বের আদলে গড়ে তোলার কাজ নতুন শিক্ষানীতিকে সামনে রেখে ইতিমধ্যেই তারা শুরু করেছে। প্রতিবাদ চলছে, এবার দেশজুড়ে প্রতিরোধ জরুরী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে ব্রিটিশ আমলের দানবীয় ইউএপিএ আইন নবকলেবরে কার্যকর করেছে বর্তমান বিজেপি সরকার।
সম্পূর্ণ নিবন্ধটি তিনটি পর্বে প্রকাশিত