সীতারাম ইয়েচুরি
৭ই নভেম্বর, ২০১৭- অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষপূর্তি।
১৮৬৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুঁজি (ক্যাপিটাল)-র প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়। ক্যাপিটাল প্রকাশের ১৫০ বছর, অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ এবং কার্ল মার্কসের সার্ধশত জন্মবর্ষ (৫ মে, ১৮১৮) তিনটি ঘটনাই ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুনিয়াজুড়ে মানুষের লড়াইতে অক্টোবর বিপ্লবের অনুপ্রেরণা আজও অব্যাহত রয়েছে। দুনিয়াজুড়ে মানুষের লড়াইতে অক্টোবর বিপ্লবের অনুপ্রেরণা আজও অব্যাহত রয়েছে। অক্টোবর বিপ্লবের পরেই বিশ্বের অধিকাংশ দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে এবং স্বাধীনতা ও মুক্তির দাবিতে মানুষের সংগ্রাম তীব্রতর হয়।
সমাজতন্ত্রের বিপরীতমুখী চলন
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া ও সমাজতন্ত্রের পতন কিভাবে এবং কেন ঘটল সেই প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) তার বিচার বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছে। আমাদের বিশ্লেষণ, মার্কসবাদ লেনিনবাদ যা সৃজনশীল বিজ্ঞান, প্রকৃতপক্ষে তার দুর্বলতার কারণে ঐ বিপর্যয় ঘটেনি বরং মার্কসবাদ লেনিনবাদের বৈপ্লবিক মর্মবস্তু থেকে বিচ্যুতির কারণেই এমনটা ঘটেছে। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই কারণে মার্কসবাদ লেনিনবাদ বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে খারিজ করে দেওয়া চলে না।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্হিতির সাথে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা
ভিন্ন মতাদর্শবাদী ও কমিউনিস্ট বিরোধীরা লাগাতার প্রশ্ন করে চলেছে যে আমরা এমন একটি বিপ্লবের শতবর্ষ কেন পালন করছি, যা আজ ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে। তাদের বক্তব্য, অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্য ও অবদান যাই হোক না কেন, আজকের দুনিয়ায় তার আর কোনও অস্তিত্ব নেই। তাহলে কেন এই বিপ্লবের শতবর্ষ পালন?
বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রবল প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই, একথা যেমন সত্য, ঠিক ততটাই সত্য আজকের পৃথিবীতে তার প্রাসঙ্গিকতা।
প্রথমত, মানব মুক্তির সংগ্রাম যে বিজয়ী হতে পারে অক্টোবর বিপ্লব তা প্রমাণ করে দিয়েছে। পরবর্তীকালে এই বিপ্লব দুনিয়া জুড়ে মুক্তিকামী মানুষের লড়াইয়ে সাফল্যের সম্ভাবনাকেও সামনে এনেছে। ঐ বিপ্লব আসলে গোটা পৃথিবীতে একটি আত্মবিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যদি অক্টোবর বিপ্লব সফল হতে পারে, তবে অন্যান্য দেশেও বিপ্লব সংগঠিত করা সম্ভব, এটাই সেই অনুপ্রেরণা।
অক্টোবর বিপ্লবের অন্তত চারটি এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আজও প্রাসঙ্গিক।
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে অবিচল না হয়ে কোন বিপ্লবী সংগ্রাম বিজয়ী হতে পারে না, অক্টোবর বিপ্লব এই শিক্ষকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে তার নিয়মসমূহ আবিষ্কার করেন কার্ল মার্কস। লেনিন তার থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে দেখালেন, সমসাময়িক বিশ্ব পরিস্থিতিতে কিভাবে পুঁজি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এবং তার নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়াচ্ছে কতিপয় গোষ্ঠী। এরই সুবাদে আধুনিক পুঁজিবাদ ক্রমাগত লগ্নী পুঁজি নির্ভর হয়ে উঠেছে। লগ্নী পুঁজির ব্যবস্থাই পুঁজিবাদকে সাম্রাজ্যবাদের স্তরে পৌঁছে দেয়। দুনিয়াজুড়ে এমন ব্যবস্থার বহুবিধ প্রভাব পড়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হল, সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীর সমস্ত দেশকেই শোষণের একটি অভিন্ন শৃঙ্খলে জড়িয়ে নেয় এবং তার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ক্রমশই তীব্রতর হতে থাকে। এহেন সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলাকে ভাঙতে লেনিন ‘শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থিতে আঘাত হানার তত্ত্ব’ হাজির করেছিলেন। গত শতাব্দীর প্রথম দুটি দশক জুড়ে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়াই ছিল বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের সেই দুর্বলতম গ্রন্থি। এমন পরিস্থিতিই রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর সামনে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত করার সুযোগ করে দেয়।
সিপিআই(এম)-এর বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসের মতাদর্শগত দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমান সময়ে লগ্নী পুঁজির বিপুল বিস্তৃতি ঘটেছে এবং তারই নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন এগিয়ে চলছে। এমন পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির অন্তর্দ্বন্দ্ব অনেকটাই স্তিমিত অবস্থায় রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী স্তরের অন্তর্গত বিশ্বায়নের আজকের এই পর্যায়ে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজিকে কাজে লাগিয়ে ক্রমাগত পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটে চলেছে। আরও আরও মুনাফা ও লুটের উদ্দেশ্যে শিল্প পুঁজি সহ পুঁজির অন্যান্য যাবতীয় রূপভেদের সাথে আজকের লগ্নী পুঁজি নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে। বিপুল মুনাফা বৃদ্ধি ও পুঁজির বিরাট কেন্দ্রীভবনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি নতুন করে আক্রমণ হানছে। এই উদ্দেশ্যেই সে তার যাবতীয় শক্তিকে সংহত করছে।
পুঁজিবাদের ইতিহাস বলে পুঁজির কেন্দ্রীভবন হয় দু’ভাবে। প্রথমত, পুঁজিবাদের স্বাভাবিক গতি, যার সুবাদে উৎপাদন প্রক্রিয়ার শেষে পুঁজি নিজেকে বাড়িয়ে নেয়। দ্বিতীয়ত সরাসরি লুটের কৌশল। সেই নির্মম পদ্ধতি প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে মার্কস ‘পুঁজি সঞ্চয়ের আদিম কৌশল’ (প্রিমিটিভ অ্যাক্যুমুলেশন) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। অনেকসময় এই আদিম কৌশলকে ইতিহাসের বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এমন বিবেচনা আসলে ভ্রান্তি, এতে পুঁজিবাদকে আদিম ও আধুনিক এরকম দুটি পর্বে ভাগ করার বিভ্রান্তি ঘটে।
মুনাফার সর্বোচ্চ বৃদ্ধির জন্য পুঁজিবাদ কার্যত হানাদারের চেহারায় নিজেকে হাজির করেছে। এই হানার জোর এমন যে, সে যেমন দুনিয়াজুড়ে মানুষের মধ্যে অসাম্যকে উৎকট চেহারায় ক্রমশ বিস্তৃত করে চলছে, তেমনই এক বিশাল সংখ্যক মানুষের উপর দারিদ্র ও দুর্দশা চাপিয়ে দিচ্ছে। এই মুহুর্তে পুঁজিবাদ যে সংকটের মধ্যে চলছে তাকে আমরা তার নিজস্ব গঠনগত সংকট (সিস্টেমিক ক্রাইসিস) বলতে পারি। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে পুঁজিবাদ যা কিছুই চেষ্টা করুক না কেন, বিকাশের পথে তার নিয়ম এমনই যে, একটি সংকট থাকে মুক্ত হওয়ার পথে সে পরেরবার আরও বড় সংকটের মুখোমুখী হয়।
আজকের পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় দুটি স্তরেই লড়াই চালাতে হবে। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে তীব্রতর করার কাজে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির তরফে দুনিয়াজুড়ে সাম্রাজ্যবাদের সামরিক আক্রমণ, দখল ইত্যাদির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে। আবার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চাপিয়ে দেওয়া নির্মম অর্থনৈতিক শোষনের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে হবে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এটাই হবে আন্তর্জাতিক আন্দোলনের মূল কাঠামো।
বিপ্লবের বিভিন্ন স্তর
আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল ভেঙে অক্টোবর বিপ্লব যখন সফল হয় তখনকার পরিস্থিতিতে রাশিয়া ছিল পশ্চাদপদ ধনতান্ত্রিক দেশ। এতদিন দুনিয়াজুড়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে যে ধারণা ছিল তাতে মনে করা হত, কেবলমাত্র উন্নত পুঁজিবাদী দেশেই বিপ্লব সম্পন্ন হবে। কিন্তু জার্মানিতে বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। লেনিনের ভাবনায় ছিল, বিপ্লবোত্তর দুনিয়ায় জার্মানির মতো উন্নত দেশের শ্রমিক শ্রেণীর অভিজ্ঞতা থেকে রাশিয়ার মতো পিছিয়ে থাকা দেশের শ্রমিকশ্রেণী সমাজ বদলের অনুপ্রেরণা পাবে, যদিও বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি। জার্মানিতে বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পরে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য হয়। ‘এক দেশ এক সমাজতন্ত্র’র ধারণা তখনই সামনে আসে। পশ্চাদপদ অর্থনৈতিক অবস্থার নিরিখে একেকটি দেশ নিজেদের বাস্তবতা অনুযায়ী বিপ্লবের একেকটি স্তর নির্ধারণ করে সমাজতন্ত্রের অভিমুখে এগোবে, এভাবেই লেনিন ‘এক দেশ এক সমাজতন্ত্র’র ধারণাকে আরও প্রসারিত করলেন। অক্টোবর বিপ্লবের পরই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে সংগ্রামের গণতান্ত্রিক স্তর ও সমাজতান্ত্রিক পর্যায়ের ধারণা গড়ে ওঠে, যা আজও প্রাসঙ্গিক।
সিপিআই(এম) নিজেদের পার্টি কর্মসূচিতে ভারতে বিপ্লবের বর্তমান পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক স্তরে রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছে। এর অর্থ কী? গণতান্ত্রিক স্তরের কাজ হল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভের সময়কার অসমাপ্ত কর্তব্যগুলির সমাপন।
কোন কোন কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে?
১) সাম্রাজ্যবাদী বন্ধন থেকে ভারতকে মুক্ত করা, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধিতায় সক্রিয় থাকা।
২) দেশের জনগণের এক বিরাট অংশকে বুর্জোয়া জমিদারি শাসনের বন্ধন থেকে মুক্ত করা, সামন্তবাদী শাসনের অবসান।
৩) দেশের কর্তৃত্বে থাকা বুর্জোয়া শাসনের অবসান ঘটানো অর্থাৎ একচেটিয়া পুঁজি বিরোধী সংগ্রাম।
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, সামন্ততান্ত্রিক শাসন বিরোধী এবং একচেটিয়া পুঁজি বিরোধী – এই ত্রিমুখী সংগ্রামে বিজয়ী হতে হবে। তবেই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ সম্পন্ন হবে এবং জনগণের জন্য প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে দেশের জনসাধারণের এক বিরাট জোট গড়ে তুলে দেশের শাসক হিসেবে বুর্জোয়া জমিদারি শাসনকে উচ্ছেদ করার মধ্যে দিয়েই এ কাজ সম্পন্ন করা হবে।
শ্রমিক-কৃষক জোট
অক্টোবর বিপ্লব দেখিয়েছিল যে, শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী গড়ে তোলা এবং তাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমেই একটি পশ্চাৎপদ দেশে বিপ্লবের সাফল্য অর্জন করা যেতে পারে। প্যারি কমিউন থেকে শিক্ষা নিয়ে, যেখানে কমিউনার্ডদের (কমিউনের সদস্য) বিরুদ্ধে শাসকশ্রেণি কৃষকদের সফলভাবে সংগঠিত করেছিল, লেনিন স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কৃষিক্ষেত্র ও গ্রামীণ প্রত্যন্ত অঞ্চলের শোষিত শ্রেণিগুলিকে বিপ্লবের মিত্র হিসাবে দৃঢ়ভাবে সংগঠিত করা দরকার। শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী, সমাজ পরিবর্তনের জন্য বর্তমান সময়ের বিপ্লবীদের হাতে শক্তিশালী অস্ত্র।
সিপিআই(এম)-এর পার্টি কর্মসূচি কৃষি বিপ্লবকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অক্ষরেখা হিসাবে গ্রহণ করেছে, যার নেতৃত্ব দেবে শ্রমিকশ্রেণি। এই উপলব্ধির মধ্যেই অন্তর্নিহিত রয়েছে কেন্দ্রীয় বিষয়টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য অর্জনের অত্যাবশ্যক হাতিয়ার হিসাবে, শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী গঠন এবং তার বিকাশের প্রয়োজনীয়তা।
আমাদের পার্টি কংগ্রেসগুলিতে এবং আমাদের সময়ের ভারতের বাস্তব পরিস্থিতিতে এই বিষয়টির উপর বারবার জোর দেওয়া হয়েছে – জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার জন্য শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী গড়ে তুলে একে শক্তিশালী করতে হবে।
জাতীয় ও ঔপনিবেশিকতা প্রশ্নে লেনিনের থিসিস, বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সাথে দেশীয় বিপ্লবী সংগ্রামকে একীভূত করা, স্বাধীনতার জন্য ঔপনিবেশিক জনগণের সংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে একত্রীভূত করার বিষয়টিকে জোরালোভাবে তুলে ধরেছিল।
অক্টোবর বিপ্লবের সময়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলির আন্তর্জাতিকতাবাদই বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ভিন্ন ধারায় আজও প্রাসঙ্গিক।
আমরা দেখেছি, ২০০৮ সালে শুরু হওয়া সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিশ্ব পুঁজিবাদের বিভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, আর্থিক মন্দা এক গভীর সংকটের নতুন রূপ নিয়েছে। সংকটের বর্তমান পর্যায়ের সমস্যা অতিক্রম করার জন্য চেষ্টা চলছে, শ্রমিকশ্রেণি এবং শ্রমজীবী জনগণের উপর অভূতপূর্ব ‘কৃচ্ছ্রসাধন ব্যবস্থা’(Austerity Measure) চাপিয়ে, এমনকি বর্তমান আয় এবং জীবিকার শর্তকে অস্বীকার করে। মজুরি, পেনশন এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অন্য কথায়, বিশ্ব পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক শোষণের তীব্রতা বাড়িয়ে তার সংকট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বরাবরের মতোই।
এটা নিশ্চিত করার জন্যই সাম্রাজ্যবাদকে সমগ্র বিশ্বে তার রাজনৈতিক আধিপত্যকে শক্তিশালী করতে হয়, যা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে তীব্রতর করবে। এই সঙ্কটের ফলে আরোপিত নতুন অর্থনৈতিক বোঝা এবং অর্থনৈতিক শোষণের তীব্রতার বিরুদ্ধে অনেক দেশে শ্রমিকশ্রেণি ও শ্রমজীবী জনগণের বড় আকারের প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে। তবে আমরা একবিংশ কংগ্রেসের রিপোর্টে উল্লেখ করেছি, এই সংগ্রামগুলির চরিত্র মূলত প্রতিরোধমূলক। প্রতিরোধমূলক এই অর্থে যে, সেগুলি মূলত বিদ্যমান জীবিকার অবস্থা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে আরও আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য। তবে এই সংগ্রামগুলির ওপরে ভিত্তি করেই খোদ পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ সংগ্রামগুলিকে শক্তিশালী করা ও উচ্চতর স্তরে এগিয়ে নেওয়া দরকার।
এই সংকট যতই তীব্র হোক না কেন, পুঁজিবাদ কখনও আপনা আপনি ভেঙে পড়ে না। সর্বদা তীব্রতর শোষণ এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদিকা শক্তির ধ্বংসের মাধ্যমে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজে। সুতরাং পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করতে হবে, যা নিশ্চিতভাবে নির্ভর করে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজে সেই বস্তুগত শক্তিকে শক্তিশালী করার উপর, যা গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ শুরু করার জন্য শ্রেণিসংগ্রামের তীব্রতাকে বৃদ্ধি করতে পারে। এই বস্তুগত শক্তি ও তার নির্মাণ হচ্ছে ‘বিষয়গত উপাদান’; লেনিন বলেছেন, একে শক্তিশালী করা অত্যাবশ্যক এবং অপরিহার্য। বস্তুগত উপাদান – সঙ্কটের বাস্তব পরিস্থিতি বৈপ্লবিক অগ্রগতির পক্ষে যতই সহায়ক হোক না কেন, এই ‘বিষয়গত উপাদান’কে শক্তিশালী না করে পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইকে বিপ্লবী আক্রমণে রূপান্তরিত করা যাবে না।
প্রত্যেক দেশের বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণের ভিত্তিতে শ্রমিকশ্রেণিকে বিভিন্ন মধ্যবর্তী শ্লোগান, ব্যবস্থা ও রণকৌশল প্রয়োগ করতে হবে, শ্রেণিসংগ্রামকে তীক্ষ্ণ করতে হবে এবং এই বাস্তব অবস্থার চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করতে হবে, যাতে ‘বিষয়গত উপাদান’কে শক্তিশালী করা যায় এবং এইভাবে তাদের নিজ নিজ দেশে বৈপ্লবিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া যায়।
আমাদের পার্টির নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন এবং রাজনৈতিক-মতাদর্শগত কার্যকলাপ অব্যাহত রাখার ভিত্তি হলো, বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ করে এবং ভারতীয় পরিস্থিতিতে বিষয়গত উপাদানকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় জরুরি প্রচেষ্টা চালানো। সিপিআই(এম) বিশতম কংগ্রেসের মতাদর্শগত প্রস্তাবে, বিষয়গত উপাদানকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের মনোযোগ দাবি করে এমন ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করেছিল। একুশতম কংগ্রেসে আমরা পার্টি সংগঠনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একটি সাংগঠনিক প্লেনাম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্লেনাম সিদ্ধান্ত নেয়, সিপিআই(এম) ‘গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী রাজনৈতিক দল’ হিসাবে নিজেদের গড়ে তুলবে। প্লেনামের দিকনির্দেশ হল, ভারতীয় জনগণের সাথে আমাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করা এবং সেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারতীয় পরিস্থিতিতে বিষয়গত উপাদানকে শক্তিশালী করা।
এই লক্ষ্যে, অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষের এই বছরব্যাপী উদযাপনগুলি, অবশ্যই আমাদের প্রচেষ্টায় যথেষ্ট অবদান রাখবে।
কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির লেখা প্রবন্ধটি ৭ নভেম্বর, ২০১৭ ‘নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ’ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছিল পিপলস ডেমোক্রেসি পত্রিকায়।