রবিকর গুপ্ত
হিংস্র বাঘের ন্যায় পদচারনা করছিলেন বোম্বের রয়্যাল ইন্ডিয়া নেভির ‘তলোয়ার’ জাহাজের কম্যান্ডিং অফিসার ফ্রেডরিক কিং। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর ক্রোধের নিমিত্ত, এক ভারতীয় নাবিক। পায়চারি থামিয়ে কিং তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন – ‘তোমার কার্যকলাপের পরিণতি কী, তা কি তুমি জান?’ তৎক্ষণাৎ নির্ভীক উত্তর এল – ‘আমি ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত’। এর পরেই নৌসেনার যাবতীয় শতাব্দী প্রাচীন নিয়ম ও শৃঙ্খলাকে নস্যাৎ করে চেয়ার টেনে কম্যান্ডিং অফিসারের সামনে বসে পড়লেন ঐ তরুণ ভারতীয় নাবিক। হতভম্ব হয়ে গেলেন কিং। দীর্ঘকাল তিনি রাজকীয় নৌবহরে রয়েছেন, কিন্তু এর পূর্বে এমন ঘটনার তিনি কোনোদিন মুখোমুখি হননি। এ কোন সব উলটে দেওয়া নতুন ক্রান্তির হাওয়া বইছে আরব সাগরে, যে সামান্য সিগনালম্যান জাহাজের কম্যান্ডিং অধিসারের সামনে এই ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে?

আরব সাগরে ভাসমান ‘তলোয়ার’ জাহাজ। এই জাহাজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজ করেছে সিগন্যাল রেটিংদের শিক্ষাকেন্দ্র রূপে। হাজার হাজার রেটিং এখানে প্রশিক্ষণ লাভ করেছে, কোনোদিন শৃঙ্খলায় কোনো চিড় ধরেনি। ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর মতো, রাজকীয় ভারতীয় নৌবাহিনীও চুড়ান্ত অরাজনৈতিক। প্রায় তিন দশক ধরে চলা জাতীয় আন্দোলনের উত্থান ও পতনের ঢেউ তাকে স্পর্শও করেনি। ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ‘সেডিশন’ আর যেখানেই মাথা তুলুক, নৌ-সেনা তার থেকে নিরাপদ। তার উপর ‘তলোয়ার’-এর মতো জাহাজে, যেখানে ফ্রেডরিক কিং-এর মতো দুঁদে কম্যান্ডিং অফিসার আছে সেখানে তো তা অসম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর থেকেই একটির পর একটি ঘটনা এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে লাগল। প্রথম অশনি সংকেত দেখা গেল ১৯৪৫ সালের ১-লা ডিসেম্বর। অসামরিক জনসাধরনের প্রদর্শনের জন্য সেইদিন জাহাজ উন্মুক্ত করার কথা। রাত অবধি সেই মর্মেই প্রস্তুতি চলেছে। কিন্তু সকাল হতেই হতবাক অফিসাররা দেখলেন বিক্ষিপ্ত পোড়া পতাকা আর কাপড়ের জঞ্জালের মাঝখানে কারা যেন একফুট উঁচু অক্ষরে লিখে গেছে কতগুলো আগুন ঝরানো স্লোগান – ‘ভারত ছাড়ো’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘এখনই বিদ্রোহ কর’, ‘গোরাদের হত্যা কর’। কোনো রকমে অসামরিক লোকদের জন্য ফাটক খুলে দেওয়ার আগে লেখা পরিষ্কার করা গেলেও, রেটিং দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল দারুণ উত্তেজনা।
সেই শুরু। এর পর ঘটে যেতে লাগল একের পর এক একই রকম ঘটনা। কম্যান্ডিং অফিসারের সামনে মাথার টুপি ছুঁড়ে ফেলে তাতে লাথি মেরে কারাবরণ করলেন আর কে সিং। ১৯৪৬ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি কম্যান্ডার ইন চিফের জাহাজ পরিদর্শন করতে আসার দিন যে বেদির উপর দাঁড়িয়ে তিনি অভিনন্দন গ্রহণ করবেন সেখানে দেখা গেল বড়ো বড়ো হরফে লেখা আছে ‘জয় হিন্দ’ আর ‘ভারত ছাড়ো’। অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। যে করেই হোক ধরতেই হবে রেটিং-দের মধ্যে থেকে চক্রান্তকারীদের। শীঘ্রই তাঁদের এই প্রচেষ্টার সুফল পাওয়া গেল। জনৈক ভারতীয় অফিসারই ধরিয়ে দিল এতদিন ধরে কর্তৃপক্ষকে অপদস্ত করার প্রচেষ্টার অন্যতম মাথাকে। ধরা পড়লেন সিগনালম্যান বলাই চন্দ্র দত্ত। তিনি গ্রেপ্তার হলেন বটে, কিন্তু তারপর নৌ-বাহিনীর সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সামনেও তাঁর দৃপ্ত আচরণ, যা নিবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে, নাবিকদের প্রবল ভাবে অনুপ্রাণিত করল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিদেশ থেকে ফেরত রেটিংদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরেই একটি টানাপোড়েন তীব্র হচ্ছিল। সমগ্র যুদ্ধ তারা তাদের ব্রিটিশ সহকর্মীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, কিন্তু প্রাপ্য সম্মান তো পায়ই নি, বরং পদে পদে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে তারা শাসিত ও ব্রিটিশ বাহিনী শাসক। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে সেই বিভাজন বেড়েছে বৈ কমেনি। এরই মধ্যে তাঁদের কানে এসেছে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা। আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের লালকেল্লায় বিচার উপলক্ষে সারা ভারত যে রাস্তায় নেমে এসেছে দল-মত নির্বিশেষে, সেই সম্পর্কেও তাঁরা অবগত ছিলেন। রেটিং-দের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলের সেল সক্রিয় ছিল না, কিন্তু তাঁদের মধ্যে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিত ভাবে গড়ে উঠছিল একপ্রকার স্বতঃস্ফুর্ত রাজনৈতিক সচেতনতা। এই সচেতনতাই আর.কে সিং বা বলাই চন্দ্র দত্তের মতো নাবিকদের বিদ্রোহী করে তুলেছিল। খারাপ খাদ্য, বেতন বৈষম্য, ব্রিটিশ অফিসারদের বর্ণ বিদ্বেষী আচরণ এবং ডি-মোবিলাইজ করার দেরির মতো বিষয় নিয়ে যে ক্ষোভ পূর্ব থেকেই ছিল, তাই ক্রমশ ব্রিটিশ শাসনের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিরোধিতার একটি আকার ধারণ করল।
বলাই চন্দ্র দত্তকে গ্রেপ্তার করার পরেও অবস্থার উন্নতি হল না। নাবিকরা গোপনে প্রতিরোধ চালিয়েই যেতে লাগলেন। অবশেষে ১৯৪৬-এর খ্রিস্টাব্দের ১৭-ই ফেব্রুয়ারি রাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ধর্মঘট করার। গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহের অনুকরণে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল প্রাথমিক ভাবে খারাপ খাদ্যের বিরোধিতার মাধ্যমেই ধর্মঘট শুরু করা হবে। সেই পরিকল্পনা অনুসারেই ১৮-ই ফেব্রুয়ারি সকালে তলোয়ার জাহাজ জুড়ে মুখরিত হল, ‘না খাবার, না কাজ !’-এর স্লোগান, কিন্তু বেলা গড়াতেই দেখা গেল ভালো খাবারের প্রতিশ্রুতি দিয়েও এমনকি স্বয়ং রিয়ার অ্যাডমিরালও পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না, তাঁর আপোষের প্রস্তাবের জবাব মারমুখী রেটিংরা দিচ্ছে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ ধ্বনির মাধ্যমে। ১৮ তারিখ বেলা চারটের পর ‘তলোয়ার’ জাহাজ আর ব্রিটিশদের হাতে থাকল না। ব্রিটিশ অফিসাররা আগেই জাহাজ ত্যাগ করেছিলেন, এবার তাঁদের সঙ্গী হলেন অধিকাংশ ভারতীয় অফিসার। মূলতঃ শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণী থেকে আগত রেটিংরাই বিদ্রোহের মশাল হাতে তুলে, তলোয়ার জাহাজের দখল নিল। সেই রাতেই দাবি সমূহ সংবাদমাধ্যমের হাতে তুলে দিল তলোয়ারের নাবিকরা। তাতে যেমন ছিল উন্নত চাকরির ও খাদ্যের দাবি, তেমন ছিল আই.এন.এ-এর বন্দী সেনাদের মুক্তি, ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সেনার অপসারণ, ব্রিটিশদের ভারত পরিত্যাগ করার মতো রাজনৈতিক দাবিও।
১৯ তারিখ ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়ল ক্যাসেল ব্যারাক সহ বোম্বের তীরবর্তী ১১টি নৌ-প্রতিষ্ঠান এবং ২০ টি জাহাজে। গঠিত হল প্রায় ২০ হাজার রেটিং-এর প্রতিনিধিত্বকারী ছত্রিশ জনের কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি। সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন এম.এস খান ও সহ-সভাপতি মদন সিং। সমস্ত জাহাজ ও প্রতিষ্ঠান থেকে ইউনিয়ন জ্যাক টেনে নামিয়ে দেওয়া হল। তীরের লরিগুলিতে একত্রে বেঁধে দেওয়া হল জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা। Royal Indian Navy-এর নাম পাল্টে রাখা হল Indian National Navy। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল করাচি, মাদ্রাজ, বিশাখাপত্তনম ও কলকাতার নৌবাহিনী জাহাজেও, যদিও আংশিক ভাবে করাচিতে ছাড়া তা বোম্বের আকার ধারণ করেনি। বোম্বেতে সত্যিই সামগ্রিক ঘটনাবলি এক অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক সম্ভবনা তৈরি করেছিল। ১৯ তারিখ সন্ধ্যে যখন অস্তমিত হচ্ছে, জনৈক ব্রিটিশ অফিসার, পার্সি গর্জে লিখেছেন বোম্বে নিদ্রায় গেল বাতাসে বিপ্লব নিয়ে। অধ্যাপক গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলেছেন ‘Almost Revolution’, ‘প্রায় বিপ্লব’।
ঠিক এই সময়ে যদি নাবিকরা অস্ত্র হাতে প্রায় অরক্ষিত বোম্বে শহরের দখল নিতেন, যদি তাঁদের প্রতি তীব্র সহানুভূতি সম্পন্ন শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন শহর জুড়ে, হয়তো ভারতের ইতিহাসই পাল্টে যেত। দুর্ভাগ্য আমাদের, তা হয় নি। রেটিং-রা তাঁদের ধর্মঘট কুড়ি তারিখে জাহাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে, অন্যদিকে তাঁদের নেতারা সহায়তার আশায় কংগ্রেস ও লীগের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকে। তাঁদের আশা ছিল খুব সহজেই জাতীয় নেতাদের সমর্থন তাঁরা পাবেন, কিন্তু কোনো দলই এই সমর্থন দিতে রাজি ছিল না, এক কংগ্রেস-সোশ্যালিস্ট নেত্রী অরুণা আসফ আলি ব্যতীত কেউই তাঁদের পাশে দাঁড়াতে রাজি ছিল না।
ব্রিটিশরা এই সময়ের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে প্রস্তুত হয় প্রত্যাঘাত করার। তাও ২১ তারিখ যখন ধর্মঘটিদের ঘেরাও করতে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঠানো হয়, তারা গুলি তো চালায়ই নি, বরং অনেকে ধর্মঘটিদের সঙ্গে যোগদান করে। এর পর আরও বড় বাহিনী প্রেরণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বর্ষণ শুরু হয়। এরই মধ্যে ঐ গুলি বৃষ্টির মধ্যেও নাবিকদের সহায়তা করতে এগিয়ে আসে সাধারণ ভারতীয়। সন্ধ্যের পর অ্যাপলো বন্দরে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। নাবিকদের দেওয়ার জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন বোম্বে বাসী, কেউ নিয়ে এসেছেন ফলভর্তি টুকরি, কেউ বা মিষ্টি। ঐ গুলি বিনিময়ের মধ্যেই তা লঞ্চে করে জাহাজে প্রেরণ করা হল। এক প্যাকেট ছোলা দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হল বছর আঠেরোর এক শ্রমিক সন্তান। এই সময়েই বোম্বের শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর বারংবার সংঘাত লাগতে থাকে।
পরের দিন ২২ তারিখ যখন ধর্মঘটী নৌ-সেনারা কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির কাছে সাহায্যের আবেদন জানায় তখন এই তিন সংগঠনের মধ্যে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই সেই ডাকে সাড়া দেয়। বোম্বের রাস্তায় রাস্তায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ব্যারিকেড। শ্রমিকরা হামলা চালায় মিলিটারি লরির উপর। পুলিস ও মিলিটারির রাইফেল অবিরাম অগ্ন্যুদগার করতে থাকে। বোম্বের রাস্তা পিচ্ছিল হয় শ্রমিকদের রক্তে। পারেলে প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা কৃষ্ণ দেশাই (পরবর্তী কালে তিনি এখান থেকেই সিপিআই-এম এর বিধায়ক হয়েছিলেন, কংগ্রেস মদতপুষ্ট শিবসেনা দুষ্কৃতির হাতে নিহত হন) মেশিন-গান কেড়ে নিয়ে তার নল ঘুরিয়ে দেন ব্রিটিশ বাহিনীর দিকেই। বুলেশ্বর ও গিরগাঁও-এ শ্রমিকরা গড়ে তলে সুতীব্র প্রতিরোধ, বারংবার গুলি বর্ষণ করেও তাঁদের ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি এই পরিস্থিতিতে এই দিনও যদি নাবিকরা জাহাজ থেকে নেমে শ্রমিকদের সঙ্গে বিদ্রোহে যোগদান করতেন অস্ত্র হাতে পরিস্থতি অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু তা হয় নি। মেশিনগানের সামনে শেষ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীকে পিছিয়ে আসতে হয়। শুধু সরকারী হিসেবেই এইদিন মৃত্যু হয়েছিল প্রায় আড়াইশো জনের। অসংখ্য কমিউনিস্ট কর্মী সমর্থক আহত ও নিহত হন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পারেল মহিলা সঙ্ঘের কোষাধ্যক্ষ কমল ধোন্ধে। বুলেটবিদ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যুর সময় সঙ্গেই ছিলেন কুসুম রণদিভে ও অহল্যা রঙ্গনেকর। কুসুম রণদিভেও বুলেট বিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।
এদিকে একদিকে কংগ্রেস অন্যদিকে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে তাঁদের রাজনীতির সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানের ফলে মন ভেঙে গেছে। প্যাটেল তাঁদের ক্রমাগত বুঝিয়ে চলেছেন আত্মসমর্পণই শ্রেয় এবং তাঁদের যাতে শাস্তির ব্যবস্থা না হয় তা তিনি দেখবেন। একধাপ এগিয়ে প্যাটেল এও বলেন যে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগদান না করার কলঙ্ক মুছে ফেলতে কমিউনিস্ট পার্টিই নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে এই ঝামেলা লাগিয়েছে। তাঁর মাপের নেতার নিকট থেকে এইপ্রকার ভিত্তিহীন অভিযোগ সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। নাবিকরা কোনো রাজনৈতিক দলের অনুগামী ছিলেন না। এই আন্দোলন তাঁরা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই শুরু করেছিলেন, তাঁদের সহায়তার আহ্বানে কমিউনিস্ট পার্টি সাড়া দিয়েছিল মাত্র। সর্দার বল্লভভাই-এরপ পাশাপাশি পন্ডিত নেহেরুও ধর্মঘট উঠিয়ে নেওয়ার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে মহম্মদ আলি জিন্নাহও একই বক্তব্য রাখেন। মহাত্মা গান্ধী বলেন হিংসাত্মক উদ্দেশ্যে ব্যারিকেডে হিন্দু-মুসলমানের মিলনকে তিনি অশুভ মনে করেন। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় স্ট্রাইক কমিটি ২৩-শে ফেব্রুয়ারি নিঃশর্ত আত্ম-সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তারা একথা বলে দেয় এই আত্ম-সমর্পণ দেশের জনতার কাছে, তাঁদের নেতৃত্বের কথা মান্য করে, ব্রিটিশ শাসকদের কাছে নয়। শেষ বার্তায় সেন্ট্রাল স্ট্রাইক কমিটি বলে – ‘Our strike has been a historic event in the life of our nation. For the first time the blood of men in services and men in streets flowed together in a common cause.’
নৌ-বিদ্রোহ বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো ঘটনা ছিল। মহাত্মা গান্ধী হিংসাত্মক কাজে ব্যারিকেডে হিন্দু-মুসলিমের মিলন অপবিত্র মনে করেছিলেন, একথা জানা নেই ভবিষ্যতে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের ফলে কোন গরল পান করতে দেশবাসী বাধ্য হবে তা জানলে তিনি একই কথা বলতেন কিনা। কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট ও কমিউনিস্টদের তরফ থেকে সমর্থন ছাড়া নৌ-বিদ্রোহ-এর সময় শ্রমিক ও নাবিকরা প্রধান জাতীয় নেতৃত্বের থেকে কোনো প্রকার সহায়তা বা সমর্থন তো লাভ করেই নেই বরং জাতীয় নেতৃত্ব যতরকম ভাবে সম্ভব তাঁদের তিরস্কার করেছিল। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহ ছিল ঐক্যবদ্ধ অ-সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী শেষ স্ফুলিঙ্গ গুলির অন্যতম। রজনী পাম দত্ত লিখেছেন – “The naval rising in February, 1946, the mass movement of support within India and the heroic stand of the Bombay working people constituted the signal of the new era opening in India and one of the great landmarks of Indian history.” সোমনাথ লাহিড়ী ‘স্বাধীনতা’-য় ২৪-শে ফেব্রুয়ারি ‘ভুলিব না’ শীর্ষক শিরোনামে যা লিখেছেন, তার একাংশও স্মরণ করা যেতে পারে –
“বোম্বাই শহরে প্রথমদিন এক লক্ষ, দ্বিতীয় দিন তিন লক্ষ মজুর ধর্মঘট করিয়া লাল ঝান্ডা লইয়া বাহির হইয়াছে। মৃত্যুপথযাত্রী নাবিক ভাইদের ম্লান হতাশার সম্মুখে তাহারা আশার গর্জন তুলিয়াছে – আমরা তোমাদের ভুলি নাই, ভুলিতে পারিনা, তোমাদের সংগ্রাম যে আমাদেরই সংগ্রাম।…সাম্রাজ্যবাদের প্রতিটি আঘাত প্রতিঘাত করিবার জন্য আমরা আছি, ভারতবাসীর মেরুদন্ডকে আমরা বাঁকিতে দেব না।“
আজ ১৮-ই ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক নৌ বিদ্রোহের ৭৯ বছর সম্পূর্ণ হবে। ভারতের কমিউনিস্ট কর্মীরা সেই গৌরবময় সংগ্রামের ঐতিহ্যকে আজও একই ভাবে স্মরণ করেন– ‘তোমাদের ভুলি নাই, ভুলিতে পারিনা, তোমাদের সংগ্রাম যে আমাদেরই সংগ্রাম।’