ময়ূখ বিশ্বাস
১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকস। ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র বক্সিংয়ে স্বর্ণ জিতেছিলেন। গোটা আমেরিকার হিরো তিনি। আবার ঠিক সেই সময় তার নিজের শহর লুইসভিল, কেন্টাকি এলাকা জর্জরিত বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিসংঘাতে। এমনই এক সময় ক্যাসিয়াস একদিন একটি রেস্তোরাঁয় খেতে যাচ্ছিলেন। এই রেস্তোরাঁর মালিক ছিলেন শ্বেতাঙ্গ। ক্যাসিয়াস ক্লে’র কালো রঙটার জন্য সেদিন সাদা চামড়ার সেই মালিক তাঁকে খাবার দিতে অস্বীকার করেন এবং তাড়িয়ে দেন রেস্তোরাঁ থেকে। ক্ষোভে, দুঃখে, যন্ত্রণায়, দেশের জন্যে ঘুষি-রক্তাক্ত হওয়া ক্লে রেস্তোরাঁ ছেড়ে ওহাইও নদীর ব্রিজে ওপর গিয়ে তাঁর অলিম্পিকসের সোনার মেডেলটি নদীতে ফেলে দেন।
“এই কি ওদের বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও?“
গত পরশু রাতেও ভারতীয় কুস্তিগিরদের জন্য সেই ক্লে’র মুহূর্ত ছিল। মোদি সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ এর বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। কিন্তু সেই দেশের চ্যাম্পিয়ন বেটিদেরই সম্মানহানি করছে মোদির পার্টির লোকেরাই। তারপর পেটাচ্ছে পুলিশ দিয়েই। ইজ্জত লুঠ করবে বিজেপি-আরএসএস। আর তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই পুলিশ বা আরএসএসের গুন্ডা দিয়ে মার! কাঠুয়া- হাথরস- বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহিলা কুস্তিগিরদের সাথে সেই আরএসএসের কপিবুক বর্বর মনুবাদী ট্রাডিশন সমানে চলছে।
ঘটনা হলো, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া বা ভিনেশ ফোগতের মতো অলিম্পিকস, কমনওয়েলথ ও এশিয়ান গেমসে মেডেল জয়ী কুস্তিগিররা ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান তথা বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার অন্যতম অপরাধী বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগে ধর্না চালাচ্ছেন রাজধানী দিল্লির যন্তর মন্তরে। প্রায় ১৪ দিন ধরে চলছে এই লড়াই। হঠাৎ গত বুধবার গভীর রাতে এই ধর্নার ১১ দিনের মাথায় কুস্তিগিরদের ওপরে লাঠি চালাতে আসে অমিত শাহের দপ্তরের অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশ। আক্রান্ত হল অনেকে। মহিলা কুস্তিগিরদের ওপর মদ্যপ অবস্থায় হামলা করে পুরুষ পুলিশ। তিরঙ্গার শান তুলে ধরা মেডেল জয়ী কুস্তিগিরদের প্রতি সরকারের এই আচরণে ভেঙ্গে পড়েন দেশের জন্যে রক্ত, ঘাম, হাড় ভাঙ্গা শ্রম দেওয়া এই কুস্তিগির ও তাঁদের আত্মীয় পরিজনরা। চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগির ভিনেশ ফোগত, সাক্ষী মালিকরা কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, “এই ব্যবহার পাওয়ার জন্যই কি দেশের জন্য পদক নিয়ে এসেছিলাম?“ এদিকে কয়েক মাস আগেও কুস্তিগিররা বিজেপি নেতা সিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে ধর্নায় বসেছিলেন যখন, সরকার সেই সময়ে তাদের আশ্বস্ত করেছিল যে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কোনও শাস্তি না হওয়ায় ফেডারেশন প্রধানের পদত্যাগ এবং গ্রেপ্তারির দাবিতে আবার ধর্নায় বসেছেন কুস্তিগিররা।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলেছে সাত কুস্তিগিরকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ নিয়ে পুলিশকে এফআইআর করার। কোর্ট বলেছে, ওই কুস্তিগিরদের নিরাপত্তার নির্দেশ আগেই দিয়েছিল। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এফআইআর দায়ের হয়েছে কুস্তি ফেডারেশনের প্রধানের বিরুদ্ধে। কিন্তু এও বলেছে কোর্ট, ওই তদন্তের ওপরে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিরও দরকার নেই বলেই মনে করেছে শীর্ষ আদালত। এরপরেই কুস্তিগিররা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, এটা তাদের পরাজয় নয়। তবে তারা ধর্না চালিয়েই যাবেন। ক্ষোভ রাগ যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়ে চ্যাম্পিয়নরা মেডেল ফেরত দেওয়ার কথাও বলছেন। যা আমাদের গোটা দেশের কাছেই কষ্টের হবে। অলিম্পিকস পদক জয়ী বক্সার মেরি কমের নেতৃত্বে একটি তদন্তকারী কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে গতমাসে। কিন্তু তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় নি। ওই তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কুস্তিগিররা।
চ্যাম্পিয়নদের পাশে ছাত্র যুব মহিলারা
যন্তর মন্তরে কুস্তিগিরদের প্রতিবাদ স্থলে ভোরবেলায় গেলে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যাবে। দেশের সেরা চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগিররা রাস্তাকেই প্র্যাকটিস প্যাড বানিয়ে কসরত করছে। রোজ বিজেপি সরকারের অপমান, মানসিক- শারিরীক অত্যাচার চলছে ওনাদের ওপর। তবু ধন্য ওদের অধ্যাবসায়। হয়তো এই জন্যেই ওনাদের নিয়ে ‘দঙ্গল’ বা ‘সুলতান’ রিল লাইফে সুপারহিট।
পাঠকের হয়তো স্মরণে থাকবে, ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক্সে সুশীল কুমার ব্রোঞ্জ জেতার পর থেকেই ভারতে কুস্তিগিররা সম্মান পেতে শুরু করেন। এরপর টানা ২০১২ লন্ডন-রিও- অলিম্পিকস, এশিয়াড, কমনওয়েলথ গেমস, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, প্রতিটা প্রতিযোগিতাতেই ভারতের কুস্তিগিররা যথেষ্ট ভাল পারফর্ম করতে থাকেন, পদকও আসতে থাকে। এই সময়ে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হলো, মহিলা কুস্তিগিরদের অভূতপূর্ব সাফল্য। তীব্র রক্ষণশীল হরিয়ানা বা উত্তর ভারতের জাঠ সমাজ থেকে লড়াই করে উঠে আসা এই মহিলা কুস্তিগিরদের সাফল্য গোটা দুনিয়ার কাছে শিক্ষণীয় ছিল। কিন্তু তাদের প্রতিই দেশ দেখলো তীব্র বঞ্চনা, অপমানের কিসসা! দেশের গর্ব, চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের যৌন হেনস্থা করলো বিজেপির সাংসদ। মুখ বুজে এখনো তথাকথিত সেলিব্রিটিরা। স্পোর্টস স্টাররা। দেশের অলিম্পিকস কমিটির প্রধান তথা সদ্য বিজেপির সাথে দহরমমহরম করা পি.টি. ঊষাও বিজেপি নেতাদের সুরে সুর মিলিয়ে বললেন,’দেশের মুখ কালো করছে এই কুস্তিগির দের প্রতিবাদ।’ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে কুস্তি সমাজ। পরে প্রতিবাদ স্থলে আসতে বাধ্য হয় পি.টি. ঊষা।
এখন ‘দেশ কি বেটি’দের পাশে, এই কুস্তিগিরদের প্রতিবাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে সংযুক্ত কৃষক আন্দোলনের নেতারা, হরিয়ানার পঞ্চায়েত গুলো, সিপিআইএম-কংগ্রেস-আপ সহ সব বিরোধী দল। ছাত্র সংগঠনগুলো পাহারা দিচ্ছে। এমন কি সেদিন রাতে পুলিশের আক্রমণের মুখে এসএফআই সহ ছাত্র সংগঠনগুলো পাশে ছিলো। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে ছাত্ররা আক্রান্তও হয়েছে অমিত শাহের পোষা দিল্লি পুলিশের হাতে। তবু লড়াই চলছে। সংহতি জানিয়ে এসেছেন ওদের পাশে SFI-DYFI-AIDWA-CITU-AIKS-AIAWU নেতৃত্বরা। প্রতিদিন হরিয়ানার গ্রাম থেকে আসছেন মানুষ। ভীড় বাড়ছে। রাগ বাড়ছে। একটা সময় এই কুস্তিগিররাও ভেবেছিলেন, লড়াইটা একার। মোদির সাথে ছবি তুলে অনেকে ভেবেছিলেন, উনিই মসীহা। উনি সমাধান করবেন। অরাজনৈতিক হবে সরকারের এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রে আরএসএস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। এমনকি গত জানুয়ারী মাসে প্রতিবাদের সময়েও ওরা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে কাছে আসতে দেয়নি। কিন্তু এখন লড়াকু পালোয়ানরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় শিখেছেন লড়াই জিততে গেলে, একসাথে লড়তে হবে। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা, আরএসএসের নয়নের মণি তথা ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান এবং বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিং সম্মানহানি করেছে আমার আপনার দেশের মেয়েদের। এ অপমান আমাদের সবার। আর ওই ব্রিজভূষণরা আসলে আরএসএসের অসভ্য সমাজেরই অঙ্গ। তাই এই নরাধমদের বিরুদ্ধে এককাট্টা হওয়া আমাদের কর্তব্য। কুস্তিগিররাও নিজেদের কেরিয়ারকে বাজি রেখে এখন বৃহত্তর লড়াইয়ের সাথী। কুস্তির প্যাঁচের মতোই শক্ত হাতে এই জনবিরোধী আরএসএস-বিজেপির দমবন্ধ করে ভবলীলা সাঙ্গ করতেই হবে। নাহলে তিরঙ্গার অপমান। এই দেশের বিপদ অবশ্যম্ভাবী।