Moholanobish Cover 2024

The Man, The Plan: The History

প্রাককথন

বিগত এক দশক যাবত দেশের কেন্দ্রীয় সরকার ‘নয়া ভারত’ শিরোনামে নিজেদের আর্থ-রাজনৈতিক পরিকল্পনা হিসাবে গ্রহণ ও কার্যকরী করে চলেছে। এহেন পরিকল্পনা শুনতে যতটা ভালো লাগে, উপলব্ধিতে তার ঠিক উল্টোটাই ঘটে। এমন নয় যে এর আগেকার বন্দোবস্তগুলি একেবারে ‘স্বর্গ হতে বিদায়’ নিয়ে মাটিতে নেমে এসেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালের ধারাবাহিক লুটের ধাক্কায় স্বাধীনতার পরে বেশ কিছু যোগ্যতা থাকা সত্বেও আমরা অনেকটা পিছিয়ে থেকেই শুরু করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তৎকালীন দুনিয়ার বাস্তবতা অনুসারে আমাদের দেশ নতুন করে প্রবল শক্তিধর রাষ্ট্রব্যবস্থার ধামাধরা হতে চায়নি। তখনও নিজেদের দেশ ও দুনিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ উপলব্ধি আমাদের দেশে রাজনীতির অন্যতম উপাদান ছিল, আজকের মতো সবকিছুকেই নতুন করে গড়ে তোলার নামে সার্বিক ধ্বংস বা অবনমনের পর্যায় শুরু হয়নি। তাই জোটনিরপেক্ষতা কেবলই আমাদের বিদেশনীতি ছিল না, দুনিয়ার দরবারে ভারতীয় নাগরিকদের গর্ব করার জন্যও অন্যতম বিষয় ছিল। এখন আমরা সেসব ঐতিহ্য হারিয়েছি, অন্য দেশে যারা আক্রমণ করে তাদের সাথে হাসিমুখে হাতে মেলাতে আমাদের তিলমাত্র অস্বাচ্ছন্দ্য নেই। নতুন প্রজন্মকে শেখানোর চেষ্টা চলছে- এছাড়া নাকি আর বিকল্প কিছু নেই।

তাই স্বাধীন ভারতের প্রথম আর্থিক পরিকল্পনা প্রসঙ্গে রাজ্য ওয়েবডেস্ক নিজস্ব প্রতিবেদন প্রকাশের পরিকল্পনা নেয়। সেই উদ্দেশ্যেই আমরা অধ্যাপক ইন্দ্রনীল দাশগুপ্তের সাথে আলোচনা করি। অধ্যাপক দাশগুপ্ত ব্যখ্যা করেন তৎকালীন ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি, দেশের সরকারের চ্যালেঞ্জসমূহ। সেইসকল চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করার লক্ষ্যেই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ’কে বিশেষ দায়িত্ব দেন দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। আজ অর্থনীতিবিদ বলতে আমরা যেমনটি ধরে নিই, প্রশান্তচন্দ্র ঠিক তেমনটি ছিলেন না। গণিত ও পদার্থবিদ্যার এই কৃতি শিক্ষার্থী হঠাৎ কেন ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনায়’ যুক্ত হলেন, কিভাবেই বা সেই দায়িত্ব সামলালেন- আমরা সেই নিয়েই আলোচনা করি।

অধ্যাপক দাশগুপ্ত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্কিক্যাল ইন্সটিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক হিসাবে কর্মরত। আইএসআই’র নির্মাণও হয়েছিল সেই দেশ গঠনের পরিকল্পনা অনুসারেই। গতকাল ২৯শে জুন, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের জন্মদিবস ছিল। আজ রবিবার, অধ্যাপক দাশগুপ্তের সেই সাক্ষাৎকারই কিছুটা সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনের আকারে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হল।

ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

ওয়েবডেস্কঃ

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও তাঁর কাজকে কীভাবে, কোন দৃষ্টিতে বিচার-বিবেচনা করা উচিত হবে?

অধ্যাপক দাশগুপ্তঃ

আমি বরং আরও একটু পিছিয়ে শুরু করতে চাইব। প্রথমেই মনে রাখতে হবে প্রশান্তচন্দ্র’রা ঠিক কোন প্রজন্মের ভারতীয়। আমাদের দেশের ইতিহাসে যে পর্বের ঘটনাবলীকে বেঙ্গল রেনেসাঁ বলা হয়, উনি ছিলেন সেই উত্তরাধিকারের অন্যতম একজন। পদার্থবিদ্যা থেকে রাশিবিজ্ঞানের দিকে এগিয়েছিলেন তিনি। দুটি বিষয়ই নিবিড়ভাবে ধাপে ধাপে সত্যে পৌঁছানোর বিজ্ঞান। ‘পরিকল্পনা’ নির্ভর কর্মকাণ্ডের প্রতি তার একনিষ্ঠ অবস্থান সম্ভবত সেই কারণেই। ভারতে রাশিবিজ্ঞান চর্চার প্রাণপ্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তাঁকে যেভাবে তুলে ধরা হয় আমি সেই মতামতের সাথে সবটা একমত নই। কারণ তিনি শুধুই রাশিবিজ্ঞান চর্চা করেননি। রাশিবিজ্ঞান এমনকি বলা চলে প্রায় পদার্থবিদ্যার কায়দায় দেশের প্রথম অর্থনৈতিক কর্মসূচিকে সাজিয়েছিলেন। তার পরিকল্পনা প্রসুত মডেলটি আজ ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়। মহলানবিশের সময় থেকে আজকের দিনে অর্থশাস্ত্রের চেহারাটিতে অনেককিছু বদলে গেছে ঠিকই তবু ঐ মডেলের জন্যই আমরা উপলব্ধি করতে পারি আমাদের দেশে অর্থনৈতিক বাস্তবতা কখন, কিভাবে বাঁক-মোড় নিয়েছে। জোট নিরপেক্ষতার নীতি শুধুই রাজনৈতিক কৌশল ছিল বললে কিছুটা কম বলা হয়, শক্তিধর রাষ্ট্র যেকোনো সময় নিজের মর্জিমাফিক আমাদের ঘাড়ে চেপে বসবে- এহেন দুশ্চিন্তা একেবারে অমুলক ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথেই স্পষ্ট হয়ে যায়, ঔপনিবেশিক শাসন আর চলবে না, স্বাধীনতা আসতে চলেছে। তাই দেশ নির্মাণে অন্যের ভরসায় না থেকে নিজেদের রসদ (রিসোর্স), ক্ষমতা (ইন্টেলিজেন্সিয়া) ইত্যাদিকেই কাজে লাগাতে হত, নেহরু সেই উদ্দেশ্যেই মহলানবিশ’দের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন।  

ওয়েবডেস্কঃ

তৎকালীন আর্থিক পরিকল্পনা পরে যাকে প্ল্যানিং কমিশন বলা হত তাকে ‘জোট নিরপেক্ষ’তার রাজনৈতিক অর্থনীতি বলা যায় কি? মহলানবিশের ভূমিকাকে Sampling as a political choice- বললেই কি সঠিক বিবেচনা করা হবে?

অধ্যাপক দাশগুপ্তঃ

স্বাধীনতার পরে আমাদের দেশে গোটা তিনেক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রস্তাব ছিল। প্রথমটি সরাসরি পুঁজিবাদী নিয়ম-বিধি মোতাবেক পরিকল্পনা, যাকে আমরা বোম্বে প্ল্যান বলে জানি। এম এন রায়’রা সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধির’ও বেশ কিছ ভাবনাচিন্তা ছিল। নেহরু সরকারের প্ল্যানিং কমিশন এগুলির কোনোটার পথেই চলেনি। মহলাবিশ’রা যা করতে চেয়েছিলেন তাকে অনেকটাই ইনপুট আউটপুট মডেল হতে অনুপ্রাণিত পরিকল্পনা বলা যায়। ওয়েসলি লিয়েন্তিয়েফ এহেন মডেলের প্রধান পরিকল্পনাকার। ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুবাদে প্ল্যানড ইকোনমির বিষয়টি অনেকটাই প্রচার পেয়েছে। একদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদকে গিলে খেতে আসা বৃহৎ পুঁজির যথেচ্ছ অনুপ্রবেশকে আটকাতে হত, যাতে দেশীয় বাজার প্রসারিত হয়, জনজীবনের মান বিকশিত হয়; আরেকদিকে দেশজুড়ে বিভিন্ন প্রদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অধীনে আনাও ছিল লক্ষ্য। এই পরিস্থিতিতেই মহলাবিশ’দের কাজ করতে হয়েছিল। এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে- দেশের নিজস্ব সম্পদ ইত্যাদির যা তথ্য হাতে ছিল সেসবকিছুকে কেন্দ্রীভূত করে পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া। এই কাজ আসলে অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির দিশা খোঁজার কাজে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে প্রাপ্ত তত্থ্যের উপরে রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ। স্যামপ্লিং-র বিষয়ে যে গুরুত্ব তিনি দেন তার কারণ ওটাই। পলিটিক্যাল চয়েস বলে যা বলা হচ্ছে আসলে ঐ অবস্থান মহলানবিশ’দের অর্থনীতি প্রসঙ্গে মূল অবস্থান। তারা চেয়েছিলেন আমাদের মতো এক বিশাল দেশের যাবতীয় আর্থিক বাস্তবতাকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে। তাদের পরিকল্পনার সবটা সফল হয়েছিল একথা বলা চলে না, তবে চিহ্নিত করা গিয়েছিল দেশের উন্নয়নকল্পে অগ্রাধিকার হিসাবে কোন কোন বিষয়কে চিহ্নিত করতে হয়।   

ওয়েবডেস্কঃ

মহলানবিশ পরিকল্পনায় সমস্যা কি ছিল?

অধ্যাপক দাশগুপ্তঃ

মূল সমস্যা কেন্দ্রীভূত আর্থিক প্ল্যানকে কার্যকরি করে তোলায়। যেকোনো পরিকল্পনাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার বিষয়টিই সাফল্যের আসল কথা। সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা করেই থেমে থাকেনি, তাকে সফল করে তুলতে সক্রিয় গণউদ্যোগকেও কার্যকরী করতে পেরেছিল। এহেন উদ্যোগ যে রাজনৈতিক কাঠামোর সুবাদে সম্ভব হয়েছিল আমাদের দেশে তেমন বাস্তবতা ছিল না। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও থাকে, তাকে সফল করে তুলতে পুঁজিবাদের নিজস্ব অর্ডার’ও থাকে। মহলানবিশ প্রকৃত অর্থে স্টেটসম্যান ছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে সফল করতে যেরকম সর্বব্যাপী প্রশাসনিক দৃঢ়তার প্রয়োজন হয় তখন সেই পরিস্থিতি ছিল না।

ইনপুট-আউটপুট মডেলের সাফল্য নির্ভর করে দুটি বিষয়ের উপরে। প্রথমটি জাতীয়স্তরে চাহিদার ক্রমপরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার উপরে। দ্বিতীয় যাবতীয় সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের জন্য গোটা উৎপাদন প্রক্রিয়াকেই কেন্দ্রীয় নজরদারির আওয়তায় নিয়ে আসা। প্রথম কাজে বিপুল পরিমাণ তথ্যকে বিচার-বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা করতে হয়। দ্বিতীয়টি মূলত রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রসঙ্গ, দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদের যাই পরিকল্পনা থাকুক না কেন, কাজটা করতে শাসকের স্বদিচ্ছাই শেষ কথা। প্রশান্ত চন্দ্রের পরিকল্পনার সুবাদেই দেশজুড়ে যে বিপুল তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল তা অ্যানালাইজ করার জন্য কম্পিউটার এসেছিল আমাদের দেশে, আইএসআই’তেই। প্রথম পর্যায়ের কাজটি সম্পন্ন করতেই কম্পিউটার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আজকের আলোচনায় দ্বিতীয় বিষয়টিকে নিয়ে আসার সুযোগ নেই, তবে এটুকু বলাই যায় তৎকালীন পরিস্থিতিতে তেমন কিছু হওয়া সম্ভব ছিল না।   

ওয়েবডেস্কঃ

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী সময় থেকেই তো ঐ মডেল কার্যকরী হয়। ঐ সময় মহলানবিশ’রা কিভাবে এগিয়ে ছিলেন?  

অধ্যাপক দাশগুপ্তঃ

আইএসআই গড়ে তোলাই ছিল তার প্রথম কাজ। সেই কাজের পাশাপাশি তিনি মনোযোগ দেন বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে দেশ নির্মাণের পরিকল্পনায় কাজে লাগানোর। এজন্য তিনি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। ভারতকে মজবুত আর্থিক অবস্থায় নিয়ে যেতে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন, বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গকে টেনে আনতে চেয়েছেন এদেশে। এমন কাজের উদ্দেশ্য ছিল মেধাবৃত্তির যাবতীয় সম্ভাবনাকে ব্যবহার করার। আমরা মনে রাখতে পারি তিনি নিজে ছিলেন পদার্থবিদ্যার বিশিষ্ট ছাত্র। পদার্থবিদ্যার গবেষণায় যেমন কায়দায় বিভিন্ন শাখা থেকে বিশিষ্টদের একজায়গায় এনে কাজে এগোনো হয় তিনি খানিকটা তেমনই পন্থা নিয়েছিলেন বলে মনে করা যেতে পারে।

এই পদ্ধতিতে সকলেই সহমত ছিলেন না। দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বি মনে করতেন বিদেশ থেকে বুদ্ধিজীবীরা এলেই আমাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন না, কারণ তাদেরর অনেকেই ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনও সম্যক ধারণা ছিল না। জে বি এস হ্যাল্ডেন তখন আইএসআই’তে বিশেষ দায়িত্বে নিযুক্ত- এমন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিটির দেশে বিদেশে দৌড়ে বেড়ানোকে তিনিও কিছুটা অপছন্দই করেছিলেন। তবু মহলানবিশ সে কাজে ব্যস্ত থেকেছেন কারন তিনি জানতেন জোটনিরপেক্ষ নীতির কারণেই দুই প্রতিপক্ষই চাইবে না ভারতের মতো এক বিরাট দেশ কোনও একদিকের প্রভাবে বিশেষভাবে প্রভাবিত হোক, তাই বিভিন্ন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা তার আমন্ত্রণ স্বীকার করে এদেশে এসেওছিলেন। দেশ গড়ার কাজে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ব্যবহার করে এমন কর্মসূচিকে একধরণের ‘সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্ট’ হিসাবেই বিবেচনা করা উচিত। দেশের উন্নয়নে এমন পদ্ধতির প্রয়োগ আগে কখনও কোথাও হয়নি। এই কারণেই মহলানবিশের ঐতিহাসিক ভুমিকা আজও মনে রাখতে হয়।

ওয়েবডেস্কঃ

জওহরলাল নেহরু প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ ও তার মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর এমন সিদ্ধান্তের কারণ কী?

অধ্যাপক দাশগুপ্তঃ

সম্ভবত জওহরলাল নেহরুর প্রাথমিক ভাবনা ছিল এগোনোর পথে বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ। তার আধুনিকমনস্কতাই তাকে যাবতীয় সম্ভাবনাকে চিনে নিতে, এক্সপ্লোর করতে সাহস যুগিয়েছিল। তাই শুধু তত্ত্ব (থিওরি) না তিনি চেয়েছিলেন দ্রুত কিছু ফলাফলও উঠে আসুক যাতে উন্নয়নের পথে যা কিছু ঘটবে তাকে মূল্যায়ন করা যাবে, প্রয়োজনে জরুরী সংশোধন করতে দেরি হবে না। সদ্য স্বাধীন দেশের উন্নতির পথ সুনিশ্চিত করতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে অন্যতম ভূমিকা পালন করবে এই নিয়ে নেহরুর কোনও সংশয় ছিল না, আরেকদিকে মহলানবিশের পদ্ধতিটি পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় তার বাড়তি ভরসা তৈরি হয়েছিল। একথাও মনে রাখতে হবে মহলানবিশ’দের মতো ব্যক্তিবর্গের সাথে জওহরলাল নেহরুর পরিচিতি আকস্মিক ছিল না। তার নিজস্ব রাজনৈতিক সঞ্চারপথে তিনি প্রায় সবসময়েই সমসাময়িক মেধাবৃত্তিকারদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের কারনেও এহেন নৈকট্য তৈরি হওয়া ছিল একরকম স্বাভাবিক। আমি খানিকটা এভাবে দেখি- ‘হি নিডেড নাম্বার্স, অ্যাটলিস্ট সামথিং… নো ওয়ান এলস প্রমিসড সাচ নাম্বার্স এক্সেপ্ট মহলানবিশ’। তাই প্রশান্তচন্দ্রের প্রতি তার বাড়তি মনোযোগে খুব একটা আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

ওয়েবডেস্কঃ

আজকের দিনে যদি পিছন ঘুরে তাকাতে হয় তাহলে তৎকালীন অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে কিভাবে বিচার করা উচিত? মহলাবিশ’কে অর্থনীতি শাস্ত্রের প্রেক্ষিতেই বা কিভাবে মনে রাখব আমরা?

অধ্যাপক দাশগুপ্তঃ

দ্বিতীয় প্রসঙ্গের উত্তরটি আমি আগেই দিতে চাইব। প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। দেশ গঠনের জন্য জরুরী আর্থিক পরিকল্পনায় পরিসংখ্যান বিজ্ঞান এক বিশেষ ভূমিকা পালন করবে এই ছিল তার ভাবনার মূল বিষয়। আজকের অর্থশাস্ত্র অনেকটাই ‘ইকোনোমেট্রিক্স’ নির্ভর। বিভিন্ন ম্যাথামেটিক্যাল মডেল তার অন্যতম প্রসঙ্গ। সেই সময়কার বাস্তব পরিস্থিতিতে আদৌ তেমন কিছু ছিল না। পাঠক যেন মনে রাখেন যে ডায়নামিক মডেলের সুবাদে ইয়ান টিনবার্গেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান সেসবই গত শতাব্দীর ৬০’র দশকের একেবারে শেষ পর্যায়ের ঘটনা। তাই মহলানবিশ মডেল কার্যত এমন এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা যা ভারতীয় বাস্তবতায় এক নতুন যুগের সুচনা করেছিল। একথা ঠিকই যে কৃষি অর্থনীতির জরুরী বিষয়টি তার পরিকল্পনায় বেশ কিছুটা উপেক্ষিত থেকেছে, বহির্বানিজ্যের বিষয়ে আমদানি সংক্রান্ত নীতি প্রসঙ্গে তার অনড় মনোভাব আজকের পরিস্থতিতে কল্পনা করা কিছুটা শক্তই। তবু তার মডেল আমাদের জানতে হয়, কারণ দেশ গঠনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি বিজ্ঞানসম্মত আচরণের যে বীজ তিনি সেদিন বপন করে গেছেন আজকের পরিস্থিতিকে পর্যালোচনা করতে বসেও আমরা অন্তত কিছু ক্ষেত্রে সেসবের উদাহরণ টেনে আনতে বাধ্য।

প্ল্যানিং কমিশন থাকা সত্বেও জরুরী অনেক কিছু করা যায়নি একথা ঠিক, কিন্তু দেশের সরকারকে সেসবের জন্য বারংবার বহুবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই সরকার নিজেদের কর্তব্য করছে বলে ব্যখ্যা দেওয়া হত, আবার সেইসকল তথ্যের জোরেই সরকারের সমালোচনা করারও সুযোগ ছিল। এই যে তথ্যনিষ্ঠ, বস্তুনিষ্ঠ রাজনীতির চর্চা- একটা দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের দেশের জনজীবনে তার বিপুল প্রভাব ছিল। আজকের ভারতে সংবিধান স্বীকৃত ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানগুলি, তাদের কার্যকারীতা অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়ছে। এর প্রভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক উভয় পরিমণ্ডলেই বস্তুনিষ্ঠ সত্যকে এড়িয়ে গিয়ে মনগড়া ভাবনাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আপনাদের প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় ঐ পরিকল্পনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই যে দেশ পরিচালনার কাজে বিজ্ঞানসম্মত একনিষ্ঠতা তখনই প্রাধান্য পেয়েছিল, সেই মনোভাব আজকের বাস্তবতায় আরও অনেকদূর বিস্তৃত হতে হবে। প্রতিদিন সেই প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে।  

Spread the word

Leave a Reply