সৌতক সরকার
আফ্রিকার সবচেয়ে নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকার মূল ফটকে মোটা হরফে লেখা রয়েছে, ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই, বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। ছোটোবেলায় বাড়ির বড়দের থেকে শুনেছিলাম ৭২’র ব্যাচের কথা। বছরের শুরুর থেকেই রাজ্যজুড়ে শুরু হয় আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস। তারপরেই ঐতিহাসিক বিধানসভা নির্বাচন।১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শাসক পার্টির বিজয়, সন্ত্রাস ও কারচুপির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনার প্রভাব ছিল সমাজের প্রত্যেক স্তরে। কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত মূলত এই সময় থেকেই। এই বিষয়ে বিদগ্ধ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অমল কুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন : ‘সারা রাজ্যে যে সন্ত্রাস আর বিশৃঙ্খলা নিয়ে এসেছিল নকশালপন্থীরা, কংগ্রেসি শাসনকালে তা চলতেই থাকে। পাড়ায় পাড়ায় কংগ্রেস যুব বাহিনীর ঔদ্ধত্যে ও দাপটে সাধারণ মানুষের হয়রানি হতে থাকে আর শিক্ষাক্ষেত্রে নকশালদের ‘মহাজনপন্থা’ অনুসরণ করে আমদানি করা হয় চরম অরাজকতা। বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থায় অবিশ্বাসী নকশালরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পবিত্রতা নষ্ট করেছিল। বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থায় আস্থাশীল হয়েও কিন্তু কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বার্থে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কর্তৃপক্ষের ওপর অশালীন ভাবে ভয় দেখিয়ে ছড়ি ঘোরাতে থাকে। একই সঙ্গে ছাত্রমহলে সুলভে সমর্থন ও জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য পরীক্ষা ব্যবস্থার সমস্ত পবিত্রতা ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে চালু করা হয় গণ টোকাটুকি। এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কংগ্রেসি ছাত্র সংগঠন দ্রুত দখল নিতে সক্ষম হয় বটে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই প্রহসনে পরিণত হয় (বাঙালি রাজনীতির পঞ্চাশ বছর)।’

এরপর কেটে গিয়েছে বহুদিন, প্রায় পাঁচ দশক। তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের আমলের এই ক্ষত মুছে গিয়েছে বেশ খানিকটা। এর ঠিক মধ্যভাগের একটা বড় সময় ধরে বাংলার প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলেছে বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষানীতি: অবৈতনিক শিক্ষা, প্রত্যন্ত গ্রামে প্রাইমারী, আপার-প্রাইমারী স্কুল নির্মান, মিড-ডে-মিল, আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা ছাত্রদের জন্য স্কলারশিপ, ফার্স্ট জেনারেশন ছাত্রদের জন্য আরেকটু বাড়তি মনোযোগ এই ক্ষতকে ঢেকে দিয়েছিল বেশ খানিকটা। কিন্তু আজ ছাত্রসমাজ যে চূড়ান্ত অব্যবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে তা আরও ভয়ানক। শুধুমাত্র একটা বা দুটো ব্যাচ নয় একটা গোটা প্রজন্মকে শিক্ষা বিমুখ করে তুলছে। এমনিতেই কোভিড পরবর্তী সময়ে স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েছে বেশ খানিকটা। এমতাবস্থায় উচ্চশিক্ষার এই দশা থাকলে যে গুটিকয়েক ছাত্রছাত্রী স্কুলের গন্ডি পেড়িয়ে কলেজ অবধি আসার সাহস দেখাচ্ছে তাদের সংখ্যাও গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশে।
এমনিতেই আমাদের রাজ্যের সরকারী স্কুল ব্যবস্থার উপর থেকে ছাত্র-অভিভাবকদের বিশ্বাস হারাতে শুরু করেছে। বেসরকারী (মূলত ইংরেজি মাধ্যমের) স্কুলগুলোতে যাওয়ার প্রবণতা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। সরকারী স্কুলগুলোতে পড়লেও প্রাইভেট কোচিং কিংবা অনলাইন টিউশনে পড়া ছাত্রের সংখ্যা বাড়ছে লাগাতার। শ্রেণিকক্ষের চেয়ে কোচিং করতে শিক্ষার্থীদের বেশি উৎসাহিত করা হয়। আগে কোচিং সেন্টার ছিল মূলত শহরাঞ্চলে, এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও প্রসারিত হয়েছে। কোচিং মানে শিক্ষা নয়, পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে, কী উত্তর হবে; সেটা শিক্ষার্থীকে জানিয়ে দেওয়া। বহু বছরের ‘কু–অভ্যাসে’ শিক্ষা আজ এই স্তরে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সবটুকুর সাথে বিষফোঁড়া হয়ে জুড়েছে এই টালবাহানা; যার কারণে প্রত্যক্ষভাবে রাজ্যের প্রত্যেকটি প্রান্তে নতুন নতুন করে গড়ে উঠছে বেসরকারী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু সামাজিক স্তরে নয়, রাজনৈতিক ভাবেও নতুন বেসরকারী কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে রাজ্যজুড়ে। সেন্ট জেভিয়ার্স টেকনো ইন্ডিয়া, জেআইএসের মতো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছে আমাদের রাজ্যে। এইসকল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্রাস্টি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হয়। সরকার শুধু কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ করার কোনো এখতিয়ার নেই। এখানেই দাঁড়িয়ে যায় মূল সমস্যা। ফি স্ট্রাকচার, একাডেমিক ক্যালেন্ডারের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে থাকেনা কোনোরকম সরকারী হস্তক্ষেপ। ফলত স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্রদের ব্যয় হয় লাগামছাড়া। কখনও সেই ফি’র অঙ্ক দাঁড়িয়ে পড়ে প্রায় ৩০গুণ!
বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে বিরোধীরা অনেকসময় বলে যে বেসরকারী স্কুল-কলেজ তো সেই সময় থেকেই গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। আমরা যদি শুধু পরিসংখ্যান দেখি, তাহলে আপাতভাবে মনে হবে এমনটাই ঠিক। কিন্তু সেইসময় বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে উঠতে পারেনি। কারণ , গুণগতভাবে প্রত্যন্ত গ্রামের সরকারী স্কুলে পড়া ছাত্রটিও টক্কর দেওয়ার যোগ্যতা রাখতো মেট্রোপলিটনের কোনো বেসরকারী স্কুলের ছাত্রকে তার মেধা, যুক্তিনির্ভর মনন দিয়ে। কিন্তু আজ, কালের নিয়মে সেই পরিস্থিতি পাল্টেছে। শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের মৌলিক ভিত্তিই ছিল গণমুখী। সমাজের প্রান্তিকতম মানুষের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই করা হয়েছে তিন দশক ধরে।বামফ্রন্ট সরকারই প্রথম সরকারি কাজকর্মে ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সাঁওতালি ভাষার স্বীকৃতি দেয়। নেপালী ভাষার স্বীকৃতিও বামফ্রন্টের সময়েই। উচ্চশিক্ষায় সংখ্যালঘুদের আরও বেশি উৎসাহিত করতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করে বামফ্রন্ট সরকারই। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ২লক্ষেরও কম ছিল, যা ২০১১ সালে এসে দাঁড়ায় ১০ লক্ষের খানিক বেশি।
গত ১৯শে জুন থেকে শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের সরকারী এবং সরকার পোষিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তির ফর্ম ফিলআপের প্রক্রিয়া। ১৫ জুলাই জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে উচ্চশিক্ষা দপ্তর জানিয়েছে যে, কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ, যা ইতিমধ্যে ১ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল, তা আরও ২৫ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এখনও অবধি কোনো মেরিট লিস্ট প্রকাশ করতে পারেনি উচ্চশিক্ষা পর্ষদ। ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কী, কী ভাবে ভর্তি নেওয়া হবে কোনো বক্তব্যই এখনও পাওয়া যায়নি পর্ষদের তরফে। মূলত যে বিষয়টা আমরা আপাতভাবে সকলেই বুঝতে পারছি, ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে গোটা রাজ্যজুড়ে যে টালবাহানা চলছে তার জন্যই আজ এই অব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে গোটা ছাত্রসমাজকে।
শুধু স্নাতক স্তরের ভর্তির ক্ষেত্রেই নয় , রাজ্যের ২৭ শে এপ্রিলে সংগঠিত হওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং প্রবেশিকার ফল প্রকাশ ও ভর্তিতে এ বারের বেনজির বিলম্ব এই রাজ্যের ছাত্রসমাজের একটা বড় অংশ যারা কারিগরী বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত হয়ে তথাকথিত ভাবে একটা ‘সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ’-র স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিল তাদেরকেও অনিশ্চিয়তার দিকে ঠেলে দিল। প্রত্যেক ছাত্রই যে সর্বভারতীয় জয়েন্ট পরীক্ষায় ভালো নম্বর পায় এমনটা বাস্তবিক নয়। তাদের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ উপায় থাকে ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট এন্ট্রান্স এক্সামিনেশন। কিন্তু সেইদিকেও থাবা বসাতে বাদ রাখলো না রাজ্য সরকার। গোটা রাজ্যের সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ভর্তি আপাতত স্থগিত। উল্টোদিকে রাজ্যের বুকে গজিয়ে ওঠা বেসরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ভর্তি হচ্ছে লাগামছাড়া মূল্যে।
তৃণমূল আমলের গোঁড়া দিক থেকেই সমাজের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করা এবং বেআইনি অর্থ উপার্জনের নজির তৈরি করতে সফল হয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রও তার থেকে আলাদা কিছু নয়। স্কুলগুলোতে পরিচালন সমিতিগুলোতে তৃণমূলী নেতাদের বলপূর্বক সংখ্যাবৃদ্ধি, বিরুদ্ধ মতামতের অস্তিত্ব না রাখার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার শুরু। পরবর্তীতে বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দূর্নীতি এই ব্যবস্থাকে বেশ খানিকটা প্রসারিত করে। সর্বশেষ শিক্ষক নিয়োগ দূর্নীতির মাধ্যমে এই বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো। আসল কথা ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে আনা বা ধরে রাখার সহায়ক সরকারি প্রকল্প নয়, স্কুলে শিক্ষার পরিকাঠামো এবং শিক্ষক সংখ্যা। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিগত দশ বছরে এ রাজ্যে যা যা হয়েছে তেমন কুকীর্তি ইতিহাসে বিরল। কলেজেও বছরের পর বছর ইউনিয়ন নির্বাচন বন্ধ করার মাধ্যমে ছাত্রদের প্রতিষ্ঠান বিরোধী বড় বিরুদ্ধ কন্ঠস্বরে আঘাত আনা হয়েছে। এই অবৈধ ছাত্র সংসদগুলোর মাধ্যমে তৃণমূল কলেজে কলেজে স্নাতক স্তরের বিভিন্ন বিষয়ের ‘জূমলাবাজির মেনুকার্ড’ বানিয়েছে এবং চড়া দামে সিট্ বিক্রির কাজ সম্পন্ন করেছে। স্বভাবতই মেইনস্ট্রিম কোর্স এত চড়া দামে না পড়ার কথা মাথায় না রেখেই বাধ্য হয়েছে কারিগরী বিদ্যার দিকে ঝুঁকতে এবং সেক্ষেত্রেও সরকারী ব্যবস্থা উন্নত না থাকায় বাধ্য হয়েছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা রাখতে।
ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে ভুল হবে। আমাদের রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাকেই যে চরম বানিজ্যিকরণের দিকে ঠেলা হচ্ছে , এই ঘটনাগুলোই তার নিকৃষ্টতম উদাহরণ। একদিকে যেমন শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করে তোলার মাধ্যমে আর্থসামাজিক ভাবে এগিয়ে থাকা অংশের কাছেই সীমাবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে অন্যদিকে প্রান্তিক মানুষের মধ্যে শিক্ষার ছিঁটেফোঁটাটুকুও পৌঁছাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা, শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত ও বস্তিবাসী শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এমনিতেই নিম্নবিত্তের জনপরিসরে এ ধারণা গেঁথে গেছে, সাধারণ মানের শিক্ষা চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না বলে স্কুল-কলেজে গিয়ে কোনো লাভ নেই। এটা সমস্যাজনক। গুরুতর সমস্যাজনক।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে জমা দেওয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে সরকারি শিক্ষা থেকে সরকারের পশ্চাদপসরণ এবং উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান বেসরকারিকরণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ‘অস্থায়ী’ শিক্ষক নিয়োগ এবং চুক্তিভিত্তিক চাকরি বৃদ্ধির জন্য নব্য-উদারনীতির ‘ক্রমবর্ধমান প্রভাব’কে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলিতে, বিশেষ করে কেন্দ্র সরকারের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলিতে, বেশিরভাগ একাডেমিক পদে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগের সংখ্যা বেশি। ‘সরকারের সরকারি শিক্ষা থেকে পশ্চাদপসরণ এবং নব্য-উদারনীতিমূলক নীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব’-এর কারণেই অস্থায়ী, স্বল্পমেয়াদী চুক্তির দিকে ঝুঁকছে। শিক্ষার মান কমছে। সরকারী শিক্ষাক্ষেত্রের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ একরূপ ধারণ করছে।
এই প্রতিযোগিতার বাজারে স্কুল পাশ করার পরেও কলেজে ভর্তি না হতে পারার যে মানসিক অস্বস্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে ছাত্রদের তা অনভিপ্রেত। এই অনিশ্চিয়তার কারণেই অধিকাংশ ছাত্রের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। আজকের যুগে ছাত্রছাত্রীদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার এবং আর্থিক সহায়তার জন্য পিতামাতার উপর নির্ভর না করার প্রবণতা অনেক বেশি। শিক্ষাগত চাপের পাশাপাশি, এই ছাত্রদের প্রাপ্তবয়স্কদের মতো পরিবারের আরও দায়িত্ব গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে যে পরিমাণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে এবং জনপ্রতি গড় আয় কমছে তার জন্য আজকের এই নিউক্লিয়াস পরিবারের প্রায় প্রত্যেক সদস্যকেই উপার্জন করতে হয়। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে না পারার দরুন ড্রপ আউট হচ্ছে। ভর্তি প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতার ফলে একটা অংশ উচ্চ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। অত্যন্ত কম আয়ে অস্থায়ী অনিশ্চিত কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে এবং এভাবে একটা বড় অংশ তৈরী হচ্ছে যারা নূন্যতম মজুরিতে সর্বোচ্চ শ্রম দিতে প্রস্তুত।ফলে শ্রমের মূল্য সস্তা হচ্ছে এবং চাকরীর বাজার দুর্মূল্য হচ্ছে। যা আদপে গোটা বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামোয় আঘাত করছে। খানিক বাধ্য হয়েই একটা অংশ তৃণমূলের তৈরী সমান্তরাল ‘কাটমানি অর্থনীতি’র চক্রে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।এবং এর সাইড এফেক্টে নেশাগ্রস্ততা বাড়ছে, আত্মহত্যার প্রবনতা বাড়ছে, সামাজিক হিংসার ঘটনা বাড়ছে।সামাজিক শিক্ষার হার কমলে হিংসা,সাম্প্রদায়িকতা বাড়ে।আসলে তৃণমূল ঘুরিয়ে আরএসএসের জন্য ঊর্বর মাটি তৈরী করে দিয়েছে।
সরকারী কলেজে এতদিন ভর্তি প্রক্রিয়া, ইউনিয়নের নেতাদের দাদাগিরি কিংবা আর চারটে বিষয় নিয়ে কথা বা চর্চা ছিল কিন্তু তৃণমূল আমলে শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। কলেজগুলো নিজস্ব মর্যাদা হারাচ্ছে, গবেষণার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। কলেজ ক্যাম্পাসগুলোর স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এবং পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। যার ফলে এই গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের স্বর শাণিত হয়ে উঠছেনা। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। যার জন্য আমাদের প্রয়োজন নির্বাচিত ছাত্র সংসদ। এটাই এইসময়ের শিক্ষা আন্দোলনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। রাজনীতি বিমুখ হচ্ছে গোটা ছাত্রসমাজ। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে বলা যেতে পারে পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক ঘটনা দেখতে দেখতে রাজনীতি থেকে ‘ভালো’ কিছু পাওয়ার আশা হারাচ্ছে একটা গোটা প্রজন্ম। এইসময়েই দায়িত্ব নিতে হবে বামপন্থীদের এই ব্যাধি নিরাময়ের জন্য। স্কুল- কলেজ ক্যাম্পাসে, পাড়ায়-মহল্লায় ছাত্রদের প্রতি মুহূর্তে মনে করাতে হবে “When Politics detemines everything, we must determine our politics”। রাজনৈতিক ভাবে সচেতন সমাজ গড়ে তোলার এই লড়াই চালিয়ে যেতে পারলেই অন্ধকারকে পেরিয়ে আলোর সন্ধান আমরা খুঁজে পাবোই।
আগামী প্রজন্মকে বাঁচাবার এই লড়াইয়ের অগ্নিমন্ত্রে অবিলম্বে শপথ নিতে হবে আমাদের সবাইকে।