মহামারি ও অর্থনৈতিক পতনের অসম প্রভাবগুলো আমাদের বাধ্য করছে এই ব্যবস্থার ধারণক্ষমতা সম্পর্কে নতুন করে পর্যালোচনা করতে। – The New York Times এ লিখছেন ভেরমন্ট এর সেনেটার ও ডেমোক্র্যাট দলের পক্ষ থেকে পূর্বতন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স ।
আমরা বিশ্বের ইতিহাসে সবথেকে ধনী দেশ কিন্তু আয় ও সম্পদের বন্টনের ব্যাপক বৈষম্যের এই সময়ে আমাদের দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার কাছে এই তথ্যভিত্তিক বাস্তব অর্থহীন কারণ তাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে একটি বেতন পাওয়া থেকে পরের বেতনের অপেক্ষাতেই। এদেশের ৪ কোটি মানুষ থাকে দারিদ্রে, ৮কোটি৭০ লক্ষ মানুষের কোন বিমা নেই বা আংশিক বিমা আছে আর ৫ লক্ষ মানুষের মাথা গোঁজার কোন জায়গা নেই।
করোনাভাইরাস মহামারি ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের জোড়া আক্রমণের সম্মুখীন আমরা।এখন আমাদেরকে পর্যালোচনা করতেই হবে মার্কিন সমাজের কিছু ভিত্তিকে, কেন সেগুলো আমাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে তা বুঝতে হবে এবং একটা ন্যায়ভিত্তিক ত্রুটিহীন দেশ গঠনের জন্য লড়াই করতে হবে।
আমাদের নিয়োগকর্তা-ভিত্তিক বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমা ব্যবস্থার অযৌক্তিকতা এবং নির্মমতা এখন সবার কাছে উন্মোচিত হওয়া উচিত। মহামারির কারণে যখন লক্ষ লক্ষ আমেরিকান তাদের কাজ ও রোজগার হারাচ্ছে তখন একইসাথে তাদের অনেকে স্বাস্থ্যবিমাও হারাচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিসেবাকে কোনও নিশ্চিত অধিকার হিসাবে নয় বরং কর্মচারীর সুবিধা হিসাবে দেখা হলে এমনটাই ঘটে।এই মহামারির পরবর্তীতে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের এমন আইন প্রনয়ন করতে হবে যা অবশেষে প্রত্যেক পুরুষ, নারী এবং শিশু – বয়স নির্বিশেষে কর্মরত ও বেকারদের জন্য স্বাস্থ্য পরিসেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেয়।
এই মহামারি বিদ্যমান ব্যবস্থার অযৌক্তিকতাকেই স্পষ্ট করেছে। অবিশ্বাস্যভাবে, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যেও হাজার হাজার স্বাস্থ্য কর্মীকে ছাঁটাই করা হচ্ছে এবং অনেক হাসপাতাল এবং ক্লিনিক দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে । বাস্তব এটাই যে আমাদের কোন স্বাস্থ্য পরিসেবা ‘ব্যবস্থা’ নেই। আমাদের আছে বিমা কোম্পানি ও ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর মুনাফা নিশ্চিতকারী একটা গোলকধাঁধার মত জটিল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো । দীর্ঘদিন উপেক্ষিত এই প্রত্যাশিত নতুন স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ওয়াল স্ট্রীট বা স্বাস্থ্য পরিসেবার সঙ্গে যুক্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলিয়ন ডলারের মুনাফার লক্ষ্যে পরিচালিত হবে না । নতুন ব্যবস্থার লক্ষ্য হবে দেশের সমস্ত প্রান্তের সকল মানুষের জন্য স্বাস্থ্য পরিসেবা নিশ্চিত করা।
এটা ঘটনা যে কোভিড -১৯ ভাইরাস আয় বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে যে কাউকে, যে কোনও জায়গায় আঘাত করে। ব্রিটেনের প্রিন্স চার্লসের কোভিড -১৯ সংক্রমণ সনাক্ত হয়েছে এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সবেমাত্র হাসপাতাল থেকে মুক্তি পেয়েছেন।বাস্তব হল ধনীদের এই ভাইরাস সংক্রমণ হয় এবং তারা মারাও যায়। তবে এটাও সত্য যে দরিদ্র ও শ্রমজীবীদের অসুস্থতার হার বেশি এবং মৃত্যুর হারও ধনীদের তুলনায় বেশি।
বিশেষত আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এটা ভয়ানক বাস্তব। ভাইরাসের সংক্রমণের ফলাফলগুলির মধ্যে এই বৈষম্য কেবল একটা ভেঙে পড়া ও অন্যায্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই নয়, এই দেশের দরিদ্র ও শ্রমজীবী শ্রেণীকে ভয়াবহ উপায়ে অত্যাচার করে এমন এক অর্থনীতিরও প্রত্যক্ষ প্রতিচ্ছবি।
একদিকে লক্ষ লক্ষ নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর কোন স্বাস্থ্যবিমা নেই তার ওপরে এই কোভিড-১৯ ভাইরাসটি ইতিমধ্যে বিদ্যমান কোন শারীরিক সমস্যা এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সুযোগকে অত্যন্ত সুচারুভাবে ব্যবহার করে নিজের সংক্রামক ক্ষমতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণে, এদেশের দরিদ্র ও শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষদের মধ্যে ডায়াবেটিস, মাদকাসক্তি, স্থূলত্ব, মানসিক চাপ, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি এবং হৃদরোগের হার অত্যন্ত বেশি এবং তাদের এই সমস্ত পূর্ব-শর্তের কারনেই ভাইরাসটি তাদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। সাধারণত দরিদ্র ও শ্রমজীবীদের আয়ু ধনীদের তুলনায় কম হয় এবং এই মহামারির ক্ষেত্রে এই মর্মান্তিক অসাম্যটি আরও প্রকট।
উপরন্তু, যখন চিকিৎসক, গভর্নর এবং মেয়ররা আমাদের বলছেন যে আমাদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা উচিত এবং বাড়িতেই থাকা উচিত তখন ধনীরা অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল অঞ্চলে তাদের দ্বিতীয় বাড়িতে থাকা শুরু করছেন কিন্তু শ্রমজীবীদের ক্ষেত্রে সেই বিকল্প নেই।যখন আপনি একমাসের বেতন থেকে পরবর্তী বেতনের মধ্যে টিঁকে রয়েছেন, এবং আপনার সবেতন অসুস্থতাজনিত ছুটি এবং পারিবারিক ছুটির অভাব রয়েছে, তখন বাড়িতে থাকা কোনও বিকল্প নয়।আপনাকে যদি পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের এবং মাথা গোঁজার জায়গা নিশ্চিত করতে হয় তবে আপনাকে কাজে যেতে হবে। আর শ্রমজীবী শ্রেণীর জন্য এর অর্থ আপনাকে বাড়ির বাইরে যেতে হবে এবং কাজের সূত্রে বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে আসতেই হবে যাদের অনেকের মধ্যে হয়ত ভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে।
আমরা যে ভয়াবহ মহামারি ও অর্থনৈতিক পতনের সম্মুখীন হচ্ছি তাতে যদি কোনও রূপালী রেখা দৃশ্যমান হয় তবে তা হল এটাই যে আমাদের দেশে এখন অনেকেই এই মার্কিন মূল্যবোধের সূচকের মূল ধারণাটিরই পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করেছে।
আমাদের কি সত্যিই লোভ এবং নিরবচ্ছিন্ন পুঁজিবাদের পথে এগিয়ে চলতে হবে, যেখানে মাত্র তিনজন ব্যক্তি দেশের আর্থিকভাবে নিচের দিকে থাকা অর্ধেকের বেশি মানুষের চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় জীবনযাপন করছে – রোজ নিজেদের খাবার টেবিলে কিছু খাবার নিশ্চিত করতে, বাড়ি ভাড়া জোগাড় করতে, শিক্ষা নিশ্চিত করতে আর অবসরের জন্য সামান্য কিছু ডলার নিশ্চিত করতে ? নাকি আমদের একটা নতুন লক্ষ্যের দিকে এগোনো উচিত ?
আমার রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে প্রচারের সময় আমি রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্টের পদক্ষেপ অনুসরণ করতে চেয়েছিলাম, যিনি, ১৯৩০ এবং ৪০ এর দশকে বুঝতে পেরেছিলেন যে সত্যিকারের একটি মুক্ত সমাজে, অর্থনৈতিক অধিকারকে মানবাধিকার হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। এটি ৮০ বছর আগে সত্য ছিল এবং এটি আজও সত্য।
এই দেশের সমস্ত মানুষকে একত্রিত করে আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাষ্ট্রপতিকে পরাস্ত করে জো বিডেনকে জয়ী করতে আমি আমার সাধ্যমত প্রচেষ্টা করব। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের পেছনে যে অসাম্যগুলো প্রধান কারণ সেগুলোকে নির্মূল করার ক্ষেত্রে আমার দৃঢ় অবস্থান থাকবে কারণ এই ব্যবস্থার নিষ্ঠুরতা এবং অক্ষমতায় এই মহামারি চলাকালীন অগুণতি আমেরিকান জীবনকে মূল্য চোকাতে হয়েছে।
শুধুমাত্র ট্রাম্পের বিরোধিতা করাই যথেষ্ট হবে না – আমেরিকার জন্য আমাদের একটি নতুন দিশার কথা বলা দরকার।
আমরা যে নতুন আমেরিকার জন্য লড়াই করছি তা অবশ্যই আমাদের দেশে নামমাত্র মজুরির অবসান ঘটাবে এবং যারা কাজ করতে সক্ষম তাদের উপযুক্ত বেতনের কাজের নিশ্চয়তা দেবে।
শৈশব থেকে স্নাতক স্তর অবধি সমস্ত আমেরিকানকে উন্নত মানের শিক্ষার নিশ্চয়তা না দিলে আমরা বিশ্ব অর্থনীতিতে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারব না বা একটা শক্তিশালী গণতন্ত্র হতে পারব না।
আমাদের অবশ্যই একটি বিশাল নির্মাণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে যা গৃহহীনতার অবসান ঘটাবে এবং আমাদের সকল নাগরিকের জন্য নিরাপদ এবং সাধ্যের মধ্যে বাসস্থানের বন্দোবস্ত করবে।
আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের জনপদগুলো বায়ু এবং জল দূষণমুক্ত হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অস্তিত্বের সঙ্কট প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিশ্বের দরবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকতে পারে।
আমাদের অবশ্যই প্রবীণদের ভালবাসতে এবং শ্রদ্ধা করতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে যে সমস্ত আমেরিকানদের একটা সুরক্ষিত এবং মর্যাদাপূর্ণ অবসরকালীন বন্দোবস্ত হয় ।
আমি সেইসব রাজনীতিবিদ এবং পন্ডিতদের কথা শুনে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যারা আমাদের বলেছেন যে আমাদের সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনা কতটা কঠিন। নেলসন ম্যান্ডেলা একটা কথা বলতেন “একটা কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সবসময় অসম্ভব মনে হয়” । আসুন কাজে যোগ দিই এবং কাজটা শেষ করি।
১৯ এপ্রিল ২০২০ এর নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বার্নি স্যান্ডার্স আসন্ন মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রসঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করেন । বিশ্ব ব্যাপী ভয়াবহ করোনা সংক্রমণ ও আর্থিক সঙ্কটের এই পরিস্থিতি ১৯৩০এর দশকের মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে অভূতপূর্ব।বিপর্যয়ের সম্মুখীন গোটা বিশ্ব। এই সময়ে প্রকৃত অর্থে শ্রমজীবী মানুষের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরা হচ্ছে ও বিকল্প দিশার কথা বলা হচ্ছে খোদ সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন মুলুক থেকে -এই দৃষ্টিভঙ্গীর থেকেই লেখাটির ভাষান্তর প্রকাশ করা হল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে সিপিআই(এম) এর কোন অবস্থান ঘোষণার উদ্দেশ্যে এই লেখা প্রকাশ করা হয়নি।