প্রাককথন
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ধার কমে এলে ভারতের যুবসম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে দেশের মুক্তির জন্য কার্যকরী ও নতুন রাজনৈতিক পন্থার জন্য একধরনের খোঁজ শুরু হয়। এদেরই একটি অংশ মুহাজির (দেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় দেশান্তরী) পরিচিতি নিয়ে বাইরে থেকে সাহায্যের প্রত্যাশায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। নানা ঘাত প্রতিঘাতের শেষে তারা তুরস্কে পৌঁছেছিলেন, ততদিনে তারা রাশিয়াতে বিপ্লবের খবর পেয়েছেন। জার্মানি যে তাদের সাহায্য করবে না একথাও কম বেশি বুঝেছেন। মানবেন্দ্রনাথ রায় এদের তুরস্কে পৌঁছানোর খবর পেলেন। একসময়ের সশস্ত্র বিপ্লববাদী এই মানুষটি অনেক আগেই দেশ ছেড়ে এসেছিলেন। আমেরিকায় নিজের পরিচয় গোপন রাখার উদ্দেশ্যেই তাকে এম এন রায় নামটি ব্যবহার করতে হয়েছিল। ওদেশেই তার সাথে এভেলিন ট্রেন্টের পরিচয়, প্রণয় ও বিবাহ হয়।এদের সাথেই ছিলেন অবনী মুখার্জী ও তার স্ত্রী রোজা ফিটিংগোফ। রোজা শুধু অবনীর স্ত্রীই ছিলেন না, রুশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও ছিলেন। এরাই একসাথে ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই পার্টির সম্পাদক ছিলেন মহম্মদ শফিক। এটাই ইতিহাস।
বিদেশের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার খবর দেশে অনেক পরে এসে পৌঁছায়। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে খবর পাঠানোই ছিল অন্যতম প্রধান বাধা। তাসখন্দে প্রতিষ্ঠিত পার্টি খুব একটা কাজ এগোতে না পারলেও এম এন রায় নানাভাবে দেশের বুকে সক্রিয় একাধিক কমিউনিস্ট গ্রুপগুলির সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিলেন। ১৯২১ সালে গুজরাটের আমেদাবাদ শহরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রিশতম অধিবেশনের আয়োজন হয়েছিল। রায় এই আয়োজনে নিজে উপস্থিত হতে না পারলেও অধিবেশনে কমিউনিস্টদের বক্তব্য তুলে ধরতে চাইলেন। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি ও অবনী মুখার্জী একটি ইশতেহার লেখেন। লেখা শেষ হলে খসড়াটি নিয়ে তারা হাজির হন লেনিন ও স্তালিনের সামনে। সাধারণভাবে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তরফে বিবৃতিটি অনুমোদিত হলেও একটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ আজও জরুরী। রায়ের লেখায় এক জায়গায় বিকল্প কর্মসূচি হিসাবে সমস্ত দেশীয় সুদখোরদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। এই প্রস্তাবটি শুনতে ভালো লাগলেও, স্তালিন এই সম্পর্কে নিজের মতামত জানিয়ে উল্লেখ করলেন, এমনটা হলে ছোট ও মাঝারি কৃষকরা চাষের কাজে জরুরী অর্থের সংস্থান কোথা থেকে করবে? কে তাদের টাকা ধার দেবে? তখনকার বাস্তবতায় স্তালিনের প্রস্তাব ছিল উচিত হবে সুদের হার যেন কোনোভাবেই ৬শতাংশের বেশি না হয়।
এম এন রায় নিজের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন সেদিন স্তালিনের প্রস্তাবে তার ভুল ভেঙে যায়। তিনি উপলব্ধি করেন বিপ্লবী কর্মসূচি আকাশ থেকে নামিয়ে আনা যায় না, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই তাকে নির্মাণ করতে হয়, কার্যকরী করতে হয়।
আজ ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪।
রাজ্য ওয়েব ডেস্কের তরফে এম এন রায় ও অবনী মুখার্জির লেখা সেই ইশতেহারটি দুই পর্বের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হল। স্বাধীন ভারত কেমন হবে এই প্রসঙ্গে কমিউনিস্টদের বক্তব্য জানতে এই দলিলটি এখনও প্রাসঙ্গিক। এই দলিলের শুরু থেকে শেষ অবধি দুটি বক্তব্য বারে বারে উঠে এসেছে। এক, স্বাধীন ভারত সম্পর্কে তখনও অবধি যে সকল মতামত রাজনীতির আবহে ভেসে চলছিল তার কোথাও গরীব, মেহনতী ভারতীয়দের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য ভাবনাচিন্তা ছিল না। দুই, দেশের স্বাধীনতা আসবে অথচ দেশের এক বিরাট অংশের মানুষের উপরে যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষন, নিপীড়নের বন্দোবস্তটির কোনরকম বদল ঘটবে না এমন স্বাধীনতায় কার লাভ হবে, কাদের লাভ হবে?
কংগ্রেসের অধিবেশনে এই ইশতেহারটি সহজে প্রচার করা যায়নি, গোপনে বিলি করতে হয়েছিল। এমনকি ইশতেহারের কোথাও একে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিবৃতি বলেও উল্লেখ করা হয়নি, রায় ও মুখার্জির নামেই প্রচার হয়েছিল। ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও পুলিশের চাপ, কংগ্রেসের দোলাচলে থাকা নেতৃত্ব এমনকি স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীর অনুমোদন না থাকা সত্বেও সেদিন এ কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দুজন। প্রথমজন মৌলানা হসরৎ মোহানি, দ্বিতীয়জন স্বামী কুমারানন্দ। এই ইশেতাহারের এক বিশেষ দিক, এতে বারে বারে দেশের জনসাধারণকে সহযাত্রী বলে সম্বোধন করা হয়। তখনকার পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের এক বিরাট অংশের মধ্যেই কমিউনিজম ও কমিউনিস্টদের সম্পর্কে কার্যত কোনও ধারানাই ছিল না। এ স্বত্বেও নিজেদের দেশের মানুষ যে তাদের বক্তব্যের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে একমত হবেন এমন অনুভব থেকেই কমিউনিস্টরা সমগ্র দেশবাসীকে ‘সহযাত্রী’ হিসাবে অভিনন্দিত করেছিলেন। এটি নিছক সৌজন্যের বিষয় না, এটাই বিপ্লবী হিম্মৎ।
ভারতের বুকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহ্মদের স্মৃতিকথা থেকে ইশতেহারটি সংগৃহীত। মূল লেখার বানান আমরা অবিকৃত রেখেছি। কাকাবাবুর লেখা থেকেই জানা যাচ্ছে ঐ ইশতেহারের বাংলা ভাষান্তর করেছিলেন শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়।
২য় পর্ব
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুদ্রিত ইস্তিহার
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ৩৬তম অধিবেশনে প্রতিনিধিগণের প্রতি ইস্তিহার
মিঃ গান্ধী ঠিকই বলেছেন যে, ‘কংগ্রেসকে কতকগুলি সূক্ষ্মবুদ্ধি ব্যবহারজীবীর বিতর্ক সভা করে আর রাখা চলে না’। কিন্তু ওই একই বিবৃতিতে তিনি চেয়েছেন যে কংগ্রেস ‘ব্যবসায়ী আর শিল্পপতিদের সংস্থা হয়ে উঠুক’। তা যদি হয় তবে বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে এর কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটবে না। এই কংগ্রেসও তার পূর্বগামীর চেয়ে বেশী জাতীয় চরিত্রসম্পন্ন হয়ে উঠবে না। এর পরিণতিও খুব সম্মানজনক হবে না। কংগ্রেস যদি ‘ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি’ শ্রেণীর স্বার্থই দেখে, তাঁদেরই প্রতিনিধিত্ব করে তবে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় কংগ্রেস ব্যর্থ হবে। তার অবশ্যম্ভাবী ফল হবে কংগ্রেস বৃহত্তর জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি গোষ্ঠীর পক্ষে বিচ্ছিন্নভাবে এই জাতীয় সংগ্রামকে সাফল্যমণ্ডিত করা সম্ভব নয়। এমনকি বুদ্ধিজীবী এবং দোকানদার শ্রেণীও এ লড়াইয়ে তেমন কিছু শক্তি সঞ্চার করতে পারবে না। জনসাধারণের শক্তি অপরিহার্য। সাধারণ মানুষের সচেতন সংগ্রামেই দেশ স্বাধীন হবে, স্বরাজ সম্ভব হবে। কংগ্রেসের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবার জন্য কী করে জনসাধারণের শক্তিকে প্রয়োগ করা যায় সেটাই বিচার্য। কঠিন লড়াইয়ের ময়দানে জনগণকে টেনে আনতে হবে। কিন্তু কংগ্রেসের কার্যসূচীতে দেখা যায় জনগণের স্বার্থের প্রতি অপরিসীম ঔদাসীন্য এবং সেই স্বার্থ উপলব্ধির বোধশক্তির শোচনীয় অভাব। উপরন্তু দেখা যায় যে কংগ্রেস জনসাধারণের অজ্ঞতার সুযোগ পুরামাত্রায় নিতে চায় এবং তারপরেও আশা করে যে জনসাধারণ অন্ধভাবে কংগ্রেসকে মেনে চলবে। তা কখনোই হতে পারে না। নেতা যদি তাঁর অনুগামীর স্বার্থের প্রতি উদাসীন হন, তবে দুই পক্ষের বিরোধ ও ব্যবধান অচিরেই দেখা দেবে। জনগণ জাগছে। তাদের প্রচণ্ড শক্তির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি গড়ে উঠছে, তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি না ঘটিয়ে, তাদের নিচে ফেলে রেখে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল শীঘ্রই ব্যর্থ হবে। কংগ্রেস যদি ভুল ক’রে বিত্তশালী শ্রেণীর রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়, সে অবস্থায় তাকে জাতির নেতৃত্বের দাবি ছাড়তে হবে। অভ্রান্ত সমাজশক্তি কাজ করে যাচ্ছে। তার ফলে শ্রমিক-কৃষক তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা সম্বন্ধে অচিরেই সজাগ হবে। অচিরেই তারা নিজেদের রাজনৈতিক সংস্থা গড়ে তুলে উচ্চশ্রেণীর রাজনীতিবিদদের দ্বারা বিপথে চালিত হতে অস্বীকার করবে। অসহযোগ আন্দোলন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম। বাস্তব ঘটনাকে স্বীকার করার যদি আমাদের সাহস থাকে, তবে স্বীকার করতেই হবে যে অসহযোগ ব্যর্থ হয়েছে। এ আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য কারণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর কোনো বক্তব্য ছিল না। যাদের হাতে অসহযোগ সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারত, সেই শ্রমিকশ্রেণীকে আন্দোলনের কর্মসূচী থেকে শুধু বাদই দেওয়া হয়নি অসহযোগের উদগাতা ঘোষণা করেছেন, ‘কারখানার মজুরকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা বিপজ্জনক’। সুতরাং যে-শ্রমিকশ্রেণী তার অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থার সুযোগে অসহযোগকে সফল করতে পারত তাকেই বাদ দেওয়া হল। তার কারণ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগোষ্ঠীর স্বার্থের প্রহরীর কাজ যারা নিয়েছে তারা মনে মনে ভয় পাচ্ছে, পাছে দিনমজুর শ্রমিকশ্রেণী আবার বিত্তশালী সম্প্রদায়ের শোষণের অধিকার- যা তারা সকল সভ্য সমাজে পেয়েছে, সেই অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বসে। অন্যান্য শ্রেণী যাদের কাছে অসহযোগের আহ্বান রাখা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক কারণে এই সমাজব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত, তাদের পক্ষে এই সমাজব্যবস্থাকেই অস্বীকার করা অসম্ভব। নেতারা ‘শয়তানের সমাজ’ বলে যতই না নিন্দা করুন।
অসহযোগ হয়তো লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে চলতে পারে তার চেয়ে বলা সঙ্গত যে বিদেশী আমলাতন্ত্রকে ব্যতিব্যস্ত করবার উপযোগী। কিন্তু আসলে এ তো ধ্বংসাত্মক। কারণ বিদেশী শাসকের অবসানের কথাতেই সাধারণ মানুষের মনে যথেষ্ট উৎসাহ সৃষ্টি হবে না। তাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে হবে যে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার ফলে তাদের কী কী সুবিধা হবে। তাদের মনে এই উপলব্ধি জাগাতে হবে যে জাতীয় স্বাতন্ত্র্য তাদের জীবনধারণের নানা সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে। কতকগুলি ফাঁকা বুলি আর স্পষ্ট প্রতিশ্রুতিতে কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। কংগ্রেসকে কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তারা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মোচনে আগ্রহী এবং প্রমাণ করতে হবে যে তারা দরিদ্রের প্রতিদিনের অভাব অভিযোগকে অবহেলা করে সুদূর ভবিষ্যতে একটা অলীক আজাদীর সন্ধানে ছুটছে না।
দেশীয় শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষা এবং তাদের শিল্প প্রসারের স্বার্থেই স্বদেশী ও বয়কটের কার্যসূচী গৃহীত। হয়তো এ ইংরেজ ধনিকগোষ্ঠীকে আঘাত করতে সক্ষম হবে এবং তার ফলে হয়তো ইংরেজ সরকারের উপর পরোক্ষ চাপও সৃষ্টি করবে। কিন্তু ভ্রান্ত অর্থনীতির ভিত্তিতে রচিত এই কার্যসূচীর চূড়ান্ত সাফল্য সম্বন্ধে স্বাভাবিক ভাবেই সংশয় জাগে। কংগ্রেসের পতাকাতলে জনগণকে সমবেত করার স্লোগান হিসেবে বয়কট ব্যর্থ হবে। কেননা, বৃহত্তর জনসাধারণের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে এর কিছুমাত্র যোগ নেই বরং বয়কট কার্যত তাদের প্রতিকূল। কংগ্রেস যদি স্বপ্ন দেখে থাকে যে বিদেশী কাপড় পুড়িয়ে উন্মত্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে তার ভিত্তিকে দৃঢ় করবে, তবে সে চোরাবালির উপর সৌধ নির্মাণের চেষ্টা করছে। এই উত্তেজনা বেশীকাল টিকবে না। কিছুদিনের মধ্যেই জনগণের বস্ত্রের অভাব ঘটবে এবং যতদিন বাজারে বিদেশী বস্ত্র সস্তা থাকবে ততদিন গরীব মানুষকে কিছুতেই এ প্রতিজ্ঞা করানো যাবে না যে তারা সেই বিলিতি কাপড় কেনার চেয়ে বস্ত্রহীন হয়ে থাকবে। চরখা যথাযথভাবেই যাদুঘরে নির্বাসিত হয়েছে। এই যন্ত্রযুগে চরখা আবার ফিরে আসবে এবং ৩২ কোটি লোকের প্রয়োজন মেটাবে এ চিন্তা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। বয়কট শিল্পপতিদের সমর্থন পাবে, কিন্তু ক্রেতাদের পূর্ণ সমর্থন কখনোই পাবে না। সুতরাং আত্মার বিশুদ্ধিকরণ জাতীয় উদ্ভট মতবাদ বিত্তশালী বুদ্ধিজীবীদের কাছে ভালো লাগতে পারে, কিন্তু ক্ষুধিত মানুষের কাছে এর মোহ চিরস্থায়ী হতে পারে না। বাঁচার তাগিদে কোনো বাধাই মানে না। এবং রাজনৈতিক আন্দোলনকে বাস্তব যুক্তি আর প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে তুলে নিয়ে যাওয়া যায় না। অনেকে আবার মনে করেন যে ভারতীয় সভ্যতা হল আধ্যাত্মিক আর ভারতীয় জনগণ বাইরের জগতের মানুষের মতো বাস্তব যুক্তি ও অনুশাসনের অধীন নয়-এ ধারণা সর্বৈব ভ্রান্ত।
যখন প্রমাণ হয়ে গেছে যে অসহযোগ তেমন কিছু আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, ৩৬তম কংগ্রেস তা সত্ত্বেও অসহযোগের পথেই আরো এক পা এগোতে চায়। কংগ্রেস নেতারা বেশ বুঝতে পারছেন যে জনসাধারণের মধ্যে খিলাফৎ ও অসহযোগের উৎসাহে দিনে দিনে ভাঁটা পড়ছে। কয়েক লক্ষ সদস্য বৃদ্ধি বা তিলক স্বরাজ ভাণ্ডারের চাঁদা ওঠাকে কংগ্রেসের পিছনে জনসমর্থনের লক্ষণ বলে ধরা চলে না। সদস্য খাতায় নাম লেখালে বা স্বরাজ ভাণ্ডারে এক টাকা চাঁদা দিলেই মনে করার কারণ নেই যে সেই সদস্য সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে প্রস্তুত। সাম্প্রতিককালে দায়িত্বশীল কংগ্রেস নেতারা বার বার সভায় সংবাদপত্রে দলগত ঐক্য বা আন্দোলনের সাফল্য সম্বন্ধে নৈরাশ্য প্রকাশ করেছেন। কৃত্রিম উপায়ে ফাঁপানো উদ্দীপনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁরা নূতন কোনো উত্তেজনার ফিকিরে আছেন। কিন্তু সচেতনভাবেই হোক আর অজ্ঞতাবশেই হোক তাঁরা কিছুতেই গণ- অসন্তোষের মূল কারণে হাত দেবেন না বা জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এই অসন্তোষকে বৃহত্তর সংগ্রামে পরিচালিত করবেন না। অন্যদিকে আরেকটি দায়িত্বজ্ঞানহীন পথ নেওয়া হয়েছে। কংগ্রেসের অপেক্ষায় না থেকে সর্বভারতীয় কমিটি আইন অমান্যের সুপারিশ করে বসে আছেন। কিন্তু সে প্রস্তাবের ভাষা থেকেই দেখা যায় যে এই নূতন আন্দোলন অধিকতর সার্থকভাবে বাস্তবে রূপায়িত করা যাবে কিনা প্রস্তাবকদের নিজেদের মনেই তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। প্রস্তাবের ভাষায় আছে-‘যাঁরা সরকারী চাকরি ছাড়তে সক্ষম’-সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে প্রায় শতকরা ৯০ জন এই অকিঞ্চিৎকর বেতনে যেখানে দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করতে পারেন না সেখানে এই হুকুমনামার সাড়া যে মোটেই চমকপ্রদ হবে না সে তো সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
কার্যত আইন অমান্য হবে জাতীয় ধর্মঘটের শামিল। যদি প্রত্যেকে কাজ বন্ধ করে তবে সরকার অচল হয়ে পড়তে বাধ্য। কিন্তু কংগ্রেস কি নিশ্চিত যে সকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ডাকে সাড়া দেবে? তাই যদি হয় তবে বলতে হবে যে তারা জনসাধারণের বাস্তব পরিস্থিতি সম্বন্ধে শোচনীয়ভাবে অজ্ঞ এবং যে অর্থনীতির চাপ সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাকে নিয়ন্ত্রিত করে সে সম্বন্ধেও তাদের কোনো ধারণা নেই। সামরিক ও বেসামরিক চাকরি ছেড়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ লোক বেকার হবে-কংগ্রেস কি তাদের কাজের সংস্থান করে দিতে পারবে? একটা কথা মনে রাখা দরকার যে সরকারী দফতরের নিম্নমধ্যবিত্ত চাকুরিয়ারা কিছুতেই কায়িক শ্রমে রাজী হবে না। কংগ্রেসী নেতারা যে এই জটিলতা বোঝেন না তা নয়। মিঃ গান্ধির ভাষায়, ‘যেসব সৈনিক সেনাবাহিনীর কাজ ছেড়ে আসবে তাদের কাজ দিতে তারা প্রস্তুত নয়’। আসামের চা-বাগান থেকে চলে আসা মজুরদের শোচনীয় অবস্থার কথা এখনও ভোলেননি। কী করে ভরসা রাখা যায় যে আবার একই কৌশল অনুসরণ করা হবে না? জাতির রাজনৈতিক সংস্থা কেবল সভা করেই তার দায়িত্ব পালন শেষ করতে পারে না। আমাদের লক্ষ্য তো শুধু সরকারকে উত্যক্ত করা নয়, আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়ছি। যতদিন পর্যন্ত কংগ্রেস একটা গঠনমূলক কার্যসূচীর ভিত্তিতে তাদের আন্দোলন না চালাচ্ছে, যতদিন না তারা আরও দায়িত্বশীল এবং আরও কম আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত স্বাধীনতার লড়াই কিছুতেই সফল হবে না। লঘুচিত্তে আইন অমান্যের প্রস্তাব গ্রহণ করলে কংগ্রেসকে হাস্যম্পদ হতে হবে।
কারণ যত আশাবাদ যত উত্তেজনাই থাক না কেন কংগ্রেস জাতির সকল শ্রেণীস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে না। আর যে অগণিত শ্রমিক-কৃষক জাতির সবচেয়ে বড় শরীক তাদের বাস্তব উন্নতি ও কল্যাণের কথা কংগ্রেস সামান্যই বলে। যখন লম্বা লম্বা বক্তৃতার পিছনে কোনো স্থায়ী কার্যসূচী নেই, সেখানে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে কী লাভ। জনগণের জীবনীশক্তিকে ওইসব ফাঁকা কথায় উজ্জীবিত করা যাবে না, সরকারকেও সন্ত্রস্ত করা যাবে না। অবশেষে তা শুধু বক্তাকেই বেইজ্জত করবে। খিলাফৎ উদ্ধার না হলে জেহাদ ঘোষণা করা হবে এ হুমকি তো বস্তাপচা হয়ে গেছে। মাসের পর মাস স্বরাজ লাভের তারিখ পিছিয়ে দিলে বুদ্ধিমান মানুষের মনে আর বিশ্বাস জাগানো যাবে না। কংগ্রেসের লম্বা লম্বা প্রস্তাবগুলি কিছুতেই ভাষার ফুলঝুরির বাইরে আসতে পারে না কেন? কারণ কংগ্রেস সমাজশক্তির পরিপ্রেক্ষিতে কখনোই তাদের কার্যসূচী নির্ধারণ করে না।
সমস্ত দেশজুড়ে শহরের ধর্মঘট আর গ্রামের জমির লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে জনশক্তির যে বিপুল আলোড়ন দেখা দিয়েছে তা কংগ্রেসেরই আন্দোলন-বিশেষ করে অসহযোগ আন্দোলনেরই ফল এরকম ধারণা একেবারেই মিথ্যাচার। ‘শয়তানী বিলিতি সভ্যতার বিরুদ্ধে’ তীব্র ঘৃণা বা পাঞ্জাবের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে লম্বা লম্বা গরম বক্তৃতা বা খিলাফতের প্রস্তাব কোনোটিই নির্যাতিত মানুষের অসন্তোষের জন্য দায়ী নয়। মার-খাওয়া মানুষ আজ নিষ্ক্রিয়তার হাতে আত্মসমর্পণের পথ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করেছে এই গণ-জাগরণই জাতীয় সংগ্রামের যথার্থ শক্তি ও মর্যাদা সঞ্চার করেছে। এই গণ-জাগরণের কারণ অনুসন্ধান করতে হবে বহু যুগসঞ্চিত অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামাজিক দাসত্বের ইতিহাসের মধ্যে। গণ-বিদ্রোহ আজ বিত্তশালী শ্রেণীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, সে-শ্রেণী ইংরেজ কি ভারতীয় সে বিচার আজ নিরর্থক। এই শোষণ দীর্ঘকাল ধরেই বেড়ে চলেছিল, তবে যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক সংকট একে তীব্রতর করে তুলেছে। জনগণের তীব্র অসন্তোষ যুদ্ধের অব্যবহিত পরে প্রকাশ্য বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে। কংগ্রেস বলছে এ বিক্ষোভের কারণ সরকারের প্রতিশ্রুতিভঙ্গ। তা ঠিক নয়। আসলে যুদ্ধের অব্যবহিত পরে যে অস্বাভাবিক বাণিজ্য স্ফীতি ঘটেছে তার ফলে অর্থনৈতিক শোষণ এমন এক স্তরে এসে পৌঁছেছে যে মানুষ আজ ক্ষেপে উঠেছে-ধৈর্যের সমস্ত বাঁধ আজ ভেঙে গিয়েছে।
নূতন নূতন শিল্প প্রসারের ফলে হাজার হাজার শ্রমিক জনাকীর্ণ শহরে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে এবং সেখানে তাদের বীভৎস অবস্থার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি শ্রেণীর আকস্মিক ঐশ্বর্যস্ফীতি স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকশ্রেণীর দারিদ্র্য ও লাঞ্ছনা বাড়িয়ে দিয়েছে। শহরের জীবন শ্রমিকের কাছে নূতন চিন্তা খুলে দিয়েছে। এতকাল তারা তাদের শোচনীয় অবস্থাকে ঈশ্বরের বিধান বলে মেনে নিয়ে মুখ বুজে বসেছিল। ধর্ম-বৈষম্য ও সুযোগ-সুবিধার তারতম্য আরও প্রকট হয়েছে। শ্রমিকশ্রেণী আজ গতানুগতিক ভারতীয় কৃষক জীবনের জড়তা থেকে মুক্তিলাভ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। এ বিদ্রোহ কোনো বিশেষ সরকারের বিরুদ্ধে নয়, এ বিদ্রোহ সেই নৃশংস সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে সমাজব্যবস্থা প্রতিদিন তাকে ধুলোয় গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে। গণ-বিদ্রোহ দ্রুত প্রসারমুখী। এই ভাবনা অতিদ্রুত নানা সূত্রে গ্রামাঞ্চলে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। সেখানে জমির লড়াই শুরু হয়ে গেছে। এ লড়াই আগুনের মতো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এই হল বাস্তব ঘটনার অপ্রতিরোধ্য চাপে সমাজশক্তির স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ। তথাকথিত রাজনৈতিক আন্দোলন এই জাগরণ ঘটিয়েছে এ ধাপ্পা প্রচার করা অর্থহীন। তার চেয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনওয়ালাদের উচিত এই মহান জাগ্রত শক্তির কাছে মাথা নীচু করে তারই প্রেরণায় নিজেদের আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রিত করা। এই সমাজশক্তিই রাজনৈতিক আন্দোলনকে যথার্থ শক্তি ও সম্ভাবনা সঞ্চার করতে পারে। বস্তুতপক্ষে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক আন্দোলনই কতকগুলি সমাজশক্তির অপরিহার্য বহিঃপ্রকাশ।
শ্রমিক-কৃষক শ্রেণীর অর্থনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে কংগ্রেস এ যাবৎ কী করেছে? কংগ্রেস গণ-আন্দোলনকে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করেছে মাত্র। প্রত্যেক ধর্মঘট বা কৃষক বিক্ষোভে অসহযোগীরা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ধর্মঘটীদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে। বুদ্ধিজীবী কংগ্রেস তার আদর্শবাদের চূড়ায় বসে জনগণের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে স্বরাজ দাবী করে আর আশা করে যে জনগণ তাকে অন্ধের মতো মেনে চলবে। কংগ্রেস দারিদ্র্যক্লিষ্ট শ্রমিক-কৃষকশ্রেণীকে সর্বপ্রকার ত্যাগের আহ্বান জানাতে দ্বিধাবোধ করে না। এই ত্যাগ করতে বলা হয় আবার জাতীয় কল্যাণের দোহাই পেড়ে, যদিও এই ত্যাগের ফলে বিদেশী শাসকের ক্ষতির চেয়ে দেশীয় ধনিকদেরই লাভ হয় বেশী। কংগ্রেস সমগ্র জাতির রাজনৈতিক নেতৃত্ব দাবী করে। কিন্তু এর প্রত্যেকটি কাজ প্রমাণ করে যে কংগ্রেস বৃহত্তর জনসাধারণের স্বার্থ সম্বন্ধে নিদারুণভাবে অজ্ঞ ও উদাসীন। এযাবৎ কংগ্রেস জনগণের প্রতিদিনের লড়াইকে তার নিজের লড়াই হিসেবে দেখতে পারেওনি, দেখতে চায়ওনি। তার ফলে জনগণের সচেতন ও বলিষ্ঠ সমর্থনও তারা আশা করতে পারে না। যদিও এটা মনে রাখা দরকার শ্রমিক- কৃষকশ্রেণী যে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক লড়াই চালিয়ে যাবেই এবং তারা যা চায় তা শেষ পর্যন্ত তারা অর্জনও করবে-সে লড়াইয়ে তারা কংগ্রেসের নেতৃত্ব পাক আর না পাক। কংগ্রেসের নেতৃত্ব তাদের যে খুব বেশী প্রয়োজন তা নয়, কিন্তু অপরপক্ষে কংগ্রেসের রাজনৈতিক সাফল্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে জনগণের সচেতন সমর্থনের উপর। কংগ্রেস যেন মনে না করে যে জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য কিছু না করেও জনগণের নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব তারা অর্জন করেছে।
মহাত্মাজীর ব্যক্তিগত চরিত্রের জন্য তিনি মানুষের পূজা পেতে পারেন। ধর্মঘটী মানুষেরা তাদের কয়েক পয়সার মজুরী বৃদ্ধির আন্দোলনে ‘মহাত্মাজী কি জয়’ স্লোগানও তুলতে পারে। বিক্ষোভের প্রথম উত্তেজনায় তারা এমন সব পথে পরিচালিত হতে পারে, যে পথে তাদের প্রকৃত সংগ্রামের যোগ নেই। তাদের নবার্জিত উদ্দীপনা যা বহুযুগের ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভাষা পায়নি, তা হয়তো তাদের শেষ কৌপীনটুকু পুড়িয়ে ফেলতে উত্তেজিত করতে পারে। কিন্তু তাদের ধীর চিন্তার মুহূর্তে তারা কী চায়? নিশ্চয়ই রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য বা খিলাফত উদ্ধার নয়। তারা চায় জীবনধারণের আপাত সামান্য কিছু অপরিহার্য উপকরণসমূহ-এরই জন্য তারা লড়াইয়ে নেমেছে। শহরের শ্রমিকেরা মজুরী বৃদ্ধি দাবী করে, খাটুনির ঘণ্টা কমাতে চায়, জীবনধারণোপযোগী উন্নততর পরিবেশ দাবী করে। গরীব কৃষক জমির মালিকানা দাবী করে, অতিরিক্ত কর ও খাজনা থেকে রেহাই চায় এবং জমিদারদের দুঃসহ শোষণ থেকে মুক্তি চায়। তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। শোষকের জাতি নির্ণয়ে তাদের দুঃখের কোনো তারতম্য ঘটে না। এই হলো যথার্থ বৈপ্লবাত্মক শক্তির স্বরূপ। এই শক্তিই রাষ্ট্রনৈতিক শাসনের পরিবর্তন আনতে পারে এ সত্য কংগ্রেস যত শীঘ্র উপলব্ধি করতে পারে ততই মঙ্গল।
কংগ্রেস যদি এই গণ-জাগরণের সঙ্গে কোনো যোগ না রেখেই জাতীয় নেতৃত্বের আশা করে তবে এই কংগ্রেসকেও তার পূর্বসূরীর মতো মৃত অতীতের অন্ধকারে অখ্যাতির মাঝে নির্বাসন ভোগ করতে হবে। জনগণের সক্রিয় সমর্থন অর্জন করতে গেলে কেবল চলবে না। তাদের দৈনন্দিন অভাব অভিযোগ মোচনের জন্য তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে প্রস্তুত থাকতে হবে। তারপর সেই বেঁচে থাকার লড়াইকে ধাপে ধাপে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। খিলাফতের দাবি, বয়কট প্রস্তাব, “চরখা হাতে বেদের যুগে ফিরে যাবার” উদ্ভট আদর্শ অথবা বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত এবং দোকানদারদের সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বানের পথে কংগ্রেসের পতাকাতলে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যাবে না। বক্তৃতায় মানুষকে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করা যাবে না। বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে তাদের লড়াইয়ে উদ্দীপ্ত করতে হবে। দারিদ্র্যপীড়িত নির্যাতিত নিঃস্ব শ্রমিক আর কৃষক লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়তে বাধ্য। কারণ অন্য কোথায়ও তাদের কোনো উপায় নেই, আশা নেই। এই শ্রমিক-কৃষককে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব কংগ্রেসের। কংগ্রেস তখনই জনগণের আস্থাভাজন হতে পারবে যখন আর সে তাদের কাছে লোক দেখানো জাতীয় স্বার্থ নামক একটি তথাকথিত উচ্চ আদর্শের নামে (যা আসলে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ঐশ্বর্য বৃদ্ধির অবলম্বন) তাদের স্বার্থ বিসর্জন দেবে না। আজ ভারতবর্ষ বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। কংগ্রেস যদি সেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে চায়, তবে সে যেন কেবল কতকগুলি বাইরের লোক দেখানো সভা বা ক্ষণস্থায়ী উন্মত্ত উত্তেজনার উপর ভরসা না রাখে। কানপুরের শ্রমিকেরা যে দাবী রেখেছে সেই ট্রেড ইউনিয়ন দাবীগুলিকে কংগ্রেস নিজের দাবী বলে ঘোষণা করুক। কিসান সভার কার্যসূচীকে কংগ্রেস তার নিজের কার্যসূচী বলে স্বীকার করুক-তবেই দেখা যাবে যে কোনো বাধাই কংগ্রেসকে থামাতে পারছে না। তখন আর কংগ্রেসকে একথা বলে অনুশোচনা করতে হবে না যে দেশের মানুষ যথেষ্ট পরিমাণে ত্যাগ স্বীকার করেনি বলে কোনো নির্দিষ্ট তারিখে স্বরাজ অর্জন করা গেল না, কংগ্রেসের পিছনে তখন সমগ্র দেশের অপ্রতিরোধ্য জনশক্তি এসে দাঁড়াবে। এ পথে না গেলে অসহযোগের সমস্ত নিষ্ঠা, সেভেরস চুক্তি সংশোধনের সমস্ত দৃঢ়তা, আত্মশক্তির সমস্ত আদর্শ সত্ত্বেও কংগ্রেসকে সরে দাঁড়াতে হবে এবং সেখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিয়ে লড়বে এমন নূতন সংগঠন সাধারণ মানুষের ভিতর থেকেই গর্জে উঠবে। কংগ্রেস যদি সমগ্র জাতিকে তার সঙ্গে চায়, তবে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা শ্রেণীর স্বার্থে সে যেন নিজেকে আবদ্ধ না রাখে। কংগ্রেসে আজ ‘তীক্ষ্ণধী ব্যবহারজীবী’র স্থান নিয়েছে ‘ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি’র গোষ্ঠী। কংগ্রেস যেন তাদের অদৃশ্য অঙ্গুলি নির্দেশে না চলে। তাদের আসল মতলব হল ইংরেজের জায়গায় তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
কংগ্রেস যখন অসহযোগের পতাকাতলে বিপ্লবী শক্তির অপব্যয় ঘটাচ্ছে, তখন প্রতিবিপ্লবী শক্তি মানুষকে বিপথে পরিচালিত করবার জন্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী চেতনা ঝিমিয়ে পড়েছে-ধর্মঘটের ক্ষেত্রে শৈথিল্যই তার প্রমাণ। ট্রেড ইউনিয়নগুলি সংস্কারবাদী বা হঠকারী বা সরকারী দালালের হাতে চলে যাচ্ছে। ‘আমন সভা’গুলি কৃষকদের গ্রাস করছে। সরকার জানে কোথায় আন্দোলনের প্রকৃত উৎস। সরকার জনগণকে কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। এই সব চতুর আমলাদের ধূর্ত ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করতে গেলে কেবল ফাঁপা বুলি আর আবেগপূর্ণ আবেদনে কাজ হবে না। সমান চতুর নীতি অনুসরণ করতে হবে। জনতার চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে-এই হল লড়াইয়ে তাদের টেনে আনার একমাত্র পথ।
সহযাত্রী দেশবাসীগণ,
কংগ্রেসের কার্যসূচীতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সমস্যাটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, সে সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। ভারতের মানুষ অগণিত জাতি, ধর্ম মত ও সম্প্রদায়ে বিভুক্ত। এই ব্যবধানকে দূর করতে কতকগুলি কৃত্রিম ও আবেগভরা প্রচারে কোনো কাজ হবে না। সৌভাগ্যক্রমে এই অসংখ্য দল ও সম্প্রদায় একটি প্রবল শক্তির চাপে দুটি সুস্পষ্ট শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সেই শক্তি হল অর্থনীতি। এই অর্থনীতির অমোঘ বিধানে বিত্তশালী শ্রেণী সম্পদহীন নিঃস্ব মানুষকে শোষণ করে চলেছে। এই শ্রেণীবিভাগে কিছু কিছু ‘উগ্র দেশপ্রেমিক’ বড় অস্বস্তি বোধ করেন। কারণ তাঁরা প্রচার করে বেড়ান যে এই ভারতবর্ষ ঈশ্বরের এক বিশেষ সৃষ্টি। কিন্তু একথা অস্বীকার করা চলে না যে অর্থনীতির অমোঘ বিধানে ভারতবর্ষেও সক্রিয়-তারই প্রভাবে সহস্র সামাজিক ব্যবধানকে দূর করে ভারতবর্ষ দুটি বিরাট শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই অমোঘ বিধানেই হিন্দু শ্রমিক তার মুসলমান সহকর্মীর ঘনিষ্ঠ হয়ে আসছে। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের এই একমাত্র পথ। যারা স্পষ্টভাবে এই সমাজ-অর্থনীতির অভ্রান্ত নীতি অনুধাবন করবে, তারা আর উদভ্রান্তের মতো সন্ধান করতে যাবে না যে কীভাবে মুসলমানের মনে গোজাতি সম্বন্ধে শ্রদ্ধা জাগানো যায় বা হিন্দু কৃষককে বোঝাতে হবে না যে তাঁর আত্মার মুক্তি ও ইহকালের সকল যন্ত্রণা মোচনের একমাত্র উপায় হলো খিলাফৎ উদ্ধার বা তুর্কীদের হাতে আর্মেনিয়াদের বশ্যতা স্বীকার। ফাঁকা ভাবালুতার পথে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য আসবে না। অর্থনৈতিক শক্তির বাস্তব পথেই তা সম্ভব হবে। আমাদের কর্তব্য সে বাস্তব যুক্তির উপর জোর দেওয়া এবং সেই পথে আস্থা রাখা।
সহযাত্রী দেশবাসীগণ,
আপনারা একটি ক্ষুদ্র শ্রেণীর উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে সমগ্র জাতির অভাব-অভিযোগের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। রাজনৈতিক জুয়াখেলা ছেড়ে সমাজশক্তির সমর্থনে কংগ্রেস উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠুক। আপনারা কাজের দ্বারা প্রমাণ করুন যে কংগ্রেস দেশীয় ধনিকশ্রেণীর একচেটিয়া অধিকার অর্জনের জন্য নয়, সমগ্র ভারতীয় জনগণকে-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সর্বপ্রকার শোষণ থেকে মুক্তি দেবার জন্য বিদেশী শোষণের অবসান চায়। আপনারা প্রমাণ করুন যে কংগ্রেস সত্যই জনগণের যথার্থ প্রতিনিধি এবং জনগণের সংগ্রামে প্রতিস্তরে নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা কংগ্রেসের আছে। তবেই কংগ্রেস যথার্থ জাতীয় নেতৃত্ব অর্জন করবে। এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষের খামখেয়ালে নির্ধারিত কোনো নির্দিষ্ট তারিখে স্বরাজ আসবে না, স্বরাজ অর্জিত হবে সর্বস্তরের মানুষের সচেতন ও সম্মিলিত চেষ্টায়।
১লা ডিসেম্বর, ১৯২১
মানবেন্দ্রনাথ রায়
অবনী মুখার্জি