২৬ জানুয়ারি ২০২২ ( বুধবার )
আর.এস.এস’র হিন্দুত্ববাদী মতাদের্শ প্রাণিত কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ্ জুটির সরকার ২৬শে নভেম্বর দিনটিকে সংবিধান দিবস হিসেবে চালু করেছে। সদ্য সমাপ্ত ২০১৯ সালের ২৬শে নভেম্বর বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই কর্মসূচী পালিত হয়েছে। এছাড়া এই কর্মসূচী পালিত হয়েছে পশ্চিমবাংলায়। বরং এ রাজ্যেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন বসেছে সংবিধান বিষয়ে দু’দিনের জন্য, ২৬ এবং ২৭শে নভেম্বর।
সম্প্রতি একের পর এক ঘটনায় আমরা দেখেছি মোদী-শাহ জুটি সরকার কিভাবে আমাদের সংবিধানকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত হয়ে আমাদের প্রজাতন্ত্রের মর্মবস্তুকেই ধ্বংস করছে। গোয়া, মণিপুরে সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে সরকার গঠন করেছে; মহারাষ্ট্রে রাতের অন্ধকারে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকার গঠনের চেষ্টা চালানো হয়েছে। কাশ্মীরে সংবিধানের অবমাননা ঘটানো হয়েছে; সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অসাংবিধানিক নাগরিকত্ব সংশোধন আইন পাশ করানো হয়েছে ইত্যাদি। যারা এইসব কাজ করলেন তারা আসলে সংবিধান বিরোধী। সেকারণেই ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে ২৬শে নভেম্বর তারিখটাকে সংবিধান দিবস হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদীজি যখন প্রধানমন্ত্রী তখন থেকেই এটা শুরু হলো। একটা পলিটিক্যাল ইভেন্ট হিসাবে ২৬শে নভেম্বর দিনটাকে ব্যবহার করার অপচেষ্টা।
আমাদের দেশে প্রজাতন্ত্র দিবস ২৬শে জানুয়ারি, সেটাই সংবিধান দিবস হিসাবে বরাবরই পালিত হয়। ২৬শে নভেম্বর কেন? আগে তো কখনও ২৬শে নভেম্বর পালিত হয়নি। ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে খসড়া সংবিধান গৃহীত হলো। কিন্তু সেখানেও বলা হয়েছিল এই সংবিধান কার্যকর হবে ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০। আমাদের কারোর না বোঝার কোনো কারণ নেই। যেদিন গৃহীত হলো, আর যেদিন কার্যকর হলো, এই দুটোর মধ্যে বিরাট পার্থক্য। যেমন আমাদের রাজ্যে এ দফায় বিধানসভায় রাজ্য সরকার নির্বাচিত হয়েছে ১৯শে মে, ২০১৬, ভোটের ফলাফল বেরিয়েছে তারা নির্বাচিত হয়েছে। সরকার শপথ নিল কিন্তু ২৬শে মে, ২০১৬। এই সরকরের জন্ম তারিখ হচ্ছে ২৬শে মে। জন্ম তারিখ ১৯শে মে নয়। ঠিক তেমনই সংবিধান দিবসটা ২৬শে জানুয়ারী, ২৬শে নভেম্বর কখনই হতে পারে না। তাহলে এই প্রশ্ন আসবেই ২৬শে নভেম্বর কি ভারতের সংবিধান কার্যকর হলো? ২৬শে নভেম্বর থেকে ২৬শে জানুয়ারী এই দু’মাস কোন আইনের দ্বারা ভারত শাসন হলো? সংবিধান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন, তার দ্বারা নয়। এই দু’মাস দেশ পরিচালনা হলো Indian Independence Act, 1947 দ্বারা, যেটা হাউস অফ কমন্সে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি পেশ করেছিলেন। অর্থাৎ ব্রিটিশ আইনে ভারত শাসিত হলো ২৬শে নভেম্বর থেকে ২৬শে জানুয়ারী পর্যন্ত।
তাহলে ২৬শে জানুয়ারী, ১৯৫০-এর আগে পর্যন্ত এই আইনটা কার্যকর হয়নি, ব্রিটিশ আইনে দেশ চলল। স্বভাবতই ২৬শে নভেম্বর দিনটাকে সংবিধান দিবস হিসাবে গ্রহণ করাটা ইতিহাসের বিকৃতি ছাড়া অন্য কিছু নয়। ইতিহাস বলে ২৬শে নভেম্বর ১৯৪৯-এর পর কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বসল, ২৪শে জানুয়ারী এবং ২৫শে জানুয়ারী ১৯৫০। ২৪শে জানুয়ারী আমাদের National Anthem (জাতীয় সঙ্গীত) গৃহীত হলো। ২৪ এবং ২৫শে জানুয়ারী কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সদস্যরা সই করলেন। অথচ মোদী সরকার দিনটা পালন করছে ১৯৪৯, ২৬শে নভেম্বর। অর্থাৎ মোদী সরকার যা করছে তা ইতিহাস বিকৃতি। সংবিধান বিরোধীরা সচেতনভাবেই আশ্রয় নিতে চাইছে বিকৃতির। এবং সে কারণেই পলিটিক্যাল ইভেন্ট হিসাবে ২৬শে নভেম্বর এই প্রস্তাবনা। সংবিধানকে অস্বীকার করার লক্ষ্যেই এই বিকৃতি।
আমাদের সংবিাধানে ঐতিহ্য এবং পরম্পরাকে আধুনিক ভারত গড়ার স্বপ্নের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে এবং আমাদের সংবিধান নিয়ে যথেষ্ট গর্ব করার কারণ আছে। সংবিধানের প্রথম বাক্যটি ÒWe the people of India’’ আমরা রাজতন্ত্র থেকে উত্তরণ ঘটাচ্ছি প্রজাতন্ত্রে, উত্তরণ ঘটাচ্ছি গণতন্ত্রে। Preamble-এ(প্রস্তাবনায়) যে কথাগুলো আছে, তা এক গভীর অন্তদৃষ্টিকেই স্পষ্ট করে। To secure justice, social, economicand political; liberty of thought, expression, belief, faith and worship; Equality of status and of opportunity; Fraternity assuring the dignity of the individual and the unity and integrity of the Nation – এই Preamble Uv Constituent Assembly-র সামনে প্রস্তাব হিসাবে যিনি রেখেছিলেন, তিনি জওহরলাল নেহেরু। Objective resolution হিসাবে এই বিষয়ে যথেষ্ট চর্চা হয়েছিল। এটা আমাদের সংবিধানের মূল সূত্রগুলিকে বেঁধে দিয়েচে, যেখান থেকে সরে আসবার মতো কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। বস্তুত পক্ষে দেশের সংবিধান রচনা করতে গিয়ে আলাপ-আলোচনা, যুক্তি-তর্ক যথেষ্টই হয়েছে। সংবিধানের ভ‚মিকা অত্যন্ত স্পষ্ট, ঋজু এবং সদর্থক। এটা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি এবং সমসাময়িক বিচারে একটি জরুরি দেশপ্রেমিক কর্তব্য হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে সংবিাধান রচয়িতা বাবাসাহেব আম্বেদকারকে আমাদের স্মরণ করতে হবে। আম্বেদকার বলেছেন : “On the 26th of January, 1950 we are going to enter into a life of contradiction. In politics we will have equality and in social and economic life we will have inequality. In politics we will be recognizing the principle of one man, one vote and one vote, one value. In our social and economic life we shall by reason of our social and economic structure, continue to deny the principle of one man one value. This is the contradictio” আম্বেদকর সতর্ক করছেন, যে সতর্কবার্তাটি আমাদের সকলের কাছে জরুরি। বলেছেন – “If we continue to deny it for long we will do so only by putting our political democracy in peril.
………….. We must remove this contradiction at the earliest or else those who suffer from this inequality will break the structure of this political democracy that this Assembly has so laboriously built.”
বাস্তবের চেহারা আ কিরকম? মানুষ বেঁচে আছে চরম দুর্দশায়। মানুষ বেঁচে আছে, খাদ্যের সুযোগ নেই। দারিদ্র, বেকারি ভয়ঙ্কর। শিক্ষিত যুবক-হাপিত্যেশ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কৃষক-শ্রমজীবী মানুষ সংকটে। কেন? অনাহার সূচকে আমরা তলায়, স্বাস্থ্য সূচকে আমরা তলায়। বৈষম্য এমন জায়গায় গিয়ে পৌছাচ্ছে যে, এক শতাংশের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত। একটা বিশাল অংশের মানুষ চরম দুর্দশায়। সংবিধানের নির্দেশ কতটা কার্যকর হচ্ছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার, ১৫ ধারার ধর্ম-বর্ণ-জাত-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান অধিকার কি পালিত হচ্ছে? কতটা হচ্ছে? ২১-এ ধারায় বলা হয়েছে শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, ক্রমশ রাষ্ট্র তা থেকে সরছে। শিক্ষার অবাধ বেসরকারিকরণ ঘটছে। পুষ্টি, ক্ষুধাসূচক কোথায় দাঁড়াচ্ছি? নির্দেশাত্ম নীতি – আমরা মানছি না। ৪১ ধারায় কাজের অধিকার মানছি না। ৪৩ ধারায় মজুরি, উপভোগের অধিকার, খুশির অধিাকার, মানছি না। সংবিধানে আমাদের সংস্কৃতির, সমৃদ্ধ প্রচীন ঐতিহ্যগুলিকে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে; অথচ বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে, অসুহিষ্ণুতা বাড়ছে, বিভাজনের রাজনীতি বাড়ছে। যেখানে সহিষ্ণুতা ছিল আমাদের সংস্কৃতির অংশ, সেখানে অসুহিষ্ণুতা ঐক্য-সংহতিকে তছনছ করছে। মানবিকতা, অনুসন্ধানের স্পৃহা, বিজ্ঞানমনস্কতায় কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। গণেশের মাথা নাকি প্লাস্টিক সার্জারি! অন্য কেউ নন, প্রধানমন্ত্রীর উবচা। স্টেম সেল নাকি তখনকার আবিস্কার, অতএব কর্ণ, আমরা পুরাণের মধ্যে চলে গেছি। পুরাণকে আমরা ইতিহাস এবং বিজ্ঞানের সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করছি! অপরাধ করছি। বিজ্ঞানমনস্কতার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছি। গোরুর দুধে সোনা পাওয়া যাচ্ছে, গোরুর মূত্র সর্ব রোগহরকর – এই যারা বলছেন, তারা দেশ চালাচ্ছেন, বিভিন্ন রাজ্য চালাচ্ছেন। আমরা সংবিধানের ভিত্তি থেকে মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে সরতে সরতে কোথায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছি? সংবিধানকে আমরা মান্য করছি না-ভ্রষ্ট করছি, সংবিধান প্রণেতাদের সম্মান করছি না, না অসম্মান করছি – ভেবে দেখতে হবে। দেশের পরিচালকরাই সংবিধানকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় লিপ্ত। রক্ষা করার দায়িত্ব মানুষকেই নিতে হবে।
স্বাধীন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদকে স্মরণ করা যাক। তিনি বলেছিলেন : After all, a Constitution like a machine is a lifeless thing. It acquires life because of the men who control it and operate it. India need today nothing more than a set of honest men – পুরুষ-নারী নির্বিশেষে তিনি একথা বলেছেন। রাজেন্দ্র প্রসাদ যে শর্তগুলো, যে স্বপ্নগুলো, যে ভাবনাগুলোকে উপস্থিত করেছিলেন আমরা তার কতটা কাছাকাছি যেতে পেরেছি তা বিবেচনা করা খুব জরুরি।
বস্তুত পক্ষে, যারা সংবিধানকে সবচাইতে বেশি ভাঙতে চাইছেন, তারাই আজ দেশের পরিচালক। তাদের দরকার ছিল সংবিধান দিবস নাম কোনো একটা ইভেন্ট-এর আশ্রয় নেওয়া। প্রতিটি সাংবিধানিক সংস্থার ক্ষেত্রে যারা সংবিধানকে ভাঙছেন তারা সেই সংবিধান দিবসের নামে কোনোকিছুর আশ্রয় নিতে চাইছেন। নির্বাচন কমিশন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সি.বি.আই, পাবলিক সার্ভিস কমিশন কিছুই এদের হাতে নিরাপদ নয়। বিরোধীহীন রাজনীতির পথ যারা খুঁজছেন তারা সংবিধান দিবসের আশ্রয় নিতে চাইছেন। দখলদারির রাজত্ব কায়েম করা ছাড়া যারা কিছু ভাবতে পারছেন না তাদের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। দল বদল, হেরে গেলেও সরকার বদল এবং ক্ষমতা দখল যাদের ভাবনা তারা সংবিধান দিবসকে অনৈতিকহাসিকভাবে ব্যবহার করতে চাইছে। গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশকে নষ্ট করা যাদের কাজ তারা এই সংবিধান দিবসের নামে একটি নতুন ইভেন্টের আশ্রয় নিচ্ছে। দৃষ্টি ঘোরাবার জন্য কাশ্মীর, কিংবা এন.আর.সি, ধর্মকে ভিত্তি করে নাগরিকত্বের অসাংবিধানিক আইন আনা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিকল্প আমাদের কাছে নেই। ইতিহাস বিকৃতির পথেই বিজেপি যাবে। ঐতিহ্য, পরম্পরা, মূল্যবোধ এগুলোকে বিকৃত করেই ওরা চলবে। আমাদের রুখতে হবে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের গভীর থেকে উঠে আসা বাস্তবতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এদেশের সংবিধান। আর.এস.এস. তা কখনোই মানতে পারেনি। তাকে বাতিল করার মনোভাবেই ২৬শে জানুয়ারীকে বদলে দেবার প্রচেষ্টা। আর সেই লক্ষ্যেই ২৬শে নভেম্বর বিজেপির পছন্দ। একটা নতুন ইভেন্ট হিসাবেই। আর সেই ইভেন্টের জুতোতেই পা গলায় এ রাজ্যের তৃণমূল। জাঁকজমক করেই ২৬শে নভেম্বর সংবিধান দিবসের শরিক তারাও। রুখতে হবে আমাদেরই। রুখতে হবে বিকৃতি। রক্ষা করতে হবে সংবিধান। এবছর আমাদের সংবিধান এবং প্রজাতন্দ্র ৭৩ বছরে পদার্পন করছে। ২৬শে জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে আমাদের সংবিধান ও প্রজাতন্ত্র রক্ষা করার শপথই গ্রহণ করতে হবে। এটাই কর্তব্য