প্রভাত পট্টনায়েক
এই বছরের অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার (আরও নির্দিষ্ট ভাবে বলতে হলে রিক্সব্যাঙ্ক পুরষ্কার) পেয়েছেন তিনজন মার্কিন অর্থনীতিবিদ। যে সকল কারন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে বা বাধা দেয়, সেই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা গবেষণা করেছিলেন, এ পুরস্কার তাকেই স্বীকৃতি দেয়। নিজেদের গবেষণায় তারা তুলে ধরেছেন যে এহেন উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের ঐ যুক্তি ‘নির্বাচনী গণতন্ত্রের’ মডেল হিসাবে পশ্চিমী প্রতিষ্ঠানসমুহের বৃদ্ধির জন্য সহায়ক। তাঁরা বলেছেন দুনিয়ার যেখানে যেখানে ‘ঔপনিবেশিকতা’ বসতি স্থাপন করে উপনিবেশ পরিচালনা করেছিল সেখানেই ঐসকল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান’-এর সুবাদে বিকাশ ঘটেছে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অন্যত্র যেখানে ঔপনিবেশিকতা ‘কেবলমাত্র মুনাফা নিষ্কাশনের প্রতিষ্ঠান’ হিসাবে সক্রিয় থেকেছে সেখানেই বিকাশের বদলে ক্ষতিকর প্রভাব দেখা গেছে।
তাদের এই গবেষণা অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ বলছেন তাদের যুক্তির কোন সারবত্তা নেই। পূর্ব এশিয়ায় দুর্নীতিমুক্ত থেকেই সাফল্যের সাথে উন্নয়ন ঘটেছে এবং সেখানে পাশ্চাত্যের ধাঁচায় গণতন্ত্রের কোনরকম প্রভাবই ছিল না। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমের দেশগুলিতে উন্নয়নের উচ্চহারে বৃদ্ধি ঘটার সময়েই দুর্নীতিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। অন্যরা যুক্তি দিয়েছেন যে বসবাসের জন্য উপনিবেশ এবং কেবলমাত্র লুঠের জন্য উপনিবেশের মধ্যে বৈসাদৃশ্যকে ব্যখ্যা করতে প্রথম গোষ্ঠীভুক্ত অঞ্চলগুলিতে বিদেশী অভিবাসীরা স্থানীয় জনজাতিগুলিকে যেভাবে পশ্চিমীদের ‘আত্মীয়’ হিসাবে গ্রহণ করার বিষয়টি মনে রাখা উচিত। এছাড়াও অনেকেই ঐ তিন অর্থনীতিবিদ যেভাবে পশ্চিমী প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রভুত পরিমানে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন এবং ঔপনিবেশিক শাসনে চরম নিপীড়ন চালানোর বিষয়ে নীরব থেকেছেন সেসবের সমালোচনা করেছেন।
আমাদের উদ্দেশ্য তাদের যুক্তিগুলি নিয়ে নিছক আলোচনা করা নয় বরং ‘উন্নয়ন/শ্রীবৃদ্ধি’ এবং ‘অনুন্নয়ন’ সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি সম্পর্কিত আলোচনায় একটি মৌলিক ত্রুটিকে চিহ্নিত করা। এটি এমনই এক ত্রুটি যা তাদের সমালোচকদের উপলব্ধিকেও চিহ্নিত করে, সে সমালোচকরা যত সঠিক কথাই বলে থাকুন না কেন। সেই ত্রুটি হল এই যে তারা দারিদ্রকে শ্রীবৃদ্ধির দ্বান্দ্বিক অনুষঙ্গী হিসাবে বিবেচনার পরিবর্তে ‘উন্নয়নের অভাব’ থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি হিসাবে দেখেছেন। তাদের এহেন ধারণায় যা অন্তর্নিহিত রয়েছে তা হল একটি জাতিগত দৃষ্টিভঙ্গি, যা বলে কয়েকটি দেশ কতিপয় ভাল (অন্তর্ভুক্তিমূলক- ইনক্লু্যুসিভ) প্রতিষ্ঠানের কারনে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে গেছে এবং অন্যরা খারাপ (লুণ্ঠনমূলক এক্সট্র্যাক্টিভ) প্রতিষ্ঠানগুলির সুবাদে পিছিয়ে পড়েছে। এমন ব্যখ্যায় যেটা অস্বীকার করা হয় তা হল ‘দুনিয়ার একটি অংশের এগিয়ে যাওয়াই আরেক অংশের পিছিয়ে পড়ার কারন’ অর্থাৎ ‘পুঁজিবাদের বৃদ্ধিই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে চলে’। প্রয়াত আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক একে ব্যখ্যা করতে নিজের একটি কথা ব্যবহার করতেন: ‘অনুন্নয়নের বিকাশ’, এতে বোঝানো হয় অনুন্নয়ন আসলে উন্নয়নের অভাব নয় বরং এ হল সেই উন্নয়নেরই একটি নির্দিষ্ট রূপ যাকে আমরা সাধারণভাবে ‘উন্নয়ন’ বলে মেনে নিতে শিখেছি। রিক্সব্যাঙ্ক পুরস্কারপ্রাপকদের গবেষণায় উন্নয়ন এবং অনুন্নয়নের মধ্যে বা বলা চলে দুনিয়ার এক প্রান্তে সম্পদের বিপুল বৃদ্ধির সাথে আরেক প্রান্তে দারিদ্র্যের সেই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের কোনও উল্লেখই নেই।
দারিদ্র্যের বৃদ্ধির সাথে সম্পদের বৃদ্ধির বা এরা যেভাবে বলতে চান যে কয়েকটি দেশের উন্নয়ন অন্যান্য দেশের অনুন্নয়নের সাথে যে মাত্রায় সম্পৃক্ত সেই ঘান্দ্বিকতার মূল কারণ হল এক অমোঘ সত্য যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শ্রীবৃদ্ধিটুকু অপরিহার্যভাবে আদিম সঞ্চয়ের প্রক্রিয়াতেই সম্পন্ন হয়। পুঁজি বাড়ে আর তাই ক্ষুদ্র উৎপাদকরা উৎখাত হন, সমাজে দারিদ্র আরও বৃদ্ধি পায়। পুঁজিবাদী সেক্টরের মধ্যে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সংখ্যা, যাদের সরাসরি শ্রমিক হিসাবে আত্তীকরণ করে, তারা কিন্তু এই দরিদ্রদের একটি ভগ্নাংশ মাত্র। আদিম পুঁজি সঞ্চয়ের শিকার যারা ‘ব্যবস্থার বাইরে’ রয়ে গেছে তাদের সংখ্যা পুঁজি আহরণের সাথে সাথে বাড়তে থাকে; অথবা, যদি তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যা বৃদ্ধি না পায় তবে হয় সেটা স্থির থাকে বা হ্রাস পায়, তবে তাদের মধ্যে দারিদ্র্যের পরিমাণগত বৃদ্ধি হয়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই জীবনযাত্রার একটি অধঃপতন লক্ষিত হয়। সিস্টেমের দ্বারা দরিদ্র সংখ্যার বৃদ্ধি বা এর বাইরে থাকা লোকের সংখ্যা এবং এই ধরনের ব্যক্তিদের দারিদ্র্যের পরিমাণ বৃদ্ধি এই সত্যকেই প্রমাণিত করে যে আদিম সঞ্চয় একটি অবিরাম প্রক্রিয়া।
এ ঘটনাটিই ব্যাখ্যা করে যে কেন এক মেরুতে সম্পদের সঞ্চয় হয় অথচ অন্য মেরুতে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদি সাধারণ সঞ্চয় প্রক্রিয়ার সামগ্রিকতার প্রসঙ্গে আমাদের ব্যাপক ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি না থাকে তবে এর কারণ বোঝার ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা রয়ে যাবে। যদি আমাদের মনোযোগ শুধুমাত্র এমন পরিস্থিতির একটি নির্দিষ্ট অংশের উপরেই আটকে থাকে তবে তা এক ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গীর জন্ম দেবে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত পুঁজিবাদের দীর্ঘ সাফল্য চলাকালীন, যখন পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে নিজেকে সুসংহত করেছিল, তখন সম্পদ ও দারিদ্রের এই দ্বান্দ্বিকতা নিম্নরূপ কাজ করেছিল। ব্রিটেন থেকে মহাদেশীয় ইউরোপ এবং কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ইউরোপীয় বসতির নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পুঁজিবাদের বিস্তার ছিল। এর জন্য প্রক্রিয়াটি ছিল বসতি স্থাপনকারী ঔপনিবেশিকতার এই অঞ্চলগুলিতে শিল্পের বিস্তৃতি, যা ব্রিটেনের দ্বারা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র এই অঞ্চলগুলি থেকে আমদানির জন্য তার বাজার উন্মুক্ত রাখা দিয়েই নয় বরং ব্রিটেন থেকে ব্যাপকভাবে বহির্গমনের সাথে সাথে তাদের এই অঞ্চলে ইউরোপের বাকি অংশগুলির কাছে মূলধন রপ্তানি করাও পুঁজির বিস্তারের অন্যতম কারণ।
নেপোলিয়নের যুদ্ধের শেষ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে ইউরোপীয় অভিবাসনের পরিমাণ কমপক্ষে পঞ্চাশ মিলিয়ন ছিল বলে অনুমান করা হয়। যারা স্থানান্তরিত হয়েছিল তারা তাদের অধিকৃত জমি থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করেছিল। এই উচ্ছেদ হওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা যুদ্ধে মারা যাননি, বা হালফিলের মতামত হিসাবে ‘উন্মোচিত নয়া রোগ’-র প্রকোপ থেকে মুক্ত ছিলেন, তাদের ‘সংরক্ষণের ঘেরাটোপ’র মধ্যে রাখা হয়। শুধু ব্রিটেন থেকেই অভিবাসন এত বেশি ছিল যে প্রতি বছর ব্রিটেনের জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির পঞ্চাশ শতাংশ এইসময়ের মধ্যে ‘নতুন বিশ্বের’ জন্য বৃটেন ছেড়ে গিয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।
যেহেতু ব্রিটিশ বাজার প্রাইমারী সেক্টর এবং নতুন শিল্পায়নকারী দেশগুলি থেকে শিল্প রপ্তানি উভয়ের জন্যই উন্মুক্ত ছিল, এবং ব্রিটেন নিজেও ঐসকল দেশগুলিতে মূলধন রপ্তানি করত, তাই এসব দেশে ব্রিটেনের তুলনায় আয়-ব্যয়ের ঘাটতিও অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও, ঐ অঞ্চলগুলি থেকে ব্রিটেনের আমদানি উদ্বৃত্ত স্বাভাবিকভাবে ব্রিটিশ অর্থনীতিতে কিছু বি-শিল্পীকরণ ঘটাতই যা বেকারত্ব এবং আমদানিকৃত পণ্যগুলির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বাজারকে রক্ষা করার জন্য চাপ সৃষ্টি করত। একে এড়ানো সম্ভব হয়েছিল কারণ ব্রিটিশ পণ্য, সর্বোপরি তুলাজাত বস্ত্র সহ যা শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং আরও যা কিছু তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদার চাইতে অনেক বেশি উৎপাদিত হচ্ছিল, সেগুলি ঐসব ক্রান্তীয় এলাকাভুক্ত উপনিবেশগুলিতে রপ্তানি করা হয়েছিল। এরিক হবস্বম ব্রিটেনের (ক্রান্তীয়) উপনিবেশগুলিতে ক্রমবর্ধমান বিক্রির কথা উল্লেখ করেছেন, এসবই হল সেই পণ্য যা কিছু ব্রিটেন নিজেদের দেশীয় বাজারে বিক্রি করতে পারেনি। এ ধরনের রপ্তানির ফলে ঐ সকল উপনিবেশগুলিতে শিল্পায়নের প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। সেখানকার ঐতিহ্যবাহী কারিগরী শিল্প এবং কারিগররা যাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল সুতা উৎপাদক এবং তাঁতিরা, তারা নিজেদের চিরাচরিত পেশা থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়। এদের বাধ্য হতে হয় জমির কাজে যুক্ত হতে, এর প্রভাবে ফলে খাজনা বৃদ্ধি পায়, মজুরিএ ব্যাপক হ্রাস ঘটে এবং ব্যাপক দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। .
সেই সময় ক্রান্তীয় এলাকার উপনিবেশসমূহের মধ্যে ‘শিল্পে উন্নয়নশীল দেশগুলি’র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনার তুলনায় ব্রিটেনের মোট আয়ব্যয়ের ঘাটতিকে দুটি জবরদস্তির কৌশল মারফত আড়াল করে রাখা হয়েছিল। প্রথম কৌশল ছিল ঐ সকল উপনিবেশগুলি থেকে রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া। দ্বিতীয় পন্থাটি হল উপনিবেশগুলি থেকে সম্পদের একমুখী নিষ্কাশন। কোনোরকম ক্ষতিপূরণের তোয়াক্কা না করেই ভারতের মতো দেশগুলি থেকে বার্ষিক রপ্তানি বাবদ উদ্বৃত্ত আয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই বিপুল সম্পদের সহায়তায় ব্রিটেন নিজেদের ঘাটতি (বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশ এবং অন্যান্য ‘নতুন শিল্পপতিদের’ সাথে ব্যবসায় যে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল) মেটাতে সফল হয়। এহেন বন্দোবস্তটি কাজ করেছিল কারণ ইউরোপীয় মহাদেশ, বর্ধিত বাজারের নিরিখে বিকশিত হতে থাকা নতুন বিশ্ব এবং জাপানের তুলনায় ক্রান্তীয় এলাকার উপনিবেশগুলিতে পণ্য রপ্তানি পরিমাণে উদ্বৃত্ত ছিল। ঐ দেশগুলির সাথে ভারতের পণ্যদ্রব্য রপ্তানি বাবদ বিশাল উদ্বৃত্ত সম্পদের পরিমাণ বহু দশক ধরেই সারা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ছিল। শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক পণ্য সরবরাহ করার ক্ষমতা থেকেই এ সম্পদ উদ্ভূত হয়। এ রপ্তানি দ্বারা উদ্বৃত্ত আয়ের সবটাই ব্রিটেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নিজেদের হস্তগত করে। ‘নতুন বিশ্ব-বাজারের’ সাথে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে সেই সম্পদই ছিল ভরসা। বিনামূল্যে বলার কারণ ব্রিটেন নিজেদের রপ্তানি পণ্যের জন্য কৃষকদেরকে ‘দেয়’ হিসাবে যা দিত সেটা ঐ দেশ থেকে প্রাপ্য খাজনা থেকেই দিত। বিপুল সম্পদের এমন লুন্ঠন সম্ভবত ক্রান্তীয় এলাকার উপনিবেশগুলিতে দারিদ্র্য সৃষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল।
বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশ এবং অন্যত্র সম্পদের এহেন বৃদ্ধিকে হবসবম ‘দীর্ঘ উনিশ শতক’ (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত প্রসারিত) বলে অভিহিত করেছেন তার উল্টোদিকে ক্রান্তীয় উপনিবেশগুলিতে (লুটের উপনিবেশগুলিতে, যেগুলো বসবাসের উপনিবেশগুলির থেকে স্বতন্ত্র) পর্যায়ক্রমিক দুর্ভিক্ষ সহ দারিদ্র্যের বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে ভারতের মতো দেশগুলি স্বাধীনতার সময় দরিদ্র ছিল। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ শিরিন মুসভির একটি প্রাসঙ্গিক অনুমান এখানে উল্লেখ করা উচিত। মুসভি ১৫৭৫ সাল নাগাদ আবুল ফজল কর্তৃক প্রদত্ত রাজস্বের পরিসংখ্যান থেকে মুঘল ভারতের মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করেছিলেন। এস সুব্রামানিয়ান কর্তৃক প্রদত্ত ১৯১০ সালের হিসাবের নিরিখে ভারতে মাথাপিছু আয়ের সাথে নিজের হিসাবের তুলনাও করেন। তুলনামূলক পরিসংখ্যানের সুবাদে তিনি ১৯১০ সালে সারা দেশে মাথা পিছু আয়ের হিসাব ১৫৭৫’র তুলনায় কম ছিল বলে প্রমাণ করেন।
গোটা উনিশ শতক জুড়ে ক্রান্তীয় উপনিবেশগুলি থেকে উদ্বৃত্তের একটি অংশ শোষণ/লুন্ঠন করে নেওয়ার মাধ্যমেই শিল্প পুঁজিবাদের বিস্তার সম্ভব হয়েছিল। ঐ পর্বে যে সমস্ত ‘নিত্যনতুন শিল্পপতি’দের বাজারে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়, উপনিবেশগুলি থেকে সম্পদ লুটের প্রক্রিয়ায় এটা কার্যত ব্রিটেনের সহায়ক বন্দোবস্ত ছিল। এ দুটি কৌশলই ছিল পুঁজি সঞ্চয়ের আদিম প্রক্রিয়ার অংশ। এরই সুবাদে একদিকে উপনিবেশগুলিতে আধুনিক অর্থে গণদারিদ্র্য চেপে বসে। উল্টোদিকে ঐ আদিম সঞ্চয়ের সুবিধাভোগ করেছিল ইউরোপীয় বসতির নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলগুলি। ঐ সকল এলাকায় সম্পদের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে এভাবেই। একদিকে সম্পদের সঞ্চয় আরেকদিকে দারিদ্র্যের চেপে বসা, এই ছিল এদের মাঝের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক।
কিন্তু বুর্জোয়া অর্থনীতি এই সত্যটুকু কোনোদিনও স্বীকার করবে না।
ডায়লেক্টিক্স অফ ওয়েলথ অ্যান্ড প্রপার্টি শিরোনামে
পিপলস ডেমোক্রেসী পত্রিকায় ২৭শে অক্টোবর ২০২৪ এ প্রকাশিত