১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ (সোমবার)
বর্তমান শতকের শুরু থেকেই আমাদের রাষ্ট্র পুঁজির লুঠকে তীব্রতর করতে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে প্রথমেই নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে গুজরাটে। বিপুল পরিমাণ জমি থেকে কৃষকদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে তা বৃহৎ পুঁজির মালিকদের হাতে তুলে দেয়। কয়েক বছরের মধ্যেই সারা দেশের জমির অধিগ্রহণ শুরু ব্রিটিশ আমলের তৈরী অধিগ্রহণ আইনে। রাজ্যে রাজ্যে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। তৎকালীন ইউ.পি.এ সরকার আলোচনার মাধ্যমে নতুন আইন করে ২০১৩ সনে।
পরের বছরই বিজেপি সরকার এসে সে আইন বাতিল করে সংশোধনী মারফত। আন্দোলন শুধুমাত্র জমি অধিগ্রহণে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ’৯০ -এর দশক থেকে দেশে কৃষি সংকট দেখা দেয়। দেশের অর্ধেক কৃষকই কৃষি অলাভজনক হওয়ার কৃষি কাজ বন্ধ করতে চায়- চায় বিকল্প কর্মসংস্থান। কৃষি উৎপাদন ব্যায় বৃদ্ধি এবং কৃষি পণ্যের লাভজনক মূল্য না পেয়ে গভীর সংকটে কৃষি। কৃষি পণ্যের উৎপাদন ব্যায়ের অনেক কম কৃষি পণ্যের সহায়ক মূল্য হিসাবে সরকার ধার্য করে। চুক্তি চাষে বাধ্য করে কৃষককে গোলামে পরিণত করতে চায়। রাষ্ট্র ক্রমশ কৃষি ও কৃষককে সহায়তা দেবার কাজ থেকে বিরত হয়।
আমাদের রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার নানাভাবে কৃষককে সহায়তা দেবার চেষ্টা করে। কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বনিম্ন সহায়ক মূল্য থেকেও বাড়তি টাকা দিয়ে সর্বত্র সরকারী ক্রয় ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সমবায় এবং স্বনিযুক্ত গ্রুপ গুলিকে ব্যাপকভাবে একাজে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। ফলে দেশে কৃষি সংকটের সময়ে এরাজ্যের কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধি সর্বদাই থেকেছে শীর্ষ স্থানে। ’১১ সনের পরে এখানেও নেমে আসে সংকট।
ইউরোপের গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার পর সমস্ত কৃষক জমির মালিকানা পায়। কিন্তু কৃষিতে পুজিবাদী অনুপ্রবেশের ফলে, অর্থাৎ কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি এবং কৃষি পণ্য মূল্য হ্রাসের ফলে কৃষক জমিহারা হতে থাকে। কৃষি পণ্য এবং কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণের সমগ্র ব্যবসায় দখল নেয় পুঁজিপতিরা। কৃষক জমিহারা হয়ে ক্রমশ জমির কেন্দ্রীভবন হতে থাকে। বর্তমান ৫-৭ শতাংশের হাতে ইউরোপের কৃষি জমি। আমেরিকার ৩ শতাংশের ও কম সংখ্যক। সামান্য মজুর ব্যবহার করে যন্ত্রের সাহায্যেই সমস্ত কৃষি উৎপাদন সংগঠিত হচ্ছে।
বর্তমান ভারতরাষ্ট্র চাইছে ইউরোপের মতো জমির কেন্দ্রীভবন এবং কৃষির উপকরণ এবং কৃষি পণ্যের সমগ্র ব্যবসার উপর পূর্ণ দখলদারী। তাই দেশের কৃষক যখন প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছে, যখন ফসলের লাভজনক দাম চাইছে, সরকারী সহায়তা তুলে দেবার প্রশ্নে বিরোধিতা করেছে, রাষ্ট্র অনড়। বিভিন্ন রাজ্যে দমন নীতির পথ নিয়েছে। মধ্যপ্রদেশের মন্দশোরে গুলি চালিয়ে আন্দোলনরত কৃষকদের খুন করেছে।
আক্রমণ তীব্রতর হওয়ার ফলে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়- ক্রমশ আন্দোলন ছড়িয়ে যায়। সবচেয়ে তীব্রতা লাভ করে মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশে। ক্রমশ অনেক বেশি সংগঠন আন্দোলনে যুক্ত হয়। গড়ে ওঠে সংগ্রামী মোর্চাদারী ৫০০ কৃষক সংগঠন যুক্ত ভাবে আন্দোলন পরিচালনায় সামিল হয়। ঐক্য গঠনে এবং নতুন দাবি সংযোজনে সারা ভারত কৃষক সভার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একই সাথে অন্য অংশের দাবীও উত্থাপন করা হয়। বিশেষত রেগায় বরাদ্দ বৃদ্ধি রাখার ক্ষেত্রে। সরকার নানা প্রকার বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টায় ব্যার্থ হয়। দমন-পীড়নেও আন্দোলন বন্ধ হয়নি। বরং প্রসারিতই হয়েছে। নাসিক থেকে মুম্বাই বা হিসার থেকে জয়পুর অভিযানে সক্রিয় সহায়তা এগিয়ে এসেছে অন্য আংশের শ্রমজীবী মানুষ। কৃষকের লড়াইতে সামিল খেতমজুর। তারপর শ্রমিকরা এগিয়ে আসে সক্রিয় সহায়তায়। যুক্ত কর্মসূচী বার বার সংগঠিত হয়। দেশে শুরু হলো করোনা মহামারী। চীন দেশে তা শুরু। মহামারি কীভাবে হচ্ছে? তার ফলাফল কী? কেমন করে মোকাবিলা করতে হবে? সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিল। সেই চীন দেশেও আমাদের তুলনায় নগণ্য মৃত্যু হয়েছে। কারণ দেশের সরকার মানুষকে বাচাতে নয়- দেশের বৃহত্তম জনসংখ্যা কৃষকদের লুটের পরিকল্পনা করতে সে সময় বেশি ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তারা কোনো বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না নিয়ে, কোন কৃষক সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের মতামত না নিয়ে তিনটি কৃষি আইন পাশ করিয়ে নেয় প্রায় বিনা আলোচনায়। পুঁজিপতিদের পৌষ পার্বন এসে যায়, কিন্তু দেশের কৃষকদের সর্বনাশ।
কৃষক স্বেচ্ছায় চুক্তি করে নিজেদের করবে বৃহৎ মালিকের দাসানুদাস। তাদের স্বার্থে, তাদের নির্দেশে, তাদের নির্দিষ্ট দামে ফসল বিক্রি করবে, তাদের নির্দিষ্ট ফসল কৃষক তৈরী করবে। তৈরী ফসলও তাদের হাতে তুলে দিতে কার্যত বাধ্য থাকবে। আর বৃহৎ মালিকরা তাদের নির্দিষত দামে কৃষি পণ্য কিনবে। সরকারী হস্তক্ষেপ! কখনই নয়। মজুতদারীর অবাধ সুযোগ থাকবে, থাকবে যত খুশি মুনাফার সুযোগ। এমন খাসা চুক্তিই পাশ করানো হল।
এবার দিল্লীর চারিপাশের সমস্ত রাজ্য থেকে সংগঠিত হয় দিল্লী অভিযানে। সরকার মারমুখী – দেশের কৃষকদের দাবী জানাতে রাজধানীতে আসা চলবে না। শুরু হয় আক্রমণ। তারা রাজধানীতে প্রবেশ পথ খুড়েও কৃষককে আটকাতে চেয়েছে। সেখানেই কৃষক বসে পড়েছে। ট্রাক্টার দাড় করিয়ে তাঁবু খাটিয়ে চলল মাসের পর মাস – পার হয়ে গেল বছর। এলাকা থেকে আসছে খাদ্যের যোগান। পথে খাবার যোগান দিচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা – আসছে নানা প্রকার সহায়তা। বছর পার হয়ে যাচ্ছে। প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দেশে, প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। বিশ্বের বৃহত্তম কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে এমন প্রচার ছড়িয়ে পড়ে। মোদি মুখ লোকাবে কোথায়? সারা দেশে দু দফায় তিনদিন ধর্মঘট পালন করা হয়। দেশের ৭০০ জেলায় সংগঠিত হয় আইন অমান্য। কয়েক দফায় সারা দেশে রাজ্য ও জাতীয় সড়কে ট্রাক্টর সহ কৃষকের বিপুল বিক্ষোভ সমাবেশ সংগঠিত হয়। শাসকদের সমগ্র সাম্প্রদায়িক বিভেদের উদ্যোগ সম্পর্কে সকলেই সচেতন। কৃষক আন্দোলন এ অপচেষ্টাকেও আনেকটা প্রতিহত করতে পেরেছে। যে মুজফ্ফর নগর দাঙ্গায় কলঙ্কিত, সেখানেই হলো বিশাল খাপ পঞ্চায়েত সমাবেশ – হিন্দু, মুসলমান সকলেই সামিল। একসাথেই এসেছে কৃষকের দাবী জানাতে।
সারা দেশে প্রতিবাদে সোচ্চার। পশ্চিমবাংলা সহ সমস্ত রাজ্যে কৃষক সমাবেশ হয়। সমস্ত রাজ্য থেকে কৃষকরা অবস্থানরত কৃষকদের পাশে সমবেত হয়। আন্দোলনের প্রতি সমর্থন- সহানুভূতি উপচে পড়তে থাকে। বছর পার হবার পর আলোচনা। শেষ পর্যন্ত কৃষকের দাবী মানার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বেইমানদের বিশ্বাস নেই। আগে আইন প্রত্যাহার করবে, তবেই কৃষক চলে যাবে – দিল্লী ঘেরাও প্রত্যাহৃত হবে। শেষ পর্যন্ত তাই করতে হয়েছিল। তবেই ঘেরাও প্রত্যাহৃত হয়।
আন্দোলন সারা দেশে হলেও বিভিন্ন রাজ্যে পরিস্থিতি পরিবেশের পার্থক্য সুপষ্ট। কৃষি পণ্যের বিক্রয় ব্যবস্থায়ও যথেষ্ট পার্থক্য। কেরালা ধানের দাম দেয় কুইন্ট্যাল প্রতি ২৯০০টাকা, ছত্রিশ গড়ে ২৮০০ টাকা, আবার পশ্চিমবাংলায় সরকার নির্ধারিত ১৯৫০ টাকাও পায়না। এখানে ফোড়েদের কাছে বিক্রি করতে হয় ১৪০০/১৫০০ টাকায়। জমির কেন্দ্রীভবন ও সব রাজ্যে সমান নয়। পঃবাংলায় বামফ্রন্টের ভূমি সংস্কার কর্মসূচীর ফলে বৃহৎ মালিকানা নেই। তাই ভূমি ব্যবস্থা, বাজার, রাজ্য সরকারগুলির ভূমিকায় পার্থক্য স্পষ্ট।
আমাদের রাজ্যে কৃষক, কৃষি পণ্যের দামে যেমন বঞ্চিত, রাজ্যের কৃষির ক্ষেত্রেও বর্তমানে সরকারী সহায়তা আর মিলছে না। তাছাড়া নানা ভাবে বর্গাদার-পাট্টাদারদের উৎখাতের চেষ্টা চলছে। এমনকি তাদের নামও উপরতলা থেকে রের্কডে বাদ দেওয়ার উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সারা দেশের ন্যায় এখানেও দেউচা-পাচামীতে জমি থেকে আদিবাসীদের উৎখাতের জন্য চেষ্টা চলছে। চলছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনও। অন্য আনেক স্থানে এ ধরণের অনেক উদ্যোগ আছে। সম্প্রতি আদানীদের বিদ্যুৎ ব্যবসার (বাংলা দেশে বিদ্যুৎ সরাবরাহ) কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে।
সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কৃষকদের দাবীর মান্যতা পেলেও আজও তা কার্যকর করা হয়নি। সরকারের এ আচরণ আকস্মিক নয়। তাই এ আন্দোলন চলবে সংগ্রামী কৃষক তার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত বর্তমান শাসকদের উৎখাত না করে কৃষকের দাবী কার্যকর হবে না। তাই স্বৈরাচারী শাসকদের উৎখাত করেই কৃষি ও কৃষককে তথা দেশবাসীকে রক্ষা করতে হবে। ২৪শে আগষ্ট দিল্লীতে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এবং শ্রমিক সংগঠনের কনভেনশনে সেই আহ্বানই জানানো হয়।