The Crisis of Liberalism

প্রভাত পট্টনায়েক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন। তার জয় বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়, দুনিয়াজুড়ে যে সাধারণ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এটা তারই অন্তর্গত। আজকের পৃথিবীতে উদারবাদী রাজনীতির কেন্দ্রীয় ধারণাটি বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। যেখানে যেখানে বামপন্থী রাজনীতি নিজেকে সংহত ও শক্তিশালী অবস্থায় ধরে রাখতে পেরেছে, সেখানে জনমত তাদেরই সমর্থন জানাচ্ছে, অন্যথায় সেই সমর্থন ঢলে পড়ছে উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রতি। বর্তমান অবস্থায় নয়া ফ্যাসিবাদই হল উগ্র দক্ষিণপন্থার চেহারা। সম্প্রতি ফ্রান্সের নির্বাচনেও এই প্রবণতা স্পষ্ট ছিল, নয়া ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে ফরাসী জনসাধারণ নিতান্ত তাড়াহুড়ো করে গড়ে ওঠা বামপন্থী ফ্রন্টকেই সমর্থন জানিয়েছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছে। রাষ্ট্রপতি পদে বামপন্থী প্রার্থীর প্রতি কিছুটা আকস্মিক ভাবেই জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন দেখা গেল। এমনকি সে সেদেশের সংসদ নির্বাচনেও বিপুল জয় পেয়েছে বামপন্থীরা। এসবই হল উদারবাদী রাজনীতির দুর্বল হয়ে পড়ার লক্ষণ।

Neoliberalism

এখন প্রশ্ন হল, এমনটা ঘটছে কেন? কারণ আজকের দুনিয়ায় উদারবাদী রাজনীতি মূলত উদার অর্থনীতির সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদার অর্থনীতি এখন গভীর সংকটগ্রস্থ অবস্থায় চলেছে, ফলে জনসমর্থন তার বিরুদ্ধে চলে গেছে।

ধ্রুপদী উদারবাদের রাজনৈতিক দর্শনই উদারবাদী রাজনীতির কর্মসূচি নির্ধারণ করেছিল। একদিকে ধ্রুপদী রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র (ক্ল্যাসিক্যাল পলিটিক্যাল ইকোনমি) আরেকদিকে নয়া-উদার অর্থনীতি (নিও-ক্ল্যাসিক্যাল ইকোনমিকস)-র উপরে নির্ভর করে  উদারবাদের রাজনীতি এক দীর্ঘকাল যাবৎ নিজেকে টিকিয়ে রেখেছিল। এই দুটি অবলম্বনেরই মূল কথা অবশ্য একই। উভয়েই মুক্ত বাজারের ক্ষমতায় আস্থাশীল, মুক্ত বাজার নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বন্দোবস্তটি এরা সবার আগে ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ই মুক্ত বাজার অর্থনীতির সমর্থনে হাজির করা যুক্তিসমূহ খারিজ হয়ে যায়। কার্যত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণই ছিল ঐ বন্দোবস্ত ভেঙে পড়া। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ঐতিহাসিক মন্দার (গ্রেট ডিপ্রেশন) প্রভাব। আমরা পুঁজিবাদের ‘যথেচ্ছাচার নীতি’র কথা জানি। কেইনস দেখালেন অমন নীতির সুবাদেই বিচ্ছিন্ন কতকগুলি উত্তেজনার পর্ব ব্যতিরেকে (যখন সবই ঠিক চলছে বলে মনে হয়) পুঁজিবাদ ইচ্ছা করেই কর্মক্ষম শ্রমশক্তির এক বিরাট অংশকে কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখে, বেকার করে রাখে। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এ হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিজস্ব গঠনগত বৈশিষ্ট। তাঁর যুক্তি ছিল মুক্ত বাজার ব্যবস্থাকে সমস্যার সমাধানে সর্বরোগহর দাওয়াই হিসাবে তুলে ধরা হলেও বাস্তবে সে আদৌ তেমন কিছু না, বরং এর জন্যই পুঁজিবাদ বারংবার গভীর সংকটে পড়ে। এহেন সংকট পুঁজিবাদকে উচ্ছেদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, একের পর এক দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। কেইনসের মতামত ছিল সমাজতন্ত্রের বিপদের সামনে যদি টিকে থাকতে হয়, তবে একগুঁয়েমি ছেড়ে পুঁজিবাদকে উদার হতেই হবে। আধুনিক সময়ের উপযুক্ত উদারবাদী বন্দোবস্তের প্রস্তাবটি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত, তিনি নিজেই একে নয়া-উদারবাদ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ধ্রুপদী উদারবাদে বাজারের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে সরাসরি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল, কেইনস সে পথে এগোলেন না। বাজারের মোট চাহিদা যাতে দুর্বল না হয়, কর্মসংস্থানের হার যাতে হ্রাস না পায়, সেজন্য তিনি বাজারের উপর দীর্ঘকালব্যাপী রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রস্তাব দিলেন।

লগ্নী পুঁজি অবশ্য কেইনসের মতামত মেনে নেয়নি। তাঁর তত্ত্বের গুরুত্ব উপলব্ধিতে ফাঁকি রয়েছে, এই বলে তিনি নিজেও যুক্ত হাজির করেছিলেন। যদিও এর কারণ ছিল আরও গুরুতর। কেইনসের তত্ত্বকে মেনে নিলে প্রমাণ হয়ে যেত পুঁজিবাদ একটি অমানবিক ব্যবস্থা, মালিকের জন্য মুনাফা নিশ্চিত করা ব্যতীত অন্য কোনও সামাজিক ভূমিকাই এর নেই। রাষ্ট্র তার ঘাড় ধরে কর্মসংস্থান, চাহিদা ইত্যাদি প্রশ্নে ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই পুঁজিবাদ চিরকাল নিজের চলার পথে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ কিংবা নিয়ন্ত্রণকে খারিজ করতে চেয়েছে। লগ্নী পুঁজির কারবারীদের কেইনস নিজের তত্ত্বে যেভাবে দায়হীন বিনিয়োগকারী (ফাংশনলেস ইনভেস্টরস) বলে চিহ্নিত করেছিলেন, তাতেই তারা আরও ভয় পেয়ে যায়। লগ্নী পুঁজির সেই ভয় আজও রয়ে গেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে কেইনসের মতামতকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে পালন করা শুরু হল। ঐ যুদ্ধ লগ্নী পুঁজির কারবারে বিরাট ধাক্কা দেয়, দুনিয়াজুড়ে সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্রের পক্ষে সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেই সমর্থনের জোরেই কেইনসের মতামত প্রতিষ্ঠিত হয়।

যুদ্ধ পরবর্তী যুগে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে পুঁজির কেন্দ্রীভবন লক্ষ্যনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। সেই বন্দোবস্ত এমন পর্যায়ে বিস্তৃত হয় যাতে লগ্নী পুঁজি ক্রমশ আন্তর্জাতিক শক্তি হিসাবে সামনে চলে আসে। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্বেও বিভিন্ন ছোট বড় অর্থনৈতিক সংকটের পরিস্থিতি তৈরি হতে থাকে। বাজারে চাহিদা কমতে থাকার কারণে নয়, ১৯৬০-র শেষদিক থেকে ১৯৭০-র শুরুর দিক অবধি ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতিই ঐ সংকট তৈরি করে। এর প্রকৃত কারণ ছিল দুটি। প্রথম, উচ্চহারে কর্মসংস্থান! যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের জন্যই শ্রমের বাজারে মজুত বাহিনী (বেকারদের লম্বা লাইন, যার জোরে মজুরির হার নির্ধারণের সময় দর কষাকষির লড়াইতে মালিক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে) অনেকটাই সংকুচিত হয়। এমনটা ঘটলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির উপরে শ্রমের বাজারের ‘স্থিতিশীল প্রভাব’ (স্টেবিলাইজিং ইনফ্লুয়েন্স) বাতিল হয়ে যায়। দ্বিতীয় কারণটি ছিল উপনিবেশগুলির হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। আন্তর্জাতিক বাজারে একান্ত জরুরী পণ্যসামগ্রীর (প্রাইমারী কমোডিটি) দাম কম রেখেও মুনাফার হার বজায় রাখার জন্য ঔপনিবেশিক শাসনের জোরে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে নিংড়ে নেওয়া হত। সেই ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেলে জরুরী পণ্যের দামও আর আগের অবস্থায় রাখা যায় না। এহেন সংকটের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি কেইনসীয় অর্থনীতিকে অকেজো ব্যবস্থা হিসাবে চিহ্নিত করার সুযোগ পেয়ে যায়। কেইনস যা বলেছিলেন তাতে পুঁজিবাদের দু’পায়ে বেড়ি পরিয়ে রাখার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। নতুন সংকটের অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের ভরসা (কনফিডেন্স অফ দ্য ইনভেস্টরস) যোগাতে সেই বেড়ি ছিঁড়ে ফেলার পক্ষে যুক্তি হাজির করা হল। কেইনস’কে খারিজ করার মধ্যে দিয়ে কার্যত উদারবাদী রাজনীতিকেই খারিজ করা হল। দুনিয়াজুড়ে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা তো বটেই এমনকি একাংশের স্বঘোষিত বামপন্থীরাও ঐ সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার অজুহাতে নয়া-উদারবাদের অনুসারী হল।

নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই উন্নত দেশগুলিতে শ্রমিক শ্রেণীর উপরে অপরিসীম দুর্ভোগ নেমে আসে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে শ্রমজীবী জনসাধারণের অবস্থা আরও খারাপ, প্রতিদিন সেই দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংকটগ্রস্থ হওয়ার আগে থেকেই এমন পরিস্থিতি ছিল, সংকটে পড়লে যন্ত্রণা আরও বাড়ে। যতদিন বাজারের উপরে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল, নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার তার চাইতেও কমে যায়। ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের বাজারদর সংক্রান্ত বুদবুদ ফেটে যায়। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় আয়ের বৈষম্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, তার ফলে ক্রমাগত অতিরিক্ত উৎপাদনের প্রবণতা দেখা দেয়। একে চেপে রাখতেই নিজেদের সম্পদের বাজারদর ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়ে সার্বিক চাহিদাকে স্থিতিশীল রাখতে কোনরকমে সামাল দেওয়া হচ্ছিল। সেই বুদবুদ ফেটে গেলে সংকট দেখা দিল। নয়া উদারবাদী বন্দোবস্তে এহেন সংকট থেকে মুক্তির কোনও উপায় নেই। কেইনসের মতবাদে চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ ছিল, কিন্তু নয়া উদারবাদ সেই বন্দোবস্তকে আগেই বাতিল ঘোষণা করে দেওয়ায় বাজারদরের একটি বুদবুদ ফেটে গেলে আরেকটি বুদবুদ তৈরি করা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। এহেন সংকটের অবস্থা সম্পর্কে ইতিমধ্যে দুনিয়াজুড়ে মানুষ বেশ কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জন করায় কোনোভাবেই সংকট এড়ানোর পথ খোলা থাকছে না, সেটা বুঝতে শুরু করলো। চাহিদার সার্বিক অবনমনের পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে আগের চাইতে আরও বেশি হারে মুনাফার টোপ দেখিয়ে (মার্ক আপ) মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে চলা ছাড়া নয়া উদারবাদের আর কিছু করার নেই। এহেন কৌশলে সংকট কমে না, বরং প্রতিবার আগের চাইতে আরও বড় আকারে সামনে আসতে থাকে।

নয়া উদারবাদী পরিকল্পনার স্বার্থরক্ষার জন্য আজকের উদারবাদ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জনসাধারণের হিতাকাঙ্খী হিসাবে তার সেরকম কিছুই করার নেই। তাই এমন বন্দোবস্তের প্রতি বিরক্ত হয়ে জনসাধারণ যে ক্রমাগত হয় বামপন্থা নাহলে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিকে সরে যাচ্ছে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে অতি দক্ষিণপন্থাও জনসাধারণকে মুক্তি দিতে পারবে না, নির্বাচনের আগে তারা যত কোথায় বলুক না কেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসার পরে তারাও নয়া উদারবাদী পথেই এগোয়। ইতালিতে জর্জিয়া মেলোনি ঠিক তেমনটাই করেছেন। মেরিন লে পেনের দলের  পক্ষে ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী জর্ডান বার্দেল্লা তো নির্বাচনের আগে থেকেই নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির প্রতি তাদের মনোভাবও তখনই বোঝা গিয়েছিল। উদারবাদী রাজনীতি সাধারভাবে উদ্ভূত সংকটকে এড়িয়ে গিয়ে সমাধানের রাস্তায় হাঁটে, কিন্তু নয়া উদারবাদের পক্ষে দাঁড়ানো আজকের দক্ষিণপন্থা তেমনটা করে না। তারা সংকটকে সংকট হিসাবেই চিহ্নিত করে, কিন্তু তার কারণ হিসাবে দায়ী করে দেশের মধ্যে বসবাসকারী সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের। এদের প্রতি ঘৃণা প্রচার চালিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাবতীয় দুর্ভোগের জন্য দায়ী ঐ ‘ওরা’। এখানেই আজকের দক্ষিণপন্থার সাথে ধ্রুপদী উদারবাদী রাজনীতির পার্থক্য। ব্যাপক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের আধিপত্য কায়েম রাখতে রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থা ক্রমশই নয়া ফ্যাসিবাদের দিকে হেলে পড়তে থাকে। এতে উদারবাদ জনমানসে নিজেদের জমি হারাতে থাকে। আজ যখন আমরা বলছি উদারবাদ সংকটগ্রস্থ, সেই পরিস্থিতির অন্যতম কারণই হল ঐ জমি হারানো।

কেউ তর্ক করতে পারেন যে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর যাই হন, তিনি মেলোনি নন। তাদের যুক্তি সম্ভবত এই যে, চীন তো বটেই এমনকি খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের থেকেও আমেরিকাকে সুরক্ষিত রাখার মতো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ট্রাম্পের রয়েছে, ফলে তিনি মেলোনির মতো আগেকার নয়া উদারবাদী পন্থা আঁকড়ে থাকবেন না। এই বিতর্কে অনেক কথাই বলা যায় যার কিছু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের আগে থেকে এখনও অবধি ট্রাম্পের তরফে আমেরিকার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হিসাবে মুক্ত বাণিজ্য নীতি খারিজ করে দিয়ে তাকে নিজেদের দেশের ভৌগলিক সীমানার ঘেরাটোপে আটক রাখার মতো তেমন কিছু ঘোষণা করা হয়নি। এমনও কিছু বলেননি যাতে মনে হয় তিনি নয়া উদার অর্থনীতির বিকল্প কোনও রাস্তায় এগোবেন। যদি আগামীদিনে আমেরিকার বাণিজ্যনীতিকে দেশের মধ্যেই আটকে রাখা হয়, তাহলেও মনে রাখতে হবে ব্যাপারটা ট্রাম্প শুরু করছেন না, ওবামার সময়েই তার সূত্রপাত হয়েছিল। এমন সিদ্ধান্তে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে তেজী ভাব তৈরি হয় না, কারণ এর ফলে অভ্যন্তরীণ বাজার প্রসারিত হতে পারে না। ঐ অবস্থায় বাজার প্রসারিত করতে গেলে পথ দুটি। হয় সরকারি তহবিল থেকে জনস্বার্থে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, অথবা বাড়তি আয়ের জন্য ধনীদের উপরে বাড়তি কর চাপাতে হবে। এই দুটি পথই লগ্নী পুঁজির ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ চাপানোর সমার্থক। কিন্তু ট্রাম্প ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করেছেন, নির্বাচনী বক্তৃতায় ঘোষণাও করেছেন যে কর্পোরেটদের কর কমানোর জন্য তিনি খুবই উৎসাহী। তিনি কিছুতেই সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধির রাস্তায় হাঁটবেন না। কারণ অর্থনৈতিক সুরক্ষার নামে আমেরিকার বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দেবে এবং পুনরায় সংকট ফিরে আসবে।

যেভাবে দুনিয়াজুড়ে উদারবাদী রাজনীতি কোনঠাসা হচ্ছে তাতে ট্রাম্পের জয় অবশ্যই প্রত্যাশিত ছিল। এতে বোঝা যায় যে, নয়া উদার অর্থনীতির মৌলিক বোঝাপড়া সম্পর্কে ট্রাম্পের অবস্থান জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট নয় কিন্তু মনে রাখতে হবে এহেন সিদ্ধান্তে কাজের বাজারে সাময়িক আশা তৈরি হলেও ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির বিপদ বেড়ে চলে। সস্তায় আমদানি করার সুযোগকে বন্ধ হলে সেই পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে বিচার করলে এমন পরিস্থিতি বামপন্থার উত্থানের জন্য অনুকূল। বামপন্থাই একমাত্র রাজনীতি যা নয়া উদারবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে পারে। চলতি যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরিস্থিতিগুলির নিরসনও করতে পারে কেবল তারাই। উদারবাদ এর একটি সমস্যারও আর কেউ সমাধান করতে পারবে না। কেন পারবে না সে সম্পর্কে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। এ দুটি ঐতিহাসিক কর্তব্যের কার্যকরী সমাধানের জন্য বামপন্থীরা প্রস্তুত থাকুন, এটাই সময়ের দাবী। 

পিপলস ডেমোক্র্যাসির ১৭ নভেম্বর, ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত

Spread the word

Leave a Reply