ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতকে একটি ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্রে পরিবর্তন করতে চাইছে আরএসএস। অথচ দেশের জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরা সমাজের সমস্ত অংশের মানুষকে নিয়ে দেশকে একটি আধূনিক, সমৃদ্ধশালী ভারত হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আজ আরএসএস-বিজেপি তার বিপরীতদিকে ভারতকে নিয়ে যেতে চাইছে। দেশকে এবং সংবিধানকে রক্ষা করার লক্ষ্যেই আমাদের এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে হবে। বৃহস্পতিবার পাঞ্জাবের লুধিয়ানা জেলার আইতিয়ানা গ্রামে ভাকরা নাঙ্গাল কর বিরোধী আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে এক জনসভায় একথা বলেন সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পাঞ্জাবের কংগ্রেস সরকার নবগঠিত ভাকরা নাঙ্গাল প্রকল্পের সেচের জলে কর বসানোয় কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ঘনিয়ে ওঠে। ১৯৫৯-এ এই আন্দোলন তুঙ্গে উঠে গোটা দেশে ইতিহাস সৃষ্টি করে। ইয়েচুরি সেকথা স্মরণ করেন এদিনের সভায়।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরে পাঞ্জাব প্রদেশ প্রায় আড়াআড়ি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। ভারতের দিকে থাকে আজকের পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং হিমাচল প্রদেশের কিছু অংশ। প্রধানত কৃষিজীবী অঞ্চল। কিন্তু আধুনিক সেচ ব্যবস্থার অভাবে মরশুমের একটা বড় সময়ে কৃষিকাজ ব্যাহত হতো। সমস্যার সমাধান করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে সিদ্ধান্ত হয় শতদ্রু নদীর ওপর একটি বাঁধ তৈরি করা হবে। ভাকরা নাঙ্গাল বাঁধ। এই বাঁধের জলকেই সেচ খালের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। গোল বাধে ১৯৫৯ সাল নাগাদ। পাঞ্জাব সরকার বাঁধ তৈরিতে ব্যাপক অর্থ ব্যয় হচ্ছে মনে করে, যেহেতু বাঁধের জলে লাভবান হবে কৃষকরা, তাই প্রকল্পের ব্যয়ভারও তাদের ওপরেই চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ‘বেটারমেন্ট লেভি’ বা ‘ভালো থাকার কর’ জারি হয় রাজ্য জুড়ে। একর প্রতি ১০টাকা কর ধার্য করা হয় কৃষকদের ওপর। ব্রিটিশ আমলেও একই ধরনের কর চাপাতেন বিভিন্ন পরগণার জমিদারেরা। সেই ধারাবাহিকতাই পাঞ্জাব জুড়ে চালু হওয়ায় রুখে দাঁড়ালো কৃষকসভা। প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড হরকিষেণ সিং সুরজিতের নেতৃত্বে জেলায় জেলায় গড়ে উঠলো স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী। রাজ্যের গ্রামে গ্রামে প্রান্তিক এলাকায় ঘুরে ঘুরে এই করের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করলেন এই বাহিনীর সদস্যেরা। পাঞ্জাবের একের পর এক গ্রামে রীতিমত সাড়া ফেলে দিল কৃষকসভার এই আন্দোলন। প্রাথমিকভাবে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী প্রতাপ সিংহ কাঁয়রো ভেবেছিলেন এই বিক্ষোভ সাময়িক। অচিরেই ভুল ভাঙে তাঁর। এমনকি কংগ্রেসের সমর্থক সাধারণ কৃষকেরাও সামিল হন বেটারমেন্ট লেভি-বিরোধী আন্দোলনে। ৫ মার্চ ১৯৫৯। লুধিয়ানা জেলার আইতিয়ানা গ্রামে গুলি চালায় পাঞ্জাব প্রদেশের পুলিশ! শহীদের মৃত্যুবরণ করেন দুই কৃষক রমণী। কৃষক আন্দোলন মুহূর্তে চেহারা নেয় গণআন্দোলনের। বিদ্রোহের লেলিহান শিখা গ্রাস করে গোটা পাঞ্জাব। অবস্থা বেগতিক দেখে জরুরি বৈঠকে বসেন। প্রতাপ সিং কাঁয়রো নিজের গদি টলমল দেখে বাতিল ঘোষণা করেন গোটা বেটারমেন্ট লেভি প্রকল্পটিকেই। শহীদের আত্মবলিদান লাভ করেন পূর্ণতা।
১৯৯৮ সালে কমরেড হরকিষেণ সিং সুরজিত ঐতিহাসিক এই আন্দোলনকে স্মরণীয় করে রাখতে এই গ্রামেই স্থাপন করেন এক স্মৃতিসৌধ-গণআন্দোলনের অমলিন স্মৃতি। ইতিহাসের ধারা অক্ষুন্ন রেখে ২০২০ সালের ৫ মার্চ সেই স্মৃতিসৌধের প্রাঙ্গণে শহীদদের উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা জানান সীতারাম ইয়েচুরি। উপস্থিত পাঁচ হাজার জনতার সামনে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। সংবর্ধনা দেওয়া হয় শহীদ পরিবারের সদস্যদের। আত্মবলিদানের গৌরবগাঁথাকে পাথেয় করে এগিয়ে চলে গণসংগ্রামের প্রবহমান ধারা।