ভারতীয় রাজনীতিতে এখন যে নাম ভেসে উঠেছে আবার তা হল তিস্তা শিতলবাদ। তাঁর বিচার হয়েছে, বিচারে সাজা হয়েছে। আর সাজাকে ঘিরেই তৈরী হচ্ছে নানা গল্প।
কথায় কথায় ধর্মীয় গ্রন্থ নিয়ে টানাটানি করা চাতুরী নিয়ে কেন্দ্রীয় গদি সামলানো বিজেপি নেমে গেছে আসরে! এতে সুবিধা হল ওই গ্রন্থ শাশ্বত, তা নিয়ে প্রশ্ন করা যায় না অতএব উদাহরণ ও শাশ্বত এমনটা প্রতিষ্ঠা করা৷ আর তাতেই গুজরাট দাঙ্গা তথা গোধরা কান্ডেরও অন্যতম নায়ক অমিত শাহ জি নেমে গেছেন আসরে। শিবের মত ২০ বছর ধরে গরল গলায় ধরে ছিলেন নরেন্দ্র মোদী তা বোঝাতে ন্যাশানাল টেলিভিশনে। আর বলা হয়েছে মোদীজি প্রপিতামহ ভীষ্ম। তিনি এতদিনে শাপমুক্ত হলেন। মজার কথা মহাভারতের শেষ পর্ব “স্বর্গারোহণ” পড়ার আগে অবধি ভালো করে বিশ্লেষণ না করলে এমনটাই মনে হতে বাধ্য।
২০০২ -এ জ্বলন্ত গুজরাটের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল গোটা দেশ। অগুন্তি নিরপরাধ মানুষ দাঙ্গায় শেষ হয়ে গেছিল। মা এর গর্ভ থেকে ভ্রুণ বেড় করে এনে তলোয়ারের ডগায় নাচানোর ক্যানিবালাজিম দেখে শিউরে উঠেছিল বিশ্ব। খুন আর তার নারকীয় অভিঘাতকে মুছে ফেলতে মসনদ লাগে, তাতে বসে বিচারব্যবস্থা তৈরী করতে লাগে, তারপর অন্ধ আইনের রাস্তায় আইন চলবে বলার মত সাধুভাষণ লাগে। যে বিচারের নবরূপ দেখতে পাই কর্ণাটকের হাইকোর্টে, এজলাসে দাঁড়ানো ধর্ষিতা তরুণীর দিকে বিচারকের আসনে বসা, কালো কোর্ট পরা, হাত পাওয়ালা মনুসংহিতা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে – “এত কালো কুচ্ছিত দেখতে তোমাকে, তারপরেও তোমায় ধর্ষণ করতে ইচ্ছা করল ওদের!”
আসলে আইন আইনের রাস্তা দিয়ে চলে, আর সেই রাস্তার ফুটপাতে কিছু নির্দোষ অভুক্ত লোক শুয়ে থাকতে বাধ্য হয়, তাদের ওপর দিয়ে ন্যায়ের চাকা পিষে চলে যায়, অন্ধত্বের সুযোগ নিয়ে।
তিস্তা শিতলবাদের যাত্রা প্রায় সেই সময় থেকেই, গুজরাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরিমান দেখে তার পেশা সাংবাদিকতা শুধু তাকে আটকে রাখতে পারেনি। পক্ষ নিতেই হয়েছিল। তৈরী হয়েছিল “Citizens for Justice and Peace (CJP)” নামক NGO, যুক্ত ছিলেন তার সাথে আরও অনেকে৷ এই CJP র মাধ্যমে লাগাতার লড়াই চলে গুজরাটের দাঙ্গা ও তার সরাসরি সংগঠক নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে৷ তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীকে কার্যত “পিন পয়েন্ট এজেন্ডা”-য় মামলায় টেনে নিয়ে যায় CJP, গত কুড়ি বছরের মধ্যে বিশেষ করে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপির রাস্তার মূল কাঁটাগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠে গুজরাত ফাইলস। প্রোপাগাণ্ডা ছবি সারাদিন চ্যানেলে চ্যানেলে হলুদ প্রচারের পরেও ভোটে তথাকথিত ভাবে জিতে বা এমএলএ / এমপি কিনে সরকার গড়েও এই কাঁটা দিবারাত্রি জ্বালিয়ে যাচ্ছিল, যেমন – গ্রাম উজার করে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া বল্লবভাই প্যাটেলের মূর্তি বসিয়েও আরএসএস গান্ধী হত্যার রক্ত হাত থেকে মুছতে পারে না আজও৷
এই কুড়ি বছরের মধ্যেও তিস্তাকে তার সঙ্গীসাথিদের একের পর এক হয়রানির শিকার হতে হয় এই মকোদ্দমার চক্করে। তার মধ্যে তাঁর এবং তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক তছরুপের মামলা মূল হয়ে ওঠে। এনজিও-টি গুজরাত কান্ডের জন্য সংগৃহীত অর্থ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করছে এই অভিযোগে মামলা দায়ের হয়। কোটি খানেক টাকা ট্রানসার হওয়া ব্যংক একাউন্টের তদন্ত করতে গিয়ে উঠে আসে কিছু তথ্য তাতে মামলার মোড় ঘুরে যায়। এই তছরুপের অভিযোগ আনে ন্যাশানাল টেলিভিশনে যে সাংবাদিক তার একাউন্টে ওই দিনই বেনামী উৎস থেকে জমা পরে কোটি টাকার বেশি। তাতে বিরুদ্ধ স্বর ক্ষয়িষ্ণু হয় মামলায়।
আসলে সাংবাদিকতা এমন পেশা যা দুনিয়ার বহু মানুষকে আর পেশায় সীমাবদ্ধ রাখে না, কখনো গোয়েন্দা বা কখনো রাষ্ট্রদ্রোহী করে তোলে। যেমন – টিনটিন, যেমন – গৌরী লংকেশ।
এরই মধ্যে গুলবার্গ স্যোসাইটি কেসে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে আবার আদালতের দারস্থ হন তিস্তা৷ কংগ্রেসের আগের এমপি এহসান জাফারির বিধবা স্ত্রী জাকিয়া জাফরিকে সাথে নিয়ে ন্যায়ের লড়াই চলে ১৪ বছর। যদিও এইবারের তিস্তার গ্রেফতারের পর কংগ্রেসের পার্টির তরফের এই বিষয়ের বিবৃতিতে পলিটিকাল পার্টি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে নারাজ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
বর্তমানে তিস্তার গ্রেফতারিতে যে যে ধারায় এত্তেলা রুজু হয়েছে তা হল – আইপিসির সেকশন ১৯৪, ২১১, ২১৮, ৪৬৮, ৪৭১ আর সেকশন ১২০র বি ধারা।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় তিস্তার অর্থনৈতিক তছরুপের মামলা রুজু হয় আমেদাবাদে৷ মজার কথা হল তাতে কত কোটি টাকা CJP তছরুপ করেছিল বলে অভিযোগ তার হিসেব গুগুলে আছে, আর মামলার মোড় ঘুরে যাওয়ার পর কেসের হাল আর তার পালটা কেসের খবর নেই। যেমন – নন্দীগ্রাম, মরিচঝাঁপি নিয়ে দিনে দিনে মৃতের সংখ্যা বাড়ার খবর পাওয়া যায় ইন্টারনেটে কিন্তু ২০২২ এ ঘটে যাওয়া বগডুইয়ে মৃতের সংখ্যা কত ঠিক হিসাব নাই।
তো এই আমেদাবাদের মামলায় সেই সময়ের আগে থেকেই জড়িয়ে যায় পূর্বতন ডিজিপি আর বি শ্রীকুমারের নাম গ্রেফতার। এতদিন কিচ্ছু হয় নি, এবার দিল্লিতে সুপ্রিম কোর্ট অর্ডার শোনানোর পরেই দাঙ্গায় মদতের অভিযোগে আমেদাবাদ থেকে গ্রেপ্তার হলেন শ্রীকুমার। এর আগে একই অভিযোগে বিজেপির সরকার গ্রেফতার করে আই পি এস সঞ্জীব ভাট কে। এই দুজন অফিসারই গুজরাটের ঘটনায় সরকারের ফতোয়া না মেনে আইনের শাসন আনতে সচেষ্ট হন। দাঙ্গা সংঘটিত করা ও খুনের অভিযোগে গ্রেফতার ও মামলা করেন বহু বিজেপির নেতা ও তাদের চ্যালাচামুণ্ডাদের বিরুদ্ধে, সেইসব দাঙ্গাপিড়ীতদের হয়ে গ্রহণ করেন অসংখ্য মানবিক পদক্ষেপ, চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য ইত্যাদি।
কার্যত গুজরাটের গোধরাকান্ড ও তার পরবর্তী সময়ে দাঙ্গাবাজদের ত্রাস হয়ে দাঁড়ায় এই দুই নাম।
সেইসব তথ্য পরে দেন CJP-কে। বর্তমানে আইনের কলে এই দুজন আইনের রক্ষক-ই বন্দী।
অন্যদিকে ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট এ এল টি নিউজের কো-ফাউন্ডার মহম্মদ জুবীর গ্রেফতার হয়েছেন এইসব ঘটনার ধারাবাহিকতায়, ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগে। তিনি এইসব গ্রেপ্তারির মূলের কান্ড নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন।
আদালতের নতুন রায়ে আবেদনকারীদের বলা হচ্ছে তারা বিচার ব্যবস্থা থেকে অসাধু ফায়দা তুলছেন। আর সেই গ্রাউন্ডেই গ্রেফতার এতগুলো মানুষ। সেই গ্রাউন্ডে অপরাধী যারা দাঙ্গাপিড়ীতদের জন্য বিচার আনতে গেছেন, সেই গ্রাউন্ডেই ভুক্তভোগীদের জন্য চাওয়া বিচার হল – “অলীক ভবিষ্যতের জন্য কল্পনার চুলায় রান্না বসানোর বিলাসিতা” (এই ভাষা ব্যবহার হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে)।
আসলে “সত্য” বড় মজার জিনিস। আকিরা কুরোসাওয়ার ফিল্ম “রসোমন” তাই যুগে যুগে নানা ঘটনায় সত্য হয়ে ওঠে। “সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।” – তাই সত্য কি ঠিক করে পুঁজি, কোন সত্য আদালত সত্য বলে ধরবে বা কোনটা ধরবে না তাও ঠিক হয় পুঁজি বা পুঁজির সহোদর ক্ষমতার দ্বারা। কে বিচারের অন্যায় ফায়দা তুলছে তা ঠিক করবে কে! কে বিচার করবে তা ঠিক হবে কোত্থেকে। মা অন্ধ সেজে থাকলে পুত্ররা দুরাচারী হয়ে ওঠে একথা মহাভারতই না আইনব্যবস্থাও শেখাচ্ছে আমাদের৷ তাই শিক্ষকরা বলেন – ট্রুথ নয় ফ্যাক্ট! ইকুয়ালিটি নয় জাস্টিস৷ তার জন্য লড়াই চলবে, ভাঙাচোরা ব্যবস্থা ঠুকেঠাকে মেরামতই শুধু নয় দরকারে খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে৷ দেশ জোড়া নিরপরাধ, কেবলমাত্র মতাদর্শগত বিশ্বাসের কারণে গ্রেফতার হওয়া সব তিস্তা শিতলবাদ, সব ফুল্লরা মন্ডলদের মুক্তির দাবীতে আপোষহীন লড়াই চলবে।
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া