স্বামী বিবেকানন্দকে কিভাবে দেখি – ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত…

পরিশিষ্ট

স্বামী বিবেকানন্দকে আজকে যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, আমার মনে হয় তদ্বারা তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে আমার এই ধারণা হয়েছে যে, একদল তাঁকে বর্ণাশ্রমধর্ম প্রচারকারী “সনাতনী” হিন্দু বলে মনে করেন এবং এই যুগের নিজেদের গোঁড়ামীকে স্বামীজীর নাম দিয়ে সমর্থন করেন। এই দলের লোকেরা বলেন — কেন, এই-তো ঠিক হয়েছে, ব্রাহ্মণ রামকৃষ্ণের শিষ্য শুদ্র বিবেকানন্দ! অন্যপক্ষে দ্বিতীয় দল বলেন– তিনি প্যান হিন্দু ছিলেন, –“হিন্দু-পদ-পাত-সাহী”। তাঁহার মনের মধ্যে আদর্শ ছিল– ভারতের হিন্দু-প্রাধান্য স্থাপন ও হিন্দু- ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা। আবার তৃতীয় দল বলেন– রামমোহন, কেশবচন্দ্র, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখের নেতৃত্বের যে সংস্কারের আন্দোলন ভারতকে আধুনিকত্বের পথে অগ্রসর করছিল, তার পথ তিনি রোধ করেছিলেন। এই মতটি আধুনিক তথাকথিত চরমপন্থী যুবক শ্রেণীর মধ্যে অনেকের মুখ থেকে শুনা যায়।

একজন লোকের জীবনান্ত পর্যন্ত যে কর্মক্ষেত্রের ধারা বিস্তৃত থাকে ,তার পশ্চাতে যে ভাবুকতা থাকে, তা নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয় না। “ড্যায়ল্যাকটিকাল মেটেরিয়ালিজম”-এর রীতি অনুসারে এই ভাবধারার মধ্যে দ্বন্দ্বভাব প্রকাশত হয়। আবার ভাবধারাও হিস্টরিক্যাল মেটেরিয়ালিজম’-এর প্রভাব প্রসূত হয়, এইজন্যেই একজনের ভাব ও তৎপ্রসূত কর্মের মধ্যে যে দ্বন্দ্বভাব (antithesis) থাকে, তাকে বুঝে সেই লোককে বিচার করা প্রয়োজন। স্বামী বিবেকানন্দকেও এই মাপকাঠিতে দেখতে হবে।

যাঁরা স্বামীজিকে প্রথম দল অন্তর্গত বলে মনে করেন, তাঁরা এই ঘটনা হয়তো জানেন না। অথবা বর্থমানে স্বামীজির জনপ্রিয়তা দেখে এই মনে করে চেপে যান যে, বর্ণাশ্রমী সনাতনবাদী হিন্দুরা তাঁকে বরাবরই নির্যাতন করেছিল।তাঁর “স্বামী” উপাধিতে ও তাঁর সর্বকর্মে তাঁরা আপত্তি করেছিলেন। যখন তিনি ক্ষেত্রীর রাজা অজিতসিংহকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিনেশ্বর কালীবাড়িতে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন, তাতেও তাঁদের আপত্তি ছিল। এই বিষয়ের উল্লেখ ক’রে যখন ‘বঙ্গবাসী’ ও ‘বসুমতী’ পত্রিকাদ্বয়ের মধ্যে বাদানুবাদ হয়, তখন ‘বঙ্গবাসী’ প্রকাশ করল যে, তাঁকে মন্দির হ’তে বিতাড়িত করা হয়েছে, এবং এ উক্তিকে সমর্থন ক’রে রাণী রাসমণির দৌহিত্র ও মথুরবাবুর পুত্র ‘বঙ্গবাসীতে’ লিখলেন যে উক্তি কালীমন্দির স্বামীজীর প্রবেশের জন্য কলুষিত হ’বার ফলে তিনি পূজারী ব্রাহ্মণকে হুকুম দিয়েছেন মন্ত্র দ্বারা যেন উক্ত মন্দির ও ঠাকুর শুদ্ধ ক’রে নেওয়া হয়। জনসাধারণের মনে স্বামীজী সম্বন্ধে বিকৃত ধারণা উৎপাদন করবার জন্যে ‘বঙ্গবাসী’ তার বাংলা ও হিন্দি সংস্করণে নানা প্রকার ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করতে লাগল। পরে স্টার থিয়েটারে মাসের পর মাস “অবতার” নাম দিয়ে এক ব্যঙ্গনাটক অভিনীত হ’তে থাকে।

এ আশ্চর্যের বিষয় যে, ধর্ম ও সমাজসংস্কারকগণ বর্ণাশ্রমীদের কাছ হ’তে ততটা নির্যাতিতা হননি যতটা হয়েছিলেন স্বামীজী। যখন অব্রাহ্মণ কেশবচন্দ্র বললেন – ‘প্রতিমা পূজা কোরো না, পৈতে ত্যাগ করো , বিধবা-বিবাহ দাও, জাতিভেদ ভাঙও ‘ ইত্যাদি ,তখন তিনি হিন্দু-সাধারণের নিকট হ’তেও এত নির্যাতিত হননি। আবার যখন ব্রাহ্মণ পন্ডিতবংশীয় শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছিলেন – ”মনুকে কর্মনাশার জলে ফেলে দাও”, তখন বর্ণাশ্রমীরা বেশি মাথানাড়া দিতে পারেননি। কিন্তু হিন্দুধর্মের সমর্থনকারী – হিন্দু সভ্যতার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাবান স্বামীজী কেন বর্ণাশ্রমীদের কাছে এত নির্যাতিত হতেন, তা ঐতিহাসিকরাই অনুসন্ধান করবেন। আজকে স্বামীজিকে বর্ণাশ্রমধর্মের সমর্থনকারী ব’লে যে উল্লেখ করা হচ্ছে, তা’ নিছক মিথ্যা, আর এই গল্পও তাঁদের শ্রেণীস্বার্থপ্রসূত। তাঁরা স্বামীজীর মাদ্রাজ ও কলিকাতার বক্তৃতা সম্বধে কোনো খোঁজই রাখেন না। শেষকালে তাঁর একটি পত্রে তিনি বলেছেন- What I have seen in South Indian temples…Is that religion or Devil’s dance? এই সব উক্তি ও কার্যকলাপ দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে স্বামীজী কতটা ব্রাহ্মণবাদীয় বর্ণাশ্রমধর্মের পক্ষে ছিলেন।

অন্যপক্ষে, দ্বিতীয়দলের মতও সমীচীন নয়। এটা সত্য যে, প্রথম অবস্থায় তিনি হিন্দু chauvinist ছিলেন ও বর্তমান ভারতে প্রথম হিন্দু ছিলেন- তিনি হিন্দুধর্মকে আক্রমণশীল করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে হালফ্যাশনের “হিন্দুসভা”-র দল অথবা ভারতে “হিন্দুস্বার্থ”- কায়েমকারীদলের লোকেদের সঙ্গে সনাক্ত করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। ভবিষৎ ভারতের জাতীয় সংগঠন কর্মে সব-ধর্মের লোকেরই স্থান আছে ও তাদের সহানুভূতি দরকার- এ সত্য তিনি কখনও অস্বীকার করতেন না। মুসলমানধর্মী ভারতবাসীর প্রতি তাঁর বিশেষ দরদ ছিল। একটি বিশিষ্ট ধর্মসম্প্রদায়ের বা শ্রেণী নিয়ে তাঁর ভবিষৎ ভারতের পরিকল্পনা ছিল না। (ভগ্নী নিবেদিতার The Master as I saw him নামক পুস্তক ও স্বামীজীর শেষের ‘পত্রাবলী’ দ্রষ্টব্য )।

শেষে আসে তৃতীয় দল। এ কথা সত্য বটে যে ধর্ম ও সমাজ- সংস্কার-আন্দোলন হিন্দু – সমাজে প্রতিক্রিয়া উপস্থিত হয়। হিন্দু -সমাজ নিজেকে বাঁচাবার জন্যে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। সংস্কারকগণের কর্ম উল্লেখ ক’রে স্বামীজী নিজেই বলেছেন, Those galvanic shocks have aroused the sleeping leviathan (An appeal to young Bengal দ্রষ্টব্য)। স্বামীজী সংস্কারকগণের কর্মকে অস্বীকার করতেন না। ইতিহাসে তাদের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করতেন। তিনি এক প্রবন্ধে বলেছেন যে, খ্রিস্টিয় আক্রমণ হ’তে হিন্দুসমাজকে বাঁচাবার জন্যে বর্তমানযুগে ব্রাহ্মসমাজ, অর্যসমাজ প্রভৃতি bulwork- রূপে উত্থিত হয়েছে। আবার America-য় বক্তৃতা ক’রে টাকা তুলে ব্রাহ্মদের পরিচালিত বরাহনগরের বিধবা- আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আবার যখন তিনি লাহোরে ছিলেন তখন আর্যসমাঞ্জিরা স্বামীজীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে একযোগে কাজ করবার জন্য প্রস্তাব আনেন। শুনা যায়, তাঁর গুরুভাইদের আপত্তি থাকাতে এ আলোচনা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। অবশ্য এখানে কথা উঠবে যে, তৎকালের সংস্কারকামীদের মত ও পথ যে একমাত্র সত্য ,তারই বা প্রমাণ কী? ঊনবিংশ শতাব্দীর English literalism এবং old Victorian ideologies- এর ওপর আমাদের জাতীয় জীবনের সর্ব কর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার বৈধতা বিষয়ে আজ প্রশ্ন উঠেছে। আবার জাতীয় জীবনের কর্মের মধ্যে দ্বন্দ্বভাব ওঠা স্বতঃসিদ্ধ। সর্ব কর্মই ক্ষণিকের জন্য ,- তা ক্রমাগতই রূপান্তর গ্রহণ করছে। স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাবের পর থেকে সংস্কারের স্রোত নতুন খাতে প্রবাহিত হ’য়ে আজ বিপুলাকার ধারণ করছে।এ দেশে প্রাচীন পন্ডিতেরা এই phenomenon- টিকে উপলব্ধি ক’রে “ক্ষণিকাবাদ”- মতের সৃষ্টি করেন। এই ক্ষণিকবাদ অনুযায়ী আমাদের জাতীয় জীবনের কর্ম নূতন নূতন রূপ পরিগ্রহণ করছে, কিন্তু মূলত তা’ একই। এ জন্যই হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানে সংস্কারকদের হা-হুতাশ, অভিশম্পাৎ যে বৃথাই গেছে তা’ প্রত্যেক ডায়লেকটিকাল মতাবলম্বীরা স্বীকার করেন। এক্ষণে বক্তব্য যে, এই বিষয়টিকে যথাথর্ত কী ভাবে দেখা যেতে পারে ? যাঁরা স্বামিজীকে জটাজুটধারী গাঁজার কল্কে হাতে করা সন্ন্যাসীরূপে দেখতে চেয়েছিলেন,তাঁরা বহুপূর্বেই নিরস্ত হয়েছেন! এখন লোকে তাঁকে শিক্ষিত শ্রেণীমধ্যে উত্থিত হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসভার প্রচারক ও সমর্থনকারী ব’লে মনে করেন। আজ তিনি শিক্ষিত হিন্দুর আদর্শস্থানীয় হয়েছেন,কিন্তু তাঁকে বুঝতে হ’লে ,যে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভিতর হ’তে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন, কিন্তু তাঁকে বুঝতে হ’লে , যে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভিতর হ’তে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন তা’ বুঝা প্রয়োজন। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন দেশী ও বিদেশী সংস্কারকগণের প্রচারের ফলে শিক্ষিত লোকের মনে ধারণা হয়েছিল যে, হিন্দুর গৌরবের কিছুই নেই । বাংলার কবিও লিখেছেন- “ভূতলে অধম বাঙ্গালী জাতি।” ইউরোপীয়ানদের নকলনবীশিকরা ভারতের উন্নতির একমাত্র সোপান ব’লে শিক্ষিতসমাজে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু দ্বন্দ্বশাস্ত্রানুসারে এর প্রতিক্রিয়ার শীর্ষদেশে আসেন। এ প্রতিক্রিয়ার ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে হিন্দু Chauvinism- এর উদ্ভব হয়। বিশেষত যখন Moscow থেকে মাদাম ব্লাভাস্কি ও ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে জনকতক পাশ্চাত্যবাসী এসে বললেন যে- হিন্দুর সবই ভাল, তখন হিন্দুর মনে স্বভাবতই আক্রমণশীলতার ভাব জেগে ওঠে। অবশ্য এ সময়ে হিন্দু সমাজের মধ্যে একটি শিক্ষিত বুর্জোয়া শ্রেণীর আবির্ভাব হয়- যা তৎশ্রেণীর ইউরোপীয়দের সঙ্গে সর্ববিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আরম্ভ করেছিল। তখন হিন্দুর পুনর্জাগরণে সাড়া পড়ে গেছে। তখন দাঁড়িয়ে বিদেশী বা অন্য ধর্মের লোকের কাছে গালি খাওয়া বা গন্ধ শুকলে জাত যাওয়ার মনোবৃত্তি অন্তর্হিত হচ্ছে। সুতরাং এ হিন্দু- পুনর্জাগরণের দিনে হিন্দু -বুর্জোয়াদের মধ্যে Chauvinism -এর প্রথম প্রচারক ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনিই আবার হিন্দুধর্মকে আক্রমনশীল করলেন। (–ভগ্নী নিবেদিতার Aggressive Hinduism দ্রষ্টব্য) হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের সমর্থনকারীরা সর্বপ্রথমে তাঁকে সমাদরে গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য স্বামিজী যে প্রকারের হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের সহায়তা করেছিলেন, তা অন্যান্য লোক হ’তে বিভিন্ন ছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী আমায় বলেছিলেন – “হিন্দুধর্ম – পুনরুত্থানকারীদের মধ্যে তোমার ভাই-ই সর্বাপেক্ষা বেশি liberal ছিলেন।” অবশ্য এ কথা পরিষ্কার যে, তিনি সংস্কারকগণের পশ্চাৎধাবন করতেন না বা টিকির ভিতর বিদ্যুতের অস্তিত্ব স্বীকার ক’রে তার আধ্যাত্মিকভাব ব্যাখ্যা করতেন না, অথবা সর্বত্রই ভুতের অস্তিত্ব স্বীকার ক’রে তার আধ্যাত্মিকভাব ব্যাখ্যা করতেন না, অথবা সর্বত্রই ভুতের অস্তিত্ব প্রমাণ ক’রে তার হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করতেন না। (ঢাকা প্রভৃতি স্থানের বক্তৃতা ও প্রবন্ধাবলী দ্রষ্টব্য)। প্রচলিত গড্ডালিকা- প্রবাহসকল হ’তে তিনি পৃথক থাকতেন ব’লেই তাঁকে বিভিন্ন দিক থেকে নির্যাতন ভোগ করতে হত।

তিনি চাইতেন- হিন্দুজাতিকে একটা fighting programme দিয়ে সজাগ করতে।এ জন্যই তিনি বেদান্তরূপ প্রোগ্রাম শিক্ষিত হিন্দু যুবকদের হাতে দিয়ে তাদের দেশবিদেশে গিয়ে নিজেদের দেশকে প্রতিষ্ঠিত করে দেখতে চেয়েছিলেন।আর তাঁরই দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দুযুবকরা আবার বিদেশে ধর্ম প্রচার করতে বাহির হয়।

স্বামিজীর এই রূপটিই শিক্ষিত শ্রেণী শেষে ধরতে পারে। তাঁর হিন্দু Chauvinism-এ তাদের কাছে হৃদয়স্পর্শী হয়।এর ফলে ভারতে বিশেষতঃ বাংলাদেশে স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে স্বামিজীর বক্তৃতাগুলি পঠিত হতে থাকে। ১৯০৩ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত বাংলায় স্বদেশীওয়ালাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেক ব্যায়ামাগার ও পাঠচক্রে তাঁর From Colombo to Almorah নামক পুস্তক পঠিত হত। Heaven is nearer through football than through the Gita, We want men of strong biceps প্রভৃতি উদ্দীপনাময়ী কথা তরুণ বৈপ্লবিকপন্থীদের অনুপ্রাণিত করত।তৎপরে পন্ডিত সখারাম গণেশ দেউস্কর ও তাঁর আমেরিকান শিষ্যদের কথা বলেছিলেন যে, ভারতকে স্বাধীন করবার উদ্দেশ্যে তিনি যে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ঘুরে ছিলেন তা জনসমাজে প্রচারিত হয়। এ কথা বাংলার তরুণদের মধ্যে তাঁকে আরও জনপ্রিয় করে । এরই ফলে ১৯০৩ সাল থেকে তিনি শিক্ষিত লোকদের মধ্যে বিশিষ্টভাবে আদৃত হতে থাকেন।

শেষে আসে তাঁর শেষ কালের রূপ – এটি শিক্ষিত বাঙলা বা ভারত তখন ধরতে পারেনি। শেষবার যখন তিনি পাশ্চাত্য দেশে যান ও সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন তিনি আর এক রূপ পরিগ্রহণ করেছিলেন। এ সময় তিনি পাশ্চাত্যখন্ডের সাম্যবাদীয় ভাবধারার সহিত যে পরিচিত ছিলেন তার প্রমাণ দেন। এ সময়ে একটি পত্রে তিনি নিজেকে Socialist বলেন।( বর্তমান লেখকের Vivekananda the Socialist পুস্তক দ্রষ্টব্য) বোধহয় তিনিই সর্বপ্রথম ভারতবাসী- যিনি নিজেকে সোশ্যালিস্ট বলেছিলেন। যে পত্রে তিনি নিজেকে এই নামে অভিহিত করেন,সেই পত্রেই তিনি মানবসমাজের বিশ্লেষণ করে বলেছেন-
” সর্ব শেষে আসে শূদ্রের যুগ। এখন জগতে সে যুগ আসবে, The proletariat will come to power , none shall be able to resist it!” এ সময়ে তিনি মুষ্টিমেয় ধনীদের দ্বারা জনসাধারণের শোষণের বিপক্ষে লেখেন। এ সময়েই তিনি এ দেশের রাজনীতিকারদের ঠাট্টা করে বলেছিলেন যে – এরা নিজেদের মুক্তি চান, কিন্তু জনসাধারণকে তা দিতে চান না এবং তাদের শ্লেষ করেই বলেছিলেন যে It is the slaves who want to keep others slaves!

তাঁর জীবনের এই শেষ সময়েই প্যারিসে রুশ বৈপ্লবিক ও অনার্কিস্ট-কমুনিস্ট নেতা পিটার ক্রপ্টকিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।স্বামিজীর আমেরিকান ও ইংরেজ শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই ক্রপটকিনের বন্ধু ছিলেন । তাঁরাই এ সাক্ষাতের যোগাযোগ করে দেন। আমি এ দলের একজন আমেরিকান শিষ্যের নিকট শুনেছি যে, ক্রপটকিন ও স্বামিজী উভয়ে নিভৃতে বারো ঘণ্টাকাল আলোচনা করেন। এ দীর্ঘ আলোচনার বস্তু কী ছিল তা আমরা জানি না। অবশ্য এটা যেন কেউ মনে না করেন যে, স্বামিজী ক্রপটকিনের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন, কারণ ভগ্নী ক্রিস্টিন আমায় বলেছিলেন যে স্বামিজী শেষকালের জন্য নিউ ইয়র্ক ছাড়বার আগেই জগতের কোথায় সর্বপ্রথম “প্রলেটারিয়ান্” স্টেট স্থাপিত হবে সে বিষয়ে চিন্তা করতেন।
ক্রিস্টিন আমায় বলেন -“স্বামিজী ঘরে পাইচারী করছিলেন এবং বলছিলেন,- ‘জগতে প্রথমে ব্রাহ্মণের (পুরোহিত) রাজ্য ও সর্বশেষে আসবে শূদ্রের (শ্রমজীবীর) রাজ্য।’ কিন্তু কোথায় সর্বপ্রথমে এ রাজ্য কায়েম হবে, তা আমি এখনও নির্দ্ধারণ করতে পারিনি।” তিনি বলেছিলেন- Either Russia or China will be the first proletariat state in the world; কারণ উভয় দেশেই কৃষক শ্রেণী দুর্দশাগ্রস্ত ও অধঃপতিত। (রোঁম্যা রোলাঁ প্রণীত -The Life of Vivekananda and the Universal Gospel,পৃ.১৭৪ দ্রষ্টব্য)

এ সময়ই তিনি দেশবাসীকে একটি নতুন পদ্ধতি প্রদান করেন। এ সময় তাঁকে আর Hindu Chauvinist-রূপে আমরা পাইনি। এ সময়ে তিনি ভারতের গণসমূহকে জাগিয়ে হিন্দু-মুসলমান ও ব্রাহ্মণ-শূদ্রকে এক কৃষ্টির ভিতর এনে একটা নতুন জাতিতে পরিণত করবার কথা বলেছিলেন। এ জন্যই তিনি বলেছিলেন ,- “বেরুক ভূনুরির দোকান থেকে,চাষার লাঙলের ফলা থেকে নূতন সভ্যতা।” যাঁরা পাশ্চাত্যের সাম্যবাদী ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত আছেন তারাঁই জানেন যে, একে ‘প্রোলেটারিয়ান্ কালচার্’ বলা হয়। এটি ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া-কৃষ্টি হতে পৃথক। এই প্রোলেটারিয়ান্ কালচার্ কে এদেশে উদ্ভূত করবার জন্যই তিনি এ দেশে বনিয়াদী স্বার্থের(Vested Interest) দলকে বলেছিলেন- “অতীতের কঙ্কালচয় শুন্যে বিলীন হও…তোমরা বিলীন হলে তোমরা বিলীন হলে ভারতে নূতন সভ্যতার উদয় হবে।”

এতদ্বারা স্পষ্টই প্রতীত হয় যে, সনাতনবাদী ও বুর্জোয়া Chauvinism হতে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে তিনি দেশের গণশ্রেণীসমূহকে জাগাবার জন্য চেষ্টিত হন।এ সময়েই দেশের যুবকদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে নিরক্ষর লোকেদের মধ্যে বাস করে তাদের শিক্ষিত করবার উপদেশ দিয়েছিলেন। আবার সমষ্টির কল্যাণের জন্য “দরিদ্রনারায়ণের সেবা” নাম দিয়ে বিভিন্ন জনহিতকর প্রতিষ্ঠান স্থাপন করবার জন্যে তিনি শিক্ষিত লোকদের উৎসাহিত করতেন।

ব্রাহ্মণ্যবাদীয় হিন্দুরা চিরকাল ব্যক্তিত্বের উপাসক। সে ব্যক্তির মুক্তি চায়,কিন্তু বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের “বহুজন হিতায় চ বহুজন সুখায় চ”- কর্ম করতে বলে গেছেন। এই উপদেশই পাশ্চাত্য দেশে Greatest good to the largest number-নামে সাম্যবাদীদের দ্বারা প্রতিধ্বনিত হয়। স্বামিজী দেশের অধঃপতিতদের উদ্ধার করবার জন্যই অস্পৃশ্যতার-(যাকে তিনি Don’ts touchism বলতেন)বিপক্ষে লড়তেন। সমষ্টির মুক্তির জন্যে তিনি গণ-নারায়ণের সেবার কথা বলতেন ও নানা জনহিতকর প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে বলতেন।ব্যষ্টি অপেক্ষা সমষ্টির মুক্তিই ভারতের পক্ষে এ যুগে বিশেষ প্রয়োজনীয় বলেই ভারতের গণশ্রেণী উত্তোলিত করবার কথা পুনঃ পুনঃ তিনি বলে গেছেন। যদি দেশ সে কর্মপদ্ধতি সেসময়ে গ্রহণ করত, তা হলে জাতীয় সংগঠনকর্মে ভারত আজ অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু শ্রেণী-স্বার্থ তা করতে দেয়নি।

যা হোক আজ তাঁর কর্মপদ্ধতি ভারতের স্থানে স্থানে বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন লোক দ্বারা কর্মে পরিণত হতে চলেছে। গণশ্রেণী যখন নানাপ্রকারের দাসত্ব থেকে মুক্ত হবে,তখন তারা বুঝবে- স্বামিজী তাঁদের জাগাবার জন্য কী বলে গিয়েছিলেন। -শুভমস্ত সর্ব্বজাতাম্ !

শ্রী ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত
শ্রী ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত
স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো শহরে ১৮৯৩ সাল
Spread the word

Leave a Reply