সৌভিক ঘোষ
বেঙ্গালুরুতে বিজেপি বিরোধী জাতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলির সমবেত দুদিনের বৈঠক আয়োজিত হয়েছে।
আজ সেই বৈঠকের প্রথম অধিবেশন ছিল।
এই প্রসঙ্গেই সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ মজার এক প্রচার শুরু হয়েছে।
যেহেতু তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি দুজনেই ঐ বৈঠকে রয়েছেন অতএব এতদ্বারা পশ্চিমবঙ্গে পার্টি কমরেড, সমর্থক, দরদী এবং সর্বোপরি তৃনমূলের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো জনসাধারণকে ভয়ানক অপমান করা হল। অথচ সেই ভয়ানক অপমানের বোঝা এমনই যে জনসাধারণ, পার্টির কর্মী, সমর্থকেরা নিজেরা কিছুতেই সেকথা অনুভব করতে পারছেন না- তাই তাদের মাথায় সেই অনুভব (পড়ুন অপমানের লালিমা) গেঁথে দেওয়ার পবিত্র কর্তব্যটির সমাপনে একদল নেমে পড়েছেন। কমিউনিস্ট পার্টির বিবেক সাজতে চাওয়া নতুন কিছু নয়, ওসব দুরমুশ করে দিতে সময় লাগে না। কিন্তু সেসবের আগে আমরা আরেকবার ঝালিয়ে নিতে চাইছি এখন আমাদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে কোন বাধা পেরোতেই হবে।
এই বৈঠক কেন?
সামনের বছর লোকসভা নির্বাচন। গত দুবারের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর মোদী সরকার (আসলে আরএসএস’র নেতৃত্বে বিজেপি’র সরকার) যা কিছু করেছে তাতে দুটো বিষয় স্পষ্ট। এক – স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত ঐতিহ্য, মর্যাদাবোধ নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, সার্বভৌমত্ব ও সাধারণতন্ত্রের সাংবিধানিক অধিকার সবকিছুকে হিন্দুত্বের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ও ধর্মোন্মাদ দৃষ্টিভঙ্গিতে খারিজ করতে চাইছে নাথুরাম গডসে’র উত্তরাধিকারিরা। দুই – এরা আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির সামনে মাথা ঝোঁকানোকেই দেশের উন্নতিসাধন বলে বোঝে। কর্পোরেটদের সাথে সাম্প্রদায়িক শক্তির আঁতাতে গড়ে ওঠা আরএসএস-বিজেপি’র সরকার আরেকবার ক্ষমতায় এলে ভারতের চরিত্রই বদলে যাবে- আর তাই বিজেপি’কে হারাতেই হবে।
এটুকু রাজনৈতিক সদিচ্ছায় যারা একমত তাদেরই এই দুদিনের বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ছিঁচকাঁদুনেদের যুক্তি কি?
বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইতে জাতপাতের অভিশাপের বিরুদ্ধে সংগ্রামও একটি জরুরী ইস্যু। একসময় আমাদের দেশে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হয়েছে। মনে করা হয়েছিল ওসব আর ফিরে আসবে না। আরএসএস-বিজেপি সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সাংস্কৃতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠায় একদিকে প্রাচীন ভারতের নামে আধুনিকতম কায়দায় অপবিজ্ঞান ও অযুক্তির ব্যাপক প্রচার আরেকদিকে বিরোধী শক্তিকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে বিজেপি ভোটে জিততে চাইবে। এই পরিস্থিতিতেই কেউ কেউ ধুয়ো তুলছেন বিরোধী বৈঠকে উনি কেন? উনি তো বিজেপি বিরোধী নন।
উনি যে তা নন একথা আমাদের থেকে, পশ্চিমবঙ্গবাসীদের থেকে বেশি কেউ জানে কি? সেই সত্যটুকু জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে (যেখানে দেশের ও দেশের জনসাধারণের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে চলেছে) স্পষ্ট করে দিতে হবে না? যদি এর উত্তর হ্যাঁ হয় তবে ‘ওরা আদৌ বিজেপি’র বিরুদ্ধে নয়’ এটুকু প্রমাণ করার দায় কাদের? আমাদের নয়?
ওরা বলছেন এতে নাকি পার্টি কর্মী, সমর্থকদের অপমান, দুর্নীতি-সন্ত্রাসের শিকার জনসধারনের অপমান। তারা ভুলে গেছেন বেঙ্গালুরুর বৈঠক প্রথম সভা নয়, আর আগে পাটনাতেও এমনই বৈঠক হয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেস সেখানেও ছিল। জনসাধারণ দেখেছেন। সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, সরকারী আধিকারিকদের কাজে লাগিয়ে ভোট লুট করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপি’কে আমাদের রাজ্যে বিরোধী শক্তি হিসাবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টাও তারাই চালিয়েছে। আবার ভোটের ফলাফল বেরনোর পরেই তারাই বিজেপি থেকে নিজেদের এজেন্টদের ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এসব জনসাধারণ দেখছেন না?
আসলে যারা ‘উনি কেন আছেন’ বলে কান্না জুড়েছেন তারা জনসাধারণকে মূর্খ প্রতিপন্ন করতে চাইছেন।
তারা বোঝাতে চাইছেন জনগণ জাতীয় স্তরের বিজেপি বিরোধী বৈঠকে তৃণমূল কংগ্রেসের উপস্থিতি দেখেই স্বজন হারানোর যন্ত্রণা ভুলে যাবেন। তারা তৃণমূলের চাল-ত্রিপল থেকে চাকরি হয়ে ব্যালট চুরির সবটা ভুলে যাবেন, মস্তানদের হাতে খুন-জখম- লুট-সন্ত্রাস ভুলে যাবেন এমনকি এসবের বিরুদ্ধে নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়াইও ভুলে যাবেন।
তাই কমিউনিস্ট পার্টিকে জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী বৈঠক বয়কট করতে হবে!
মূর্খ জনসাধারণের ভালো করতে চাওয়া এহেন রাজনৈতিক অবস্থানে ছুঁতমার্গী বাতিক থাকতেই পারে, জনসাধারণের লড়াইতে পাশে থাকার দায় নেই।
আমরা মনে করি না জনসাধারণের মেধা অতটা তুচ্ছ।
আমরা জনসাধারণের রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে মুর্খামি মনে করি না।
তাই আমরা মনে রাখি সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমাদের রাজ্যের জনসাধারণের ইচ্ছার সঠিক প্রতিফলন ঘটলে তৃণমূল কংগ্রেস ধুয়ে মুছে যেত। আর তাই ভোটের নামে প্রহসন চালানো হয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেস কি শেষ অবধি থাকবে?
একথা একমাত্র উনিই বলতে পারবেন। আর হয়ত তাকে যারা দুর্গা বলে মানেন তারা এর উত্তর জানেন। আমরা জানি বিভিন্ন রাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা এক না। সীতারাম ইয়েচুরি আজ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন রাজ্যের পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই বিরোধী ঐক্য গড়ার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেছেন- ‘২০০৪ সালে কেন্দ্রে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে হটাতেও বিরোধীরা লড়াই করেছিল। বামফ্রন্ট ৬১ আসনে জয়ী হয়েছিল। তার মধ্যে ৫৭টি আসনে কংগ্রেসও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কংগ্রেসকে হারালেও দেশের স্বার্থে কেন্দ্রে তাদের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিল বামেরা। টানা দশ বছর আসীন ছিল মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার। সেই অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে’।
তৃণমূল কংগ্রেস ইতিমধ্যেই লোকসভা ও রাজ্যসভায় বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে অধিবেশন বয়কটের কৌশলে বিজেপি’কে বিল পাশ করিয়ে নেওয়ার সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। তারা বিজেপি’র পক্ষে ভোট ভাগের সুবিধা করে দিতে বিরোধী ঐক্য ভেঙ্গে চলে গেলে পশ্চিমবঙ্গের ভিতরে এবং বাইরে জনসাধারণের মনে তাদের প্রতি যেটুকু ভুল ধারণা রয়েছে সেটাই পরিস্কার হয়ে যাবে। তাতেও এক জরুরী রাজনৈতিক কর্তব্যের সমাধা হয়। আমরা সেই সুযোগ হারাতে পারি না।
তাই তৃণমূল কংগ্রেস কি করবে সেই নিয়ে মাথা খারাপ করে দেশের স্বার্থের সাথে ছেলেখেলা করা চলে না।
বিজেপি কি করবে?
মোদী ও অমিত শাহ’রা আসলে যাদের ইচ্ছায় চলছেন তাদের মাথায় একটা ভূত ঢুকে রয়েছে। ঢুকে থাকে। সেই ভূত অতীত সম্পর্কে ভিত্তিহীন অহমিকাকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, বাস্তব পরিস্থিতির সমস্যা সমাধানের ব্যর্থতা ভুলে থাকতে অজুহাত যুগিয়ে টিকে থাকে। ভারতের যাবতীয় অতীত, ইতিহাস, দর্শন ও প্রজ্ঞার যথার্থ সমন্বিত রূপ যার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয় সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এহেন ভূত সম্পর্কে লিখে গেছেন- ‘ভবিষ্যৎকে মানলেই তার জন্যে যত ভাবনা, ভূতকে মানলে কোনো ভাবনাই নেই; সকল ভাবনা ভূতের মাথায় চাপে। অথচ তার মাথা নেই, সুতরাং কারো জন্যে মাথাব্যথাও নেই।
তবু স্বভাবদোষে যারা নিজের ভাবনা নিজে ভাবতে যায় তারা খায় ভূতের কানমলা। সেই কানমলা না যায় ছাড়ানো, তার থেকে না যায় পালানো, তার বিরুদ্ধে না চলে নালিশ, তার সম্বন্ধে না আছে বিচার।
দেশসুদ্ধ লোক ভূতগ্রস্ত হয়ে চোখ বুজে চলে। দেশের তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, “এই চোখ বুজে চলাই হচ্ছে জগতের সবচেয়ে আদিম চলা। একেই বলে অদৃষ্টের চালে চলা। সৃষ্টির প্রথম চক্ষুহীন কীটাণুরা এই চলা চলত; ঘাসের মধ্যে, গাছের মধ্যে, আজও এই চলার আভাস প্রচলিত।”
শুনে ভূতগ্রস্ত দেশ আপন আদিম আভিজাত্য অনুভব করে। তাতে অত্যন্ত আনন্দ পায়।’
আজ এসব দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
শেষ বিশ্বযুদ্ধে কিছু মানুষের মাথায় অমন ভূত চেপেছিল- সময় হলে সেবারের মতো আরও একবার ভূত ছাড়িয়ে দেওয়া যাবেখন।
আমরা কি বলছি?
সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) স্পষ্ট ভাষায় নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।
‘ক্ষমতাসীন দল এবং প্রশাসনের দ্বারা বিরোধীদের টার্গেট করা বাম, কংগ্রেস এবং অন্যান্য জোটসঙ্গীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল, যেখানে বিজেপির জন্য অনেকটাই সংযত,নরম মনোভাব দেখানো হয়েছিল। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বাম, কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিজেপি-বিরোধী, তৃণমূল-বিরোধী শক্তিগুলিই শাসক ব্যবস্থার এই গুণ্ডামিকে সামনাসামনি মোকাবিলা করেছে।
জনগণের এই প্রতিরোধ পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র, ঐক্য ও শান্তির সংগ্রামের এক নতুন বৈশিষ্ট্য’।
সুত্রঃ পলিট ব্যুরো বিবৃতি- ১১ই জুলাই, ২০২৩
পরে আরও একবার বলা হয়েছে- ‘গণনাকেন্দ্রে যে কায়দায় কারচুপি চলেছে তাতে স্পষ্ট ফলাফলের চিত্রে যেন-তেন-প্রকারেণ বিজেপি’কে দ্বিতীয় স্থানে তুলে আনাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এই ফলাফলের সাথে বাস্তব পরিস্থিতির কোনও সম্পর্ক নেই।
এই পরিস্থিতি নির্বাচনকে এক নির্মম পরিহাসের বিষয়ে পর্যবসিত করেছে। কলকাতা হাইকোর্ট আজ একটি অন্তর্বর্তী নির্দেশের মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় স্থগিতাদেশ জারী করেছে।
তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি’র বিরুদ্ধে এই লড়াই কার্যত বাঁচা-মরার সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ আজ এক ভয়াবহ সন্ধিক্ষণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করছে, গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে থাকা দেশের সমস্ত মানুষকে সেই সংগ্রামের পাশে থাকার আহ্বান জানাচ্ছে সিপিআই(এম)-র পলিট ব্যুরো’।
সুত্রঃ পলিট ব্যুরো বিবৃতি- ১২ই জুলাই, ২০২৩
আজকের বৈঠক শেষে সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন- ‘কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার দেশের চরিত্রই বদলে দিতে চাইছে। গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সাধারণতন্ত্র ভারতের চরিত্র। দেশের এই চরিত্র যাতে অটুট থাকে তার জন্যই বিরোধীদের এই উদ্যোগ। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সরকার থেকে দূরে রাখতে হবে বিজেপি’কে। বিরোধী দলগুলি চাইছে যাতে বিজেপি বিরোধী ভোট এমনভাবে ভাগ না হয় যাতে বিজেপি’র সুবিধা হয়’।
এতে কোথাও কোনও অস্পস্টতা নেই। ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার সুবিধা নিয়ে বিজেপি এর আগেও নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। ভোটের ফলাফল সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে যারাই চোখ রাখবেন সেকথা সহজেই বুঝবেন।
যারা বিজেপি বিরোধী ঐক্য ভাঙ্গতে চাইবেন- দেশের জনগণের শত্রু বলে তারাই চিহ্নিত হবেন।
পার্টির স্বার্থের উর্ধে উঠে দেশ ও জনসাধারণের স্বার্থকে এগিয়ে রাখার ঐতিহ্য ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে। রইল বাকি দুই ফ্রন্টে সংগ্রামের কথা। মানে কেন্দ্রে বিজেপি ও রাজ্যে তৃনমূল কংগ্রেস বিরোধী লড়াই। ওরকম লড়াই আমরা আগেও জিতেছি, আবারও জিতব।
এবার তৃণমূল কংগ্রেসই প্রমাণ দিক তারা বিজেপি’র বিরুদ্ধে আদৌ লড়াকু না দালাল।