মহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল
প্রলেতারীয় কালচার বা সংস্কৃতি সম্বন্ধে সমাজবাদী মতবাদ একটা বিপ্লবী মতবাদ। ইতিহাসের প্রথম সমাজবাদী রাষ্ট্র সোবিয়েত ইউনিয়নের এবং কমিউনিস্ট (তৃতীয়) আস্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠাতা, এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতা ভ্লাদিমির ইলিইচ লেনিন সমাজবাদী চিনের ও রাষ্ট্রের সংগ হিসাবী রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সমাজবাদী সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বহু তত্ত্ব ও নীতি ব্যাখ্যা ও প্রচার করেছিলেন। আজ এই মহান বিপ্লবী নায়কের জন্ম শতবার্ষিক উৎসব উপলক্ষে তাঁর সেই বিপ্লবী সাংস্কৃতিক মতবাদ সম্বন্ধে আলোচনার অবকাশ ও গুরুত্ব অনেক। এই উপলক্ষে লেনিনের রচনা পড়া ও তাই থেকে শিক্ষা লাভ করা প্রত্যেক বিপ্লবী কর্মীর কর্তব্য।
বর্তমান ভারতে সমাজ ব্যবস্থার ও সামাজিক চিষ্টাধারার মধ্যে সাংস্কৃতিক বিকাশের যে পর্যায়ের পরিচয় পাওয়া যায় তার উপর সামন্তবাদী ও দুই শ্রেণীরই প্রভাব সুস্পষ্ট। প্রাচীন সামন্তবাদী চিন্তাধারার প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে। তাকে বিপ্লবী উপায়ে মুছে ফেলা হয়নি বলে তা অবক্ষয়ী অবস্থাতেও জীবিত থেকেছে। ভারতে আধুনিক পুঁজিবাদী চিন্তাধারার প্রভাব প্রাচীন সামন্তবাদী চিন্তাধারার প্রভাবকে সম্পূর্ণ হঠিয়ে না দেওয়ায় বরং তার সঙ্গে আপস করে বিরাজ করতে থাকায়, এদেশের সমাজ জীবনে সামন্তবাদী ভাবধারা নতুন স্বপ্নে অনেকখানি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রক্ষমতার উপর প্রধান শক্তি হিসাবে বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রভাব সমাজ জীবনে এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে তাকে সাহায্য করেছে।
শোষণ-বিরোধী সংস্কৃতি
লেনিনের মতে সামগ্রিকভাবে মতবাদের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা একটা শ্রেণী-ভিত্তিক চিন্তাধারা। এই বিচারে প্রলেতারীয় সংস্কৃতি সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী সংস্কৃতির বিরোধী। প্রথমোক্ত দুই শ্রেণীর সংস্কৃতি নিজ নিজ পদ্ধতিতে সামাজিক শোষণের ধারক ও বাহক। শেষোক্ত বা প্রলেতারীয় সংস্কৃতির আগু লক্ষ্য তামাম শোষণ ব্যবস্থাকে নির্মূল করা। এই মৌলিক শ্রেণীগত বিরোধ শুধু সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই নয়, বর্তমান সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আছে, এবং শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা প্রকট হয়ে উঠছে।
কোন বিপ্লবী শ্রেণী যখন একটি প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীর হাত থেকে বিপ্লবের পথে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়, তখন পুরোন অর্থব্যবস্থার পরিবর্তে তার নিজস্ব বিপ্লবী অর্থব্যবস্থাও গড়ে তোলে এবং তার সাথে সাথে পুরোন। সংস্কৃতির জায়গায় তার নিজস্ব শ্রেণীগত সংস্কৃতিও গঠন করে।
১৯১৭ সনের অক্টোবর (নবেম্বর) মাসে লেনিনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যখন রুশিয়ার শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ মহান অক্টোবর সমাজবাদী, বিপ্লবের পথে সে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, ‘তখন বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পরিবর্তে সোশালিস্ট রাষ্ট্র কায়েম করে, অর্থনীতিক ক্ষেত্রে সমাজবাদী অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলতে আরম্ভ করে। আর সেই সঙ্গে সমাজবাদী সংস্কৃতি গঠনের কাজও চালাতে থাকে।
উৎপাদন-ভিত্তিক শিক্ষা
সাংস্কৃতিক কাজের মধ্যে ব্যাপকতর জনশিক্ষা রুশিয়ার অর্থনীতিক গঠনের কাজে বিশেষভাবে সহায়ক হয় ।। তা ছিল উন্নত অর্থব্যবস্থ। গঠনে অপরিহার্য । এই শিক্ষা সাধারণভাবে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পথে সাহায্য করে। তবে সমাজ- বাদী জনশিক্ষা, বুর্জোয়া ব্যবস্থায় যেমন, সেভাবে কেতাবী বিদ্যায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলে না, কেতাবী শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাকে উৎপাদনের কাজের সাথেও অচ্ছেন- ভাবে যুক্ত করা প্রয়োজন হয়। লেনিন এই শিক্ষার উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। এ ধরনের মিলিত শিক্ষাপদ্ধতিকে ব্যাপক করে তুলতে হলে রাষ্ট্র- ক্ষমতার সাহায্য দরকার, শুধু প্রচারের দ্বারা তা হতে পারে না।
এই পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত ও সার্থক করতে হলে তার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে শ্রেণী-চেতনা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন, যাতে তারা অর্থ- ব্যবস্থা গঠনের কাজে বুর্জোয়া শ্ৰেণীঋণ উৎখাত করে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতিক পরিচালনায় সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর মতবাদ ও রাজনীতির ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কেননা এই শ্রেণীগত মতবাদ ও রাজনীতির অভাব থাকলে, এমন কি অগ্রণী ভূমিকা না থাকলেও, প্রলেতারীয় অর্থব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতি গঠনের কাজ লক্ষ্য- ভ্রষ্ট হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে, হয়েও যায়। এ বিষয়ে লেনিনের হুঁশিয়ারি সকল সময়েই মনে রাখা প্রয়োজন ।
সংস্কৃতির মূল মনের গভীরে
প্রলেতারীয় অর্থব্যবস্থা গঠনের কাজ সম্ভব হয় শ্রমিক শ্রেণী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবার পর, প্রলেতারীয় একনায়কত্ব কায়েম হবার পর কারণ রাষ্ট্রক্ষমতার সাহায্য ছাড়া, বুর্জোয়া শ্রেণীর শোষণ-ভিত্তিক অর্থব্যবস্থাকে নির্মূল করে সমাজবাদী অর্থব্যবস্থা গঠন করা সম্ভব নয়; অর্থব্যবস্থার এই শ্রেণীগত মৌলিক পরিবর্তন ঘটাবার বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শ্রেণীর তীব্র প্রতিরোধ দমন ও ব্যর্থ করে, তাকে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করে পথ পরিষ্কার করে দিতে পারে একমাত্র প্রলে শরীর রাষ্ট্রক্ষমতা।
কিন্তু সংস্কৃতি ক্ষেত্রে শ্রেণীগত বা মতবাদগত পরিবর্তন ঘটাবার কাজ আরম্ভ করবার জন্য, বুর্জোয়। সমাজে প্রলেতারীয় সংস্কৃতির প্রচারের কাজ অন্তত কিছু পরিমাণে চলতে পারে প্রলেতারীয় একনায়কত্ব কায়েম হবার আগেও।
সমাজজীবনে সংস্কৃতির ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক, সমাজ জীবনের সমানই ব্যাপক । সামগ্রিকভাবে সমাজ জীবনে যেমন, তেমনি সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনেও, তার চিন্তা ও চেতনার মধ্যেও, প্রচলিত সামাজিক সংস্কৃতির কিছু না কিছু প্রভাব থাকতে পারে। যে মতবাদকে অবলম্বন করে প্রত্যেক মানুষের বা ব্যক্তির মধ্যে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্বন্ধে চিন্তা, চেতনা, মত ও ধারণা উদ্ভুত ও পুষ্ট হয়, গড়ে ওঠে, তার প্রভাব শুধু ব্যাপকই হয় না, সমাজের ও ব্যক্তির মনের গভীরেও তা প্রবেশ করে, শিকড় গাড়ে।
তাই কোন শ্রেণী তার রাষ্ট্রক্ষমতার সাহায্যে তার বিরোধী শ্রেণীর অর্থ- ব্যবস্থাকে যত অল্প আয়াসে ও যত অল্প কালের মধ্যে ভেঙ্গে দিয়ে, চূড়ান্তভাবে ধ্বংস ও নির্মূল করে নিজস্ব অর্থব্যবস্থা গড়তে ও কায়েম করতে পারে, সেই শ্রেণী তার রাষ্ট্রক্ষমতার হাজার সাহায্য নিয়েও তত অল্প আয়াসে ও তত অল্প সময়ে তার বিরোধী শ্রেণীর সংস্কৃতিকে চূড়ান্তভাবে ও স্থায়ীভাবে নির্মূল করে নিজস্ব সংস্কৃতিকে কায়েম করতে পারে না। একথা বিশেষভাবে খাটে শোষণ-বিরোধী প্রলেতারীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে ৷
দীর্ঘস্থায়ী শ্রেণীসংগ্রাম
কোন অর্থব্যবস্থাকে ভাঙা বা গড়া হ’ল কি না, কোন শ্রেণীর অর্থব্যবস্থা ধ্বংস করে অন্য কোন শ্রেণীর অর্থব্যবস্থা গঠন করা হ’ল, তার পরিচয় ও প্রমাণ দৃশ্যতই ও সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু সংস্কৃতি যখন কোন ব্যক্তির মন ও মানসিকতাকে অবলম্বন করে বাহ্যত অদৃশ্য অবস্থায় থাকে, শুধু তার চিন্তা, চেতনা, মত ও ধারণার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়—যে মানসিকতাকে, যে চেতনা বা মত প্রভৃতিকে গোপন করা বা অপরের অলক্ষ্যে রেখে কাজ করা সম্ভব—তখন তাকে ধরা বা তার নিশ্চিত পরিচয় পাওয়া সহজ হয় না, অনেক সময় সম্ভবও হয় না। তা আরো কঠিন বা অসম্ভব হয় এই কারণে যে কোন একটা বিশেষ ধরনের চেতনা বা ধারণা যার মনকে অবলম্বন করে থাকে, তার কাছেও তা অস্পষ্ট হতে পারে, তার অজান্তেও কাজ করে যেতে পারে। কোন নতুন-গড়া সমাজব্যবস্থার মধ্যে পুরোন শ্রেণীর সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনা নির্মূল করে নতুন শ্রেণীর সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনাকে কায়েম করা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ এবং দীর্ঘস্থায়ী সঠিক শ্রেণী- সংগ্রামের উপর নির্ভরশীল। সমাজে অর্থব্যবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটানোর পরও মৌলিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শ্রেণীগত রাজনীতির ভূমিকা ও নির্দেশ অগ্রগণ্য ও অপরিহার্য ।
মতবাদগত প্রচারের সুযোগ
তাহলে এ কথা বলা যায় যে আমাদের দেশে বর্তমানে প্রধানত বুজোয়া শ্রেণীর স্বার্থের উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা কায়েম থাকা সত্ত্বেও এই সমাজের মানুষের চিন্তা ও চেতনাকে পরিবর্তন করবার জন্য মীর্কসবাদী-লেনিনবাদী বা প্রলেতারীয় অর্থনীতিক তত্ত্ব ও নীতির মতো সাংস্কৃতিক তত্ত্ব ও নীতি প্রচার করা যেতে পারে। এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে বুজোয়। শোষণ ব্যবস্থা পরিবর্তন করবার পূর্বেও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তা ও চেতনার মধ্যে, তাদের মত ও ধারণার মধ্যে, তাদের মানসিকতার মধ্যে অনেক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
এই উপায়ে তাদের মধ্যে শোষণ-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে তার পরিবর্তে শোষণ-হীন সমাজ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ও উৎকর্ষ সম্বন্ধে এবং তার সপক্ষে তাদের মনে নতুন চিন্তা ও চেতনা জাগিয়ে তোলা এবং ক্রমশ তাদের প্রলেতারীয় সমাজ বিপ্লবের পক্ষে সচেতন ও সংগঠিত করা সম্ভব ।
এই সম্ভাবনা থাকে বলেই ইতিহাসে শ্রেণী বিপ্লব বা সমাজ বিপ্লব ঘটেছে এবং আরো ঘটবে। সেই কারণেই আমাদের দেশেও বুর্জোয়া-জমিদার রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং অর্থব্যবস্থা ও সংস্কৃতি কায়েম হওয়া ও বজায় থাকা সত্ত্বেও প্রলেতারীয় মতবাদের পক্ষে, জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্টের মতবাদগত বুনিয়াদের পক্ষে ব্যাপক জনমত ও বিপ্লবী চেতনা গড়ে উঠছে, বিপ্লবী পরিস্থিতির উদ্ভবকে চিনতে ও স্বীকৃতি দিতে পারা যাচ্ছে ।
এ সবই মার্কস ও এঙ্গেলসের প্রবর্তিত প্রলেতারীয় মতবাদ ও তত্ত্বগুলিকে লেনিনের তত্ত্ব ও নীতি অনুসারে উপযুক্ত ক্ষেত্রে ও বাস্তব পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা সম্বন্ধে তাঁর শিক্ষার ফল। পুঁজিবাদী দুনিয়ার কোটি কোটি শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ এই সব তত্ত্ব ও নীতির দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে বিপ্লবের পথে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমান প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন তারই একটা বহিঃপ্রকাশ ।
এই আন্দোলনের একটা প্রধান কাজ বর্তমান প্রতিক্রিয়াশীল ও অবক্ষয়ী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আরো ব্যাপক ও শক্তিশালী অভিযান সৃষ্টি করা। যারা এই আন্দোলনে এবং জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে ও সাধারণভাবে প্রলেতারীয় বিপ্লবে বিশ্বাসী, এ বিষয়ে তাদের যথেষ্ট দায়িত্ব আছে ৷
প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন
প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনা করতে হলে আমাদের দেশের, বিশেষত বাংলাদেশের রাজনীতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ও তার কর্মী ও সমর্থকরা বর্তমানে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে নিজেদের রাজনীতিক লক্ষ্য বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। এই লক্ষ্যে পৌঁচবার জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার জনগণের গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। প্রলেতারীয় নেতৃত্বে গঠিত এই ফ্রন্ট সমাজবাদী বিপ্লবেরই একটা প্রাথমিক স্তরের বিপ্লবী সংগঠন। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও বৃহৎ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক শ্রেণীগুলিকে সংগঠিত করে, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কয়ক মিতালির ভিত্তিতে শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য পেটিবুর্জোয়া এবং জাতীয় বুজোয়া শ্রেণী পর্যন্ত সমস্ত গণতান্ত্রিক শ্রেণী ও শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করতে হবে।
এই ফ্রন্ট গঠনের উদ্দেশ্যে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে যে রাজনীতিক প্রচার আন্দোলন চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে, তাকে পুষ্ট ও জোরদার করে তোলবার জন্য, তাকে আরো ব্যাপক ও তীব্র শ্রেণী সংগ্রামের পথে পরিচালিত করবার কাজে সাহায্যের জন্য প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্ব সমধিক।
জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের কাজটা কেবল রাজনীতিক বা সাংস্কৃতিক কর্মীদেরই দায়িত্ব নয়। বাংলাদেশের সমাজের বৃহত্তম অংশ কৃষক ও ক্ষেতমজুর শ্রেণী গ্রামাঞ্চলে কারিগর প্রভৃতি অন্যান্য মেহনতকারী শ্রেণীও আছে। তাদের অধিকাংশই নিরক্ষর। তাদের সাধারণ শিক্ষা দেবার কাজে ছাত্র ও যুব সমাজ যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। দেশকে চিনতে হলে তার পক্ষে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহযোগিত। একাস্ত প্রয়োজন । এই সহযোগিতার দ্বারা ছাত্র ও যুবকেরা জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনে সাহায্য করতে পারে।
এ প্রয়োজন শ্রমিকদেরও আছে, অন্যান্য শ্রেণীর লোকের চেয়ে বেশিই আছে। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বেই তোয়ের হবে শ্রমিক-কৃষক মিতালি । সেজন্য কৃষকদের বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে শ্রমিক শ্রেণীকে। তার জন্য কেবল নীতির প্রচারই যথেষ্ট নয়, কৃষকদের সঙ্গে সশরীরেও যোগাযোগ রাখা এবং তাদের রাজনীতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, উৎপাদনের কাজ ও জীবনযাত্রা সম্বন্ধে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করা প্রয়োজন৷ এই উপায়েও কিছু পরিমাণে রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক প্রচারের কাজকে এগিয়ে নেওয়া হবে। একাজ ইতিমধ্যেই চলছে।
শোষক শ্রেণীদের স্বার্থে বিশ্বাসঘাতকতা
এ বিষয়ে বাংলার যুক্তফ্রণ্টও একটা ভূমিকা পালন করেছে। গত এক বছরে ( ১৯৬৯-৭০ ) যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে এবং তার সাহায্যে বাংলার শ্রমিক শ্রেণী তার শক্তিশালী আন্দোলনের ও সংগঠনের জোরে বিভিন্ন শিল্পে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দাবি আদায় করেছিল এবং সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নিজের রাজনীতিক চেতনা ও সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়ে নিতে পেরেছিল। তার ফলে স্বভাবতই মালিক শ্রেণী ও তার সমর্থকরা শ্রমিকদের সাংগঠনিক শক্তির ও তার সমর্থক যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে ৷
তেমনি জমি ও ফসলের আন্দোলন উপলক্ষে ( ১৯৬৯-৭০ সনে ) গ্রামাঞ্চলে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে যে ব্যাপক অভ্যুত্থান দেখা দিয়েছিল, তার মধ্যে দিয়ে লক্ষ লক্ষ কৃষক ও খেতমজুর লক্ষ লক্ষ বিঘা জমি ও তার ফসল পেয়ে ছিল, এবং নিজেদের রাজনীতিক চেতনা ও সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে পেরেছিল। স্বভাবতই গ্রামাঞ্চলের কায়েমী স্বার্থবাদী জোতদার শ্রেণী ও তার সমর্থকরা সেজন্য যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। বিক্ষোভের কারণ যুক্তফ্রন্ট সরকার পূর্বেকার কংগ্রেস সরকারের মতো কৃষকদের আন্দোলন দমন করার জন্য পুলিস পাঠিয়ে জোতদারদের সাহায্য করেনি এবং তা না করায় কৃষকদের অভ্যুত্থানকেই। সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
শ্রমিক ও কৃষকদের শ্রেণী আন্দোলনকে এবং সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন না করে এইভাবে সাহায্য করাই ছিল অবশ্য যুক্তফ্রন্টের -সর্বসম্মত ও স্বীকৃত নীতি। সেজন্য সংগীত, নাটক প্রভৃতি মারফত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীরা সংগ্রামী জনগণের মনে উৎসাহ সৃষ্টি করেছিলেন, যুক্তফ্রন্ট এই জনকল্যাণকর নীতিকে কার্যকরী করবার জন্য তাদের আন্দোলনে সাহায্য করেছিলেন। আন্দোলনে এ ছিল প্রলেতারীয় সংস্কৃতির অবদান। অথচ যুক্তফ্রন্টের ও তার সরকারের এই নীতিকে কাজে পরিণত করবার যেটুকু ব্যবস্থা হয়েছিল, তাতে শ্রমিক ও কৃষকদের শ্রেণীসংগ্রাম যতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছিল, তাই দেখেই যুক্তফ্রন্ট-বিরোধী কারেনা স্বার্থবাদীরা ভীত সং হয়ে উঠেছিল এবং তা শহরের ও গ্রামাঞ্চলের বড় বড় শিল্পপতি ও জোতদার মহাজনদের পৃষ্ঠপোষক কয়েকজন যুক্তফ্রন্ট নেতার নিকট অসহনীয় বোধ হয়েছিল।
তারা বুঝেছিলেন এর দ্বারা গ্রামাঞ্চলে সামন্তবাদী শোষক শ্রেণীর প্রভুত্বের ও দাপটের দিন ফুরিয়ে আসছে। তাই তাঁরা জনগণের স্বার্থকে পদদলিত করে তাদেরই তৈরী করা যুক্তফ্রন্ট ও তার সরকারকে ভেঙে দিয়ে খোলাখুলি নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল ও জনবিরোধী শ্রেণী চরিত্রের পরিচয় দেন এবং জনগণের যুক্তফ্রণ্টের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তারপর আসে রাষ্ট্রপতির শাসন। আর আসে জনসাধারণের উপরে পুলিশী হামলা, জুলুম ও নির্যাতন।
এই নতুন রাজনীতিক পরিস্থিতিতে যুক্তফ্রন্ট আমলের সফলতাগুলিকে রক্ষা করবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে । সেজন্য সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আরো নতুন -কাজের দায়িত্ব এসে পড়েছে। সে দায়িত্ব সাংস্কৃতিক কর্মীরা নিশ্চয়ই যথাযথ পালন করবেন। সরকারী দমন ব্যবস্থার প্রতিরোধেও এগিয়ে আসবেন। কারণ প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক কর্ম প্রলেতারীয় রাজনীতিক প্রচারের সহায়ক।
জনগণের “সংগ্রামের হাতিয়ার” যুক্তফ্রন্ট সরকার এই এক বছরের মধ্যেই যতটুকু কাজ করতে পেরেছিল তার দ্বারা জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের কতকটা অগ্রগতি অবশ্যই হয়েছে, গণ-আন্দোলনের ও শ্রেণী আন্দোলনের অগ্রগতির ভিতর দিয়ে বেশ খানিকটা রাজনীতিক ও বিপ্লবী চেতনা ও সংগঠিত শক্তি প্রকাশ পেয়েছে ৷ যুক্তফ্রন্টেরও শোষিত মেহনতকারী জনগণের এই সফলতা ও অগ্রগতিকে সাংস্কৃতিক -কর্মের দ্বারা জনগণের সামনে তুলে ধরা দরকার। সেই সঙ্গে দরকার কোন কোন শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে কোন্ কোন্ শ্রেণীর স্বার্থ বরবাদ করবার আগ্রহের ফলে এই বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে, তাও জনগণের সামনে প্রকাশ করে দেওয়া। জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের অগ্রগতিতে বাধা দিয়ে কারা শ্রমিক ও কৃষকদের স্বার্থে আঘাত করেছে এবং কেন তা করেছে, আর এই অপকর্মে কারা তাদের দোসর ছিল, সেকথা ব্যাখ্যা করবার উদ্দেশ্যে রাজনীতিক প্রচারে সাহায্য করবার জন্য সাংস্কৃতিক কাজের প্রয়োজন। এটা বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রলেতারীয় সংস্কৃতির শ্রেণী নীতি প্রয়োগের একটা ক্ষেত্র।
প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক প্রচারের জোর যত বৃদ্ধি পাবে সেই অনুপাতে প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি তার বিরোধিতা তীব্রতর করবে। সেজন্য কায়েমী স্বার্থের রক্ষা করা ও তাদের সরকার ভয় ও প্রলোভনের দ্বারা প্রলেতারীয় সংস্কৃতির অগ্রগতিকে যথাসাধ্য বাধা দিতে চেষ্টা করবে। এই অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী অবক্ষয়ী সংস্কৃতির প্রচারের জন্যও নতুন নতুন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে। তার একটা নমুনা কলকাতার “মুক্ত মেলা”। এই প্রচেষ্টা যুক্তফ্রন্টের সময় দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল, রাষ্ট্রপতির শাসন ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার শুরু হয়েছে। এই ধরনের অনুষ্ঠানকে আপাত-নির্দোষ বলে দেখানো হয় কিন্তু তার সাহায্যে সুস্থ ও প্রগতিশীল রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক প্রচারের পথ রুদ্ধ করবার উদ্দেশ্যে মানুষকে অন্য পথে টেনে নেবার ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলবার চেষ্টা হয়ে থাকে । “মুক্ত মেলার বেলেল্লাপনা” এখন আর “কমিউনিস্ট প্রচার” নয়, অপসংস্কৃতির অনুষ্ঠান।
“সাংস্কৃতিক” অনুষ্ঠানের মারফতে এই রাজনীতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির বিরুদ্ধে সমস্ত প্রগতিশীল মানুষকে সজাগ ও সচেতন হতে হবে।
অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে জেহাদ
জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনে প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। উপন্যাস, নাটক, সংগীত, ফিল্ম, সাংবাদিকতা ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকেই তাকে সাহায্য করা যায়। প্রলেতারীয় মতবাদ বা মার্কসবাদী- লেনিনবাদী দর্শন ও নীতি প্রচার করতে এগুলির প্রত্যেকটিরই প্রভূত শক্তি ও সম্ভাবনা আছে। কেবল দেখতে হবে তা যেন প্রকৃত প্রলেতারীয় শ্রেণী- সংগ্রামের ধারক ও বাহকের কাজ করে, সংশোধনবাদের ও হঠকারিতার এবং গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সঠিক পথে কাজ করে, আর্ট বা শিল্পকলাকে বিমূর্ত ও প্রাণহীন আর্ট হিসাবে না দেখে শ্রেণী সংগ্রামের সক্রিয় হাতিয়ার বলে গ্রহণ করে, আর সমাজের সম্পদ উৎপাদনকারী শ্রেণীকে সমাজের তামাম সম্পদ ও শক্তির এবং সমস্ত সংস্কৃতির মূল উৎস বলে স্বীকৃতি দেয়।
কিন্তু আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক প্রচারের এই বাহনগুলিকে যেরূপ ব্যাপক ভাবে অপসংস্কৃতির ও অবক্ষয়ী সংস্কৃতির প্রচারের কাজে লাগানো হচ্ছে, সে কথা ভাবলে এদেশে সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তার কারণ দেখা দেয় ৷ যারা জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুর জয়গান করে, যারা আলোকের পরিবর্তে অন্ধকারের মহিমা কীর্তন করতে ভালবাসে, যাদের চোখে সামাজিক সম্পদ সৃষ্টিকারীর চেয়ে পরগাছা নিষ্কর্মার কদর বেশি, তারা লেনিনবাদী সাংস্কৃতিক নীতির বিরোধিতাই করতে পারে এবং করবেও সেইজন্য তাদের প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সংস্কৃতির বলিষ্ঠ সংগ্রাম দরকার । প্রলেতারীয় অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে গণ আন্দোলনের জোয়ারের সাথে সাথে প্রলেতারীয় গণ সংস্কৃতির আন্দোলনকেও তাই বিপুল শক্তিতে এগিয়ে নিতে হবে।
দেশের বর্তমান অর্থনীতিক সংকট যেভাবে ক্রমশই গভীরতর হয়ে উঠেছে, তাতে পুঁজিবাদী-সামন্তবাদী সাংস্কৃতিক সংকটও তীব্রতর হতে থাকা স্বাভাবিক। তার উপর সাম্রাজ্যবাদী, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অবক্ষয়ী সংস্কৃতির নোংরা ক্রিয়াকলাপের রুচিবিকারের প্রভাব তাকে আরো গভীর পঙ্কের মধ্যে টেনে নিতে চেষ্টা করছে। তার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ সংগঠিত প্রতিরোধ একান্ত প্রয়োজন। সে প্রতিরোধ সংগঠন করতে পারে প্রলেতারীয় রাজনীতির দ্বারা পরিচালিত গণ আন্দোলনের সঙ্গে প্রলেতারীয় গণ সংস্কৃতির আন্দোলনের মিলন। লেনিনবাদী সাংস্কৃতিক তত্ত্ব ও নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলনই পারে সফলভাবে সে কাজ করতে।
বিপ্লব ও বাস্তবধর্মী শিল্পকর্ম
‘আমাদের দেশে যেখানে সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী সংস্কৃতিকে সাধারণ মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত, তাকে, প্রতিক্রিয়াশীল ও অবক্ষয়ী সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হলে তার বিরুদ্ধে প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক মতবাদকে জেহাদ ঘোষণা করতে হবে, সেজন্য প্রলেতারীয় রাজনীতিক চেতনা ও মনোবল নিয়ে লড়তে হবে, তার হাত থেকে সুস্থ ও প্রগতিশীল সংস্কৃতিকে উদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজবাদী বা প্রলেতারীয় সংস্কৃতিই হচ্ছে জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ও তার সমাজ ব্যবস্থার সংস্কৃতি, তার একটা বিশেষ স্তর। তাই সে জেহাদ শুরু করতে আর বিলম্ব করা উচিত নয় ।
*১৯৭৮ সালে গননাট্য পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ। মূল লেখার বানান ও অনুচ্ছেদ বিন্যাস অপরিবর্তিত।