ww
শান্তনু দে
প্রথমত, লালকেল্লা থেকে জাতীয় পতাকা সরানো হয়নি। নামানোও হয়নি। এমনকি স্পর্শ পর্যন্ত করা হয়নি। ওড়ানো হয়নি খালিস্তানি পতাকাও।
একাধিক ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট, লালকেল্লায় প্রবেশের মুখে লাহোর গেটে দিনভর পতপত করে উড়েছে তেরঙা ঝান্ডা। অথচ, বেলা গড়াতেই টাইমস নাউ’র মুখ্য সম্পাদক রাহুল শিবশঙ্কর পর্যন্ত দাবি করে বসেন, ‘জাতীয় পতাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে!’ একটি পতাকা তোলা হয়েছে, তা হতে পারে কৃষক ইউনিয়নের, কিংবা কোনও ধর্মীয় পতাকা। বিজেপি’র আইটি সেলের তৎপরতায় সোস্যাল মিডিয়াতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ওটা ‘খালিস্তানি পতাকা’। বিজেপি’র দিল্লি শাখার মুখপাত্র হরিশ খুরানা, বরুন গান্ধীর সংসদীয় সচিব ঈশিতা যাদব এই দাবিতে সুর চড়ান। উগ্র দক্ষিণপন্থী ওয়েরসাইট ওপিইন্ডিয়া রীতিমতো একটি নিবন্ধ লিখে ফেলে দাবি করে প্রতিবাদীরা লালকেল্লা থেকে উড়িয়েছে খালিস্তানি পতাকা। ঘটনা হলো, লালকেল্লায় যে পতাকা ওড়ানো হয়েছে, তা আদৌ খালিস্তানি পতাকা নয়। শিখ ধর্মীয় পতাকা। নিশান সাহিব। আর নিশান সাহিবকে খালিস্তানি পতাকা বললে, সমস্ত গুরুদ্বার-ও খালিস্তানি, সমস্ত শিখও খালিস্তানি। ঘটনা হলো সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজেও থাকে এই শিখ পতাকা। এবারেও ছিল। আর এই সবই বেআব্রু করেছে তথ্য যাচাইকারী ওয়েবসাইট।
দ্বিতীয়ত, বিক্ষিপ্ত কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তাকে ছাপিয়ে গিয়েছে লক্ষ লক্ষ কৃষকের ট্রাক্টর মিছিল। শেষে কৃষকরা সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুর সীমান্তে ফিরে এসেছেন। জনতার রোষে একজন পুলিশেরও মৃত্যু হয়নি। অবশ্য গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন উত্তরাখণ্ডের বাজপুরের একজন কৃষক। ক’দিন আগেই তাঁর বিয়ে হয়েছিল।ঠিক ছিল কৃষকদের মিছিল নির্ধারিত পথেই রাজধানীতে প্রবেশ করবে। তবে সীমান্তের কাছেই থাকবে। এবং ফিরে আসবে। তবে নির্ধারিত পথের বাইরে বেরিয়ে একদল রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কৃষক নেতারা নিরস্ত করার চেষ্টা করেন। পুলিশ নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাস ছোডে। বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে। তাতে পরিস্থিতির অবনতি হয়। সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতারা সোস্যাল মিডিয়াতে বারংবার আবেদন করেন— কোনওরকম হিংসায় যুক্ত না থেকে মূল যাত্রাপথে ফিরে আসার জন্য। মোর্চা এই ঘটনার সঙ্গে কোনও যোগসাজশ অস্বীকার করেছে। একইসঙ্গে, শান্তিপূর্ণ প্যারেডে দুষ্কৃতীদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে অশান্তি তৈরির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ জানিয়েছে।
তৃতীয়ত, বিক্ষিপ্ত হলেও এই অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্য দায়ী কে? নৈরাজ্য কে ডেকে আনতে চেয়েছে? কে চাইছে নৈরাজ্য? কে প্ররোচিত করে চলেছে নৈরাজ টানা ষাটদিন। দিল্লিতে হু হু করে নেমেছে তাপমাত্রা। শেষে শূন্য ডিগ্রিতে। হাড়হিম করা ঠাণ্ডা। সঙ্গে বৃষ্টি।
সরকার তবু নির্বিকার। দিল্লি সীমান্তে অবস্থানে আত্মহত্যা। ১৪১ জন প্রতিবাদীর মৃত্যু। সরকার তবু নীরব। বিক্ষোভ রুখতে শুরুতেই সীমান্ত ‘সিল’ করে দেয় হরিয়ানা সরকার। দিল্লির পথে বেরিয়ে পড়া কৃষকরা যাতে রাজধানীতে প্রবেশ করতেই না পারেন। স্বাধীন দেশে লঙ্ঘিত হয় ব্যক্তি-মানুষের অবাধ গতিবিধির অধিকার। মধ্য রাতে চলে কৃষক নেতাদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। গ্রেপ্তার হন সত্তর জনের বেশি কৃষক নেতা। রাজ্যে জারি করা হয ১৪৪ ধারা। শেষে রাজধানীর সীমান্তে ব্যারিকেড।
রাস্তা খোঁড়া। আন্দোলনকারী কৃষকরা রাস্তা আটকাননি। তাঁরা যাতে দিল্লিতে ঢুকতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে সরকার নিজেই রাস্তা কেটেছে। রাস্তা আটকেছে। কাজেই, এখানে রাস্তা বন্ধ করে জনজীবনে ব্যাঘাত ঘটানোয় কেউ যদি দায়ী হয়, তবে তা সরকার। নতুন কৃষি আইনে দেশের সাংবিধানিক চরিত্র ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এক দিক থেকে নয়। দু’দিক থেকে। নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকারের দিক থেকে, এবং রাজ্যের অধিকারের দিক থেকে।
দেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে অধিকার দিয়েছে, কোনও বিষয়ে কোনও বিবাদ বা মতানৈক্য হলে আমরা আদালতের শরণাপন্ন হতে পারি ন্যায়বিচার প্রার্থনা করে। কিন্তু নতুন কৃষি আইনে বলা হয়েছে, কৃষিক্ষেত্রের বিবাদ নিয়ে আদালতে যাওয়া যাবে না। যেতে হবে সরকার-নির্দিষ্ট কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে। জেলাশাসকের কাছে। সরকারের বিরুদ্ধে, অথবা সরকার-ঘনিষ্ঠ কোনও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে সরকারের তৈরি করা প্রতিষ্ঠানের কাছে গেলে ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে কি?তাছাড়া, যে দায়িত্ব স্পষ্টতই আদালতের, সরকার সেটা কেড়ে নিতে চাইছে। আদালতের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে নাগরিককে বঞ্চিত করছে।
এবং, এই প্রবণতা যে শুধু কৃষিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। রক্তশূন্য কৃষি অর্থনীতি। বাড়ছে চাষের খরচ। বীজ, সার, কীটনাশকের দাম। অন্যদিকে কমছে ফসলের দাম। কৃষকের অভাবী বিক্রি। আত্মহত্যার মহামারি। আজকের জরুরি দাবি তাই ফসলের দেড়গুণ দাম।
চতুর্থত, কেন্দ্রের মন্ত্রীরা কখনও দেগে দিয়েছেন ‘খালিস্তানি’। কখনও বলেছেন পাকিস্তান, কিংবা চীনের এজেন্ট। আবার কখনও দেখেছেন আর্বান নকশাল, মাওবাদীদের ইন্ধন। কৃষকদের এই প্রতিবাদ নাকি ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়েছে অতি-বাম ও মাওবাদীরা। শেষে ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাংয়ের সদস্য’ বলে পর্যন্ত দাগিয়ে দেওয়া। শেষে সাধারণতন্ত্র দিবসে কৃষক প্যারেডকে ‘দেশদ্রোহী’, ‘খালিস্তানি’ তকমা দেওয়ার ছক। সঙ্ঘের নিখুঁত পরিকল্পনায় বিজেপি’র আইটি সেলের তৎপরতায় মুহূর্তে তা সোস্যাল মিডিয়াতে ‘ভাইরাল’ করা হয়েছে। যে আরএসএস প্রতিদিন সকালে বাচ্চাদের মাঠে হাজির করে তরোয়াল খেলা শেখায়, তারাই দিল্লির রাস্তায় একখানা কৃপাণ দেখে গেল গেল রব তুলেছে। পরিকল্পিত ধ্যস্টামো চলছে মূলস্রোতের মিডিয়াজুড়ে। কে বলবে মধ্যরাতে স্বাধীনতার পতাকা প্রথম ওড়ানো হয়েছিল যে কেল্লা থেকে, তাকেই এরা লিজে তুলে দিয়েছে বেসরকারি হাতে! স্বাধীনতা দিবসে যে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন, সেই ঐতিহাসিক স্মারকের যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের ভার এখন ডালমিয়া গোষ্ঠীর হাতে!
পঞ্চমত, শ্রেণি সংঘাত স্পষ্ট। প্রকট শ্রেণি বিভাজন। আসলেই এক শ্রেণিযুদ্ধ। সামনে আসছে এক নতুন শ্রেণি দ্বন্দ্ব। আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজির সঙ্গে সহযোগিতায় বৃহৎ বুর্জোয়া বনাম ধনী কৃষক ও জোতদার-সহ সমগ্র কৃষকের দ্বন্দ্ব।কর্পোরেটমুখী কৃষি আইনগুলি নিয়ে সংঘাতের একদিকে বৃহৎ বুর্জোয়ারা। অন্যদিকে, ধনী কৃষকসহ তাবৎ কৃষকসমাজ। এমনকি, পুঁজিবাদী জোতদারদের মধ্যেও রয়েছে বিভাজন। দেখা যাচ্ছে শাসক শ্রেণির শরিকদের মধ্যে সংঘাত। শুরু হয়েছে বৃহৎ বুর্জোয়ার সঙ্গে অ-বৃহৎ বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্বও। বিশেষত, বৃহৎ বুর্জোয়ার সঙ্গে ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে নানা সম্ভাবনার রাস্তা।
ষষ্ঠত, সরকার আভাস দিয়ে চলেছে কর্পোরেটমুখী পদক্ষেপ প্রত্যাহারের কোনও প্রশ্নই নেই। কর্পোরেট মিডিয়াতে বৃহৎ বুর্জোয়াদের শ্রেণিস্বার্থের স্পষ্ট প্রকাশ। তারা যথারীতি সরকারকে নিজের অবস্থানে অনড় থেকে কৃষকদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে যাওয়ার আরজি জানিয়ে চলেছে। যেমন টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় এই অবস্থান জানিয়ে বলেছে, ‘সরকার যদি প্রতিবাদীদের চাপে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য অথবা কৃষি আইন নিয়ে সমঝোতা করে, তাহলে তা হবে ভারতে কোনওরকম সংস্কার-প্রয়াসে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অন্তর্ঘাত হানতে পারে, কিংবা রাজধানী অবরুদ্ধ করে দিতে পারে, তার জন্য এক স্পষ্ট বার্তা।’বিপরীতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে শ্রমজীবী ভারত। এই লড়াই শুধুমাত্র কৃষকের নয়। এই লড়াই সবার। এই লড়াই নাগরিক অধিকার রক্ষার। শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব। শুধু সমর্থন নয়। কৃষি আইন, শ্রমআইন— এই জোড়া আক্রমণের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে যৌথ সংগ্রাম।
সরকার এহেন আইন তৈরি করে এখন বলছে বোঝাপড়ার কথা। যার অর্থ, মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়েছে, এখন বোঝাপড়ার মাধ্যমে ঠিক হবে সেটা ফাঁসিতে, নাকি গুলিতে? রাস্তা তাই একটাই— আগে কৃষকবিরোধী দেশবিরোধী সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিল করতে হবে।তাই নজর ঘোরাতে চাইছেন মোদী, আর তার মিডিয়া। সেকারণেই ঐতিহাসিক লড়াইকে আড়াল করতে বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে বড় করে দেখানোর জন্য ঝাপিয়ে পড়েছে কর্পোরেট মিডিয়া!
শান্তনু দে
২৭।০১।২১