প্রভাত পট্টনায়েক
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণের মাধ্যমে ধ্বংসের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবধি সম্প্রসারিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম সেরা স্নাতক স্তরের পাঠ্যক্রম ছিল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান এদেশে সমাজবিজ্ঞানের নানা বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে ভারতবর্ষের শহুরে আধিপত্যবাদকে প্রশ্নের মুখোমুখি টেনে আনতে শিখিয়েছে। শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই গড়ে উঠেছিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এইসকল প্রতিষ্ঠান এখন এদের অতীতের গৌরব হারিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে আর এস এস অনুগতদের। মূলত সেটাই তাঁদের প্রাথমিক যোগ্যতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পদে নিযুক্ত করা হচ্ছে যোগ্যতাহীন আর এস এস এর কর্মীদের যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ‘দখল’ নেওয়া যায়। ডিন, চেয়ারপার্সন সব পদেই তারা নিজেদের তাঁবেদারদের ক্ষমতাসীন করেছে নিয়ম বর্হিভূত নিয়োগের মাধ্যমে এবং নানাভাবে মেয়াদ বৃদ্ধি করে। বিজেপি সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গণতান্ত্রিক পরিচালনার রীতিনীতিকেও নষ্ট করেছে। নিজেদের গুণ্ডাদের দিয়ে বিরোধীদের আক্রমণ করছে। শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে, তার পাশাপাশি সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ই জরুরী অর্থাভাবে কার্যত ধুঁকছে। একদল ব্যবসায়ী, যারা মূলত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অর্থ সাহায্য করেন, তারা একটা গবেষণামূলক নিবন্ধ বিচার করার জন্য আলোচনায় বসেছেন এমনটা আগে কখনো শোনা যায়নি। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও তার অনুদানকারীদের কাছেও অবগত যে তারা এবিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। কিন্তু এখন তারা শিক্ষাবিষয়ক প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করেছেন এবং বোঝাই যাচ্ছে কাদের ভয়ে এমনটা করতে বাধ্য হচ্ছেন। একাডেমিক বা অন্যান্য গবেষণা যাই হোক না কেন যেকোনো রকম সমালোচনার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিদ্বেষ স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে তার পরিচালন সমিতি এবং বিভিন্ন বিভাগীয় অধ্যাপকদের সকলের দ্বারা ক্রমান্বয়ে সেই বিদ্বেষই প্রতিফলিত হয়েছে।
স্পষ্টতই কোনো নামী বিশ্ববিদ্যালয়ই এমন শর্তাধীন অবস্থায় কাজ করতে পারে না। এখন যদি কোনো গবেষণাপত্র ভারতের দারিদ্র নিয়ে কথা বলে, যা একটি নির্দিষ্ট সময়কালে বেড়েছে এবং সেই সময়কাল এবং বিজেপির শাসনকাল যদি সমাপতিত হয় তখন সেই গবেষককে প্রভূত নিন্দা সহ্য করতে হবে এবং পরিশেষে গবেষককে নিজের লেখা পরিবর্তন করতে নির্দেশ দেওয়া হবে। যদি কোনো গবেষণাপত্রে লেখা হয় গ্রামীন ভারতে মাথা পিছু আয় কৃষি সঙ্কটের জন্য কমেছে এবং সেই সময়কালটা যদি বিজেপির শাসনকালের সাথে এক হয় তাহলে সেই গবেষণাপত্রও সরকারের ইচ্ছানুযায়ী বদলাতে হবে। এই পরিস্থিতিতে গবেষণার কাজ আর বিজেপির সাফল্য প্রচার করা সমার্থক শব্দ। যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকাঠামোই গবেষণার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে, যেহেতু গবেষণা ব্যাহত হলে শিক্ষার কাঠামো ব্যাহত হবে, স্বাভাবিকভাবেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
যাই হোক, অনুদানকারীদের অর্থ সাহায্যে পরিচালিত বা সরকারী কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত বিদেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়ন ও বৈষম্যের ঘটনা আগে দেখা গেলেও ভারতের ক্ষেত্রে এই প্রথম। এই ক্ষেত্রে অবশ্য দুটি মূল পার্থক্য আছে। প্রথমত, বৈষম্য বা নিপীড়নের এই ধরনের সব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপের পেছনে সরকারি হস্তক্ষেপ বা হুমকির কোন প্রমাণ সরাসরি পাওয়া অসম্ভব। এইগুলিকে মূলত অর্থ অনুদানকারীদের শাসকের প্রতি পক্ষপাত হিসাবে দেখানো যেতে পারে কিন্তু কোনো সরাসরি রাজনৈতিক অবস্থান দেখানো হয়না। দ্বিতীয়ত, বিদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য ও নিপীড়নের ঘটনায় এটা দেখা যায় না যে কোন দাতা বা কর্তৃপক্ষ মিলিতভাবে একটি একাডেমিক গবেষণাপত্রের ‘তদন্ত’ করে এবং এর গবেষককে তা পরিবর্তন করতে বলে। গবেষণাপত্রগুলি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচনা করা হয় (peer – reviewed) এবং প্রকাশনার জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন পথ অনুসরণ করে। বিষয়বস্তু পরিবর্তন করার জন্য স্পষ্ট বা অন্তর্নিহিত হস্তক্ষেপ থাকতে পারে; কিন্তু এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা অর্থসহায়তা দাতাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত অস্বাভাবিক; যার দ্বারা এটাই স্পষ্ট হয় যে আসলে ভারতকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এমন রাষ্ট্র যে নিজের বিরূদ্ধে হওয়া কোনো সমালোচনাকেই, এমনকি বৌদ্ধিক চর্চা বা গবেষণার ক্ষেত্রেও, সহ্য করতে পারছে না। এর ফলে সমাজবিজ্ঞানের সকল গবেষণাই বাতিল হয়ে যায়। সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনা, সরকারের গঠন, সরকারের কার্যকলাপ ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিকভাবে গবেষণা না করতে পারেন, যদি সমাজবিজ্ঞানের নিজস্ব পদ্ধতি অবলম্বন করে কোন সত্যের দিকে এগোতে না পারেন তাহলে সমাজবিজ্ঞানে কোনোরকম গবেষণাই কার্যত অসম্ভব। অবশেষে তা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকেও প্রভাবিত করবে। বিজ্ঞান বিষয়ক কোনও গবেষণা যদি হিন্দুত্ব কুসংস্কারকে প্রশ্ন করে তাবে সেই লেখাকেও বদল করতে বলা হবে। ফলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অস্তিত্বজনিত সংকটে আক্রান্ত হবে এবং কার্যত সাধারণ কোচিং সেন্টারে পরিনত হবে।
স্বাধীনতা লাভের পরে ভারতে জনশিক্ষা প্রকল্প শুধুই জনগনের যোগ্যতা কিংবা দক্ষতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ছিল না, সেই সঙ্গে দেশের মানুষ যাতে ভারত নির্মাণে ব্রতী হন সেই কথাও ভাবা হয়েছিল। এক্ষেত্রে ভারত নির্মাণকে ‘জাতি গঠন’ এর মত সংকীর্ণ অর্থে বুঝলে ভুল হবে। আমির খসরু উল্লিখিত ‘ভারতীয় জাতি’ দীর্ঘকাল যাবত ভারত দেশ সম্পর্কে এক প্রাচীন ধারনা হিসাবেই বিদ্যমান ছিল – ব্রিটিশ শাসনে সেই অনুভব আরেকবার সামনে আসে। তখন শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসাবে দেশের স্বাধীনতায় অংশ নেবার বিষয়টি প্রাধান্য পায়, শিক্ষাক্রমে দেশের জনগনের উপরে ঔপনিবেশিক শাসন কিভাবে শোষণ-নিপিড়ন করে চলেছে সেই সম্পর্কে আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পায়। এই শিক্ষাক্রম শুধুই মানববিদ্যা কিংবা সামাজিক বিজ্ঞানের পাঠ্য ছিল না, প্রযুক্তিবিজ্ঞান সহ প্রকৃতি বিজ্ঞানের মূল ধারার ছাত্র-ছাত্রীরাও তার আওতায় ছিলেন। এহেন শিক্ষানুবর্তিতায় দেশের ভবিষ্যৎ সমাজে একাধিক সংবেদনশীল ও কার্যকরী মেধাবৃত্তিকার গড়ে উঠবেন (আন্তনিও গ্রামশী যাদের অর্গানিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল বলে উল্লেখ করেছেন)– এমনই প্রত্যাশা ছিল। নয়া উদারবাদও মেধাবি নির্মাণ করে, তবে সেই মেধা জনসাধারণের হিতে কাজ করেন না, পুঁজির সুরক্ষায় নিযুক্ত থাকেন।
ভবিষ্যতের ভারতে সংবেদনশীল মেধাবৃত্তিকার গড়ে তোলার কথা ভেবেই আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি বুনিয়াদি শিক্ষার পাঠ্যক্রম এবং বিষয়বস্তু উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেকটাই অন্যরকম ছিল। উন্নত দেশসমুহের পাঠ্যক্রমে ঔপনিবেশিক শাসনের দ্বারা উপনিবেশগুলিতে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার কথা, শোষণ–নিপীড়নের কথা সাধারনভাবে কমই বলা হয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে ডি বার্নাল বলতেন ভারতের মতো দেশে উন্নত দেশগুলির সিলেবাসের অনুসারি না হয়ে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান পড়ানোর ক্ষেত্রেও একটি সুনির্দিষ্ট এবং উপযুক্ত পাঠ্যক্রম থাকা উচিত যাতে দেশের প্রয়োজন মেটে – তিনি এমন পাঠ্যক্রমের মূল ভাবনাকে স্যুই জেনেরিস বলে উল্লেখ করেন, এর অর্থ দেশীয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় রোগের প্রোফাইল সংক্রান্ত পড়াশোনায়, ভারতীয় ডাক্তারদের অবশ্যই জোর দেওয়া উচিত এমনসব বিষয়ে যা ব্রিটেনের থেকে আলাদা। এর সাথে সাথেই ভারতীয় ডাক্তারদের অবশ্যই ঔপনিবেশিকতা এবং ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রাম সম্পর্কেও জানতে হবে। আমার নিজস্ব পড়ানোর বিষয় অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একি একই যুক্তি প্রযোজ্য হয়। অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন কোনোদিনই পড়ানো হবে না, অথচ আজকের ভারতে অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিচার বিবেচনায় কিংবা উন্নয়নমূলক অর্থনীতির আলোচনায় ঔপনিবেশিক শাসনের ফলাফল ব্যাতিরেকে কিছুতেই এগোনো যাবে না।
পাঠ্যক্রম সম্বন্ধীয় এমন নীতি অনুসরণ করে ভারতের মতো দেশে শিক্ষাকে যদি তার প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধন করতে হয়, তবে তার বিষয়বস্তু অবশ্যই উন্নত দেশগুলির শিক্ষা থেকে কিছুটা হলেও আলাদা হতেই হবে। এর মানে এই নয় যে ভারতে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন কিংবা গণিতের মৌলিক ধারনাসমুহ পড়ানো উচিত নয়; সহজভাবে বলা যায় যে এই সব বিষয়কেই এমনভাবে একটি সিলেবাসের মধ্যে সংগঠিত করতে হবে যার প্রভাব উন্নত দেশগুলিতে যা শেখানো হয় তার তুলনায় কম হবে না আবার একইসাথে আমাদের দেশের নির্দিষ্ট প্রয়োজনও মিটবে। দীর্ঘকাল ধরে আমাদের দেশের বৌদ্ধিক পরিমন্ডলে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গিই গৃহীত হয়েছে, সমর্থিত হয়েছে।
নয়া-উদারবাদী জমানায় আমাদের সাথে যা ঘটছে তা এর একেবারে বিপরীত। বিশ্বজুড়ে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি এমন কর্মী পেতে চায় যারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে খুব সহজেই স্থানান্তরিত হতে পারে। কর্মীদের এহেন স্বচ্ছন্দ গতিশীলতার প্রসঙ্গ ছাড়াও এক দেশে থেকে আরেক দেশে পূঁজির সঞ্চরণশীলতার জন্য যে অভিন্ন পরিবেশ দরকার তারই সাথে মানানসই হতে হয় নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মীদের মনোভাব এবং মানসিক গঠন – তাই কর্মীদের এদেশ থেকে ওদেশ পাঠানোয় কোনরকম বাধা পূঁজির পছন্দ না। সংক্ষেপে বললে বলতে হয় বিশ্বায়িত পুঁজি আদর্শগতভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্তকেই মূলত পছন্দ করে। কর্মীদের নিয়োগের সময় বড় বড় সংস্থাগুলি চেস্টা করে তারা যেন যতটা সম্ভব একইরকম মনোভাবের হয় এবং যেহেতু বড় বড় শহরগুলিতেই এমন কর্মীদের খুঁজে পাওয়া যায়, তারা সেইসব জায়গা থেকেই কর্মীদের নিযুক্ত করতে পছন্দ করে যারা হয় বড় শহর কিংবা তার খুব কাছের এলাকাগুলির বাসিন্দা।
তাই সারা বিশ্বেই একজাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের বিষয়ে পূঁজিবাদের গভীর আগ্রহ থাকে। নিজেদের মুনাফার স্বার্থে যে অভিন্ন নিয়োগনীতি তারা চালায় তার সামাজিক সমর্থনের ভিত্তি হল ঐ একজাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা। ভারতের মতো দেশে নয়া উদারবাদ সেই ব্যবস্থাই দেখতে চায় এবং মোদি সরকারের নতুন শিক্ষানীতি আসলে সেটাই করার চেষ্টা করছে। উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশসমুহের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পাঠ্যক্রম থেকে টুকে নিয়ে আজকের ভারতে সিলেবাস সংক্রান্ত রূপান্তরগুলি একারনেই নয়া উদারনীতি অনুযায়ী বিশ্বের অন্য কোথাও যা শেখানো হয় তাই শিখতে হবে – এই ধারনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের সাথে এহেন পরিবর্তন নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে নেয়। এটাই মোদি সরকারের অ্যাজেন্ডা। এই হল কর্পোরেট-হিন্দুত্ব আঁতাতের জনশিক্ষা সম্পর্কিত ধারনার মূল কথা যা বর্তমানে ভারতের রাজনীতিতে ক্রমশ আধিপত্য বিস্তার করছে। বিশ্বায়িত পুঁজির স্বার্থের সাথে একীভূত কর্পোরেটরা শিক্ষার এমন পরিবর্তনে খুশি হয় যা উপনিবেশবাদ এবং ঔপনিবেশিক শোষণের প্রভাবের সমস্ত উল্লেখকেই বিলুপ্ত করে দিয়ে একদিকে পুঁজিবাদকে কমবেশি এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা হিসাবেই তুলে ধরে, অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকেও এতে খুশি করা যায়। দেশের জাতীয় শিক্ষাক্রমে প্রাচীন ভারতের তথাকথিত মাহাত্মের স্বীকৃতিটুকু নিয়েই দেশীয় শাসককূল মজে থাকে।
গোটা দেশে পাঠ্যক্রমের এমন একজাতীয়করণের ফলে ভারতে নামীদামী বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিজেদের ক্যাম্পাস স্থাপনে যে বাড়তি সুবিধা পাবে (এই পরিকল্পনার সূচনা অবশ্য মোদি সরকার করেনি, ইউপিএ-২ আমলে তাদের নয়া-উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতেই এই কাজ শুরু হয়েছিল) তাকে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ‘বিশ্ব-মানের’ হয়ে ওঠার অছিলায় ন্যায্যতা যোগানো হচ্ছে। প্রথমত এই যুক্তিটি ভুল, কারণ ‘বিশ্ব মান’ সম্পর্কিত ধারণাটি মেনে নেওয়া এবং আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সেই একই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য উপযুক্ত হতে বাধ্য করা কার্যত বৈদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আধিপত্যকে মেনে নেওয়ারই সমান। ‘বিশ্ব মান’ বলে যে মানদণ্ড স্থির করা হয় তা তো তৈরি করেছে ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিজেরাই। তথাকথিত ‘প্রখ্যাত জার্নাল’গুলি যেখানে লেখাজোখা বেরোলে তবেই গবেষকের কাজকে জ্ঞানের ‘বিশ্ব মান’সম বৈশিষ্ট্য হিসাবে প্রচার করা হয় সেগুলি ঐসব দেশেই অবস্থিত যারা ঔপনিবেশিক শোষণের যাবতীয় উল্লেখগুলি সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। তাই এসব ‘বিশ্ব মান’-এর পিছনে না ছুটে জাতীয় শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য এমন হওয়া উচিত যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে প্রকৃত অর্থে ‘ভারত নির্মাণের’ চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য করে।
অবশ্যই এর অর্থ এমন হবে না যে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি মানের উৎকর্ষতা সম্পর্কে চোখ বন্ধ রেখে চলবে। কিন্তু সেই গুণমানকে অবশ্যই আমাদের নিজস্ব মাপকাঠি দ্বারা বিচার করতে হবে এবং উন্নতিসাধন অবশ্যই এমন পথ ধরে হতে হবে যাতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ‘ভারত নির্মাণ’-এর উদ্দেশ্যকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য না হয়।
দ্বিতীয়ত মনে রাখতে হবে স্বনামধন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্ধ অনুকরণ করা কখনই উৎকর্ষতার উপায় নয়। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজের অন্ধ অনুকরনে আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলি চিরতরে মধ্যমানের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। এমন কোন প্রক্রিয়া আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই মধ্যমেধার দিকে ঠেলে দেবে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির তুলনায় শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সম্পদের অভাব রয়েছে মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতেই, এমন পরিবেশে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেই মডেল হিসাবে দেখানো হলে একটি সার্বিক হীনমন্যতার আবহ তৈরি হবে যা আমাদের উন্নতিসাধনে বাধা দেবে। আর কিছু না হোক শিক্ষান্তে কাজে যুক্ত হয়ে বেঁচে থাকার মতো যে শিক্ষাটুকু আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলি দিতে পারত সেই সুযোগটুকুও হারাবে তারা। অন্যদিকে, যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়োগ করতে যথেষ্ট টাকাকড়ি আছে এবং বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মতো পরিকাঠামোগত সুবিধা দিতেও যারা সক্ষম, তারাও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে প্রতিযোগিতায় হারবেই- সরাসরি প্রখ্যাত কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানোর হাতছানি এড়িয়ে ইয়েলের অনুকরণে গড়ে ওঠা তৃতীয় বিশ্বের কোন প্রতিষ্ঠানে কেউ কেনই বা পড়ে থাকবে?
পুরো বিষয়টিকে অন্যভাবে কম কথায় বলা যায় পাঠ্যক্রম ও তার বিষয়বস্তুর একজাতীয়করন কার্যত ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির ব্যাপারেও আনুসাঙ্গিক একীকরণ ঘটাবে– অর্থাৎ এতে মূলত চাকরি সম্পর্কে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়বে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শেষ করে জনগন এবং দেশের জন্য কিছু করার যে সাধারন মানসিকতা এতদিন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভাবনা ছিল তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে জায়গা করে নেবে পড়াশোনার পরে ভিটেমাটি ছেড়ে যত দ্রুত সম্ভব বিদেশে গিয়ে বড় রোজগারের ভাবনা– মধ্যবিত্তের চিরাচরিত গোপন বাসনায় আরও বেশি ধোঁয়া দেবে নয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের যে কোন দেশে যদি এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে যেখানে ‘দেশ গঠন’, জ্ঞানের উৎকর্ষতার পরিবেশ বজায় রাখা এবং শিক্ষান্তে বিদেশে কাজের সুযোগ সংক্রান্ত উদ্দীপনা তৈরি করতে হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এমন প্রতিষ্ঠানকে বিদেশের প্রতিষ্ঠানগুলির (তারা যতই নামীদামী হোক না কেন) পথ অনুকরণ করার আন্তর্জাতিক চাপকে এড়িয়েই চলতে হবে। কোন দেশে জাতীয় শিক্ষার কার্যক্রমকে নিজের দেশের বাস্তবতার সাথে সহাবস্থানে থাকতে হয়; অন্যথায় তা নিজের আকাঙ্ক্ষিত মান থেকে বিচ্যুত হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর বন্দোবস্তে পর্যবসিত হয়।
ভারতীয় সমাজের নির্দিষ্ট সমস্যাসমূহ (যেমন জাতি এবং বর্ণভিত্তিক শোষণ ব্যবস্থা) দেশের জাতীয় পাঠ্যক্রমে গুরুত্ব হারাবে, কারণ বিশ্বায়িত পুঁজির বিকাশে এই ধরনের সমস্যাগুলি প্রাসঙ্গিক নয়। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরাও এতে হন খুশি কারন এতে তাদের তিলমাত্র শান্তি বিঘ্নিত না হয়েই তলে তলে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীন ‘মহাত্ম্য’-এর প্রচার চালানো যায়। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয় যে জাতীয় শিক্ষানীতির কোথাও একটিবারের জন্যেও ভারতীয় সমাজের এক ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে, অথবা শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ কিংবা পদোন্নতির প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নিয়মকানুনে জাতিগত পরিচয়ের কোনো উল্লেখই নেই। এই নীরবতা আসলে ঐ একজাতীকরণেরই (স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন) অনুসারী পদক্ষেপ।
তাহলে আমরা কি দেখলাম? দেশের স্বনির্ভরতা অর্জনে একান্ত আবশ্যক তিনটি মৌলিক ক্ষেত্রই কার্যত নিজেই স্বনির্ভর না। এই তিনটি বুনিয়াদী ক্ষেত্রে যাতে কোনোভাবেই আমাদের মতো দেশ স্বনির্ভর না হতে পারে, সেটা সুনিশ্চিত করাই নয়া উদারবাদের প্রধান কর্মসূচি। এমতাবস্থায় নয়া উদার অর্থনৈতিক বন্দোবস্তের ভিতরে থেকে কোনোরকম বিকল্পের খোঁজ করা মূল্যহীন। নয়া উদারবাদের কারণে আমাদের দেশের স্বনির্ভরতায় বাধা-বিঘ্ন তৈরি হচ্ছে ভাবলেও ভুল বলা হয়, আসলে নয়া উদারবাদ নিজেই দেশের বিকাশে সবচেয়ে বড় বাধা। তাই বিকল্পের আসল অর্থ নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাকেই উপড়ে ফেলা।