Sartre Cover

Sartre & Social Media: Nothingness or Being Something?

সৌরভ গোস্বামী

‘মানুষ যা হয়ে ওঠে, সে তা-ই’— জঁ-পল সার্ত্র এই কথাটিই বলেছিলেন এক পরাবাস্তব ইউরোপীয় বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাৎসি দখলদারিত্বের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়ে। সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ আমাদের শেখায়, মানুষ অর্থহীন এক জগতে জন্ম নিয়ে নিজের অর্থ নিজেই নির্মাণ করে। কিন্তু আজ, ২০২৫ সালে, যখন ব্যক্তি পরিচয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম, মনোযোগ অর্থনীতি ও কর্পোরেট নজরদারির অধীন; তখন প্রশ্ন ওঠে—এই ‘স্বাধীনতা’ কি কেবল এক ভ্রান্ত প্রতীতি?

আমরা খতিয়ে দেখব, ‘লাইক বাটনের’ দমনমূলক অর্থনীতি ও সেলফি-সর্বস্ব আত্মপরিচয়ের যুগে সার্ত্রীয় অস্তিত্ববাদ কি টিকে থাকতে পারে নাকি একে রূপান্তর করতে হবে— এক অধিকতর বৈপ্লবিক, শ্রেণিসচেতন পথে?

সার্ত্রের স্বাধীনতা বনাম ডিজিটাল পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণ

সার্ত্র যখন বলেন, “মানুষ স্বাধীন—সে নিজেকে ছাড়া আর কেউ তার দায় বহন করে না,” তখন তিনি একটি নৈতিক ও অস্তিত্বগত দৃষ্টিভঙ্গি সামনে আনেন। কিন্তু এই নৈতিক স্বাধীনতার ধারণাটি কি আজকের ‘ডেটা-ভিত্তিক’ পুঁজিবাদের মধ্যে কার্যকর?

আজকের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো—যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক কিংবা এক্স (আগের টুইটার)—ব্যক্তিকে একদিকে মেকি-স্বাধীনতার অনুভূতি দেয়, অন্যদিকে তারা সেই ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে শোষণের এক নতুন রূপে। প্রতিটি ক্লিক, স্ক্রল, পোস্ট—সবকিছু বিশ্লেষণ করে আমাদের সামনে এমন কনটেন্ট পরিবেশন করা হয় যা আমাদের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে পরিচালিত করে।

সার্ত্রের ভাষায়, এটা হলো ‘ব্যাড ফেইথ’—অর্থাৎ আত্মপ্রতারণা। আমরা ভাবি আমরা স্বাধীন; কিন্তু বাস্তবে আমরা এক মার্কেটিং ও নজরদারির পণ্যে পরিণত হয়েছি। পুঁজিবাদ আজ কেবল আমাদের শ্রমই শোষণ করে না, আমাদের মনোযোগ, পরিচয়, ও মানবিক সম্পর্ককেও মুনাফার বস্তুতে পরিণত করেছে।

মার্কস আজ বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন—‘নিউট্রাল’ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে আধুনিক পুঁজিবাদের চেতনাগত আফিম- উত্তর মতাদর্শ।

অন্যের দৃষ্টি: সার্ত্রের গেইজও ডিজিটাল নজরদারি

সার্ত্র Being and Nothingness-এ লিখেছিলেন ‘অন্যের দৃষ্টি’ (gaze) আমাদের আত্মচেতনার রূপান্তর ঘটায়। কেউ যদি হঠাৎ বুঝতে পারে, তাকে দেখা যাচ্ছে, তার অস্তিত্বই পাল্টে যায়।

আজকের ডিজিটাল বিশ্বে এই দৃষ্টি কেবল সামাজিক নয়, বরং কর্পোরেট ও অ্যালগরিদমিক। প্রতিটি পোস্ট, প্রতিটি ক্যাপশন, প্রতিটি ফিল্টার করা ছবি এক নিরব, কিন্তু সর্বব্যাপী দৃষ্টির সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে— যা কেবল মানুষের চোখ নয়, বরং সার্ভার, বিজ্ঞাপনদাতা ও রাষ্ট্রের চোখ।

এটা কেবল পারফর্ম্যান্স নয়, বরং আত্মপরিচয়ের পণ্যে পরিণত হওয়ার বাজার-ভিত্তিক পারফর্মেটিভিটির এক নয়া রূপ। প্রতিটি লাইক-কমেন্ট-শেয়ার হলো একটা সামাজিক বিনিময়মূল্য— যার মধ্যে আত্মীক মেলবন্ধনের কোনো জায়গা নেই।

এখানে সার্ত্র ও মার্কসের সেতুবন্ধন স্পষ্ট: সার্ত্র আমাদের ‘অস্তিত্বগত অস্থিরতা’র কথা বলেন; আর মার্কস বলেন, পুঁজিবাদে সব কঠিন জিনিস গলে পড়ে যায় বাষ্পে (all that is solid melts into air)। ডিজিটাল যুগে মানুষ নিজেই গলে, ক্ষয়ে যাচ্ছে—ডেটা, ক্লাউড, কন্টেন্টে।

সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার: অস্তিত্ববাদী নায়ক, না বাজারের পণ্য?

বর্তমানে ইনফ্লুয়েন্সার সংস্কৃতিকে অনেকেই দেখেন এক রকম আত্মনির্মাণ হিসেবে—যেখানে ব্যক্তি নিজের ব্র্যান্ড নিজে তৈরি করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আত্মনির্মাণ আসলে কতটা স্বতঃস্ফূর্ত, আর কতটা কর্পোরেট প্রয়োজন ও দর্শক/ভোক্তাদের-তুষ্টির জন্য?

একজন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হয়তো নিজের পরিচয় নির্মাণ করছেন, কিন্তু সেটি যদি ক্রমাগত স্পনসর, ট্রেন্ড, বা অ্যালগরিদমিক সমীকরণের মধ্যে আবদ্ধ হয়—তবে তিনি আর ব্যক্তি নন, তিনি নিজেই হয়ে যান ‘পণ্য’।

সার্ত্র বলতেন, ‘মানুষ পাথর নয়, সে পাথর হয়ে ওঠে’। আজকের পুঁজিবাদ সেই ‘হয়ে ওঠাকে’ বেঁধে ফেলেছে বাজারের শর্তে। সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার তখন আর অস্তিত্ববাদী নয়—বরং সে এক পোস্ট-মডার্ন প্রলেতারিয়েত, যার পণ্য হলো সে নিজেই।

দায়িত্ব, বিচার ও পরিবর্তনের সুযোগ

সার্ত্র বিশ্বাস করতেন, মানুষের কাছে সবসময় একটাই পথ খোলা থাকে—নিজের নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেকে পুনর্নির্মাণ করা। পুঁজিবাদি সংস্কৃতি যেভাবে ‘ক্যন্সেল কালচার’ বা বিচারের সংস্কৃতি তৈরি করেছে, তা যেন তার উল্টো রূপ।

কোনো মানুষ একবার ভুল করলেই তার সমস্ত পরিচয় সেই ভুলে সীমাবদ্ধ করা হয়—যেন সে আর পরিবর্তনের অধিকার রাখে না। অথচ বিপ্লবী রাজনীতি শেখায়, মানুষ নিজেকে সংশোধন করতে পারে, সংগ্রামে নিজেদের পুনর্নির্মাণ করতে পারে।

সার্ত্র বলতেন, ‘আমরা যা করেছি, তার জন্য আমরা দায়ী; কিন্তু আমরা যা করব, তাও আমাদেরই হাতে।’ শ্রেণিসংগ্রামের দর্শন বলে, ইতিহাস কখনো স্থির নয়; মানুষ নিজের সংগ্রাম দিয়ে ইতিহাস পাল্টায়।

সার্ত্র ও মার্কস: একটি বিপ্লবী সংশ্লেষণ

সার্ত্র পুঁজিবাদ বিরোধী অর্থনীতিবিদ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর অস্তিত্ববাদ আমাদের শেখায় মানুষ নির্ধারিত নয়, বরং গঠিত হয় তার নিজের সিদ্ধান্তে। এই ধারণা মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদে এক নতুন মাত্রা যোগ করে: মানুষের অস্তিত্ব শুধুমাত্র দর্শন নয়, বরং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্য দিয়েই নির্মিত হয়।

আজকের দিনে, যদি আমরা অস্তিত্ববাদকে বাঁচাতে চাই—তবে সেটিকে মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণে এনে বলতে হবে:

মানুষের স্বাধীনতা কেবল নৈতিক নয়, তা অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক পরিবেশ নির্ভর;

আত্মনির্মাণ সম্ভব, কিন্তু তা হতে হবে শ্রেণিচেতন, দলীয় সংগঠনের মাধ্যমে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক পারফর্ম্যান্স দিয়ে নয়;

সোশ্যাল মিডিয়া যদি হয় আত্মপ্রতারণার আধুনিক রূপ, তবে দলগত সংগ্রামই পারে সেই বিভ্রম ভাঙতে।

লাইক বাটনের বাইরে কী আছে?

সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ আমাদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়: মানুষ কী হবে, তা মানুষ-ই স্থির করে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ যদি দাঁড়িয়ে থাকে পুঁজিবাদী শর্তের ভিত্তিতে, তবে তা কেবল ‘স্বাধীনতা’র ছদ্মবেশে এক প্রকার শৃঙ্খল।

তাই প্রশ্ন হলো, মানুষ কি লাইক, ট্রেন্ড ও অ্যালগরিদমের দাস হয়ে থাকবে, নাকি তাকে ভাঙার জন্য সংগঠিত হবে?

Spread the word

Leave a Reply