চন্দন দাস
মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন থাপ্পড় মারবেন। ‘টেনে থাপ্পড়’।
একটা নয়। চার-চারটে।
কটা মেরেছেন খুঁজে চলেছি আমরা। পাচ্ছি না। কোথায় লুকোল থাপ্পড়গুলি? কোন্ খালে?

২০২২। খুব গরম। ৩০মে। মমতা ব্যানার্জির সভা পুরুলিয়ায়।
তিনি বললেন, ‘‘এত কিছু দিচ্ছি মানুষকে। তবু কয়েকজন এত লোভী কেন হয়ে গিয়েছে? আর কত চাই? আমার পার্টির লোক হলে আমি টেনে চারটে থাপ্পড় মারতাম। তাদের আমি সব সময় শাসন করি।’’
আমাদের জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথা মনে পড়ে যেতেই পারে। ২০১১ থেকে রাজ্যের দশ বছরের খাদ্যমন্ত্রী। ২০২১-এ জানা গেল ২০১৫-১৬ আর্থিক বছর থেকে রাজ্যের রেশন নিয়ে কোনও হিসাবই হয়নি। টানা ৬ বছর খতিয়ে দেখা হয়নি রেশনের সব লেনদেন, টাকার আদান প্রদান আদৌ নিয়ম মাফিক ছিল কিনা। একে বলা হয় ‘পিডিএস অডিট।’ ওই ৬ বছরে রেশনের জন্য কোষাগার থেকে অন্তত ৩০হাজার কোটি টাকার খরচ হয়েছে বলেই দাবি সরকারের। কিন্তু তার কোনও হিসাবই হয়নি।
তাঁর ‘বালু’ তো এখনও মন্ত্রীই আছেন। ‘টেনে চারটে থাপ্পড়’ তাহলে কার গালে পড়েছিল? আদৌ পড়েছিল?
আলিপুরদুয়ারে যাই। ৩ফেব্রুয়ারি, ২০২১। এবার শীতকাল।
রাজীব ব্যানার্জি তখন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে গেছেন। তিনি সেখানে হুঙ্কার দিলেন, ‘‘কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়বে! কোন্ কোন্ নেতা ওই পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে চিঠি দিয়েছিলেন, তার সব নথি আমার কাছে রয়েছে।’’ বন সহায়ক পদের নিয়োগে বনমন্ত্রী থাকাকালীন দুর্নীতি করেছিলেন রাজীব — এমনই তখন অভিযোগ। আলিপুরদুয়ারে তৃণমূলের সভা থেকে মমতা ব্যানার্জিও বলেছিলেন, ‘‘বন সহায়ক নিয়োগে কারসাজি করেছেন রাজীব। আমরা তদন্ত করছি।’’
সেই তদন্তের ভার পড়েছিল সেই জ্যোতিপ্রিয়র উপর। ২০২১-র পর যিনি বনমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু তদন্ত রিপোর্টটি কোথায়? রাজীব আবার তৃণমূলে ফিরেছেন। তিনি এখন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির ছত্রছায়ায়।
প্রশ্ন একই — ‘টেনে চারটে থাপ্পড়’ মুখ্যমন্ত্রী কাকে মেরেছেন?
এবার কলকাতা। এবার বর্ষা। ২০১৯। ১৯জুন।
নজরুল মঞ্চে তৃণমূলের সভা। মমতা ব্যানার্জি বললেন, ‘‘চোরেদের আমি দলে রাখব না।’’ আর কী বললেন? তিনি স্বীকার করলেন,‘‘গরিবদের জন্য বাংলার বাড়ি প্রকল্পে টাকা থেকেও ২৫% কমিশন দলের লোকেরা নিচ্ছে, আমি সব খবর রাখি। সমব্যথী প্রকল্পে দু’হাজার টাকার মধ্যেও ২০০ টাকা কেন নেওয়া হচ্ছে?’’
এই ক্ষেত্রে কটা থাপ্পড় কে কে খেয়েছিলেন? কোনও তালিকা নেই।
এমন উদাহরণ অনেক। শুধু মমতা ব্যানার্জির ভাষণই নয়। সরকারের রিপোর্টে আছে ‘টেনে চারটে থাপ্পড়’ মারার কারন। অনেক।
রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েতগুলির এবং গ্রামের মাতব্বরদের কাজকর্ম সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল মমতা ব্যানার্জির সরকার। ২০১৬-র জানুয়ারিতে। সরকারী এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ‘পঞ্চায়েতী রাজ’-এ। পত্রিকাটি পরিচালনা করে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর।
রিপোর্টটি ছিল সামাজিক নিরীক্ষা বিভাগ (সোসাল অডিট সেকশন)-র। নির্দিষ্ট প্রশ্নাবলীর ভিত্তিতে সমীক্ষা হয়েছিল। তিনটি প্রকল্পের হাল খতিয়ে দেখা হয়েছিল — একশো দিনের কাজের প্রকল্প, আবাস যোজনা এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প( বৃদ্ধ, বিধবাদেরসহ বিভিন্ন ভাতা)। পরে রাজ্যের ৬০টি ব্লকের ৬৩২টি পঞ্চায়েতে এই অডিট বা নিরীক্ষা হয়।
সরকারের পত্রিকায় দুটি জেলার অভিজ্ঞতা বিস্তারিতভাবে ছাপা হয়েছিল। একটি পূর্ব মেদিনীপুর। অন্যটি দক্ষিণ ২৪ পরগনা। প্রথম জেলাটিতে তৃণমূল ছাড়া ২০১৪-১৫ পর্যন্ত কেউ মিছিলও করতে পারতো না। সেই পূর্ব মেদিনীপুরে জেলা নিরীক্ষক দলের পক্ষ থেকে অভিজ্ঞতা লেখা হয়েছিল,‘‘…যাঁরা এই কাজটি করছিলেন অর্থাৎ সামাজিক নিরীক্ষার কর্মীরা, তারা বারে বারে বিভিন্ন রকম শাসানির স্বীকার হচ্ছিলেন। এই সমস্যা উপেক্ষা করে আমরা যখন সংসদ সভাতে উপস্থিত হলাম সেখানে দেখা গেল গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগকে নস্যাৎ করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন।’’ এই জেলারও পঞ্চায়েতগুলিতে একশো দিনের কাজের টাকা নয়চয়, ভাতার টাকা নিয়ে গোলমাল, ইন্দিরা আবাসে বেনিয়মের একাধিক দৃষ্টান্ত পেয়েছিল জেলার নিরীক্ষক দল।

দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সামাজিক নিরীক্ষা বিভাগ(সোসাল অডিট সেকশন) দায়িত্বে ছিলেন একজন অতিরিক্ত জেলা শাসক(ভূমি)। নোডাল অফিসার হিসাবে ছিলেন জেলার সংখ্যালঘু দপ্তরের এক অফিসার। এই জেলা সম্পর্কে রিপোর্ট জানিয়েছিল — ‘‘অনেক জবকার্ড হোল্ডারদের কাছে জবকার্ড পায়নি, জবকার্ড হোল্ডাররা বলেছেন জবকার্ড তাদের কাছে থাকে না, জবকার্ড থাকে সুপারভাইজার ও পঞ্চায়েতের সদস্যদের কাছে।…কিছু কিছু ক্ষেত্রে জবকার্ড হোল্ডারের কাছ থেকে পাশবইও পাওয়া যায়নি।’’ এই ক্ষেত্রে মন্দিরবাজার ব্লকের নিশাপুর পঞ্চায়েতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নিরীক্ষা দল জানায়, এখানে রেগা প্রকল্পের শ্রমজীবীদের কোনও পাশবুক দেওয়াই হয় না। ‘‘এর বদলে তাঁরা একটি কার্ড পান। যে কার্ডের মাধ্যমে পিন নম্বর জানলেই যে কেউ টাকা তুলতে পারে।’’
আবাস যোজনার ক্ষেত্রে সরাসরি পঞ্চায়েত সদস্য বেনিফিশিয়ারির থেকে টাকা নিয়েছেন এমন অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছে নিরীক্ষক দল। নিরীক্ষক দলের রিপোর্ট হলো — ‘‘…বাড়ির জন্য সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত সদস্যর টাকা নেওয়ার অভিযোগও আছে। অনেকক্ষেত্রে আবাস ফেশিলিটেটররা টাকা নিয়ে ২য় কিস্তির টাকা বেনিফিশিয়ারির জন্য সুপারিশ করেছেন।’’
এমন আরও ঘটনার বিবরণ ছিল রিপোর্টে। এমনকি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে বৃদ্ধ, বিধবা, প্রতিবন্ধীদের তৃণমূলীরা কী ভাবে ঠকিয়েছে, তার বিবরণ ছিল রিপোর্টে। শুধু ওই দুটি জেলাতেই নয়, এমন অভিজ্ঞতা রাজ্যের প্রতিটি পঞ্চায়েতের বাসিন্দাদেরই হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী কটা থাপ্পড় মেরেছিলেন?
মারেননি। শাসনও করেননি।
বরং প্রশ্রয় দিয়েছেন। কী বলেছিলেন তিনি ২০১৭-র ৩ জানুয়ারি? পঞ্চায়েতের সদস্যদের নিয়ে নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সেই সভায় মুখ্যমন্ত্রীর বলেছিলেন ‘‘চুরি আটকাতে হবে। তাই তাদের মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে।’’
তাঁর মানোন্নয়নের মানে কী? মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন ‘‘ভাতা বাড়ানো।’’ সেই মঞ্চে মমতা ব্যানার্জি পঞ্চায়েতের সদস্যরা যারা চুরি করেন, কেন করেন — তার ব্যাখ্যা দেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মুখ থেকে সেদিন শোনা যায়,‘‘শুধু বলবে ও’ চোর ও’ চোর। আরে চুরি করবে না কী করবে? ওদের সুযোগ তো দাও।’’
চুরি করা তবে স্বাভাবিক, তাঁর মতে? ‘টেনে চারটে থাপ্পড়’ তবে তাঁর কাকে মারা উচিত?