Sambad Pravakar Cover

Sambad Prabhakar – The History (Part II)

শাম্ব মন্ডল

১৮৩১ সালে সংবাদ প্রভাকর একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসাবে প্রকাশিত হলেও সেভাবে তা বেশীদিন চলতে পারেনি। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদের একজন ছিলেন যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুর। তাঁর ব্যয়েই চোরবাগানের এক মুদ্রণযন্ত্রে মুদ্রিত হওয়া শুরু হয় প্রভাকরের। কয়েক মাস পরে, ঠাকুরবাড়িতেই একটি মুদ্রণযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা হয়। এইভাবে দেড় বছর কাটে, ১৮৩২ এ যোগেন্দ্রমোহনের মৃত্যু হয় এবং সেবছরই মে মাসের ২৫ তারিখে ৬৯ তম সংখ্যাতে সাপ্তাহিক পত্রিকা সংবাদ প্রভাকরের প্রকাশ বন্ধ হয়। সমাচার চন্দ্রিকায় এই প্রসঙ্গে ২ জুন একটি খবরও প্রকাশিত হয়। এর চারবছর পর, ১৮৩৬ সালের ১০ আগস্ট বারত্রয়িক রূপে, সংবাদ প্রভাকর পুনঃপ্রকাশিত হয়। এই সময়ে ঈশ্বর গুপ্তের সহায়ক হয়েছিলেন পাথুরিয়াঘাটারই কানাইলাল ও গোপালচন্দ্র ঠাকুর। এইভাবে এই পত্রিকা চলেছিল তিনবছর। বাংলা ভাষায় দৈনিক পত্রিকা বলে তখনও কিছু ছিল না; প্রথমবারের জন্য ১৮৩৯ সালের আজকের তারিখে সংবাদ প্রভাকরের দৈনিকভাবে প্রকাশিত হওয়া চালু হয়। ১৮৫১ সালের ১৩ এপ্রিল সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশ পাওয়া একটি খবর এ প্রসঙ্গে এখানে তুলে দেওয়া হল—

প্রভাকর পত্রের সংক্ষেপ বিবরণ।…১২৩৭ সালের ১৬ মাঘ শুক্রবাসরে ইহার জন্ম হয়, তৎকালীন সপ্তাহে শুদ্ধ একবার করিয়া প্রকাশ হইত। ১২৪৩সালের ২৭ শ্রাবণ বুধবারাবধি ৪৬ সালের জ্যৈষ্ঠ পর্য্যন্ত সপ্তাহে বারত্রয়িকরূপে প্রকাশ হইয়া তৎপরদিবসেই অর্থাৎ ঐ সালের ১ আষাঢ় অবধি অদ্য দিবস পর্য্যন্ত যথানিয়মে ক্রমশঃ দৈনিক-রূপে প্রকটিত হইতেছে।

দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে সংবাদ প্রভাকর ছিল উচ্চাঙ্গের। এতে দেশ-বিদেশের খবর থাকত আর থাকত ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য প্রভৃতি নানা বিষয়ে আলোচনা। সেকালের নামজাদা লোকেরা সব এই পত্রিকার লেখক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র ও দীনবন্ধু মিত্রের প্রথম দিককার রচনাগুলি সবই সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত হয়েছে। ১৮৪৭ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে ঈশ্বর গুপ্ত প্রভাকরের লেখক ও অনুগ্রহকারীদের নিয়ে যা লিখেছিলেন তার কিছুটা এখানে তুলে ধরা হল—

প্রভাকরের লেখকের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি হইয়াছে, প্রভাকরের পুরাতন লেখকদিগের মধ্যে যে যে মহোদয় জীবিত আছেন তাঁহাদের নাম নিম্নভাগে প্রকাশ করিলাম,-

।১। শ্রীযুত প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ। ২। শ্রীযুক্ত রাধানাথ শিরোমণি। ৩। শ্রীযুক্ত গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ। ৪। বাবু নীলরতন হালদার। ৫। শ্রীযুক্ত গঙ্গাধর তর্কবাগীশ। ৬। ব্রজমোহন সিংহ। ৭। গোপালকৃষ্ণ মিত্র। ৮। বিশ্বম্ভর পাইন। ৯। গোবিন্দ্রচন্দ্র সেন। ১০। ধর্মদাস পালিত। ১১। বাবু কানাইলাল ঠাকুর। ১২। বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত। ১৩। বাবু নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ১৪। বাবু উমেশচন্দ্র দত্ত। ১৫। শ্রীশম্ভুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৬। প্রসন্নচন্দ্র ঘোষ। ১৭। রায় রামলোচন ঘোষ বাহাদুর। ১৮। হরিমোহন সেন। ১৯। জগন্নাথপ্রসাদ মল্লিক। ২০। সীতানাথ ঘোষ। ২১। গণেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ২২। যাদবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। ২৩। হরনাথ মিত্র। ২৪। পূর্ণচন্দ্র ঘোষ। ২৫। গোপালচন্দ্র দত্ত। ২৬। শ্যামাচরণ বসু। ২৭। উমানাথ চট্টোপাধ্যায়। ২৮। শ্রীশ্রীনাথ শীল। ২৯। শম্ভুনাথ পণ্ডিত।

সীতানাথ ঘোষ হইতে শম্ভুনাথ পণ্ডিত পৰ্য্যন্ত কয়েক জন তিন চারি বৎসর পর্যন্ত প্রভাকরের লেখক-বন্ধুর শ্রেণীমধ্যে ভুক্ত হইয়াছে।

শ্রীযুক্ত হরচন্দ্র ন্যায়রত্ন ভট্টাচার্য্য মহাশয় আমারদিগের সম্প্রদায়ের একজন প্রধান সংযুক্ত বন্ধু। শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সহকারী সম্পাদকের ন্যায় তাবৎ কর্ম সম্পন্ন করেন। অতএব ইহাদিগের বিষয় প্রকাশ করা অতিরেক মাত্র। বিশেষতঃ শেষোক্ত ব্যক্তির শ্রমের হস্তে যখন আমরা সমুদয় কৰ্ম্ম সমর্পণ করি, তখন তাঁহার ক্ষমতা সকলেই বিবেচনা করিবেন।

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় অস্মদ্দিগের সংযোজিত লেখক বন্ধু। ইহার সদ্গুণ ও ক্ষমতার কথা কি ব্যাখ্যা করিব। এই সময়ে আমাদিগের পরম স্নেহান্বিত মৃত বন্ধু বাবু প্রসন্নচন্দ্র ঘোষের শোক পুনঃ পুনঃ শেলস্বরূপ হইয়া হৃদয় বিদীর্ণ করিতেছে। যেহেতু ইনি রচনা বিষয়ে তাঁহার ন্যায় ক্ষমতা দর্শাইতেছেন, বরং কবিত্ব ব্যাপারে ইহার অধিক শক্তি দৃষ্ট হইতেছে। কবিতা, নর্তকীয় ন্যায় অভিপ্রায়ের বাদ্যতালে ইহার মানুসরূপ নাট্যশালায় নিয়ত নৃত্য করিতেছে। ইনি কি গদ্য, কি পদ্য-উভয় রচনা দ্বারা পাঠকবর্গের মনে আনন্দ বিতরণ করিয়া থাকেন।

ঠাকুরবংশীয় মহাশয়দিগের নামোল্লেখ করা বাহুল্যমাত্র যেহেতু প্রভাকরের উন্নতি সৌভাগ্য প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি যে কিছু, তাহা কেবল ঐ ঠাকুরবংশের অনুগ্রহ দ্বারাই হইয়াছে। মৃত বাবু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রথমতঃ ইহাকে স্থাপিত করেন। পরে বাবু কানাইলাল ঠাকুর, ‘চন্দ্রকুমার ঠাকুর, ‘নন্দলাল ঠাকুর, বাবু হরকুমার ঠাকুর, বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর, মৃত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর, বাবু রমানাথ ঠাকুর, বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রভৃতি মহাশয়েরা আমাদিগের আশার অতীত কৃপা বিতরণ করিয়াছেন, এবং ইহাদিগের যত্নে অদ্যাপি অনেক মহাশয় আমাদিগের প্রতি যথোচিত স্নেহ করিয়া থাকেন।

প্রভাকরের প্রতি বাবু গিরীশচন্দ্র দেব মহাশয়ের অত্যন্ত অনুগ্রহ জন্য আমরা অত্যন্ত বাধ্য আছি। বিবিধ বিদ্যাতৎপর মহানুভব বাবু কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় প্রভাকরের প্রতি অতিশয় স্নেহ করতঃ ইহার সৌভাগ্যবর্দ্ধন বিষয়ে বিপুল চেষ্টা করিয়া থাকেন। বাবু রমাপ্রসাদ রায়, বাবু কাশীপ্রসাদ ঘোষ, বাবু মাধবচন্দ্র সেন, বাবু রাজেন্দ্র দত্ত, বাবু হরচন্দ্র লাহিড়ী, বাবু অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, রায় বৈকুণ্ঠনাথ চৌধুরী, রায় হরিনারায়ণ ঘোষ প্রভৃতি মহাশয়েরা আমাদিগের পত্রে সমাদর করিয়া, উন্নতিকল্পে বিলক্ষণ যত্নশীল আছেন।

১৮৫১ সালের ২২ এপ্রিল একটি খবর প্রকাশিত হয় সংবাদ প্রভাকরে, স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্রের মতামত বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে তা দিয়ে। ইতালীয় দুই নারীর ডুয়েল-যুদ্ধের সংবাদ প্রকাশ করে স্বজাতীর নারীদের সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন—

রাজকীয় ব্যাপার কাহাকে বলে এদেশের স্ত্রীলোকেরা তাহার কিছুমাত্র জ্ঞাত নহে, কেবল দাঁটা চড়চড়ির ভুষ্টিনাশ করত গলাবাজী পূর্ব্বক কোন্দল করিয়া গৃহবিচ্ছেদের সূত্রপাত করিতে নিপুণা হইয়াছেন, দেখ দেখি বিলাতবাসিনী কামিনীকুলের কেমন অনন্ত গুণ, তাঁহারা বীরভূমে উদ্ভব হইয়া বীরভোগ্যা হইয়াছেন, সুতরাং বীর হইয়া বীরত্ব প্রকাশ করিবেন বিচিত্র কি? দেশ, কাল, আহার ও ভোগ ইত্যাদির গুণে সকলি হইতে পারে। ফলে বঙ্গাঙ্গনাগণের মনের ভাব সেরূপ হওনের আবশ্যক করে না, ইহারা চিরকাল সাড়ী পরিয়া হাঁড়ী ধরিয়া দিনপাত করুক। আমরা তাহাতেই সুখি হইব, তবে সাবকাশ ক্রমে চলিত মত স্বজাতীয় বিদ্যার আলোচন যত দূর পর্যন্ত করিতে পারে তাহাই ভাল।

বাঙ্গালির মেয়ে সব; হও বটে কালো।

পতিব্রতা ধর্ম সদা, প্রতিজ্ঞায় পালো।

দিশি বিদ্যা যাহা শেখ, সেই মাত্র ভালো।

অন্ধকারে অন্ধ থাকো, কায নেই আলো ॥

১৮৫৩ সাল থেকে সংবাদ প্রভাকরের একটি মাসিক সংস্করণ বার হওয়া শুরু হয়। এই মাস-পয়লার কাগজগুলিতে “সর্ব্বাগ্রে জগদীশ্বরের মহিমা বর্ণনা, নীতি কাব্য ও বিখ্যাত মহাত্মাদিগের জীবনবৃত্তান্ত প্রভৃতি গদ্য-পদ্য পরিপূরিত উত্তম উত্তম প্রবন্ধ এবং সর্ব্বশেষে—মাসের সমুদয় ঘটনা অর্থাৎ মাসিক সংবাদের সারমর্ম্ম প্রকটিত” হইত। এতে ঈশ্বরচন্দ্র আরেকটি অসামান্য মোড় আনলেন—বাংলার প্রাচীন কবিদের অপ্রকাশিত রচনা ও জীবনচরিত খুঁজে এনে প্রকাশ করলেন সংবাদ প্রভাকরের এই মাসিক সংখ্যার পাতায়। এ কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তা না হলে এইসব কবিদের ও তাঁদের রচনার কোনো অস্তিত্বই থাকত না। সম্পাদনার পাশাপাশি সংকলক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; এ প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ প্রদত্ত তথ্য থেকে প্রাপ্ত সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত কবিদের একটি তালিকা এখানে উল্লেখ করা হল—

কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন — ১ আশ্বিন, ১ পৌষ, ১ মাঘ ১২৬০

রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু) — ১ শ্রাবণ, ১ ভাদ্র ১২৬১

রাম (মোহন) বসু — ১ আশ্বিন, ১ কার্তিক, ১ অগ্রহায়ণ ১২৬১

নিত্যানন্দদাস বৈরাগী — ১ অগ্রহায়ণ ১২৬১

কেষ্টা মুচী — ১ অগ্রহায়ণ ১২৬১

লালু নন্দলাল — ১ অগ্রহায়ণ ১২৬১

গোঁজলা গুই — ১ অগ্রহায়ণ ১২৬১

হরু ঠাকুর — ১ পৌষ ১২৬১

রাসু, নৃসিংহ, লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস (লোকে কানা) — ১ মাঘ ১২৬১

এরপর ১৮৫৯ সালে ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যুতে সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদকের দায়িত্ব যায় তাঁর ভাই রামচন্দ্র গুপ্তের কাঁধে।

ঈশ্বর গুপ্তের ব্যক্তিগত বিশ্বাস যা ছিল, পত্রিকায় তার বিশেষ প্রভাব পড়েনি। এর প্রমাণ মিলবে ১৮৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২১ তারিখে প্রকাশিত একটি খবরে। এই খবরটি স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার জন্য পুরস্কার ঘোষণার। খবরটি এইরকম—

ডেবিড হেয়ার সাহেবের স্মরণীয় মূলধন উপস্বত্ব হইতে কমিটির মেম্বর মহাশয়েরা পুনর্ব্বার ৭৫ টাকা ব্যয় করণের অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছেন, যে কোন এতদ্দেশীয় ব্যক্তি হিন্দু স্ত্রীলোকদিগের বিদ্যাশিক্ষা বিষয়ে বঙ্গভাষায় উত্তম এসে অর্থাৎ প্রবন্ধ লিখিতে পারিবেন তাঁহাকেই উক্ত টাকা প্রদত্ত হইবেক, ঐ মাসে ইংরাজী ১৮৪৯ সালের ১ মে তারিখে কমিটির সেক্রেটরী বাবু প্যারীচাঁদ মিত্রের নিকট পাঠাইতে হইবে। রেবরেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, বাবু রামগোপাল ঘোষ এবং বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় তাহার পরীক্ষা করিবেন।

১৮৪৯ সালের এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখে প্রভাকরে প্রকাশিত বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি খবর বের হয়েছিল। সেটি ছিল—

বক্তাদেশীয় অজ্ঞানাগণের বিদ্যানুশীলন নিমিত্ত এতদ্দেশীয় কৃত বিদ্যা যুবকগণ যেরূপ মৌখিকানুরাগ প্রকাশ করিয়া থাকেন সংবাদপত্র পাঠক মহাশয়েরা তাহা বিলক্ষণরূপেই জ্ঞাত আছেন, কিন্তু এ পর্যান্ত তাহারা পরস্পর সংযুক্ত হইয়া কোন বিদ্যালয় সংস্থাপন পূর্ব্বক তথায় আপনাপন অঙ্গনাদিগ্যে প্রেরণ করিতে পারেন নাই, সুতরাং তাহারদিগের ঐ যত্ন শরৎকালের মেঘ গর্জনের ন্যায় বিফল হইয়াছে, কিন্তু উত্তরপাড়া নিবাসি স্বদেশ হিতকারি সম্ভ্রান্ত জমীদার শ্রীযুত বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে অধিক প্রশংসা করিতে হইল, তিনি স্ত্রীজাতির বিদ্যাশিক্ষা জন্য এক বিদ্যামন্দির করিবার সমুদায় অনুষ্ঠান করিয়াছেন, এবং গবর্ণমেন্টের নিকট এক আবেদন পত্র দ্বারা এরূপ অভিপ্রায় জানাইয়াছেন যে ঐ বিদ্যালয়ের বাটী নির্মাণ নিমিত্ত এক খণ্ড ভূমি এবং ১০০০ টাকা ও মাসিক ব্যয় নির্বাহ জন্য ৬০ টাকা মাসিক উৎপন্নের ভূমি সম্পত্তি প্রদান করিবেন, অবশিষ্ট যে ব্যয় হইবেক গবর্ণমেন্ট তাহা প্রদান করণে স্বীকৃত হইলেই বিদ্যালয়ের কার্যারম্ভহইতে পারে, জয়কৃষ্ণ বাবু বিদ্যালয়ের বাটী নির্মাণ বিষয়ে ২০০০ টাকা ব্যয় নিরূপণ করিয়াছেন তদ্ভিন্ন প্রতিমাসে ১২০ টাকা হইলেই সকল কার্যা একপ্রকার সুনিয়মে নির্ব্বাহ হইতে পারিবেক, অতএব রাজপুরুষেরা যদ্যপি বাটী নির্মাণ জন্য এককালীন ১০০০ টাকা ও মাসিক ৬০ টাকা প্রদান করেন তবে উত্তরপাড়া গ্রামে স্ত্রীজাতির বিদ্যাশিক্ষা জন্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, অপিচ গবর্ণমেন্ট এই আবেদন পত্রের প্রতি কিরূপ উত্তর করিয়াছেন, আমরা তাহা জানিতে পারি নাই, কিন্তু অনুমান দ্বারা নিশ্চিত বোধ হইতেছে যে তাঁহারা ইহাতে আহ্লাদপূর্ব্বক সম্মত হইবেন, কারণ প্রজার বিদ্যা বিষয়ে তাঁহারদিগের বিলক্ষণ অনুরাগ আছে এদেশে অবলাদিগের বিদ্যাভ্যাসের নিয়ম না থাকাতেই তাঁহারা তদ্বিষয়ের কোন অনুষ্ঠান করিতে পারেন নাই, যাহা হউক এই মহৎ কার্য্যের আদিসূত্র সঞ্চার জন্য বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয় স্বদেশ হিতেচ্ছু সমাজে অধিক প্রশংসার ভাজন হইবেন, বহুকালাবধি বঙ্গদেশীয় স্ত্রীলোকদিগের বিদ্যানুশীলনের প্রস্তাব আন্দোলিত হইতেছে, কিন্তু কোন মহাশয় এপর্য্যন্ত তাহার প্রথম দৃষ্টান্ত দর্শাইতে পারেন নাই, অপিচ জয়কৃষ্ণ বাবু মনের দ্বারা ও ধনের দ্বারা ঐ বিষয়ের প্রথম পথদর্শক হইলেন, যে সকল স্ত্রীলোক তাঁহার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন পূর্ব্বক বিদ্যাবতী হইবেন তাহারা যেরূপ কৃতজ্ঞতার সহিত তাঁহার নাম স্মরণ করিবেন, তাহা বাক্যের দ্বারা ব্যক্ত করা যায় না সাধারণ মঞ্জালজনক বিষয়ে জয়কৃষ্ণ বাবুর যে প্রকার অনুরাগ আছে তাহা সাধারণের অবিদিত নাই, অতএব তদ্বিষয় আমরা আর অধিক আন্দোলন করিলাম না, অধুনা জগদীশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতেছি যে উক্ত বাবু স্ত্রীজাতির মঙ্গলার্থ সংপ্রতি যে মহদনুষ্ঠান করিয়াছেন ইহাতে কৃতকার্য্য হইয়া এতদ্দেশীয় মনুষ্যদিগের স্মরণীয় হউন।

পরের মাসের ২৫ তারিখে প্রকাশিত হয় বালিকা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষদের সভা নিয়ে একটি খবর। সেই খবরটিও তুলে দেওয়া হল—

অভিনব বিকটরিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের গৃহে গত বুধবার সন্ধ্যার পর বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষদিগের এক বিশেষ সভা হইয়াছিল, তথায় অনরবিল ড্রিঙকওয়াটার বেথুন সাহেব, বাবু রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, ঈশানচন্দ্র বসু, নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমনাথ রায়, হরিনারায়ণ দে, প্যারীমোহন দে, গৌরীশঙ্কর মিত্র, হরমোহন চট্টোপাধ্যায়, রসিকলাল সেন, ভৈরবচন্দ্র দত্ত, গোবিন্দচন্দ্র গুপ্ত, তারকনাথ গুপ্ত, ক্ষেত্রমোহন চট্টোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, হরচন্দ্র ঘোষ, নীলকমল মিত্র, মাধবচন্দ্র মল্লিক, গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রভৃতি অনেক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, সভারম্ভহইলে বিদ্যালয়ের উন্নতি বিষয়ক নানাপ্রকার প্রস্তাব ধার্য্য হয়, তদনুসারে বাবু হরচন্দ্র ঘোষ মহাশয় বিদ্যালয়ের সম্পাদকরূপে নিযুক্ত হইয়াছেন, সর্ব্বশেষে সভাপতি অনরবিল ড্রিঙকওয়াটার বেথুন সাহেব অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত সদ্বক্তৃতা দ্বারা সভাস্থ সকলকে সন্তুষ্ট করিয়াছেন।

আর একটি খবর এই প্রসঙ্গে তুলে ধরতে চাইব। ওই সালেরই জুলাই মাসের চব্বিশ তারিখ সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত হয় একটি খবর যার বিষয়, স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার উদাসীনতায় আক্ষেপ। খবরটি এরকম—

এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের বিদ্যাশিক্ষা যাহা অতি কর্তব্যকর্ম তদ্বিষয়ে দেশস্থ বিচক্ষণ মহাশয়েরা কিছুমাত্র মনোযোগ করেন না, ইহা নিতান্ত আক্ষেপের বিষয়। বিশেষতঃ প্রকাশ্য পত্রে মহানুভব অধ্যক্ষেরা ইহাতে ঔদাস্য করাতে আমারদিগের পক্ষে অতিশয় ক্লেশকর হইয়াছে, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা যাহাতে একাল পর্যান্ত কেবল নানাবিধ দেশহিতজনক জ্ঞানবর্ধক বিষয় প্রকটিত হইতেছে, এবং দেশের কুরীতি সংশোধন ও সুরীতি সংস্থাপন যে পত্রের প্রধানাভিপ্রায় হইয়াছে এইক্ষণে সেই পত্রের কর্মকর্তারা এতন্মহদ্বিষয়ে এককালীন মৌনাবলম্বন করিলেন, ইহাতে সাধারণে বিবেচনা করিতে পারেন যে ‘স্ত্রীশিক্ষা বিষয় তত্ত্ববোধিনী সভার অভিপ্রায় সিদ্ধ নহে’ ব্রাহ্ম মহোদয়েরা এই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উৎকৃষ্ট কৰ্ম্মসাধনে কি জন্য এইক্ষণে পরাম্মুখ হইলেন তাহা তাঁহারাই কহিতে পারেন, কিন্তু পূর্ব্বে তাঁহারা ইহাতে দৃঢ়তর যত্ন করিয়াছেন, তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেদীপ্যমান রহিয়াছে, আমরা পাঠকবর্গের গোচরার্থ তদ্বিশেষ নিম্নভাবে উদ্ধৃত করিলাম।…

একজন সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠতার সাথে কাজ করবেন; তাঁর ব্যক্তিগত মত সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কাজ করেনা — সাংবাদিকতার এই প্রাথমিক শিক্ষাকে ঈশ্বরচন্দ্র অনুশীলন করেছেন জীবন দিয়ে। তাঁর পছন্দ-অপছন্দ নিজের জায়গায়; সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে যুক্তিনিষ্ঠা, সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা অন্য জায়গায়। একালের অধিকাংশ সাংবাদিকদের কেউ ঘাড় ধরে এ জিনিস শেখালে মনে বড়ো আমোদ হবে, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টি বাঁধা বড়ই গোলমেলে কাজ আর যুক্তিনিষ্ঠা ও সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা বড়ই কঠিন জীবনচর্চা। অতএব, উড়ো খই গোবিন্দায় নমো, এই বলে শেষ করাই আপাতত বুদ্ধিমানের কাজ।

Spread the word

Leave a Reply