Salvador Allende – another name for the movement

১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ (সোমবার)

সালভাদর শব্দের অর্থ খুজছিলাম স্প্যানিশ ডিকশনারিতে। জানলাম এটা একটা স্প্যানিশ-ইতালিয়ান নামবাচক শব্দ। গেলাম ইতালিয়ান ডিকশনারিতে। একই কথা। স্প্যানিশ-ইংলিশ ডিকশনারিতে গিয়ে চমকে গেলাম। ইংরেজিতে সালভাদর শব্দের অর্থ ‘Saviour’ যার বাংলা রক্ষক বা রক্ষাকর্তা। আগ্রহ বেড়ে গেল। আলেন্দের অর্থ দেখা যাক। আবার আশ্চর্য হওয়ার পালা। স্প্যানিশ-ইংলিশ ডিকশনারিতে আলেন্দে অর্থ ‘General’ যা বাংলায় একদিকে যেমন সাধারণ তেমন ইংরেজি ব্যবহারে উচ্চপদ। সেনাবাহিনীর জেনেরাল মানে প্রধান। চেপে বসল ডিকশনারির নেশা। সালভাদর শব্দের ব্যবহার আরও কোনো ভাষায় আছে কি না। উর্দুতে আছে। এবং শুধু আছে না উর্দু ডিকশনারিতে শব্দটার অর্থ বলা আছে ‘ আজাদ করনে ওয়ালা ‘। আমি স্তম্ভিত। কিন্তু পুরো নাম তো সালভাদর আলেন্দে গোসেনস। এই গোসেনস ও কি কোনো অর্থ বহন করে। খোঁজ খোঁজ। শব্দটার উৎস পর্তুগিজ। ব্যবহার আছে স্পেন, ইতালি, ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, এবং একটা সাধারণ অর্থ বের করা গেল না।

চিলির মানুষকে রক্ষা করার জন্য সালভাদর আলেন্দের শেষ সংগ্রাম এবং বীরের মতো জীবনদানের ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য এই লেখার অবতারণা। কিন্তু আলেন্দের কথায় আসার আগে একটু চিলির কথা না বলে নিলে সংগ্রাম – লোভ – পাশবিকতা – স্বৈরাচার – বিশ্বাসঘাতকতার মিশেল কে বোঝা যাবে না। চিলির অবস্থান লাতিন আমেরিকার দক্ষিণ অংশের পশ্চিম প্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিকে। ৭,৫৬,৯৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট এই দেশ আসলে উত্তর থেকে দক্ষিণে ৪,২৭০ কিলোমিটার বিস্তৃত এক ভূখণ্ড। নিজের দেশের ভূগোলের বর্ণনা দিতে গিয়ে পাবলো নেরুদা লিখেছিলেন
” এই গ্রহ তোমার পেশিবহুল হাতে অর্পণ করেছে
তার পাথরের গর্বিত হৃদয়, আন্দিজ শৈলমালা
বিবর্ণ পাহাড়, শীতল
ঝলসানো একাকীত্ব যেন শুভ্র ইস্পাতের ফলা।
এবং তোমারই পাশে প্রস্ফুটিত অসীম সমুদ্র… “

সত্যি সত্যিই প্রকৃতি ও জলবায়ুর এতো ব্যাপক বৈচিত্র্য আর কটা জায়গায় আছে তা খুঁজে পেতে হলে এ্যাটলাস কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু তা আবিস্কার আমাদের উদ্দেশ্য না। কলম্বাস যুগের অনেক আগে প্রাক ইনকা সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে চিলির উত্তরাংশে, পাওয়া গেছে হস্তশিল্প এবং চাষবাস জানা প্রায় দেড় ডজন প্রাচীন উপজাতীয় মানুষের বসবাসের চিহ্ন। ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান হলেন প্রথম ইউরোপীয় নাবিক যিনি সোনারূপোর খোঁজে চিলিতে পা রাখেন ১৫২১ এর ১ নভেম্বর। চিলির আবিস্কর্তার মর্যাদা উপনিবেশবাদীরা যাকে দিয়েছে তার নাম দিয়োগো ডি এ্যালমাগ্রো। তিনি চিলিতে আসেন ১৫৩৭ এ। এরপর অল্পদিনের মধ্যেই স্পেনের সেনাপ্রধান পেড্রো ডি ভালডিভিয়া চিলির মধ্যভাগে অভিযান চালান, এ্যারাউকানিয়ান উপজাতিদের যুদ্ধে হারিয়ে বর্তমান সান্তিয়াগো শহর প্রতিষ্ঠা করেন, আরও নতুন নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করতে করতে এগোতে থাকেন। কিন্তু তাদের এই অভিযান বাধাহীন ছিল না। বিশেষত মাপুচে অধিবাসীরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যুদ্ধে টোকুই লোটারোর কাছে পরাজিত এবং নিহত হন ভালডিভিয়া। ১৬০০ সালে বিশাল বিদ্রোহে মাপুচেরা স্পেনীয়দের পরাজিত করলেও শেষ পর্যন্ত বিশাল সৈন্যসামন্তের সমাবেশ ঘটিয়ে স্পেন চিলির ওপর দখলদারি প্রতিষ্ঠা করে।

দু’শো বছরেরও বেশি সময়ের ঘটনাপ্রবাহের শেষে চিলি ১৮১০ সালে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু স্পেন চার বছরের মধ্যে ১৮১৪-তে আবার নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে। যুদ্ধ চলতে থাকে। ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮১৮-এ চিলি স্বাধীনতা অর্জন করলেও চিলি ভূখণ্ড থেকে স্পেনীয়দের সম্পূর্ণ তাড়িয়ে দিতে সময় লাগে ১৮২৬ পর্যন্ত।
লাতিন আমেরিকায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্হা প্রবর্তনের দিক থেকে চিলিই প্রথম দেশ। ১৯২৫-এ তারা নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে চিলিতে গড়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বামপন্থী গণমোর্চা।


এইখানে এসে চিলির বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। ১৯১২-র জুনে রেকাবারেন নামের একজন বুদ্ধিজীবি চিলিতে সোস্যালিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। পার্টির উদ্দেশ্য ঘোষিত হয়, ‘চিলিতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম‘। নতুন সংবিধান প্রবর্তনের পরে ১৯৩০-এর দশক থেকেই বামপন্থার প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৪০-এর মধ্যে শ্রমিক শ্রেণি ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার অর্জন করে। শিল্পায়নের পথে লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর তুলনায় আগে পা ফেলা চিলির রাজনীতিতে এর প্রভাব ছিল অসীম। স্বাধীনতা অর্জনের সময় চিলিতে শিল্প শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ লাখ। চিলির উত্তরাংশে অবস্থিত আতাকামা মরু অঞ্চল তামা এবং সোরার ভান্ডারে পূর্ণ যার নিয়ন্ত্রণ ছিল বিদেশি বহুজাতিক সংস্থার হাতে। প্রধান শ্রমিক কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছিল ওখানেই। প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে আমেরিকার বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানির সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই ছিল চিলির শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষের প্রধান দায়িত্ব।
রুশ বিপ্লবের গভীর প্রভাব আর পাঁচটা দেশের মতো চিলির শ্রমিকশ্রেণির ওপরেও পড়েছিল। ১৯২০-র ডিসেম্বরে তৃতীয় সম্মেলন থেকে সোস্যালিস্ট পার্টি নিজেকে কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত করে জন্মলগ্ন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে, কঠিন পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও অত্যাচারের মধ্যে নির্মম নির্যাতন সহ্য করেও গুপ্ত কাজকর্ম চালানোর সাথে সাথে আন্দোলনের ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ রক্ষা ও দুয়ের মধ্যে সাংগঠনিক ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে নিরন্তর কাজ করে গেছে।

বহু ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে একসময় চিলির কমিউনিস্ট পার্টিও বামপন্থী বিচ্যুতি ও ট্রটস্কিপন্হী বিপথগামিতার শিকার হয়েছিল। সে ইতিহাস আজকের আলোচনার বিষয় না। তবে কমিন্টার্নের সপ্তম কংগ্রেসের গণমোর্চার কর্মনীতিকে কমিউনিস্ট পার্টি গ্রহণ করে। ওই বছরেই ১৯৩৩ সালে নতুন করে চিলিতে সোস্যালিস্ট পার্টি গঠন হয়। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম ছিলেন সালভাদর আলেন্দে গোসেনস যিনি পরবর্তীকালে চিলির রাজনীতির প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন।
আলেন্দের জন্ম ১৯০৮ সালে। ২৫ বছর বয়সে মেডিক্যাল ডিগ্রি সহ গ্রাজুয়েট হলেও চিকিৎসা পেশায় না ঢুকে রাজনীতিতে আসেন। পরিণত রাজনৈতিক বোধ নিয়ে তিনি গণমোর্চা গঠনের কাজে অগ্রসর ভূমিকা নেন এবং ১৯৩৬ সালে সোস্যালিস্ট, কমিউনিস্ট, রেডিক্যাল ও ডেমোক্র্যাটদের ঐক্যবদ্ধ করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নাগরিক স্বাধীনতা, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শোষণমুক্তি ও গরিবী দূর করা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার শ্লোগানকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক সংগ্রাম গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

গণমোর্চা গঠনের পর প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৩৮-এর ২৫ অক্টোবর। গণমোর্চার প্রার্থী রেডিক্যালপন্হী পেদ্রো আগুইয়ার সার্দা জয়ী হন। মন্ত্রিসভায় সালভাদর আলেন্দে জনস্বাস্থ্য মন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হন। সরকারের নাম হয় পপুলার ইউনিটি সরকার। অল্প সময়ের মধ্যে সরকারি কতৃত্ত্বাধীন সংস্থা গড়ে তোলা হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্হার গণতন্ত্রীকরণ, শ্রমজীবি মানুষের বৈষয়িক অবস্থা উন্নত হয়। ১৯৩৮ ও ১৯৩৯-এ দু দু’বার ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে সফল হয় পপুলার ইউনিটি সরকার। কিন্তু এতো সাফল্য সত্বেও গণমোর্চায় ভাঙন নেমে আসে। জাতীয় বুর্জোয়াদের দোদুল্যমানতার পরিস্থিতিকে মোকাবিলায় সোস্যালিস্ট ও কমিউনিস্টদের ঐক্যের অভাব ছিল এই পতনের অন্যতম কারন। তারপর অনেক ঘটনাক্রম পেরিয়ে সোস্যালিস্ট এবং কমিউনিস্টদের যৌথ মোর্চা গঠনে আলেন্দের লাগাতার প্রয়াস সফল হয় ১৯৫২-র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে। পিপলস্ ফ্রন্টের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হন সালভাদর আলেন্দে। এই নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। এর একটা বড় কারন ছিল ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির বেআইনি ঘোষিত হওয়া। ফলে কমিউনিস্টরা প্রকাশ্য কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন নি। পরাজিত আলেন্দে এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে রাজনৈতিক বিবৃতিতে জানান, ” আমি মনে করি, এই মোর্চা চিলির সংগ্রামী মানুষকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হবে এবং দেশের মর্মান্তিক বাস্তবতার আমূল পরিবর্তন ঘটানোর প্রকৃত হাতিয়ারে পরিণত হবে “। সাধারণভাবে জনগণের মধ্যে এবং বিশেষভাবে কমিউনিস্টদের মধ্যে এই বিবৃতি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। নতুন করে প্রকাশিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘ এল সিগালো ‘। আহ্বান জানানো হয় ব্যাপক ভিত্তিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলার। এতদিন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট কর্মসূচি ছাড়া কাজ করে চলা কমিউনিস্ট পার্টি নিজস্ব কর্মসূচি গ্রহণে তৎপর হয় এবং ১৯৫৬ র পার্টি সম্মেলনে কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৯৫৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হন সালভাদর আলেন্দে কিন্তু এবারেও তিনি পরাজিত হন। পরবর্তী নির্বাচন ১৯৬৪ তেও আলেন্দে পরাজিত হন। ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সরকার গঠন করে। এই সরকারের আমলে আর্থিক দুরবস্থা ভয়ংকর মাত্রা নেয়, মুদ্রাস্ফীতি অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যায় এবং বহুজাতিকদের নানারকম সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়। ফলে সরকার জনসমর্থন হারাতে থাকে এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনে বামমোর্চা বা পপুলার ইউনিটির প্রার্থী হিসাবে সালভাদর আলেন্দে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। আলেন্দে যাতে এই নির্বাচন না জিততে পারেন তার জন্য চিলির প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মার্কিন মদতে কুৎসা, প্ররোচনা, ভীতিপ্রদর্শন, ব্ল্যাকমেলের সবরকম পন্হা অনুসরণ করে। পেন্টাগন কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের আগেই মন্তব্য করে যে একমাত্র সামরিক হস্তক্ষেপই চিলিকে কমিউনিস্ট দেশে পরিনত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এই প্রসঙ্গে ১৯৬৯-এর জুনে সান্তিয়াগোর সি আই এ স্টেশন চিফকে পাঠানো একটি বার্তার কথা স্মরণ করব। বার্তায় বলা হয় সেনাবাহিনী ও পুলিশের বিশেষ ক্ষমতাশালীদের সাথে গোপন যোগাযোগ এর মাধ্যমে জানতে হবে, আলেন্দে নির্বাচিত হলে তার বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুথ্থান ঘটাতে তারা রাজি কি না। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এর লেখা থেকে জানা যায়, নির্বাচনের অনেক আগে ১৯৬৯-র শেষভাগে চিলির কিছু অফিসার ওয়াশিংটন শহরের কাছে পেন্টাগনের তিন সেনাপ্রধানকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানান। ব্যবস্হাপক ছিলেন চিলির বিমানবাহিনীর কর্নেল এবং আমেরিকায় চিলির মিলিটারি এ্যাটাশে। মোট আটজন উপস্থিত ছিলেন এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল চিলির আগামী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।

বোঝাই যাচ্ছে সরকার প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই আলেন্দেকে ভয় পাচ্ছিল মার্কিনীরা। আলেন্দেও তা জানতেন। তাই দায়িত্ব নিয়েই দেশের ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত শিল্প ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রীয়করণ ও সামাজিকীকরণের সূচনা করেন তিনি। ১৯৭১ সালে আরবীয় জুয়ান ইয়ারুরের মালিকানাধীন ইয়ারুর মিল যা সর্বোচ্চ সরকারি সুবিধা নিয়ে শ্রমিকদের শোষণ করত, চিলির লেবার কোড এই শিল্পে মানা হত না, দেওয়া হতনা ন্যূনতম মজুরি, চরম অত্যাচারী ওয়ার্কিং নর্ম কার্যকর করা হত তার দখল নিয়ে নেয় শ্রমিকশ্রেণি। জনগণের মধ্যে আলেন্দের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। আমেরিকার নাকের ডগায় আর একটা কিউবার সম্ভাবনায় প্রমাদ গুণল মার্কিনী বহুজাতিকরা। পেপসি কোলা কোম্পানির মালিকরা হেনরি কিসিঞ্জারকে নিয়ে কূট পরিকল্পনায় নেমে পড়ল। শেষপর্যন্ত ১৯৭৩-এর ১০ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে পেন্টাগন, সি আই এ, চিলিয়ান এফ বি আই সকলেই একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। ১১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় আমেরিকা সফল হয় চিলির সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রনায়কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে। চিলির জাতীয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে যৌথ বিশ্বাসঘাতকতার সামনে দাঁড়িয়েও বিপ্লবী নায়কের মতো তিনি তার শেষ আহ্বানে উদাত্ত স্বরে বলেন, ওরা আমাদের আজ ধ্বংস করে দিতে পারে কিন্তু ভবিষ্যৎ জনগণের, ভবিষ্যৎ শ্রমিকশ্রেণির। মানবসভ্যতা আরো উন্নত জীবনের দিকে চিলির জনগণকে এগিয়ে নিয়ে যাবেই।

আলেন্দের স্বল্প সময়ের শাসনকালে চিলি যে উন্নয়নের স্বাক্ষর রেখেছিল তা অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছেও ঈর্ষণীয়। চিলির প্রধান খনিজ সম্পদ তামার উৎপাদন ১৯৭০ এর ৫,৪০,৫০০ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ১৯৭৩-এ হয় ৬,১৫,৮৬১ মেট্রিক টন। অন্যান্য শিল্পদ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১৯৭০ এর ০.৮ শতাংশের জায়গায় ১৯৭২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৯.১ শতাংশ। শতাংশের হারে বৃহত্তর সান্তিয়াগোতে বেকারত্ব ৭.১ শতাংশ থেকে কমে হয় ৩.৭ শতাংশ ও সমগ্র দেশে এই হার ৩.৪ শতাংশ থেকে কমে ৩.১ শতাংশে নেমে আসে। বিদ্যালয় ও প্রাক্ বিদ্যালয়গামী ৪০ লাখ শিশুর জন্য ১ কোটি ডলার খরচ করে বিনামূল্যে দুধের ব্যবস্হা করা হয়। ৯৭ শতাংশ শিশুকে স্কুলে আনতে সক্ষম হয় সরকার। মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ৩০ শতাংশ ছাত্র বৃদ্ধি পায়। হাসপাতাল এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক প্রসার ঘটে। মজুরি, সামাজিক সুযোগ সুবিধারও বৃদ্ধি ঘটানো হয়।
প্রথমে আমেরিকা চিলির সঙ্গে যাবতীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। যে এক্সিম ব্যাংক শেষ ২৫ বছরে আমেরিকান জিনিস কেনার শর্তে চিলিকে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে তারা আলেন্দে সরকারকে কোনো ঋণ দিতে অস্বীকার করে এবং ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হেনরি কেয়ার্নস জানিয়ে দেন যে রাজনৈতিক কারণেই এই সিদ্ধান্ত। ক্রমে আই ডি বি, বিশ্বব্যাংক সকলেই এক পথ নেয়। সমস্ত ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে সরকার এগোতে থাকলে শেষ পর্যন্ত এই ক্যু দেতা বা সামরিক অভ্যুথ্থান।
আলেন্দে ততদিনে অভিহিত হয়েছেন চিলির জনতার কন্ঠস্বর হিসাবে। এই স্বর থামেনি। আত্মসমর্পণ করেননি আলেন্দে। রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক সামরিক সাজে সজ্জিত হয়ে মেশিনগান হাতে যুদ্ধে অংশ নিয়ে বীরের মতো জীবনদান করেন। এই শহিদীবরণ এ্যাপারসেলের কবিতায় নিয়ে আসে এক আশ্চর্য লাইন, ” চিলির মায়েরা এরপর থেকে শুধু গ্রেনেডের জন্ম দেবে “। মৃত্যুর আগে আলেন্দে বলেছিলেন ” এইভাবেই আমরা ইতিহাসের প্রথম পৃষ্ঠাটি লিখব, বাকি পৃষ্ঠাগুলি লিখবে আমার দেশের ও আমেরিকার জনগণ। “
সেই পৃষ্ঠার লড়াই বহমান। মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও সালভাদর মানে শ্রমজীবি মানুষের রক্ষাকর্তা।

Spread the word

Leave a Reply