Salil Chowdhury Cover

Salil Chowdhury: The Rebel

চন্দন দাস

‘বুর্জোয়া’দের অস্ত্রাগার অভিযানে

৩০টাকার হোলটাইমার

Salil 1

‘মুকাদ্দার কা সিকান্দার’-এর প্রভাব রুখতে চেয়েছিলেন।

তার জন্য চেয়েছিলেন—‘‘রাজনীতিতে কেউ সিপিআই, কেউ সিপিএম, কেউ নকশাল— তা হোক না। আমার তো মনে হয় সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে একটা জায়গায় আমরা সবাই মিলে কাজ করতে পারি।’’

কখন এই কথা বলছেন সলিল চৌধুরী? ১৯৭৯ সালে, একটি সাক্ষাৎকারে।

প্রকাশ মেহেরার ‘মুকাদ্দার কা সিকান্দার’ সেই বছরই অক্টোবরের শেষ দিকে রিলিজ করেছে। বাইকে চড়ে অমিতাভ বচ্চনের ‘এন্ট্রি’ পর্দায় দেখানো মাত্র পয়সা ছুঁড়ছে যুব সমাজ। কিশোর কুমারের ‘রোতে হুয়ে আতে হ্যায় সব/ হাসতা হুয়া যো জায়েগা…’ বাজছে শহর, গ্রাম জুড়ে।

এই সবের বিপুল প্রভাব রুখতে বিকল্পের কথা ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন সলিল চৌধুরী। বলছেন,‘‘এই যে মুকাদ্দার কি সিকান্দারের মতো ছবি সারা ভারতে লক্ষ লক্ষ লোক দেখছে, এই একচেটিয়া আধিপত্যকে ভাঙতে গেলে একটা প্যারালাল ফিল্‌ম আন্দোলন করতে হবে। ১৬মিমি ছবি করে গ্রামে গ্রামে দেখাতে হবে। এর জন্য চাই বিরাট সংগঠন।…একটা ব্রড কালচারাল অর্গানাইজেশন চাই। যারাই সুস্থ সংস্কৃতির জন্য লড়তে প্রস্তুত, তারাই আসবে সে সংগঠনে। রাজনীতিতে কেউ সিপিআই, কেউ সিপিএম, কেউ নকশাল—  তা হোক না। আমার তো মনে হয় সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে একটা জায়গায় আমরা সবাই মিলে কাজ করতে পারি।’’

সাম্প্রতিক কালে তার একটি আভাস দেখা গেছে আর জি কর হাসপাতালে তরুণী, ট্রেনি চিকিৎসককে নৃশংস ভাবে খুনের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়। বিভিন্ন মত, পথ, ভাবনার সাংস্কৃতিক সংগঠন, ব্যক্তি এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন। হয় ‘রাত দখল’-এ। নয়তো রানী রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের জনস্রোতে। সিপিআই(এম)’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি বলেছিল যে, তারা থাকবে আন্দোলনে। কিন্তু পতাকা নিয়ে আন্দোলনের সামনে সারিতে গিয়ে তারা দাঁড়াবে না।

মুকাদ্দার কা সিকান্দারের ‘অপসংস্কৃতি’ হোক, কিংবা রাজ্যের সর্বত্র ফনা তুলে দাঁড়ানো ‘থ্রেট কালচার’—  ৪৫ বছর আগে সলিল চৌধুরীর সেই কথাগুলি ভেবে দেখা, বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা প্রবল হয়ে উঠেছে। বিশেষত যখন বামপন্থার পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে বামমনস্ক পার্টি, সংগঠন, ব্যক্তিকে এক জায়গায় এসে দাঁড়ানোর আহ্বান সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

সলিল চৌধুরীর প্রাসঙ্গিকতা অনেকটা এখানেই।

১৯৪১-’৪২-এ সলিল চৌধুরী কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন। ছিলেন আইপিটিএ-র সর্বক্ষণের কর্মী। তিনি জানিয়েছেন যে, ৩০ টাকা ভাতা পেতেন সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে। ১৯৪৩-এর মার্চে পার্টির তৃতীয় রাজ্য সম্মেলনের রিপোর্টে বলা হলো,‘‘পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এক রকম ছিল না বললেই হয়, কারণ পার্টি থেকে কাউকে মজুরী দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। যিনি বাড়ির খেয়ে পরে বা স্বচেষ্টায় সর্বক্ষণের কর্মী হতে পারবেন তিনিই শুধু সর্বক্ষণের কর্মী হতেন। তারপর সাম্রাজ্যবাদ যখন আমাদের বাধ্য করল গুপ্ত অবস্থায় কাজ করতে, তখন একটু একটু করে আমরা পার্টির জন্য টাকা তুলতে শিখেছি এবং মজুরী দিয়ে সর্বক্ষণের কর্মী রাখতে শিখেছি।’’

সলিল চৌধুরী সেই পার্টির নিষিদ্ধ থাকার সময়কালে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। শুরু করেছিলেন কৃষক আন্দোলনে। কলেজে পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। তবে সাংস্কৃতিক ফ্রন্টই তাঁর প্রধান জায়গা হয়ে ওঠে। ১৯৫১-’৫২ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি, বামপন্থী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত থাকতে পেরেছিলেন। ওই সময়ে তাঁর বাবা প্রয়াত হন। সংসারের দায়িত্ব পালনে উপার্জন জরুরী হয়ে পড়ে। প্রথমে কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত সৃষ্টির কাজ করার পর মুম্বাই যান। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হন। আবার সেখানেও কয়্যার সংগঠিত করেন। সেই কয়্যারে রুমা গুহঠাকুরতা যেমন ছিলেন, তেমন কিছুদিন যুক্ত ছিলেন লতা মঙ্গেশকরও। একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪২-’৪৩ এবং তারপর বেশ কয়েকবছর গণনাট্য, আইপিটিএ-তে আমরা সলিল চৌধুরীর মতোই দেখতে পাই সাহিব লুধিয়ানভি, বলরাজ সাহানি, পৃথ্বিরাজ কাপুর, কাইফি আজমি, জান নিসার আখতার(জাভেদ আখতারের বাবা)-র মতো ব্যক্তিত্বকে।সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা, ফ্যাসিবাদ বিরোধীতা এবং কমিউনিজমের আদর্শের প্রতি ভালোবাসা তাঁদের উপস্থিত করেছিল বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিসরে।

সলিল চৌধুরীর কথাতে আছে সেই লেফট ইকোসিস্টেমের প্রমাণ।

১৯৯৩-র নভেম্বরে একটি ইংরাজী সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে সাক্ষাতকারে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার প্রিয় স্বপ্ন কী? সলিল চৌধুরীর জবাব ছিল—‘সব মানুষ সমান হবে।’ আপনার দুঃস্বপ্ন কী? জবাব ছিল— ‘ফ্যাসিবাদ।’

১৯৯৫-এর সেপ্টেম্বরে, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আর একটি সাক্ষাতকারে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের, এমনকী কলকাতারও কিছু শিল্পী বিজেপি’তে যোগ দিয়েছে। গণনাট্য থেকে উঠে এসে এটাকে কোন চোখে দেখছেন? সলিল চৌধুরীর জবাব ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রবল—‘কী জানি। মুর্খের দলে কী করে শিল্পীরা যোগ দেয়, বুঝি না।’

প্রসঙ্গত, কলকাতায় ফিরেও বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নির্বাচনের থিম মিউজিক করেছেন সেই সময়ে। নিজের কয়্যার নিয়ে বিভিন্ন সভা সমিতিতে হাজির হয়েছেন। অনুষ্ঠান করেছেন। পরিবর্তিত সময়ে আসা প্রযুক্তিকেও ব্যবহার করেছেন। মৃত্যুর আগেও সুর তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কিসে? কম্পিউটারে। বলেছিলেন,‘‘কম্পিউটার-অর্কেস্ট্রেশনে নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে নতুন কিছু সুর রচনার চেষ্টায় আছি।’’

এই মানুষটিরই বাবার দেওয়া হারমোনিয়াম নিয়ে জয়যাত্রা শুরু।

আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন,‘‘কমরেড বীরেশ মিশ্র আমায় ডেকে পাঠালেন। গোটা উত্তরবঙ্গ থেকে সারা আসাম উনি পরিক্রমা করবেন বিভিন্ন স্টেশনে রেলশ্রমিকদের মিটিং করে করে। আমাকে সঙ্গী হতে বললেন, প্রত্যেক মিটিং-এর আগে রেলশ্রমিকদের সংগ্রামের ওপর গান লিখে আমায় গাইতে হবে। একটা ইঞ্জিনের লাগোয়া বগিতে চেপে শুরু হল বীরেশদার সঙ্গে আমার যাত্রা। সাথী শুধু আমার সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম।’’প্রত্যেক স্টেশনে সেই ‘সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম’ কাঁধে নিজের লেখা গান গেয়েছেন সলিল চৌধুরী। তাঁর কথায়,‘‘সেসবও কোথায় লুপ্ত হয়ে গেছে, বেঁচে আছে শুধু একটি গান। চলন্ত রেলগাড়ির চাকার শব্দের ছন্দে রচিত…’’

কোন্‌ সে গান, যা রেলের চাকার শব্দের ছন্দ থেকে জনকল্লোলে পরিণত হয়েছে? 

‘ঢেউ উঠছে/কারা টুটছে/ আলো ফুটছে/ প্রাণ জাগছে, জাগছে, জাগছে’ —  হলো সেই গান। ১৯৪৬-র ২৯ জুলাই দেশব্যাপী ধর্মঘটের ঠিক আগের দিন ময়দানে বিশাল সমাবেশে গানটি গাওয়া হয়েছিল — ‘‘শোষণের চাকা আর ঘুরবে না ঘুরবে না/ চিমনিতে কালো ধোঁয়া উঠবে না উঠবে না/ বয়লারে চিতা আর জ্বলবে না জ্বলবে না…./ আজ হরতাল, আজ চাকা বন্‌ধ…’’

লড়াইয়ের ময়দান ছাড়া শিল্প হয় না। লেখা, গান, সিনেমা, নাটক—  কিচ্ছু না।

তবে একটি ‘কিন্তু’ আছে। ১৯৮৮-র জুনে কেন্দ্রীয় নাট্য প্রশিক্ষণ শিবিরের কর্মশালায় ‘গণসঙ্গীত’ নিয়ে আলোচনার সময় সলিল চৌধুরীর বলছেন,‘‘কিন্তু একটা কথা বলব শুধু স্লোগান দিয়ে মানুষের মন জয় করা যাবে না। আপনাদের আজকের দিনের যারা গীতিকার ও সুরকার তাদেরও শিখতে হবে। আজকের বুর্জোয়ারা যে গানগুলো তৈরি করছে— টিভিতে বলুন, রেকর্ডে বলুন, ক্যাসেটে বলুন, যেসব অসাধারণ অর্কেস্ট্রেশন, অসাধারণ রেকর্ডিং, অসাধারণ পারফেকশন দিয়ে যেসব পচা জিনিস ওরা প্রচার করছে তার জৌলুসে, তার আঙ্গিকের চমৎকারিত্বে তা যুবমানসকে আপ্লুত করছে।…আমাদেরও ওই টেকনিক আয়ত্বে করতে হবে, তা নাহলে আমরা পারব না।…ওরা যদি মেশিনগান চালায় আমরা তলোয়ার নিয়ে লড়াই করতে পারব না। অস্ত্রাগার যেটা ওদের হাতে রয়েছে সেই অস্ত্রাগারের অধিকাংশ অস্ত্র আমারও দরকার।’’

Spread the word

Leave a Reply