১৮৭১ সালের ৫ই মার্চ রোজা লুক্সেমবার্গের জন্ম। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তার হাতে খড়ি পোল্যান্ডের প্রথম মার্কসবাদী সংগঠন প্রোলেতারিয়েতে। তখনো তার কৈশোরকাল শেষ হয় নি। বলা যায় তখনো তিনি টিনএজার।
ইউরোপের ইতিহাসে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শাসন বিরোধী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম রোজা। রোজা ছিলেন পুঁজির গোলকায়নের বদলে বিকল্প যুক্তিপথের সন্ধানী। পুঁজিবাদের ক্রমান্বয় আত্মবিকাশকে তিনি তত্ত্বায়িত করেছেন, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত ভাবে পিছিয়ে থাকা অনুন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে পুঁজির ধ্বংসাত্মক সম্ভাব্য প্রভাবের বিরুদ্ধে।
রোজার সাংগঠনিক প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল সংশোধনবাদী সমঝোতা, আমলাতান্ত্রিক খুঁটিনাটি এবং অভিজাত সাংগঠনিক পদ্ধতির বিরুদ্ধে। যার মধ্য দিয়ে তিনি খুঁজেছেন পুঁজিবাদ বিরোধী এক বিকল্পকে যা সেই সময় যুক্তিবাদী র্যাডিকাল আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং যে পুঁজিবাদ বিরোধী ও নির্দিষ্ট স্তরে বিন্যাসকে প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। যে ক্রম পর্যায়ে সেই সময়কার সমাজতন্ত্রী সমাজ তৈরীর জন্য নিয়োজিত ছিল। ক্ষমতা দখলের পর বিপ্লবী গণতন্ত্রের উপর তার জোর আমাদের সময়কার বিশ্বে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে। পুঁজিবাদের কোন বিকল্প আছে? আমলাতন্ত্র এবং শাসনযন্ত্রের একমাত্র সর্বস্ব নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কি বিশ্বপুঁজির বিস্তার আটকানো সম্ভব? বিশ্বায়িত পুঁজি এবং সন্ত্রাসবাদের যুগে মানবিকতা কি সম্ভব?
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সেই সময়কার নেতৃত্বদের সাথে তার বিতর্কগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রনিধাণযোগ্য। এই নেতৃত্বদের মধ্যে মার্কসের লেখা, এঙ্গেলসের লেখা যেমন আছে, তেমনই আছে বার্ণস্টাইন ও কাউটস্কির মতন ব্যক্তিরা।
মার্কসবাদী প্রতর্কে রোজার অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ অবাদানের মধ্যে জনগণের ধর্মঘট বা Mass Strike অন্যতম। সেই সংক্রান্ত কিছু আলোচনা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। Mass Strike বা জনগণের ধর্মঘট সম্পর্কে রোজার প্রারম্ভিক কথা হল – জনগণের ধর্মঘট সম্বন্ধে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যা লেখা ও দৃষ্টিভঙ্গী পাওয়া যায় তার সবই রাশিয়ার বিপ্লবের আগে। যে বিপ্লব সশস্ত্র এবং এক বড় মাত্রায় প্রথম ঐতিহাসিক পরীক্ষা। ফলে এই লেখাগুলি একেবারেই সময়োপযোগী না।
সমাজতন্ত্রী গণতান্ত্রিকদের তূণীরে জনগণের ধর্মঘট একটি অস্ত্র মাত্র। অবশ্যই যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটা সমাজ পাল্টানোর চূড়ান্ত কার্যক্রম না। এটা এক রাজনৈতিক অস্ত্র, যেহেতু এটা নিজেই নিজের সমাপ্তি ঘোষণা করে না, তাই এর সম্বন্ধে উপর থেকে পরিকল্পনা লাভ করা যায় না।
জনগণের ধর্মঘট সম্পর্কে তার নিজস্ব ঠিকঠাক ধারণা তার সময়ের এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ফলাফল। যে অভিজ্ঞতা তার সঞ্চিত হয়েছিল রাশিয়ার ঘটনাবলী থেকে। ১৯০৫-১৯০৭ এই সময়কাল জুড়ে। এটা শুরু হয় বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের নিজেদের উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার মাধ্যমে। যা এই শ্রমের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোর স্থিতিশীলতাকে প্রবলভাবে ধাক্কা দেয়। কিন্তু এই ধর্মঘট কাজের পরিবেশের উন্নতি করা বা অন্যান্য দাবীর ভিত্তিতে না। বাস্তবিক পক্ষে এর সাথে কাজের কোন সংযোগ ছিল না। এটা ছিল পরবর্তী আন্দোলনের জন্য পূর্বশর্ত রচনা। এর ফলাফল ছিল বিপ্লবী অপেক্ষামান কর্মীদের সাথে আরও বড় অংশের মানুষকে যুক্ত করা। যাদের সরাসরি বিপ্লবী লক্ষ্যে ব্যবহার করা যাবে।
কিভাবে, কখন, কতটা, কতদূর পর্যন্ত এই জনগণের ধর্মঘট চলবে সে বিষয়ে রোজার আগ্রহ ছিল না। এগুলি নিজে নিজেই নির্ধারতি হয়। রোজার কাছে জনগণের ধর্মঘট ছিল একই সাথে এক বিপ্লবী পর্যায়ের লক্ষণ ও ফলাফল। জনগণের ধর্মঘট তার মতে তৈরী করা যায় না। বিষয়গত পরিস্থিতি তৈরী না হলে কোন সদিচ্ছার উপর ভিত্তি করে জনগণের ধর্মঘট হয় না।
রোজার কথায় জনগণের ধর্মঘট , অন্যান্য সব ধর্মঘটের একসাথে চলার ফলাফল। এরা একসাথে চলে, একে অন্যের সাথে মিশে যায়। এটা নির্ভর করে ঘটনাবলীর ক্রমান্বয় পরিবর্তনের উপর। এর কোনটিই জনগণের ধর্মঘট থেকে জন্ম নেয় না, জন্ম নেয় বিপ্লবের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাস থেকে। রোজার মতে জনগণের ধর্মঘট বিপ্লবী সংগ্রামের একটি ধরণ মাত্র। এই লড়াইগুলির সংমিশ্রন জনগণের ধর্মগট এবং সেটা এই লড়াইগুলির যোগফল নয়। রোজ জনগণের ধর্মঘটকে শ্রেণি সংগ্রামের এক যৌথ ধারণা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন যা কয়েক বছরের বা কয়েক দশক ধরে বহমান। রোজা কখনোই এই সংগ্রামের স্থান অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থানান্তরিত করেন নি। জনগণের ধর্মঘট আসলে নির্দিষ্টভাবেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার এক সম্মিলিত প্রক্রিয়া একে অপরকে রসদ যোগানোর প্রক্রিয়া এর মূল ভরকেন্দ্র হল রাজনৈতিক কার্যকলাপের নতুন গভীরতা বা ঝড়ো আবহাওয়া। অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার উপর পূর্ব ধারণার বদলে রাজনৈতিক সংগ্রামের উপর জোর দেওয়ার ধারণাকে বাতিল করে, তিনি এই দুটি ধারণাকেই একত্রিত করেছেন, জনগণের ধর্মঘট সম্পর্কে তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হল এটি আদৌ ফলপ্রসূ হবে না যদি না এটিকে বিপ্লবী প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত রাখা যায়।
এর নেতৃত্ব কি হবে? এর নেতৃত্বে থাকবে সমাজতন্ত্রী গণতন্ত্র (পার্টি) এবং তার দায়িত্বশীল নেতৃত্ব। কিন্তু অন্য অর্থে, এই জনগণের ধর্মঘটের খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে একে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে হবে। এমনকি এক বিপ্লবী প্রক্রিয়ার মাধ্যেও সমস্যা হল রোজার এই সূত্রায়ন রাশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। প্রশ্ন হোল এটা কি তৎকালীন জার্মান বা সাধারণভাবে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? রোজার উত্তর হল – … কেবলমাত্র রাশিয়ার সর্বহারার জন্য আন্তর্জাতিক শ্রেণি সংহতি নয়, একে নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অধ্যায় বলে বিবেচনা করতে হবে।
এই প্রসঙ্গেই রোজা আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন যা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে এখন একটি স্বীকৃত সত্য।
এক কঠিন যান্ত্রিক আমলাতান্ত্রিক ধারণা কেবলমাত্র সংগঠনের এক নির্দিষ্ট স্তরের ফলাফল হিসাবে সংগ্রামকে চিহ্নিত করে। অথচ জীবনের দ্বান্ধিক বিকাশে সংগ্রামের ফলাফল হিসাবে সংগঠন তৈরী হয়।
রোজার জনগণের ধর্মঘট সম্বন্ধে একটি কঠিন সমালোচনা হলো তিনি জনগণের স্বত:স্ফুর্ততার উপর নির্ভর করেছেন যা একেবারেই ভুল। যে ভুল ১৯৫৮ সালে ক্রুশ্চেভের বক্তৃতাতে পাওয়া যায়। “স্বত:স্ফুর্ততা হলো সবার জন্যই মৃত্যুসম শত্রু”। প্রথমত : তিনি জনগণের যে কোন কার্যকলাপকে সমাজতন্ত্রী গণতান্ত্রিকদের এক আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করেছেন। পরবর্তীকালে তৎকালীন জার্মান পার্টি যখন তার মতকে অনুমোদন করলেন না, তখন তিনি নেতৃত্বের ক্ষমতার সীমা পরীক্ষা করে দেখাতে বলেছেন। যদি নেতৃত্বের মত জনগণের ইচ্ছের বিপরীতে যায়। জনগণের স্বত:স্ফুর্ত ক্ষমতা কেবলমাত্র বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা হোল প্রায়োগিক (Action) ক্ষেত্রে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তার মত জনগণের ইচ্ছার উৎকর্ষতার তখনই কোন অর্থ আছে যখন নেতৃত্ব স্থানু এবং জনগণ আন্দোলনের পক্ষে।
জনগণের ধর্মঘট আসলে রোজার রাশিয়ার অভিজ্ঞতা প্রসূত ধারণা যা আন্তর্জাতিক অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতান্ত্রিক সব আন্দোলন একে অন্যের সাথে সংযুক্ত বা মিশ্রন। যা আসলে বিপ্লবী প্রক্রিয়ার পরবর্তী স্তর বা ধীপকে প্রস্তুত করে এবং নিজেও সেই প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর নেতৃত্ব দেবেন নির্দিষ্ট দেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা এর খুঁটিনাটি নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেবেন। অযোগ্য নেতৃত্বের মতামতের থেকে এক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধাণ্য দিতে রোজা পরামর্শ দিয়েছেন।
মার্কসীয় সাহিত্যে রোজার আরো অনেক অবদান আছে কিন্তু Mass Strike বা জনগণের ধর্মঘট সেই সময়কার সমাজতান্ত্রিক এবং সমাজতন্ত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সাড়া ফেলেছিল। খুবই সংক্ষেপে তার রূপলেখা আজ ৫ই মার্চ রোজা লুক্সেমবার্গের জন্মদিনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।
যে বইগুলির সাহায্য নেওয়া হয়েছে –
১. The Rosa Luxemburg Reader Edited by : Peter Hudis & Kevin B Anderson
২. Rosa Luxemburg By Peter Nettl
৩. Rosa Luxemburg Selected Writings
৪. বিতর্ক : রোজা লুক্সেমবার্গ