শোভনলাল দত্তগুপ্ত
১
গত কয়েক দশক জুড়ে মার্কসবাদী মতাদর্শ যে এক বড় রকমের সংকটের মুখোমুখি, সে কথা আজ অনস্বীকার্য। এই সংকটের অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ এখন অনেকের চোখেই ধরা পড়ছে। সেটি হল মার্কসবাদের যাঁরা প্রাণপুরুষ, যথা, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন – এঁদের ভাবনাচিন্তার আদল ও বক্তব্য সঠিকভাবে ধরা ও বোঝার ক্ষেত্রে অক্ষমতা। তাই মার্কস ও এঙ্গেলসের ২০০তম জন্মবর্ষে, লেনিনের ১৫০তম জন্মবর্ষে গোটা পৃথিবী জুড়েই বামপন্থী মহলে নতুন করে শুরু হয়েছে এঁদের লেখার পুনর্পাঠ, নতুন তথ্যের অনুসন্ধান, অনেক অনালোচিত বক্তব্যের পুনর্মূল্যায়ন। নতুন আঙ্গিকে, নতুন প্রেক্ষিতে এই ফিরে দেখার ভাবনাটা নেহাত কোনো বৌদ্ধিক কচকচি নয়, – এর উদ্দেশ্য মার্কসবাদ ও বামপন্থাকে তাত্ত্বিকভাবে শক্তিশালী করা, অতীতের ভুলত্রুটিকে সংশোধন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
রোজা লুক্সেমবুর্গের জন্মের সার্ধশতবর্ষ এরকমই একটি সুযোগ করে দিয়েছে তাঁর চিন্তাভাবনার প্রাসঙ্গিকতাকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে এই বিষয়টির আলোচনা যথেষ্ট জটিল ও স্পর্শকাতর, কারণ মার্কসবাদী মহলের একটি বড় অংশ আজও রোজা লুক্সেমবুর্গের চিন্তাকে মান্যতা দিতে নারাজ, অনেকের চোখে তিনি যথার্থ মার্কসবাদী নন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাই এতটুকু অবাক হইনা যখন দেখি যে, প্রতিষ্ঠিত সব বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও- এদের প্রতিকৃতি শোভা পেলেও কিংবা এঁদের জন্মদিবস যথেষ্ট সমাদরে পালিত হলেও রোজা লুক্সেমবুর্গ ব্রাত্যই থেকে যান। মার্কসবাদের মহাকাব্যে তিনি উপেক্ষিত এক চরিত্র মাত্র। এই অবহেলা, এই উপেক্ষা তাঁকে কেন সইতে হল, তাঁর জন্মের ১৫০তম বর্ষে কেনই বা আমরা তাঁকে স্মরণ করছি তার অবশ্যই একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
রোজা লুক্সেমবুর্গ সম্পর্কে এই অনীহার আরও একটি কারণ আছে। সেটি হল গত কয়েক দশকে পশ্চিমী দুনিয়ার বাম বুদ্ধিজীবী মহলে রোজা লুক্সেমবুর্গ নিয়ে যে বিপুল চর্চা হয়ে চলেছে, তাঁর সমগ্র রচনাবলি ইংরেজিতে যে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে, তাঁর কোনো খবর রাখার প্রয়োজন আমরা, ভারতবর্ষের বাম বুদ্ধিজীবীরা বোধ করি না। কথাটা বলতে হচ্ছে গভীর খেদের সঙ্গে, কারণ এশিয়ার অন্তত তিনটি দেশে, যথা চিন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মার্কসবাদীরা অনেকদিন ধরে লিপ্ত রয়েছেন রোজা লুক্সেমবুর্গ চর্চায়, যা দিশা দেখাচ্ছে রোজা লুক্সেমবুর্গ সম্পর্কে নতুন ভাবনার।
একদিকে অতীতাশ্রয়ী ভাবনার ভার, অপরদিকে নতুন ভাবনাচিন্তাকে আমল দেবার ক্ষেত্রে অক্ষমতা বা নির্লিপ্ততা ভারতবর্ষে রোজা লুক্সেমবুর্গকে যথার্থভাবে বোঝার ক্ষেত্রে এক বড় অন্তরায়।
২
রোজা লুক্সেমবুর্গ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে কেন ব্রাত্য থেকে গেলেন আর আজ তাঁর ১৫০তম জন্মবর্ষে কেনই বা আমরা তাঁকে স্মরণ করার কথা ভাবছি সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা শুধু একবার স্মরণ করব এই মহান বিপ্লবী সম্পর্কে ১৯২২ সালে লেনিনের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি, যার মূল কথাটি ছিল এরকম: বেশ কিছু বিষয়ে রোজা লুক্সেমবুর্গের অবস্থানে ভুলভ্রান্তি থাকলেও তিনি ছিলেন এবং থাকবেন আকাশে ওড়া ঈগল পাখির মত। পৃথিবীর সব কমিউনিস্টদের স্মৃতিতে তিনি বিরাজ করবেন এবং তাঁর জীবন ও সমগ্র রচনাবলি (যার প্রকাশে জার্মান কমিউনিস্টরা অত্যধিক বিলম্ব করেছেন) বহু প্রজন্মের কমিউনিস্টদের প্রশিক্ষিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে।
লেনিন এই উক্তিটি করেছিলেন ১৯২২ সালে। তিনি চলে গেলেন ১৯২৪ সালে। তার পরে পরেই রোজা লুক্সেমবুর্গ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ব্রাত্য হয়ে গেলেন এবং তার পরে দীর্ঘ কয়েক দশক জুড়ে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তাঁর নাম রইল অনুচ্চারিত, অনুল্লিখিত। তিনি হয়ে দাঁড়ালেন নিন্দিত ও সমালোচিত এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর ঠাঁই হল না প্রথাসিদ্ধ কমিউনিস্ট মহলে।
অন্তত তিনটি কারণ এক্ষেত্রে অনুমেয়।
এক – ১৯০৩ সালে লেনিন ও রোজা লুক্সেমবুর্গের মধ্যে যে বিতর্ক হয়েছিল এবং যার রেশ চলেছিল বেশ কিছুদিন এবং যার পোষাকি নাম দেওয়া হয়েছিল পার্টিকেন্দ্রিকতা (লেনিন) বনাম স্বতঃস্ফূর্ততা (রোজা লুক্সেমবুর্গ), তার জেরে রোজা লুক্সেমবুর্গকে বিদ্ধ করা হয়েছিল লেনিন বিরোধী এই তকমা দিয়ে। আর এই তকমা দিয়েই তাঁকে বিচার করা হল দীর্ঘ কয়েক দশক জুড়ে। দুটি বিষয় সম্পুর্ণ অনুচ্চারিত রয়ে গেল। প্রথমত, লেনিন নিজে কখনও এই ধরণের ভাবনাকে অনুমোদন করেন নি এবং উভয়ের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকলেও উভয়ের সম্পর্ক শেষদিন পর্যন্ত ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার। এই সম্পর্কের মধ্যে ছিল না কোনো বৈরীতা আর সম্ভবত সেই কারণেই জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আউগুস্ট থালহাইমার বলেছিলেন যে, বিষয়টি লেনিন বনাম রোজা নয়, বিষয়টি হল লেনিন এবং রোজা। দ্বিতীয়ত, এরই জের টেনে বলা প্রয়োজন যে, লেনিন ও রোজা উভয়ের চিন্তাতেই শেষ জীবনে দুটি বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটেছিল যার সুবাদে যেন লেনিন রোজার এবং রোজা লেনিনের ভাবনাকে আশ্রয় করেছিলেন। লেনিন তাঁর জীবনের শেষ পর্বে পার্টিকেন্দ্রিকতা থেকে উৎসারিত আমলাতন্ত্রের বিপদের মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষের সক্রিয় ক্ষমতায়নের মাধ্যমে, যা ছিল রোজা লুক্সেমবুর্গের রণধ্বণি। আবার রোজা এটা বুঝেছিলেন যে বলশেভিক পার্টির আদলে যথার্থ শৃঙ্খলাপরায়ণ পার্টির অভাবে, শুধুমাত্র গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে জার্মান বিপ্লব সম্পন্ন হবে না, অর্থাৎ, বিপ্লবকে পরিণত রূপ দিতে গেলে প্রয়োজন সংগঠন, পরাজিত জার্মান বিপ্লবের ক্ষেত্রে যার অভাব ছিল অত্যন্ত প্রকট। রোজা লুক্সেমবুর্গ এই বিষয়ে যে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, তাঁর শেষ পর্বের লেখাগুলি তার সাক্ষী, যেখানে তিনি জার্মান বিপ্লবীরা হঠকারী কোনও সিদ্ধান্ত যেন না নেন, সে ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
দুই – ১৯১৮ সালে রোজা লুক্সেমবুর্গ লিখেছিলেন The Russian Revolution, যেখানে ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়েও তিনি কঠোর সমালোচনা করেছিলেন বিপ্লবের অব্যবহিত পরে পরেই রাশিয়াতে লেনিন ও ত্রৎস্কির নেতৃত্বে যে অতিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল তার এবং তার পরিণতিতে শ্রমজীবী মানুষের গণতন্ত্রকে যে প্রাধান্য দেওয়া হল না সেই বিষয়টির। এই প্রসঙ্গটিতে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে প্রচুর বিতর্ক হয়েছিল এবং আজও সেই বিতর্ক বজায় রয়েছে, কারণ এই বিষয়টির সঙ্গে সম্পর্কিত বেশ কিছু নতুন তথ্য এখন রোজা-গবেষকদের হাতে এসেছে। মূলত বিতর্কটি একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। রোজা লুক্সেমবুর্গ রুশ বিপ্লবের যে মূল্যায়ন করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর আগে তিনি কি তার পুনর্বিবেচনা করার কথা ভেবেছিলেন? গবেষকদের এক বড় অংশ মনে করেন যে রোজা লুক্সেমবুর্গ রুশ বিপ্লবের গতিপ্রকৃতি গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন এবং যার ঐতিহাসিক তাৎপর্য এবং গুরুত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সোচ্চার হয়েও তাঁর মূল অবস্থান, অর্থাৎ, লেনিন-ত্রৎস্কি কৃত অতিকেন্দ্রিক ব্যবস্থার সমালোচনা থেকে সরে আসেন নি। অপরদিকে একটি মত আছে যার মূল কথাটি হলো যে, রোজা লুক্সেমবুর্গের কয়েকটি চিঠি পড়লে বোঝা যায় যে, তিনি ক্রমশই এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসের ক্রমবর্ধমান বিপদকে ঠেকানোর জন্য গণতন্ত্রকে সাময়িকভাবে খর্ব করে অতিকেন্দ্রিকতার পথে বলশেভিকদের পা বাড়াতে হয়েছিল, যদিও বিপ্লবী সন্ত্রাস ছিল ইউরোপীয় প্রলেতালিয়েতের ব্যর্থতা ও দুর্বলতার সূচক মাত্র, – এমনটাই ছিল রোজা লুক্সেমবুর্গের ভাবনা।
কিন্তু লেনিনোত্তর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের কোন পর্যায়েই রোজা লুক্সেমবুর্গের রুশ বিপ্লব সম্পর্কে অবস্থান প্রসঙ্গে এই বিতর্ককে আমল দেওয়া হল না। তাঁকে সরাসরি চিহ্নিত করা হল লেনিনের সমালোচক ও রুশ বিপ্লবের তাৎপর্য সম্পর্কে প্রান্ত চিন্তার অনুসারী হিসেবে এবং তার পরিণতিতে তিনি হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ ব্রাত্য, যার জেরে সোভিয়েত জমানায় রোজা লুক্সেমবুর্গের The Russian Revolution পুস্তিকাটি প্রকাশ করা নিষিদ্ধ ছিল। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় রাশিয়াতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পরে।
তিন- ১৯৩১ সালে Proletarskaia Revolutsiia পত্রিকায় “On Some Questions Concerning the history of Bolshevism” এই শিরোনামে স্তালিন প্রকাশ করলেন একটি চিঠি, যেটি কার্যত ঘোষণা করেছিল রোজা লুক্সেমবুর্গের বিরুদ্ধে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির তথা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের চরম দন্ডাজ্ঞা। ১৯২৮ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিক (কমিনটার্ন) গ্রহণ করেছিল অতি-বামপন্থী, শ্রেণি বনাম শ্রেণি রণকৌশল, যেটির অন্যতম উৎস ছিল ১৯২৭ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে “দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদের” বিরুদ্ধে গৃহীত “অতি-বামপন্থী” রাজনৈতিক লাইন। রোজা লুক্সেমবুর্গের ভাবাদর্শকে আখ্যা দেওয়া হল মেনশেভিক সংশোধনবাদের এক সংস্করণ হিসেবে, যার পোষাকি নাম দেওয়া হল Luxemburgism । অর্থাৎ, কমিন্টার্নের ঘোষিত অতি-বাম নীতির বিরোধিতা করেছিলেন যে বামপন্থীরা তাঁদের শ্রেণিশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে রোজা লুক্সেমবুর্গকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো এবং তার ভিত্তিটি হয়ে দাঁড়াল স্তালিনের চিঠিটি। তার একটি কারণ এও ছিল যে, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিনটার্নের অতি-বাম নীতির যাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন (যেমন, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির বিক্ষুব্ধ অংশ) তাঁরা তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে রোজা লুক্সেমবুর্গকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ফলে ১৯৩১ সালের পর এই শব্দবন্ধের সুবাদে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এই অকুতোভয় বিপ্লবী আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সম্পুর্ণ ব্রাত্য হয়ে গেলেন, যাঁর নাম উচ্চারণ করাটাও হয়ে দাঁড়াল এক মহা অপরাধ।
এভাবেই রোজা লুক্সেমবুর্গের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়েছিল। লেনিন তাঁর মূল্যায়ন করেছিলেন, তার সঙ্গে এভাবেই রচিত হয়েছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি, কমিনটার্ন ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রদত্ত ভাষ্যের ব্যবধান ও পার্থক্য। সত্তরের দশকে প্রথম যখন জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র থেকে রোজা লুক্সেমবুর্গের সমগ্র রচনাবলি ও চিঠিপত্র প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হলো, তখনও সম্পাদকদের যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছিল, যাতে সোভিয়েত পার্টির নেতৃত্বের সমালোচনার মুখে তাঁদের পড়তে না হয়। ১৯৯১ সালের পরে যখন সংযুক্ত জার্মানিতে রোজা লুক্সেমবুর্গ নিয়ে নতুন চর্চা শুরু হলো, তখন এই কথা প্রকাশ্যে তারা কবুল করেন। এর মধ্যে সত্যিই কোন ভুল ছিল না, কারণ সোভিয়েত শাসনপর্বে রুশ দেশে রোজা লুক্সেমবুর্গ ছিলেন অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি নাম এবং সেই কারণে তাঁর লেখাপত্র প্রকাশ করা বা তাঁকে নিয়ে চর্চা ও আলোচনার বৌদ্ধিক পরিবেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল কার্যত অনুপস্থিত।
৩
সোভিয়েত-উত্তর দুনিয়ায় রোজা লুক্সেমবুর্গ সম্পর্কে যে নতুন গবেষণা ও পুনর্মূল্যায়ন গত কয়েক দশক থেকে জারি রয়েছে, বলা বাহুল্য, তার দিশাটি অতীতের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে বিপুল তথ্য এখন রোজা-গবেষকদের সামনে উপস্থিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে বর্তমান সময়ে, বামপন্থা ও মার্কসবাদের সংকটকালে, রোজা লুক্সেমবুর্গের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতাকে নতুন করে অনুধাবন করতে অসুবিধে হয় না। এও বুঝতে এখন আর ভুল হয়না যে, লেনিন কেন আজ থেকে একশো বছর আগে তাঁর সমগ্র রচনাবলি প্রকাশ করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কেনই বা তিনি বলেছিলেন যে আগামী প্রজন্মের কমিউনিস্টদের প্রশিক্ষিত হতে রোজা লুক্সেমবুর্গকে বিশেষ করে প্রয়োজন হবে।
কী সেই প্রয়োজন? কেনই বা রোজা লুক্সেমবুর্গ আজ প্রাসঙ্গিক? একনজরে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে। এক : রোজা লুক্সেমবুর্গের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি যে, সমাজতন্ত্র যদি প্রতিষ্ঠিত না হয়, তার বিকল্প হবে বর্বরতা। আজকের পৃথিবীতে শ্রমজীবী মানুষের কাছে এর চেয়ে বড় সত্য বোধ হয় আর কিছু নেই। সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের যে আর কোন বিকল্প নেই, প্রতিনিয়ত খেটে খাওয়া মানুষ সেটি অনুভব করছেন তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে। দুই : কিন্তু কেমনে হবে সেই সমাজতন্ত্র? তার মূল চালিকাশক্তি হবে শ্রমজীবী মানুষ এবং তাঁরা তখনই গড়ে তুলতে পারবেন যথার্থ সমাজতন্ত্র যখন তাঁরা হবেন বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে সমৃদ্ধ। তিন : সমাজতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তিটি হবে গণতন্ত্র। কিন্তু সেই গণতন্ত্র হবে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত, বুর্জোয়া, লিবারেল গণতন্ত্র নয়, যেখানে ধ্বনিত হবে শ্রমজীবী মানুষের কন্ঠস্বর। চার : সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালনা করার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন হবে কমিউনিস্ট পার্টির, কিন্তু তার সংস্কৃতিকে হতে হবে গণতান্ত্রিক, অর্থাৎ, অতিকেন্দ্রিকতার ভাবনাকে খারিজ করতে হবে, কারণ তার জেরেই প্রতিষ্ঠিত হয় আমলাতান্ত্রিকতা, যা পার্টিকে করে দেয় জনবিচ্ছিন্ন। তাই রোজা লুক্সেমবুর্গ সতর্ক করে দেন যে পার্টির অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ যদি না থাকে ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি না থাকে, তার পরিণতিতে পার্টি পর্যবসিত হবে বর্ণহীন, জড়বৎ এক প্রতিষ্ঠানে। পাঁচ : পশ্চিমী, ইউরোপীয় সভ্যতা স্বীকার করে না যে অ-পশ্চিমী, অ-ইউরোপীয়, প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাছে তারা কতটা ঋণী, কারণ ইউরোপ মানতে চায় না যে প্রাচ্যের সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাস কতখানি সমৃদ্ধ। অ-ইউরোপীয় দেশগুলি সম্পর্কে রোজা লুক্সেমবুর্গের এই অবস্থান আমাদের নজর এড়িয়ে যায়।
রোজা লুক্সেমবুর্গের এই ভাবনাগুলিকে অতীতে কখনোই আমল দেওয়া হয় নি। এর কারণ ছিল অজ্ঞতা এবং অনীহা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মহলে অত্যন্ত সচেতনভাবে বিদ্বেষমূলক প্রচার, যার পরিণতিতে তিনি দীর্ঘ কয়েক দশক জুড়ে তিনি রয়ে গেলেন অপঠিত, অনালোচিত, অশ্রুত এক ব্যক্তিত্ব। মার্কসবাদের নবায়নের স্বার্থে, বামপন্থার পুনরুজ্জীবনের স্বার্থে, আজকের এই কঠিন সময়ে, রোজা লুক্সেমবুর্গের জন্মের সার্ধশতবর্ষে, আসুন, আমরা একবার ফিরে তাকাই তাঁর দিকে একটু ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন চোখে, ধুয়ে ফেলি অতীতের অনেক পাপকে, স্বীকার করে নিই অতীতের ভুলভ্রান্তিকে, মর্যাদা দিই, স্বীকৃতি দিই তাঁর চিন্তাভবনাকে, তাঁর লেখাপত্রের গুরুত্বকে। রোজা লুক্সেমবুর্গের প্রতি কমিউনিস্টদের যে দায় রয়েছে, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন লেনিন। সেই দায় তাঁরা পালন করেন নি। তাঁর জন্মের ১৫০তম বর্ষ পেরিয়ে এসে সময় হয়েছে তার প্রায়শ্চিত্ত করার, সেই মহান দায় পালন করার। সেটিই হবে লেনিনকে অনুসরণ করে রোজা লুক্সেমবুর্গের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন।
মতামত লেখকের নিজস্ব