১৫জানুয়ারী,২০২৩
তাঁর কাছে দেশ মানে ছিল বিশ্ব, জাতি মানে মানবতা, আর ধর্ম মানে বিপ্লব।
তিনি ছিলেন নীতির প্রশ্নে অটল। লক্ষ্যে অবিচল। নিজের কাজে একমনা, অনন্য চিত্ত। নিজে যা বিশ্বাস করতেন, তার জন্য অকুতোভয়, বেপরোয়া।
হাঁটু মুড়ে বেঁচে থাকার চেয়ে ঢের ভালো দাঁড়িয়ে থেকে শহীদী মৃত্যু— চে’র জীবনে তা ছিল জ্বলন্ত সত্য।
নইলে শিয়রে যখন মৃত্যু, তখন চরম তাচ্ছিল্যে ঘাতকদের উদ্দেশ্যে নির্বিকার চোখে বলতে পারেন, ‘আমি জানি তোমরা আমায় হত্যা করতে এসেছ। ভয় পেয়ো না, গুলি করো। তোমরা শুধুই হত্যা করতে এসেছ একজন মানুষকে।’
শুধুই একজন মানুষকে, মতাদর্শকে নয়!
মৃত্যু সম্পর্কে ছিলেন পুরোপুরি নিঃস্পৃহ। প্রত্যয়ী ছিলেন বিপ্লবে। চে বলতেন, ‘আমাদের প্রতিটি কাজই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রণধ্বনি।… মৃত্যু যেখানে উপস্থিত হয়ে আমাদের বিস্মিত করবে, সেখানেই আমরা তাকে আলিঙ্গন করে নেব সানন্দে।’
এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মৃত্যুর পর ত্রিমহাদেশীয় সম্মেলনের উদ্দেশে লেখা বার্তায় বলেছিলেন, ‘আমাদের এই কঠিন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে, মৃত্যু নামক দুর্ঘটনাটি মাঝেমধ্যেই ঘটে থাকে’ এবং এই মৃত্যুই ‘নতুন যুদ্ধ ও বিজয়ের জন্ম দেয়’। ফিদেলকে লেখা শেষ চিঠিতে যেমন বলেছিলেন, ‘বিপ্লবে আছে জয় অথবা মৃত্যু। বিপ্লবে কেউ জয়ী হয়, অথবা তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়’।
জীবনযুদ্ধ দিয়ে তা দেখিয়েছেন তিনি। এদুয়ার্দো গালেয়ানোর ভাষায়, ‘ম্যাজিক ডেথ ফর এ ম্যাজিক লাইফ’!
‘চে মানে একটি মানুষ, একটি নাম, একটি দৃষ্টান্ত। যা এক আবেগ-উদ্বেলিত শক্তি নিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। ইতিহাসে যা খুবই কম দেখা যায়। সম্ভবত, আর দেখা যায়নি।’ বলেছিলেন ফিদেল। ‘কারণ, চে’র মধ্যে আন্তর্জাতিক মনন বিশুদ্ধতম ও নিঃস্বার্থভাবে বাস্তব রূপ পেয়েছিল, যা আজকের দিনের বৈশিষ্ট্য, আগামী দিনে যে চেতনা উত্তরোত্তর বাড়বে।’
একুশ শতকের এই চে’কে আমাদের প্রয়োজন।
একথা ঠিক, চে মানে এক রোমান্টিক আবেদন। স্বপ্ন দেখছে যে চোখ। স্বপ্ন দেখতে উদ্দীপ্ত করে যে চোখ। যে চোখে চোখ পড়লে দৃষ্টি ফেরানো শক্ত। যা ছুঁয়ে যায় হৃদয়কে, মনকে।
আবার এও ঠিক, চে মানে শুধু রোমান্টিক এক তরুণের রাখাল চোখ নয়। চে মানে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে স্থির জ্বলন্ত দৃষ্টি। স্বপ্ন দেখতে দেখতে শহীদীবরণ করে যে চোখ। স্বপ্নপূরণে দায়বদ্ধ যে চোখ।
একজন প্রকৃত বিপ্লবী আদতেই একজন রোমান্টিক মানুষ। জীবনকে ভালোবাসা, সমাজের প্রতি ভালোবাসা পালটে দেয় একজন মানুষের জীবনকে,পালটে দেয় জীবনবোধকে। রোমান্টিক চে’র রোমান্স ছিল বিপ্লবের সঙ্গে।
পরিযায়ী বিপ্লবী তিনি। তবে এর পিছনে যতটা ‘রোমান্টিকতা’ ছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল রাজনীতি। হাতে চুরুট, কাঁধে রাইফেল— নিছকই এক অনন্ত স্বপ্নচারী ছিলেন না তিনি। বোহেমিয়ান থেকে দুঃসাহসী বিপ্লবী তিনি।
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিপ্লবীদের ঐক্য গড়তে ‘প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের’ আহ্বান জানিয়েছিলেন চে। শুধু আহ্বান জানানোই নয়, নিজের জীবন দিয়ে এই বিশ্বাসের প্রতি সততা দেখিয়েছিলেন তিনি।
চে মনে করতেন, বিশ্বজোড়া সংঘাতেই পরাস্ত করা সম্ভব সাম্রাজ্যবাদকে। তিনি বলতেন, সাম্রাজ্যবাদকে নির্মূল করার যুদ্ধ হবে দীর্ঘ ও রক্তাক্ত। ‘সাম্রাজ্যবাদের মহীরুহ থেকে একটি একটি করে দেশ যখন খসে পড়ে, তখন তা শত্রুর বিরুদ্ধে আংশিক বিজয়ই শুধু সূচিত করে না, শত্রুর প্রকৃত ক্ষমতাকে দুর্বল করে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায়।’
ভিয়েতনামের জনগণের লড়াই তাঁকে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। ১৯৬৭ সালের এপ্রিল, ‘ত্রিমহাদেশীয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের শিরোনামেই স্পষ্ট, ঠিক কী ভাবছিলেন তিনি— ‘দুটি, তিনটি… তৈরি করো অনেক ভিয়েতনাম।’
সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করা সম্ভব। অপরাজেয় ভিয়েতনামই তার প্রমাণ।
‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মৃত্যুর কোনও সীমানা নেই।’ বলেছিলেন চে। আলজেরিয়ার রাজধানী আলজেয়ার্সে ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যাফ্রো-এশীয় সংহতি সম্মেলনে চে’র প্রত্যয়ী ভাষণ ছিল, ‘পৃথিবীর কোথাও কোনও প্রান্তে কোনও ঘটনা সম্পর্কে আমরা মুখ ঘুরিয়ে রাখতে পারি না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোনও দেশের বিজয় মানে, আমাদের জয়, ঠিক যেমন কোনও দেশের পরাজয় মানে, আমাদের পরাজয়। সবর্হারার আন্তর্জাতিকতাবাদের এই অনুশীলন তাই আরও উন্নত ভবিষ্যতের লক্ষ্যে সংগ্রামরত মানুষের জন্য শুধু একটি কর্তব্য নয়, অনিবার্য বাধ্যবাধকতা।’
সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের ‘রোল মডেল’ তিনি। বলেছেন ফিদেল। প্রিয় কমরেড সম্পর্কে ফিদেলের দরাজ সার্টিফিকেট, ‘মার্কসবাদী-লেনিনবাদী চিন্তাধারার সজীবতম, শুভ্রতম ও সবচেয়ে বিপ্লবী প্রকাশ ঘটিয়েছেন চে। সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার আদর্শকে সম্ভাব্য উচ্চতম পর্যায়ে চে যেভাবে উন্নীত করেছেন, আমাদের সময়কালে আর কেউ তা করেনি।’
‘আমরা যখন একজন সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদী মানুষের কথা বলি, যখন একজন সেইরকম মানুষের উদাহরণ খুঁজি, তখন সেই উদাহরণের তালিকায় সবার চেয়ে উঁচুতে থাকবে চে’র উদাহরণ। জাতীয় পতাকা, সংস্কার, উগ্র স্বাদেশিকতা ও অহমিকা চে’র হৃদয় ও মন থেকে অপসৃত হয়েছিল। যে কোনও মানুষের জন্য, যে কোনও মানুষের কারণে তিনি তাঁর উদার রক্ত স্বতঃস্ফূর্ত ও তুরন্ত ঢেলে দেওয়ার জন্য ছিলেন সদা প্রস্তুত।’ বলেছেন ফিদেল।
‘তাঁর রক্ত যখন আমাদের মাটিতে পড়েছে, তখন তিনি বহু যুদ্ধে আহত হয়েছেন। তাঁর রক্ত বলিভিয়ায় পড়েছে শোষিত, নির্যাতিত, দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের মুক্তির জন্য। তাঁর রক্ত ঝরেছে আমেরিকার জনগণের জন্য, ভিয়েতনামের জন্য। কারণ, যখন তিনি বলিভিয়ায় অভিজাত সম্প্রদায় ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন, তখন তিনি বিলক্ষণ জানতেন, ভিয়েতনামের জন্য সংহতির শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ ঘটাচ্ছেন।’
চে মনে করতেন, প্রথমত, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অন্যত্র বিপ্লবী তৎপরতায় মদত দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদকে একাধিক রণাঙ্গনে ব্যস্ত রাখা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, কিউবার বিপ্লবকে টিকিয়ে রাখতে লাতিন আমেরিকার অন্যত্র বিপ্লবের ঢেউ তোলা প্রযোজন।
১৯৬৫ সালের বসন্ত থেকে ’৬৭-তে বলিভিয়ায় মৃত্যু পর্যন্ত— কিউবা থেকে এই দীর্ঘ অন্তর্ধান পর্বে একবারই প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন চে। ‘এই বিশ্বের কোনও এক প্রান্ত থেকে’ পাঠানো সেই বার্তা ছিল ত্রি-মহাদেশীয় সম্মেলনের সংগঠকদের কাছে।
‘আমাদের গড়ে তুলতে হবে সত্যিকারের সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ। যার সঙ্গে থাকবে আন্তর্জাতিক সর্বহারা সেনাবহিনী। যে পতাকার নিচে আমরা সংগ্রাম করব, সে পতাকা হবে মানবতাকে মুক্ত করার পবিত্র আদর্শের। ভিয়েতনাম, গুয়েতেমালা, লাওস, গিনি, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ব্রাজিলসহ আরও অনেক দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে— সেসব দেশের মুক্তি সংগ্রামের পতাকার নিচে জীবনদান করা সকলের পক্ষে সমান বরণীয় ও গৌরবের। সে তিনি আমেরিকান, আফ্রিকান এমনকি ইউরোপিয়ান— যেই হোন না কেন। যে দেশে জন্ম হয়নি, এমন দেশের মুক্তি সংগ্রামের পতাকার নিচে তাঁর প্রতিটি রক্তবিন্দু, যাঁরা বেঁচে থাকবেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা দান করবে। এবং পরবর্তীকালে এই অভিজ্ঞতা তাঁর নিজের দেশের মুক্তি সংগ্রামে যুক্ত হবে। একেকটি দেশে মুক্তি লাভের অর্থ— তাঁর নিজের দেশের মুক্তি যুদ্ধের একেকটি পর্যায় অতিক্রম করা।’
এটা ঠিক, সেদিন নেই।
আজকের বিশ্ব, গত শতকের ছয়ের দশকের বিশ্ব নয়। গেরিলা যুদ্ধ এখন ইতিহাস। এই মুহূর্তে লাতিন আমেরিকায় সশস্ত্র গেরিলাদের সংগ্রাম অপ্রাসঙ্গিক। আর এই রাজনৈতিক মূল্যায়ন গড়ে উঠেছে বর্তমান পরিস্থিতি ও লাতিন আমেরিকার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। অতীতের গেরিলা সংগঠনগুলি যেমন এল সালভাদোরের ফারাবুন্দো মার্তি ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এফএমএলএন), নিকারাগুয়ার সান্দিনিস্তা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এফএসএলএন) বা উরুগুয়ের ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট বা তুপামোরোস (এমএলএন)— প্রত্যেকেই অংশগ্রহণ করেছে মূল ধারার রাজনৈতিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়। এঁদের এই নতুন ভূমিকা এই সমস্ত দেশগুলিতে প্রগতিশীল পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি নেপালেও।
এফএমএলএন— যারা আটের দশকেও ছিল বেআইনি, নিষিদ্ধ গেরিলা সংগঠন, তারা কখনও জিতেছে এল সালভাদোরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে (যেমন নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রাক্তন গেরিলা সালভাদোর সানচেজ), কখনও আবার বিরোধী দলের ভূমিকায়। মার্কসবাদী সান্দিনিস্তা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট এখন নিকারাগুয়ার ক্ষমতায়। উরুগুয়েতে ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট বা তুপামোরোস (এমএলএন) এখন মূল ধারার রাজনীতিতে। বামপন্থী, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, কমিউনিস্ট ও প্রাক্তন কমিউনিস্টদের নিয়ে গঠিত বৃহত্তর ফ্রন্ট— ফ্রেন্তে অ্যামপ্লিও কখনও জিতেছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, কখনও বিরোধী রাজনীতিতে। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি হোসে মুজিকা যেমন ছিলেন একজন প্রাক্তন তুপামোরোস গেরিলা। কলম্বিয়াতে, পাঁচ দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান। নিরস্ত্রীকরণ শেষে মার্কসবাদী গেরিলা সংগঠন ফার্ক এখন পুরোদস্তুর একটি রাজনৈতিক দল। রাজনীতির মূল স্রোতে। কলম্বিয়ায় এই প্রথম একজন বামপন্থী রাষ্ট্রপতি, যিনি একসময় ছিলেন এম-১৯ গোষ্ঠীর গেরিলা যোদ্ধা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী গেরিলা সংগঠন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (ইএলএন) এখন সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় ব্যস্ত।
কিন্তু এও ঠিক, সাম্রাজ্যবাদ আজ আরও আগ্রাসী। একুশ শতকে এখানে আমাদের চে’কে প্রয়োজন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জন্য, বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্য।
কোনও সন্দেহ নেই, বর্তমান বিশ্বে দৃঢ় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা ব্যতিরেকে কোনও দেশেই বিপ্লবী সংগ্রাম অগ্রসর হতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থি হলো পুঁজির শ্রেণিশোষণ। তাই পুঁজির শ্রেণিশোষণের বিরুদ্ধে আক্রমণকে তীব্র করতে হবে।
ফিদেলের কথায়, চে ‘ছিল সেই ফুলের মতো, ফোটার আগেই বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে নেওয়া একটি ফুল। এক ব্যতিক্রমী যোদ্ধা। সে ছিল সান্তাক্লারা শহরের মুক্তির দূত। জন্ম দিয়েছিল স্বেচ্ছা শ্রমের। অন্য দেশের মাটিতেও আঁকা আছে তাঁর মহৎ রাজনৈতিক অভিযাত্রার পদচিহ্ন। কান্দাহারের পূর্বাঞ্চল থেকে বলিভিয়া, সে ছিল জঙ্গী আন্তর্জাতিকতাবাদের বার্তাবাহক। আমাদের আমেরিকায়, আমাদের বিশ্বে এক অভূতপূর্ব চেতনার কারিগর।’