Religion and Rabindranath

বিজয় পাল

প্রথম যৌবনের অপরিণত বয়স থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্ম নিয়ে চিন্তা করেছেন। বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথের মতো ভাবুক, চিন্তক, সৃজনশীল মানুষের ধর্মের মতো সূক্ষ্ম বিষয়ের চিন্তা কোনো স্থানু বিষয় হয়ে থাকেনি। তাতে ভাবের বদল এসেছে নানা পর্যায়ে।

আমরা লক্ষ্য করি, একেবারে কাঁচা বয়সের ‘বিদ্রোহী’ ভাব কাটিয়ে আদি ব্রাহ্ম সমাজের (১৮৮৪) সম্পাদক হওয়ার পর থেকে ধর্মচিন্তা নিয়ে তিনি দোলাচলমানতায় ভুগেছেন। কখনও তিনি হিন্দুধর্মের নীতিকে আক্রমণ করছেন। যেমন (‘আর্য-অনার্য’ ১৮৮৬, ‘গুরুবাক্য’ ১৮৮৭, ‘প্রত্নতত্ত্ব’ ১৮৯১, ‘করিমের উমেদার’ ১৮৯২, ‘আচারের অত্যাচার’ ১৮৯২) প্রভৃতি প্রবন্ধে। হিন্দুসমাজকে ‘বাঁধাসমাজ’, জড় লোকাচার, দেশাচার, জাতপাত, পাপপুণ্যের বিধানের মধ্যে’ মনুষ্যত্বের উচ্চ অঙ্গের প্রতি অবহেলা’ দেখেছেন। ‘ধর্মপ্রচার’ (১৮৮৮) কবিতায় ‘হিন্দুধর্ম ধ্বজাধারী’, ‘গেরুয়া বস্ত্রাচ্ছাদিত অনাবৃতপদ মুক্তি ফৌজের প্রচারক’দের অপহৃত উৎকট হিন্দুয়ানি বলে তীব্র ব্যঙ্গ কষাঘাত করেছেন।

সেই তিনি কয়েক বছরের মধ্যে হিন্দু ধর্মের অতীতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠেন। এই সময়ে তাঁর মধ্যে হিন্দুয়ানির প্রাবল্য দেখা যায়। বস্তুত, এই সময় তিনি হিন্দুতা ও ভারতীয়তাকে প্রায় সমার্থক হিসেবে দেখেছেন। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে তিনি এই মর্মে প্রবন্ধ লিখতে ও লেখাতে শুরু করেন। ‘হিন্দুধর্ম— সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রতিদিন পঞ্চযজ্ঞের দ্বারা দেবতা, ঋষি, পিতৃপুরুষ, সমস্ত মনুষ্য ও পশুপক্ষীর সহিত আপন মঙ্গলসম্বন্ধ স্মরণ করিতে প্রবৃত্ত করিয়াছে।'(‘স্বদেশী সমাজ’ ১৯০৪)। এই নিদান পালনের আহ্বান জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘অতীতের রসে হৃদয়কে পরিপূর্ণ’ (‘ব্রাহ্মণ’ ১৯০২) করে দেওয়ার ডাক দিচ্ছেন। আমরা দেখি, ব্রাহ্মধর্ম বিদ্যালয়— ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’— এ অব্রাহ্মণ শিক্ষকদের ব্রাহ্মণ ছাত্ররা পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের বদলে দূর থেকে নমস্কার করবে, বর্ণ অনুযায়ী শিক্ষক-ছাত্ররা ভিন্ন ভিন্ন পংক্তিতে খাবে, সংহিতায় যেরূপ উপদেশ আছে সেরূপ মেনে চলতে হবে— এমন নির্দেশ জারি করেছেন। (মনোরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি, ১৯০২)।
    
কাব্যসৃষ্টির দিক থেকে এই পর্বকে আমরা ‘নৈবেদ্য’ পর্ব বলতে পারি। এটা ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরার প্রথম পর্বের আচরণের সঙ্গে মেলে।
        ‘জগতস্রোতে ভেসে চল
         যে যেথা আছ ভাই,
         চলেছে যেথা রবিশশী
         চলরে সেথা যাই।’ (সচেতন ধর্ম)

এই পংক্তি ক’টি এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাসূত্র বুঝতে সাহায্য করবে। জগত স্রোতে ভেসে যাওয়ার কথা বলছেন তিনি। বলাবাহুল্য, বিবেচনাহীন স্রোতে গা ভাসানো রক্ষণশীলতার লক্ষণ।

এই ঘোর বেশি দিন টেকেনি। তিনি উপলব্ধি করলেন, নিজের সঙ্গে নিজের অদৃশ্য ব্যবধান তৈরি করে ফেলেছেন। সনাতন হিন্দুধর্ম আর হিন্দুতা নিয়ে গৌরববোধের এক তীব্র মোহ তাঁকে গ্রাস করেছে। এই মোহের অভেদ্য দুর্গের মধ্যে তিনি ‘মুক্তি’ খুঁজেছেন। এই মুক্তিচিন্তা তাঁর অন্তরাত্মাকে তৃপ্ত করতে পারেনি, তিনি শ্রেয়কে পাননি। এই পাওয়ার সন্ধান নিয়েই তিনি ‘গোরা’ (১৯০৭-১৯১০) উপন্যাস লেখা শুরু করেন। রূপান্তর পর্বের আগের গোরা জাতিভেদের ভারতবর্ষ, কুসংস্কারের ভারতবর্ষ, পৌত্তলিক ভারতবর্ষের সঙ্গে থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যেদিন সে জানতে পারল, সে আইরিশ, সিপাহী বিদ্রোহের সময় কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে, সেদিন কঠিন দুঃখের মাঝেও সে সত্য আবিষ্কার করল, হিন্দুয়ানির গোঁড়ামি ভেঙে তার মধ্যে এল ভারতীয়ত্বের, বিশ্বমানবতার প্লাবন। সে পরেশবাবুর পায়ে আছড়ে পড়ে বলল, ‘…আজ আমি মুক্ত, পরেশবাবু আমি যে পতিত হব, ব্রাত্য হব, সে ভয় আর আমার নেই ।…আমি যা দিনরাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান, খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ  নেই। আজ ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।… সেই দেবতার মন্ত্র দিন যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন, তিনি ভারতবর্ষীয়ের দেবতা।’ পণ্ডিতগণ সহমত যে, গোরা রবীন্দ্রনাথেরই প্রতিবিম্ব।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তার প্রায় সমগ্রপর্বে ‘ঈশ্বর’ আছেন। সে ঈশ্বরকে তিনি নানা সময়ে নানা নামে ডেকেছেন। কিন্তু প্রচলিতভাবে ঈশ্বর বলতে যা বোঝায় তাঁর ঈশ্বর তেমন নন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে ঈশ্বরসাধনার উদ্দেশ্য স্বর্গলাভ, মোক্ষলাভ বা নির্বাণলাভ। তাঁর ঈশ্বরসাধনা পার্থিব জগৎকেই বেশি করে ব্যাখ্যা করে। তাই তাঁর ঈশ্বরসাধনা সাধন— পূজনরীতির চর্চা নয়। এক অর্থে তা ক্ষুদ্র আমি’র সংকীর্ণতার গণ্ডি পেরিয়ে বৃহৎ আমি’র সন্ধান। মানুষের মধ্যে ‘চিরকালের’ মানুষের সন্ধান। মানবের মধ্যে ‘মহামানবের’ সন্ধান। তাঁর ঈশ্বরসাধনা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধর্মমতের ভিত্তিতে যৌথ আচারবিধি পালন নয়। তা একান্তই আত্মগত।আত্মগতের মধ্যেই তিনি সর্বগতের সন্ধান করেছেন। তাঁর ঈশ্বরসাধনা একান্তই স্বানুভূতির মাধ্যমে সত্য, সুন্দর ও চিরকল্যাণকরের সাধনা। মানুষের যা শ্রেষ্ঠ তাই নিয়ে ব্যক্তি মানুষের উত্তরণ খুঁজেছেন ‘সর্বকালের মানুষের’ মধ্যে।

রবীন্দ্রনাথ যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে ‘সাম্প্রদায়িক ধর্ম’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখছেন, ‘ধর্ম যদি অন্তরের জিনিস না হইয়া শাস্ত্রমতো ও বাহ্য আচারকেই মুখ্য করিয়া তোলে তবে সেই ধর্ম যতো বড়ো অশান্তির কারণ হয়, এমন আর কিছুই না।… বিশেষ শাস্ত্রমতের অনুশাসনে বিশেষ করিয়া যদি কেবল বিশেষ পশু হত্যা না করাকেই ধর্ম বলা যায় এবং সেইটে জোর করিয়া যদি অন্য ধর্মমতের মানুষকেও মানাইতে চেষ্টা করা হয়,তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরোধ কোনো কালেই মিটিতে পারে না।’ (কালান্তর, ‘ছোটো ও বড়ো’ প্রবন্ধ)। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের উদ্দেশেই নানা অর্থহীন আচার সর্বস্বতাকেই ধর্মরক্ষার আধার হিসেবে বাঁধাছাদা করে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হচ্ছে।

পুঁজিবাদী অর্থনীতি যতই সঙ্কটে ডুবছে ততই ধর্মকে ঢাল করে নানা ছলে নানা মিথ্যা, বিকৃত তথ্যের আমদানি করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তীক্ষ্ণ করে তোলা হয়। আজ এ সত্য আরও জোরালোভাবে সামনে আসছে। তথাকথিত উদার অর্থনীতির যাঁতাকলে মানুষ যখন পিষ্ট হতে হতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে তখন পরিকল্পিতভাবে ধর্মের সাম্প্রদায়িক ব্যাবহারের চেহারা তীব্রভাবে নগ্ন হচ্ছে। পরিস্থিতি শেখাচ্ছে, ধর্মের এই সাম্প্রদায়িক ব্যবহার না রুখে নয়া উদারবাদী আর্থিকনীতি- বিরোধী লড়াই জেতা সম্ভব হবে না।

ঠিকই, মহান চিন্তক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক এভাবে কথা বলেননি। বলা তাঁর স্বভাবও নয়। কিন্তু কতদূর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে সাম্প্রদায়িক বলা যায়,ভাবলে গায়ে যেন কাঁটা দেয়।

     
বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের মতো চিরানুসন্ধিৎসু মানুষের ধর্মের মতো সূক্ষ্ম বিষয়ের চিন্তা কোনো স্থানু বিষয় হয়ে থাকতে পারে না,থাকেওনি। জীবনকে উপলব্ধি করতে গিয়ে ধর্মকে তিনি বারবার আতসকাচে ফেলে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন। ঈশ্বরের অনুসঙ্গে বারবার এসেছে ধর্মের চিন্তা। তাঁর এই চিন্তা এক জায়গায় স্থবির হয়ে থাকেনি। চলতে চলতে তা বাঁক নিয়েছে। বাঁক নেয়ার অর্থ ভাবের বদল ঘটা।  এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু এক জায়গায়  বলছেন, বয়স বাড়লে সাধারণ লোকের মধ্যে আধ্যাতিকতা বাড়ে। রবীন্দ্রনাথ হলেন সেই ব্যতিক্রমী, যিনি ক্রমেই সরে সরে এসেছেন। 
   
রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় গণসচেতনতার সূচনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তার সার্থক উত্তরণ ঘটে। মাঝে নানা বিচিত্রমুখী টানাপোড়েন দেখা যায়।

১৯২৭-এ ধর্মতন্ত্রের কদর্যতায় বিরক্ত হয়ে রঁমা রঁলা’কে লিখলেন, এ দেশে এখন flood of atheism দরকার। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখলেন, ‘ধর্মমোহের চাইতে নাস্তিকতা অনেক ভালো।’ ‘রক্তকরবী’ নাটকে আমরা দেখি, যক্ষপুরীর স্বার্থ অটুট রাখতে সরদার ও গোঁসাই একজোট। চাবুকের বাড়ি খেয়ে বিশু নন্দিনীকে বলছে, ‘চাবুক মেরেছে, যে চাবুক দিয়ে ওরা কুকুর মারে। যে রশিতে এই চাবুক তৈরী সেই রশির সুতো দিয়েই ওঁদের গোঁসাইয়ের জপমালা তৈরী।’ শাসনতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মতন্ত্রের যোগ এমন তীব্রভাবে তুলে ধরার দৃষ্টান্ত বিশ্বসাহিত্যে বিরল। ১৯৩৫-এ অমিয় চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘মানুষের সভ্যতার যে রূপ আমাদের সামনে বর্তমান সে সভ্যতা মানুষ-খাদক। তার আরাম, তার ঐশ্বর্য,এমনকী তার সংস্কৃতি মাথা তোলে নিম্নতলস্থ মানুষের পিঠে চড়ে।’

হেমন্তবলা দেবীকে লেখা তাঁর ১০ ডিসেম্বর,১৯৩৪ – এর চিঠিতে বলছেন,’ …পারিত্রিকের ঠিকানা জানিনে, যারা সেখানকার বিবরণ জটিল ভাষায় বিস্তারিত করে বলতে আসে তাদের কথা বুঝতেও পারিনে, বিশ্বাসও করিনে। সকল জাতির সকল শাস্ত্রই দৈবদত্ত নিখুঁত সত্যের অহংকার করে। অথচ তাদের পরস্পরের সম্বন্ধ আদায়- কাঁচকলায়।…এই পরস্পর প্রতিযুদ্ধমান শাস্ত্রকে আমি দূর থেকে নমস্কার করি… শ্রেয়বোধের অনুমোদিত শুচিতাকেই পালন করতে আমার প্রয়াস— যে বাহ্য আচার মানুষে মানুষে ভেদ ঘটিয়ে প্রাচীর তুলে বেড়ায়,মানবপ্রেমকে ,ঈশ্বরদত্ত বুদ্ধিকে অবজ্ঞা করে শাস্ত্রের অক্ষর বাঁচাবার জন্যে খুনোখুনি করতেও অগ্রসর হয় তাকে বর্জন করে নাস্তিক অধার্মিক পদবী নিতে আমার কোনো সংকোচ নেই’।

উপলব্ধি করতে অসুবিধে হয় না, প্রচলিত ধর্মচিন্তা ও ঈশ্বরভাবনা থেকে কবি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছেন। প্রচণ্ড আত্মমন্থনে রত তিনি। তাঁর চিন্তা টাল খাচ্ছে কিন্তু ধসে পড়েছে না। এভাবেই তাঁর ঈশ্বরচিন্তা ধর্মভাবনার খোলস থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, ধর্মভাবনা ঈশ্বরলাভের অভিমুখ থেকে সরে এসে মানুষের দুয়ারে ঠাঁই খুঁজছে।

Spread the word

Leave a Reply