শমীক লাহিড়ী
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে ২৩০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে অবস্থিত জনবিরল একটা প্রদেশ বামিয়ান। হিন্দুকুশ পর্বতমালার একেবারে কাছে অবস্থিত পাহাড়-পর্বতে ঘেরা এই প্রদেশ সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৮০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। সবুজে ঢাকা প্রায় সমতল উপত্যকাটিতে মাঝেমাঝেই হঠাৎ উঠে আসা খাড়া পর্বতের দেওয়াল, এই স্থানটিকে খুবই আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ছোট্ট বামিয়ান নদীর উত্তর পাড়েই রয়েছে প্রায় ১.৫ কিলোমিটার লম্বা একটি পর্বতের প্রায় খাড়া প্রাকৃতিক দেওয়াল। অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, মঠ ও বৌদ্ধ শিল্পকর্মের প্রত্নতাত্ত্বিক অস্তিত্বর কারণে এই পাহাড়ের দেওয়ালটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় আছে।
৬ষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি প্রায় ১৭০০ বছর আগে পাহাড়ের দেওয়ালের গায়ে খোদাই করে তৈরি করা হয় অপরূপ কিছু বৌদ্ধ মূর্তি। এর মধ্যে দুটি মূর্তির নির্মাণ কাজ ছিল বিস্ময়কর। ঐতিহাসিক মূর্তি দুটি বামিয়ান উপত্যকায় একটি পর্বতগাত্রে খোদাই করা অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল। বড় মূর্তিটির উচ্চতা ছিল ৫৫ মিটার আর ছোটটির উচ্চতা ছিল ৩৫ মিটার। এছাড়াও ঐ অঞ্চলের পর্বতগাত্রে আরও অনেকগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট বুদ্ধমূর্তিও খোদাই দেখতে পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে খ্রিস্টিয় ৩য় থেকে ১০ম শতক পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে যে বিশেষ ধরনের শিল্পকলা বিকাশ লাভ করেছিল, এগুলি সেই গান্ধার শিল্পেরই উৎকৃষ্টতম নিদর্শন। বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম।
২০০১ সালের ২ মার্চ থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ কয়েক ধাপে মূর্তিগুলিকে ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করা হয়। প্রথম কয়েক দিন, বিমান-বিধ্ববংসী কামান দিয়ে তোপ দেগে মূর্তিগুলিকে ভাঙার চেষ্টা করা হয়। কিন্ত মূর্তিগুলি ভাঙতে না পারায় সেগুলির নিচে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সব শেষে পাহাড়ের গা বেয়ে মূর্তিগুলির মধ্যে ফুটো করে বিস্ফোরক লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং রকেট দিয়ে মূর্তিগুলির মাথার অংশ নষ্ট করে, বামিয়ান পাহাড়ের দেওয়ালের গায়ে খোদিত বিশ্বের অন্যতম সেরা শিল্পকর্ম এবং ইতিহাসকে ধুলোকণায় পরিণত করার সাফল্যে উন্মত্ত তালিবানদের উদ্বাহু নৃত্যের ছবি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে।
একবিংশ শতকের সূচনায় আদিম হিংস্র বর্বরতার এই চেহারা দেখে দেখে বিস্মিত বিশ্ববাসী।
এপারের মৌলবাদ
হিমালয়ের এপারে আর এক দেশ ভারতবর্ষ, আমাদের দেশ। হিমালয়ের নন্দাকোটের একটি শৃঙ্গের দক্ষিণ ঢাল থেকে বেয়ে উত্তরাখণ্ড পেরিয়ে উত্তর প্রদেশে বয়ে চলেছে এক প্রাচীন নদীর জলধারা – সরযূ নদী। এরই দু’পারে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন জনপদ, যা আজকের শহর অযোধ্যা। এখানেই গড়ে উঠেছিল একটি স্মৃতিসৌধ– যা বাবরি মসজিদ নামেই খ্যাত। মসজিদের গায়ে খোদাই করা শিলালিপি থেকে জানা যায় , মুঘল সম্রাট বাবরের আদেশে সেনাপতি মীর বাকী ১৫২৮–২৯ (৯৩৫ হিজরি বর্ষে) এটি তৈরি করেছিলেন – মানে ৪৯৫/৪৯৬ বছর আগে। এটাই ইতিহাস। আরও পিছিয়ে গেলে রামায়ণ মহাকাব্যে জানা যায় এই জনপদের উল্লেখ। সরযূ নদীর স্রোত এমন অনেক ইতিহাস-কাব্য-মহাকাব্যের সাক্ষী।
১৯৯২ সাল। ৬ ডিসেম্বর। বিকাল ৪.৪৯ মিনিট। সরযূ নদীর ধারে উন্মত্ত করসেবকদের ধ্বংসের উল্লাস ধ্বনি ধুলোয় ঢাকা আকাশ ছুঁয়ে হিমালয়ের ওপারে থাকা হিন্দুকুশ পর্বতে দাঁড়িয়ে থাকা বামিয়ানের বুদ্ধ মুর্তি ধ্বংসের আগাম ঘোষণা পৌঁছে দিয়েছিল।
তফাত নেই
কোনও তফাত আছে তালিবান আর এই হিন্দুত্ববাদী করসেবকদের? এরাই একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতাকে (নাকি অসভ্যতা) এগিয়ে (না কি পিছিয়ে) নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পাবে? ছেড়ে দেওয়া যায় এই সব তালিবানি-হিন্দুত্ববাদীদের হাতে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ?
২০০১ সালের ৬ই মার্চ দ্য টাইমস পত্রিকায় তালিবানি রাষ্ট্রনেতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের বক্তব্য ছাপা হয়। তিনি বলেন যে, ‘মূর্তির ধ্বংস সাধন করায় মুসলমানদের গর্বিত হওয়া উচিত, কারণ এতে আল্লাহ্ খুশি হয়েছেন’।
১৯৯২ সালের ৫ অক্টোবর নাগপুরে আরএসএস প্রতিষ্ঠা দিবসের প্রধান অতিথি ছিলেন অরুণ শৌরি। তার বক্তৃতায় সেদিন তিনি বলেন, “যারা বলে যে মসজিদ ভাঙলে ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে… নবী মোহাম্মদ নিজেই মসজিদ ভেঙেছিলেন। এটা কোরানে লেখা আছে… আল্লাহ্ কোরানে এটা অনুমোদন করেছেন। নিয়মিতভাবে মসজিদ স্থানান্তর করা হবে…”। ( দ্য ওয়ার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৭)
কি আশ্চর্য! তালিবানিরা আল্লাহ্’র নামে বুদ্ধমুর্তি ভাঙছে, হিন্দুত্ববাদীরাও সেই আল্লাহ্’র শরণ নিচ্ছে ধংসাত্মক কাজে।
৮ অক্টোবর, ১৯৯৩ সাল। সিবিআই বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে তাদের চার্জশিটে এল কে আদবানি’র বক্তৃতা উল্লেখ করেছিল। তাদের রেকর্ড করা বয়ান অনুযায়ী ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ অযোধ্যায় উপস্থিত উন্মত্ত করসেবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন – ‘করসেবার অর্থ কেবল ভজন এবং কীর্তন নয়, শ্রী রাম মন্দির নির্মাণের সাথে জড়িত এই করসেবা।‘ যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ৫০০ বছরের পুরোন এক স্মৃতিসৌধ নিমেষেই ধুলোকণায় রূপান্তরিত করা।
কি তফাত তালিবানি মোল্লা মুহাম্মাদ ওমর, শৌরি অথবা আদবানি’র? কেউ আল্লহ্’র নামে, কেউ রামের নামে ধ্বংস লীলা চালাচ্ছে। যুক্তি এদের বিচিত্র – ওরা বলছে ১৭০০ বছর আগের পাহাড় ফিরিয়ে আনো, তাই বুদ্ধের মুর্তি ভাঙো। এরা বলছে ৫০০ বছর আগে কি ছিল, সেটা ফিরিয়ে আনো। ওরা বলছে বৌদ্ধ হঠাও, এরা বলছে মুসলমান হটাও।
ধর্মের জিগির কেন?
কেউ বলেনা – বেকারি হটাও, গরিবী হটাও, ক্ষুধা হটাও। এদের কেউ বলছে– হিন্দু খতরে মে হ্যায়, কেউ বলছে ইসলাম খতরে মে হ্যায়। কেউ বলছে না– ইন্সান খতরে মে হ্যায়।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষকে বিভক্ত করার কাজ চালিয়ে আসছে বিজেপি। উদ্দেশ্য একটাই- হিন্দুত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন। হিন্দুত্ব আর হিন্দু ধর্ম এক নয় – একথা নিজেই বলেছিলেন গোলওয়ালকর। হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, আসলে ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করার একটি প্রকল্প। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে কি হিন্দু শ্রমিকের মজুরি বাড়বে? হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী সাধারণ সব মানুষের জন্য খাদ্য-বাসস্থান-কাজ-শিক্ষা- চিকিৎসার সুযোগ তৈরি হবে? হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী আদানী-আম্বানি সহ বৃহৎ পুঁজিপতিরা কি হিন্দু ধর্মাবলম্বী শ্রমিকদের শোষণ করা বন্ধ করে ভজন-পূজন করবে?
এর কোনোটাই হবে না, আরএসএস-বিজেপি হিন্দুত্ববাদীদের প্রস্তাবিত হিন্দু রাষ্ট্রে। আসলে হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষমতায় এনে, দেশের সম্পদ ও জনগণকে অবাধ লুট করার জন্যই হিন্দু রাষ্ট্রের অবতারণা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্যও ‘হিন্দুত্ববাদী মোদীজি’ পেট্রোল- ডিজেল- কেরোসিন-গ্যাস-ভোজ্য তেল সহ সব জিনিসের দাম বাড়িয়েছেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষের এতে কোনও উপকার হয়েছে? বরং এরফলে আদানী-আম্বনি সহ বৃহৎ পুঁজিপতিদেরই উপকার হয়েছে। তাই হিন্দুত্ববাদীদের কাছে আদানি-আম্বানিরাই শুধু হিন্দু, সাধারণ মানুষ নয়।
আসলে পাকিস্তান যেমন মুসলিম মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তেমনই হিন্দু মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষকে একটা দাঙ্গা-সন্ত্রাস বিধ্বস্ত দেশে পরিণত করতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি।
মোদী-দিদি’র প্রতিযোগিতা
২২ জানুয়ারি রাম মন্দির উদ্বোধন হবে। সেই লক্ষ্যে আবার ইঁট পুজোর মতো লোক ক্ষ্যাপাতে ব্রিগেডে লক্ষ মানুষ ডেকে গীতাপাঠ হবে। লক্ষ কেন কোটি কোটি হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ তো রোজই গীতা পড়েন – তাঁরা ধর্ম পালন করেন। আর বিজেপি গীতা-রাম মন্দির দেখিয়ে ’২৪-এর নির্বাচন জিততে চায়। ধর্ম পালন এদের লক্ষ্য নয়, ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে ক্ষমতা দখলে করাই এদের মূল লক্ষ্য।
মোদি এসে গীতা পাঠের নামে লোক ক্ষ্যাপাতে আসবেন শুনে, দিদিও বলছেন আমিও বা কম কিসের – হবে চণ্ডীপাঠ। উনি রামের নামে মন্দির করছেন, তাহলে আমিও জগন্নাথের মন্দির করবো। উদ্ধোধন হবে ভোটের আগেই। ভারতে মোদীজি’র জন্মের আগে কেউ কি গীতা পাঠ করেনি নাকি! না কি দিদি’র নতুন করে চণ্ডীপাঠ শেখাবেন? গীতাপাঠ বনাম চণ্ডীপাঠ, বা রাম বনাম জগন্নাথ এই লড়াই চায় নাকি কোনও ধর্মপ্রাণ হিন্দু? কখনোই চায় না।
ওরা ভোট আদায়, ক্ষমতা দখল, লুটের জন্য ধর্মকে হাতিয়ার করে। ধর্ম পালন করা এদের উদ্দেশ্য নয়। ধার্মিক মানুষ প্রার্থনা করে মন্দিরে-মসজিদে-গির্জায়-গুরুদ্বোয়ারায়, নিজের বাড়িতে। এদের গীতাপাঠ বা চণ্ডীপাঠের জন্য দিদি-মোদী’কে দরকার পড়বে কেন? হাজার হাজার বছর ধরে ধর্ম নানা ভাবে গড়ে তুলেছে মানুষ, কোনও মোদী-দিদি’কে ছাড়াই। দেশের মানুষ কি পুরোহিতগিরি করার জন্য ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী বানায়?
ইন্সান খতরে মে
কি হবে দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের? ২০২২ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূূচকে ১২১ টা দেশের মধ্যে ১০৭ নম্বর স্থানে থাকা ভারত, এই বছর আরো নেমে ১১১ নম্বর হয়েছে। পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি শিশু নষ্টের হার ভারতবর্ষেই – ১৮.৭ শতাংশ। বেকারত্বের হার স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ। আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি– উঠছে মানুষের নাভিশ্বাস। এই দেশে প্রতিদিন ১৫৪ জন কৃষক-দিনমজুর আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে দারিদ্র, ঋণভার আর খিদের যন্ত্রণা নিয়ে।
অথচ সম্পদ বেড়েই চলেছে মোদীজি’র পেয়ারের দুই ধনকুবেরের। ২০১৪ সালে মুকেশ আম্বানির সম্পদ ছিল ১.৬৫ লক্ষ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০২৩ সালে হয়েছে ৮.০৮ লক্ষ কোটি। আরএসএস’র সবচাইতে পেয়ারের ধনকুবের আদানির সম্পদ মোদিজির রাজত্বে বেড়েছে ১,২২৫%। ২০১৪ সালে ছিল ১.২০ লক্ষ কোটি, যা বেড়ে ২০২২ সালে হয়েছিল ১০.৯৪ লক্ষ কোটি টাকা। (দ্য ইকনমিক টাইমস, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২) অবশ্য হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে ওর জালিয়াতির কেরামতি কিছুটা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তা এক ধাক্কায় কমে হয়েছে ৫৭.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মানে ভারতীয় মুদ্রায় ৪.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা। ( ফোর্বস ২৯ নভেম্বর, ২০২৩)
কাজহীন বেকার, ঋণ জর্জরিত চাষি, খিদের যন্ত্রণায় পেট-পিঠ এক হয়ে দরিদ্র ভারতবাসী তোমারা ভজন-কীর্তন করো। ওরা মন্দির বানিয়ে দিয়েছে। ভগবানের কৃপা হ’লে খাবার পাবে, কাজ পাবে। ওনারা কৃপা না করলে মোদী-দিদি কি করবে! মন্দিরে চাষি-মজুর-বেকার-বাড়ির বউ বাচ্চা সবাই ভজন-কীর্তনে ব্যস্ত থাকুক। আর মোদী-দিদি আদানি-আম্বানিদের সেবা করবে। এটাই ওদের ঘোষিত নীতি।
এ দেশ তোমার-আমার
এটাই চলবে? হতে পারে না। রুখে দাঁড়াতেই হবে। এ দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। মাটির তলায় সম্পদ, মাটির উপরে সোনার ফসল। মজুরের তাল তাল ঘাম-রক্তের বিনিময়ে মাটির তলা থেকে উঠছে লোহা-কয়লা। মানুষের মেহনতে তৈরি হয়েছে রেল-রাস্তা। চাষির গায়ের ফোঁটা ফোঁটা ঘাম লেগে আছে প্রতিটা ধানের শীষে, সবজির পাতায়। মানুষের মেধা-বিদ্যা-জ্ঞানে গড়ে উঠেছে দেশের- স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। এ সব মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেবে আরএসএস-বিজেপি! তুলে দেবে নিজেদের পেটোয়া কয়েকজন ধনকুবের লুটেরাদের হাতে বিনা বাধায়? আর মানুষ ভজন-কীর্তন-ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা নিয়েই মেতে থাকবে?
না। হতে পারে না। ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ সিপাহী বিদ্রোহ ভাঙার জন্য ব্রিটিশ শাসকরা হিন্দু-মুসলমান ভাগ করতে চেয়েছিল ছলে-বলে-কৌশলে। এই দেশে ব্রিটিশ শাসকদের নীতিই ছিল ‘ডিভাইড অ্যা ন্ড রুল’। হিন্দু-মুসলমান ভারতবাসী একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুক আর ওরা এ দেশের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাবে। এ কাজে সেদিনও ওদের সাহায্যকারী ছিল আরএসএস। আজও সেই আরএসএস-কে সামনে রেখেই দেশের সম্পদ লুট করছে আদানি-আম্বানি সহ হাতে গোনা একদল ধনকুবের।
এ চলতে পারে না। মন্দির-মসজিদ-গির্জা-গুরুদ্বোয়ার যার যেখানে ইচ্ছে যাবে। যে কোথাও না গিয়ে নাস্তিক থাকতে চায় সেও এই দেশে সমান অধিকার নিয়েই থাকবে। এই হল দেশের সংবিধান। এই সংবিধানই আজ আক্রান্ত ধর্মীয়-ফ্যাসিবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে।
ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত
সংবিধান ধ্বংসের কাজ শুরু করেছিল এরা স্বাধীনতার পরেই। ১৯৪৯ সালেই রাতের অন্ধকারে বাবরি মসজিদে একটি বালক রামের মূর্তি (রাম লালা) কেউ রেখে দিয়ে যায়। পরদিন ভোর থেকেই রটানো শুরু হয় – রাম নাকি নিজেই নিজের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।স্বাধীন ভারতে সেই শুরু করা হয় পরিকল্পনা মাফিক বাবরি মসজিদ বিতর্ক। ফলে পরের দিনই শান্তি রক্ষা করার জন্য মসজিদে তালা লাগায় স্থানীয় প্রশাসন।
স্বাধীনতার পরে এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ৩টি মামলা হয়।
১) ১৯৫০ সালে রামচন্দ্র দাস এবং আরও কয়েকজন রামলালার মূর্তিটি যথাস্থানে রক্ষা করা এবং সেখানে পূজা অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়ে একটা মামলা করেন।
২) ১৯৫৯ সালে ‘নির্মোহী আখড়া’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান রাম মন্দির নির্মাণের জন্য মসজিদের পুরো সম্পত্তির দখল চেয়ে একটা মামলা করে।
৩) ১৯৬০ সালে মুসলিম ওয়াকফ বোর্ড মসজিদের সম্পত্তির সম্পূর্ণ দখল চেয়ে পৃথক একটা মামলা করে।
এর আগে অবশ্য ১৮৮৫ সালে রঘুবীর দাস নামে এক পুরোহিত রামের জন্মস্থান দাবি ক’রে বাবরি মসজিদ চত্বরের পাশে একটা অস্থায়ী ছাউনি তৈরি করে, সেখানে পূজা করার অনুমতি চেয়ে ফৈজাবাদ আদালতে একটা মামলা শুরু করে।
১৯৮৬ সালে স্থানীয় আদালত একটি অন্তর্বর্তী মামলার রায়ে হঠাৎই মসজিদ চত্বরের তালা খুলে দিতে বলে সেখানে রামলালার পুজো করার জন্য। কিন্তু এই রায়ের বিরুদ্ধে আশ্চর্যজনকভাবে তৎকালীন উত্তর প্রদেশ বা কেন্দ্রীয় সরকার কেউই উচ্চ আদালতে যায়নি। ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এই সংক্রান্ত সবকটি মামলার প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ মামলার রায় দেয়। এই রায় অনুযায়ী বাবরি মসজিদের সম্পত্তিকে ৩ ভাগে ভাগ করে দেয়- নির্মোহী আখড়া, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এবং রামলালার মধ্যে।
বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে
ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের রক্ষাকর্তা আদালত স্বাধীনতার পর প্রথম কোন রায়ে একটি পৌরাণিক চরিত্রকে সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদে একটি পক্ষ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। সেই শুরু, যার অবসান ঘটে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে। যে রায়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাকে অবৈধ বলা হয়, কিন্তু সমগ্র জমি প্রস্তাবিত রাম মন্দির তৈরি করার জন্য সরকার মারফত সংশ্লিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। আর রায়দানকারী বেঞ্চের অন্যতম, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বিজেপি’র দাক্ষিণ্যে রাজ্যসভার সাংসদ মনোনীত হয়ে যান। সেদিন রায়দান করা হয়েছিল। বিচার পায়নি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান।
ফ্যাসিবাদ আজ পূর্ণ মাত্রায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চাইছে ২০২৪-এর নির্বাচনে জিতে। রুখে দিতেই হবে। না হ’লে দেশের সংবিধান-সম্প্রীতি-ঐক্য কিছুই থাকবে না। দেশটাকে তালিবানি হিন্দুত্ববাদীদের হাত থেকে রক্ষা করতেই হবে। শেষ করতেই হবে হিন্দুত্ববাদী তালিবানিদের শাসন।