প্রভাত পট্টনায়েক
পিপলস্ ডেমোক্র্যাসি পত্রিকার ১মে, ২০২২ সংখ্যায় মূল প্রবন্ধটি ইংরেজিতে রিফ্লেকশন্স অন দ্য শ্রীলংকান ইকোনমিক ক্রাইসিস শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সেই প্রবন্ধেরই বাংলা অনুবাদ রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে প্রকাশিত হল।
শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে ইতিমধ্যেই অনেক আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক ঋণ সহ ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) বাবদ সরকারের আয় থেকে ব্যাপক ছাড় ঘোষণার ফলে ব্যাপক রাজকোষীয় ঘাটতিতে পরিস্থিতি এমনই যে দেশের অভ্যন্তরীণ খাতে ব্যায় সামলাতে অন্য দেশের কাছে হাত পাততে হয়েছে। মহামারীর প্রকোপে শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্প ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে ফলে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ে আয়ের সুযোগও কমতে থাকে। মুদ্রা বিনিময়ের হার ক্রমশ অধোগতিপ্রাপ্ত হবার কারনে দেশের বাইরে কর্মরত শ্রমিকেরা পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে সরকারি পদ্ধতি এড়িয়ে অন্যান্য উপায়ের দ্বারস্থ হন। এহেন নানবিধ কারনে দ্রুত বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারে টান পড়ে যার মোকাবিলায় শ্রীলংকার সরকার কৃষিকাজে রাসায়নিক সার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারী করলেও খাদ্যোৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেয়। এভাবেই একের পরে এক ঘটনায় বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
‘কল্যানকর রাষ্ট্র’ থেকে শ্রীলঙ্কা আজ এশিয়ার ‘রোগগ্রস্থ দেশ’ হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে, এমন পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী সেই প্রশ্নে মতভেদ থাকলেও বিপর্যয়ের দায় যে রাজাপক্ষে সরকারকেই নিতে হবে তাতে প্রায় সকলেই একমত। ঠিক কি কারনে সরকারের এই ব্যর্থতা সেই নিয়েই যাবতীয় মতপার্থক্য।
আজকের পৃথিবীতে নব পর্যায়ের ‘শীতল যুদ্ধের’ সেনানী হিসাবে মার্কিনিরা মনে করে চীনের সাথে বাড়াবাড়ি রকমের অর্থনৈতিক লেনদেনের কারনেই শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি আগামীদিনে এহেন অভিযোগ আরও শুনতে হবে। বৈদেশিক ঋণ বেড়ে চলার সময়েও শ্রীলঙ্কার সরকার ঘুমিয়ে ছিল বলে রাজাপক্ষে সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার নিন্দা জানিয়েই অন্যান্য দেশগুলি নিজেদের দায় সেরেছে। কিছু ভারতীয় পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছেন ভারতের কিছু রাজ্য সরকারও শ্রীলঙ্কা সরকারের পথেই চলছে, সংকটের পূর্বেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
এইসব যতরকম পর্যালোচনা উঠে আসছে সেগুলির প্রত্যেকটির সমস্যা একই। সকলেই শ্রীলঙ্কায় উদ্ভুত অর্থনৈতিক সংকটের ব্যখ্যায় নয়া-উদারনীতির ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। নয়া-উদারবাদের কথা তোলা মানেই কোন বস্তাপচা তত্ত্বের পুনরুল্লেখ নয়। নয়া-উদারনীতিতে তিন ধরনের সংকট দেখা দেয়। প্রচলিত অর্থে অপেক্ষাকৃত ভালো সময়েও শ্রমজীবী মানুষকে দুর্দশাগ্রস্থ হতে বাধ্য করা, সারা দুনিয়াজুড়ে কিংবা কোন একটি দেশে উদ্বৃত্ত-উৎপাদনের বৃদ্ধিজনিত কাঠামোগত সংকটের পাশাপাশি তৃতীয় আরেকধরনের সংকটও নয়া-উদারবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট। তৃতীয় সংকটের ধাক্কায় মুহূর্তের মধ্যেই একটি দেশের কপাল বদলে যায়, বিশেষ করে ক্ষুদ্র অর্থনীতি সম্বলিত দেশগুলির। একে আমরা ‘আকস্মিক’ সংকট হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি। নয়া-উদারবাদের কাঠামোগত সংকটের তুলনায় এর চরিত্র অনেকটাই আলাদা, এর আঘাতে তামাম বিশ্ব-অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয় না – নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্দিষ্ট কিছু দেশই এর প্রকোপে পড়ে। প্রত্যেকবারই আঘাতপ্রাপ্ত হলে তবেই সংকট মোকাবিলায় জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে, বর্তমানে এটা প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে। এই আলোকেই বলা চলে কিছু বছর আগে গ্রীস এমনই এক ‘আকস্মিক’ সংকটে পড়েছিল। গ্রীসের বৈদেশিক ঋণ যখন ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে তখন কারোরই মনে হয়নি সেই ঋণ পরিশোধযোগ্য থাকবে না। যখন টনক নড়ল ততদিনে ঋণ মুকুব করা ছাড়া গ্রীসের উদ্ধার পাওয়ার আর কোন পথই খোলা নেই। দুর্ঘটনাজনিত সংকটের সাথে এহেন ‘আকস্মিক’ সংকটকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। নয়া-উদারনীতির সাথে এই ‘আকস্মিক’ সংকটের যোগসূত্র যথেষ্ট নিবিড় এবং সজীব। আচমকা আঘাতের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ না হওয়া পর্যন্ত ঠিক কতটা ঋণের পরিমাণ ‘বাড়তি’ বলে গন্য হবে যার ফলে সংকট নেমে আসবে তা জানার কোন উপায় নেই। নয়া উদারনীতির সংকট যাকে আমরা ‘আকস্মিক’ বলে চিহ্নিত করছি কোনরকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই কাজ করে, যেন আচমকাই কেউ একটি স্যুইচ অন করে দিল এবং সংকট ঘোষিত হল।
আগত সংকট সম্পর্কে দুরদৃষ্ট মন্তব্য করেছিলেন বলে কেউ বিতর্ক উত্থাপন করতেই পারেন। মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের বিবিধ সীমাবদ্ধতা থাকে। ইচ্ছামত সরকারী ব্যয় কমিয়ে ফেলা যায় না, যত কমই হোক না কেন জনকল্যান এবং পেনশন ইত্যাদি খাতে অর্থবরাদ্দ বাতিল করা চলে না – সরকারী কর্মচারী, শিক্ষক-অধ্যাপক কিংবা চিকিৎসকদের বেতন আটকে রাখা যায় না। সুতরাং দুরদৃষ্টি সম্পন্ন কেউ ভবিষ্যৎবানী করলেও সরকার জরুরী অনেক কিছুই করে উঠতে পারে না।
এমন একটি অর্থনীতির প্রসঙ্গ ধরে নেওয়া যাক যে দেশে ব্যাবরাদ্দের তুলনায় আর্থিক ভান্ডার কিছুটা ভারসাম্যে রয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে সেই দেশটি ভারসাম্য বজায় রাখে মূলত বৈদেশিক ঋণের ভরসায়, অন্তত যতক্ষণ না সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। জনকল্যাণ বাবদ ব্যয়বরাদ্দে কাটছাঁট করে অথবা জনগণের উপরে বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বাজারে মন্দাবস্থার মোকাবিলায় পুনরায় শুন্য থেকে শুরু করার তুলনায় বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে ভারসাম্য বজায় রাখার পন্থাটি অবশ্যই মন্দের ভালো। পূর্বাভাষ অনুযায়ী আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যের সমস্যা যদি দ্রুত মিটে যায় তাহলে সবই ঠিক থাকে কিন্তু যদি সমস্যা কিছুদিন পরেও একই রয়ে যায় তখন পরবর্তী ঋণগ্রহনের শর্তাবলী হয়ে ওঠে আগের তুলনায় অনেক কঠিন এবং অচিরেই সেইসব শর্তাবলী এমন চেহারায় হাজির হয় যার ফলে সেই দেশটি বুঝতে পারে তারা গভীর সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিতে রাজাপক্ষে সরকারের কোন দোষ নেই একথা আমরা বলছি না। পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা অপ্রত্যক্ষ কর আদায়ে ছাড় দিয়েছিল যার ফলে ব্যাপক আকারের রাজকোষীয় ঘাটতির সম্ভাবনা তৈরি হয়, অথচ এর মোকাবিলায় প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে সেই ঘাটতি মেটানো হয় নি। স্বাভাবিকভাবেই সংকট ক্রমশ এতটাই গভীর আকার নেয়, অনেক পরে সম্পত্তি কর বাড়ানো হলেও সমস্যা সমাধানের কোন উপায় ছিল না। দেশীয় সংস্থাগুলিকে ছাড় এবং কমিশন পাইয়ে দিতে বিভিন্ন আইন পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল সেইসবের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকাও কম অপরাধ ছিল না। আমাদের বক্তব্য হল শুধুমাত্র এগুলিই শ্রীলঙ্কার সংকটের মূল কারন এমনটা নয়, নয়া-উদারবাদের ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে সেদেশের পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে সাধারণ মানুষজন রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন; নয়া-উদারনীতির প্রসঙ্গ ব্যাতিরেকে এর কারন খোঁজার কোন মানে হয় না।
কোনরকম জটিলতা ছাড়াই শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে দুটি বিষয় শিক্ষণীয়। আজকের দুনিয়ায় নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থায় জনকল্যানমুখি রাষ্ট্রের ভাবনা বেমানান, এই হল প্রথম শিক্ষা। অতীতে, তৃতীয় বিশ্বের ধারনার প্রেক্ষিতে কল্যানমুখী রাষ্ট্র হিসাবে শ্রীলঙ্কা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছিল। নয়া-উদারবাদী বন্দোবস্ত না থাকলে কোন একটি দেশ বৈদেশিক মুদ্রা বাবদ আয়ে আচমকা ঘাটতি হলেও বাইরে থেকে নতুন করে ঋণ না নিয়েও জরুরী নয় এমন সামগ্রীর আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই সংকটের মোকাবিলা করতে পারত। নয়া-উদারবাদী জমানায় সরকারের জন্য এহেন পরিস্থিতিতে কেবল দুটি পথ খোলা রয়েছে, হয় অভ্যন্তরীণ চাহিদা নিয়ন্ত্রণে আমদানি সহ যাবতীয় সরকারী ব্যয়বরাদ্দে ব্যাপক কাটছাঁট করে কল্যানমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে সরে আসা অথবা সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বজায় রেখে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি মেটাতে নতুন করে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে বাধ্য থাকা। দ্বিতীয় পথে চলার বিপদ বেশি, ঋণ পরিশোধে এতটুকু বিলম্ব হলেই পরবর্তী ঋণের শর্তাবলী হয়ে পড়বে আরও কঠিন যার ফলে দেশটি ক্রমাগত ঋণের জালে জড়িয়ে যাবে এবং এভাবেই জনকল্যানকারী রাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে উঠবে। অন্যভাবে বললে এর অর্থ হল, কোন একটি দেশ স্বাভাবিক পরিস্থিতির সুবাদে যদি কিছু সময়ের জন্য নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থার সাথে জনকল্যানমুখী নীতিসমুহকেও বজায় রাখতে সফল হয় তাহলেও অচিরেই এই দুই বন্দোবস্তের মধ্যেকার ব্যবধান বিকট চেহারায় সামনে আসতে বাধ্য।
এই কথাটুকু শুনেই অনেক অর্থনীতিবিদ বেঁকে বসতে পারেন। তারা বিশ্বাস করেন নয়া-উদারনীতিতে ‘বিনিয়োগকারীদের নিমিত্ত বন্ধুবৎসল’ পরিবেশ তৈরি হয় যার ফলে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষিত হয় এবং দেশীয় বিনিয়োগ উৎসাহিত হয়। তাদের যুক্তি এমনটা হলে মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন অর্থাৎ জিডিপি’র হার বেড়ে যাবে এবং তার জোরে রাষ্ট্র স্বচ্ছন্দে নিজের কল্যানকারী ভূমিকা পালন করতে পারবে। এহেন যুক্তিতে দুটি ফাঁক রয়ে যায়, একটি হল – যতক্ষণ না ধনীদের উপরে বাড়তি কর চাপানো হচ্ছে নয়া-উদারবাদী রাষ্ট্র জনকল্যানের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় রসদ জোটাতে পারে না অথচ বিনিয়োগের আবহাওয়া সুগম রাখার অজুহাতে রাষ্ট্র কিছুতেই বাড়তি কর চাপাতেও পারে না, ফলে জনকল্যানের পরিসরও একজায়গায় আটকে থাকে। দ্বিতীয়টি হল যা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি, যদি কোন একটি দেশ নয়া-উদারবাদী বন্দোবস্তের সাথেই পূর্বতন অর্থনৈতিক নীতিসমূহকেও বজায় রাখতে চায়, তাহলেও, কিছুদিনের মধ্যেই এমন সংকট তৈরি হয় যার ধাক্কায় তৎক্ষণাৎ কল্যানমুখী যাবতীয় সিদ্ধান্ত জলাঞ্জলি দিতে হয়।
শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে দ্বিতীয় যে শিক্ষাটি গ্রহন করতে হয় তা হল, নয়া-উদারবাদের শিকলে জড়িয়ে থাকার কারনে এই মুহূর্তে প্রতিটি দেশই এহেন ‘আকস্মিক’ সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে। শ্রীলঙ্কায় যা হয়েছে তা আগামিদিনে যেকোনো দেশেই ঘটতে পারে। সরকারী ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া কিংবা জনকল্যানমুখী নীতিসমূহকে বাতিল করে দেওয়ায় আদৌ কোন সুরাহা হবে না যেমনটা কতিপয় ভারতীয় পর্যবেক্ষক আমাদের দেশের কিছু রাজ্য সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন। যা প্রয়োজন তা হল নয়া-উদারবাদের শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা। নিশ্চিতভাবেই, এমন করা সহজ কাজ না, কিন্তু এছাড়া সংকট মোচনের অন্য কোন পথ নেই। নিজেদের দেশকে নয়া-উদারবাদের খপ্পরে ফেলে দেওয়াই শ্রীলঙ্কা সরকারের প্রকৃত অপরাধ, যদিও এধরনের সরকারগুলি অন্য কিছু করার সুযোগও খুব একটা পায় না। নয়া-উদারবাদী শাসনের সামনে আত্মসমর্পণে দেশগুলিকে বাধ্য করাতে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি কার্যত বুলডোজার চালিয়ে দেওয়ার কায়দায় সক্রিয় থাকে।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে ভাষান্তর করেছেন সৌভিক ঘোষ