Kishan in India 2024 MAH

Real Income in India: The Reality

প্রভাত পট্টনায়েক

যদি সরকার দাবি করে যে দেশে জিডিপি বৃদ্ধির হার উচ্চ, তাহলে দরিদ্রতম অংশের আয়েও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হওয়া উচিত ছিল।

বিশ্ব ব্যাংক সম্প্রতি ৬১টি দেশের জন্য GINI সূচক এর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, যেখানে কিছু ক্ষেত্রে আয় বণ্টন এবং অন্য ক্ষেত্রে ‘ভোগ ব্যয়’ বণ্টন বিবেচনা করা হয়েছে। সেই তালিকায়, ২০২২ সালে ভারতের GINI সূচক চতুর্থ সর্বনিম্ন ছিল, যার ভিত্তিতে নরেন্দ্র মোদী সরকার প্রচার করছে যে ভারত বিশ্বের চতুর্থ সর্বাধিক সমতাবাদী অর্থনীতি। 

এই দাবির অযৌক্তিকতা ও তথ্যের কারচুপি সংক্রান্ত বিষয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন গবেষক খোলসা করে বলেছেন। এ নিয়ে আরও খানিকটা কচকচি করে সময় ব্যয় করা নিষ্প্রয়োজন মনে হতে পারে। তবে, এই দাবির অসারতার বিষয়ে নয়, বরং অর্থনীতিতে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে সে সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। 

প্রথমে, এই দাবির অসারতা প্রকাশকারী কিছু যুক্তি সংক্ষেপে তুলে ধরা যাক। ৬১টি দেশ সমগ্র বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে না – এই সুস্পষ্ট যুক্তি ছাড়াও, সরকারের এই সহজসরল দাবির বিরুদ্ধে তিনটি প্রধান যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে, যার প্রতিটি সম্পূর্ণরূপে বৈধ। 

প্রথমত, আয় বণ্টনের বৈষম্য ভোগ ব্যয় বণ্টনের বৈষম্যের চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, আয়ের মাত্রায় যত ওপরে উঠা যায়, ভোগ বরাদ্দ খাতে আয়ের অনুপাত কমতে থাকে, এবং ‘সঞ্চয়’-এর খাতে বরাদ্দ অংশ বাড়তে থাকে। সুতরাং, যেকোনো দেশের জন্য ভোগ ব্যয় বণ্টন সর্বদা আয় বণ্টনের চেয়ে কম অসম। 

বিভিন্ন দেশের GINI সূচক-এর এমন ভাবে তুলনা করা হয়েছে, যেখানে কিছু দেশের জন্য আয় বণ্টন তথ্য এবং অন্য কিছু দেশের (ভারত সহ) জন্য ভোগ ব্যয় তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, এবং স্বাভাবিকভাবেই এরকম মিশ্র তথ্যের তুলনা অবৈধ। এমন মিশ্র তথ্যের ভিত্তিতে আয় বণ্টনের বৈষম্য কোথায় বেশি তা সম্পর্কে কোনো বৈধ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। 

এই প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়নি, তা হলো আয় বণ্টনের নিম্ন প্রান্তে যারা আছেন তাদের শুধুমাত্র সঞ্চয় শূন্য নেয়, বরং ঋণাত্মক সঞ্চয় রয়েছে; অর্থাৎ, লোকেরা তাদের আয়ের চেয়ে বেশি ‘ভোগ ব্যয়’ করতে বাধ্য হয় এবং সেই ব্যয় বজায় রাখতে ঋণ নেয়। বিশেষ করে জরুরি চিকিৎসার (emergency medical) জন্য প্রয়োজনীয় ভোগ ব্যয়ের ক্ষেত্রে এটি ঘটে। এটি আরও একটি কারণ যার জন্য ভোগ ব্যয়ের বৈষম্য আয়ের বৈষম্যের চেয়ে অনেক কম, ফলে মিশ্র তথ্যের ভিত্তিতে GINI ইনডেক্সের তুলনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দ্বিগুণ ভুল। 

আয় বণ্টনের নিম্ন প্রান্তে ‘ঋণাত্মক সঞ্চয়’ একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য। কেরলে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকার ২০০৬ সালে কৃষকদের আত্মহত্যা রোধে একটি কৃষি ঋণ মকুফ বিল আনার সময় দেখা গিয়েছিল যে বিপর্যস্ত কৃষকদের ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, চিকিৎসার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছিল। (অনেকে এমনকি এই যুক্তি দিয়ে বিলের বিরোধিতা করেছিলেন যে শুধুমাত্র উৎপাদন ঋণ গ্রহণকারীদেরই সহায়তা দেওয়া উচিত, ‘ভোগ ঋণ’ গ্রহণকারীদের নয়।) 

দ্বিতীয়ত, বণ্টন সংক্রান্ত যে কোনো নমুনা জরিপে, তা আয় বা ভোগ ব্যয়, যাই হোক, সর্বোচ্চ স্তরের অংশগ্রহণকারীরা অপ্রতুলভাবে উপস্থাপিত হয় (কারণ তাদের গুরুত্ব সত্ত্বেও সংখ্যায় তারা খুব কম)। গবেষকরা এই ত্রুটি সংশোধনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেন; কিন্তু জাতীয় নমুনা জরিপ দ্বারা উপস্থাপিত তথ্যে এমন কোনো সংশোধন করা হয়নি, যার ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাংক ভারতের জন্য GINI সূচক গণনা করেছে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। 

তৃতীয় আপত্তি উঠেছে GINI সূচক ব্যবহারের বিরুদ্ধে, যা সামগ্রিক বণ্টন সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, যদি শীর্ষ ১%-এর মোট আয়ের অংশ বাড়ে, কিন্তু একই সময়ে নিচের দিক থেকে পঞ্চম ডেসাইল[1]-এর আয় তৃতীয় সর্বনিম্ন ডেসাইলে স্থানান্তরিত হয়, তাহলে GINI সূচক হ্রাস দেখাতে পারে, যদিও ধনীরা আরও ধনী হয়েছে বাকি জনগণের খরচে। এমন পরিস্থিতিকে বেশিরভাগ মানুষ আয় বৈষম্য বৃদ্ধি হিসাবে বিবেচনা করবে, কিন্তু GINI সূচক আয় বৈষম্য হ্রাস দেখাবে। 

GINI সূচককে বৈষম্যের মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনার অযৌক্তিকতা একটি সাধারণ বিবেচনা থেকে স্পষ্ট হয়। যদি GINI সূচক একটি সন্তোষজনক পরিমাপ হত, এবং যদি ভারতের আয় বৈষম্য সত্যিই খুব নিম্ন স্তরে নেমে আসত, তাহলে দেশে ব্যাপক এবং ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা ও অপুষ্টির বিষয়টি ব্যাখ্যা করা কঠিন হত। 

যেহেতু সরকার দাবি করে যে দেশে জি.ডি.পি (মোট দেশজ উৎপাদন) বৃদ্ধির হার উচ্চ, সম্ভবত সমস্ত প্রধান দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ, তাহলে ভারতের বৈষম্য হ্রাসের সাথে সাথে জনসংখ্যার দরিদ্রতম অংশের আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল। 

যেহেতু খাদ্যশস্যের সরাসরি ব্যবহার (ভোগ) এবং পশু খাদ্যের মাধ্যমে খাদ্যশস্যের ব্যবহার, আয়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায় (যা ভারতেও বিভিন্ন আয়ের গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সত্য),তাহলে ভারত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ১০৭তম স্থানে থাকত না, বা ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার বৃদ্ধি পেত না, এবং পূর্বতন পরিকল্পনা কমিশন দ্বারা দারিদ্র্য নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত মানদণ্ড অনুযায়ী মাথাপিছু ক্যালোরি গ্রহণের নিচে জনসংখ্যার শতাংশ বৃদ্ধি পেত না। 

জি.ডি.পি বৃদ্ধির দাবিকে এই অবনতিশীল স্বাস্থ্য সূচকগুলির সাথে সামঞ্জস্য করার একমাত্র উপায় হলো আয় বণ্টনের অবনতি অনুমান করা; এবং যদি GINI সূচকের গতি এরকম না দেখায়, যেমন বিশ্ব ব্যাংক যুক্তি দিয়েছে, তাহলে GINI সূচক হলো ভুল পদ্ধতি। 

থমাস পিকেটি এবং অন্যান্যদের দ্বারা পরিচালিত ‘বিশ্ব বৈষম্য ডেটাবেস’-এর (World Inequality Database) পরিসংখ্যানগুলি আসলে ঠিক এই ইঙ্গিতই দেয়। তারা শীর্ষ স্তরের জাতীয় আয়ের অংশ দ্বারা পরিমাপ করা আয় বৈষম্যের প্রভূত পরিমণে বৃদ্ধি দেখায়। প্রকৃতপক্ষে, তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ সালে শীর্ষ ১%-এর জাতীয় আয়ের অংশের পরিমাণ ২৩%, যেটা গত একশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ! 

তবে, সরকারের দাবির এই সমালোচনাগুলিতে একটি অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অগ্রাহ্য করা হয়েছে। নয়া-উদারবাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সরকারি উদ্যোগের ‘বেসরকারি করণ’, যার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলি সরকারি থেকে বেসরকারি সরবরাহে স্থানান্তর অন্তর্ভুক্ত। এই স্থানান্তরের প্রক্রিয়ার,  আয় বণ্টনের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে, যা নিম্নরূপে দেখা যায়: 

যে কোনও দুটি বছর বিবেচনা করুন, যার মধ্যে আয় বণ্টন (তা যে সূচক দিয়েই পরিমাপ করা হোক না কেন) সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে, প্রাথমিক বছরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য এই আয় বিভিন্ন পণ্যে ব্যয় করা হচ্ছিল: উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীর জন্য ব্যয়বহুল বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় (যেহেতু ধনীরা লাইনে দাঁড়াতে চায় না), এবং দরিদ্রদের জন্য সস্তা সরকারি স্বাস্থ্যসেবায়। 

এখন, যদি প্রাথমিক ও চূড়ান্ত বছরের মধ্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা হ্রাস পায় এবং আরও বেশি মানুষ বাধ্য হয়ে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিতে যায়, তাহলে দুই বছরের মধ্যে প্রকৃত আয় বণ্টন আরও খারাপ হবে, এমনকি নিম্ন প্রান্তে প্রকৃত আয় হ্রাস পেতে পারে, (যদিও আয় বণ্টনের জন্য আমাদের কাছে কেবল অর্থ আয়ের তথ্য রয়েছে এবং যদি ধরে নিই সমস্ত মূল্য অপরিবর্তিত আছে)। প্রয়োজনীয় পরিষেবার বেসরকারিকরণের কারণে দরিদ্রদের প্রকৃত আয়ের অবনতি দুইভাবে প্রকাশ পেতে পারে: বেশি ব্যয়বহুল বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করার জন্য খাদ্য গ্রহণ হ্রাস; অথবা বেশি ব্যয়বহুল বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবহারের জন্য বেশি ঋণ গ্রহণ। অথবা, যেটার সম্ভাবনা বেশি, দুটির সংমিশ্রণ। তবে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, ভোগ ব্যয় বণ্টনে বৈষম্য হ্রাস দেখাবে। 

যেহেতু ধরে নেওয়া হয়েছে যে দুই তারিখের মধ্যে অর্থ আয় বণ্টন অপরিবর্তিত রয়েছে, দ্বিতীয় সময়কালে দরিদ্রদের দ্বারা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার জন্য বেশি ঋণ নেওয়া ‘ভোগ ব্যয়’ বৈষম্য হ্রাস হিসাবে প্রকাশ পাবে। 

এটাই হচ্ছে বাস্তব, অর্থাৎ ভোগ ব্যয় বৈষম্য হ্রাস, যার জন্য সরকার নিজেকে প্রশংসা করে এবং যেটা তারা আয় বৈষম্য হ্রাসের নির্দেশক হিসাবে নেয়, আসলে এর বিপরীত নির্দেশ করতে পারে, অর্থাৎ প্রকৃত আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি। 

এটি কেবল একটি তাত্ত্বিক সম্ভাবনা নয়; এটি সমসাময়িক নয়া-উদারবাদী ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব জীবনের ঘটনা। সংবাদপত্রগুলি উত্তর ভারতের কৃষকদের দিল্লিতে তাদের সন্তানদের চিকিৎসা জরুরি অবস্থায় নিয়ে আসার, সরকারি হাসপাতালের অত্যধিক ভিড়ে তাদের নম্বর আসার জন্য অপেক্ষা করতে না পেরে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হওয়ার, এবং এই হাসপাতালের বিল মেটাতে ঋণ নেওয়া বা জমি বিক্রি করার, এবং প্রায়শই তাদের সন্তানকে হারানোর পাশাপাশি জমিও হারানোর করুণ গল্পে ভরা। 

এমন একটি সরকারের জন্য বেসরকারি ‘ব্যয় বৈষম্য’ হ্রাস নিয়ে গর্ব করা, যখন বাস্তবতা হলো (এমনকি যদি এই হ্রাস সত্যিও হয়) যে এর পিছনে রয়েছে প্রয়োজনীয় পরিষেবার অত্যধিক ব্যয়ের কারণে জনগণের আরও বেশি দুর্দশা। এটা নিঃসন্দেহে অসংবেদনশীলতা ও নির্মমতার চূড়ান্ত প্রকাশ।

ভাষান্তর করেছেন অঞ্জন মুখোপাধ্যায়

ইংরেজি শিরোনাম ওয়েবডেস্কের নিজস্ব


[1] ডেসাইল (Decile) মানে হল একটি ডেটা সেটকে দশটি সমান ভাগে ভাগ করা। পরিসংখ্যান এবং ডেটা বিশ্লেষণে, ডেসাইল ব্যবহার করে ডেটা সেটের বিভিন্ন অংশকে তুলনা করা হয়। প্রতিটি ডেসাইল ডেটা সেটের ১০% অংশকে উপস্থাপন করে। 

উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের গ্রেড ডেসাইলে ভাগ করা হয়, তাহলে প্রথম ডেসাইল (প্রথম ডেসাইল) মানে হল শীর্ষ ১০% শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় ডেসাইল মানে হল পরবর্তী ১০% শিক্ষার্থী (১১-২০%), এবং এভাবে চলতে থাকে। 

সুতরাং, “ডেসাইল” শব্দটি মূলত ডেটা সেটের একটি নির্দিষ্ট অংশকে নির্দেশ করে যখন এটিকে দশটি সমান ভাগে ভাগ করা হয়। 

Spread the word

Leave a Reply