Rammohan Roy 2025 Cover

Rammohan Roy- The Life, The Legacy

আদিত্য নারায়ণ হাজরা

এপ্রিলের অগ্নিক্ষরা দুপুরে ব্রিগেড ময়দানে মেহনতি মানুষদের সমাবেশে ভিড় তখন সবে সান্দ্র হতে শুরু করেছে। সুদূর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে টিনের বাসের মধ্যে এতটা পথ উজিয়ে আসা মানুষটি ঘর্মাক্ত দেহে ব্রিগেডের পরিধির কাছে রাখা সুউচ্চ একটা মূর্তির পাদদেশে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘামটা একটু মুছে নিলেন। সামান্য একটু ছায়ায় দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিটের অবসরে মুখে দৃশ্যতই প্রশান্তির আভাস।

এ ঘটনা চলতি বছরের, ২০২৫।

জাম্পকাটে ফিরে দেখা যাক ১৮৩০, ৭ই নভেম্বর। কানপুরের এক ধনাঢ্য বণিকের মৃত্যুতে তার স্ত্রী সহমৃতা হচ্ছেন। যে ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় “Wandering of a pilgrim in search of a picturesque during four and twenty years in the east with revelations of life in the Zenana” বইয়ে। বলপ্রয়োগ পূর্বক সতীদাহের মর্মন্তুদ সত্যতাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বর্ণনা করেছেন এক ইউরোপিয়ান, তার নাম ফ্যানি পার্কস। ধণ-সম্পত্তির অধিকার বজায় রাখতে আধুনিক যুগে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বরাবর নিজের ব্যবহারিক প্রয়োগকে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করে এসেছে। এক্ষেত্রেও শাস্ত্রীয় বিধানের বর্মের আড়ালে নীতিপ্রণেতারা সতীদাহের প্রথা প্রতিপালন করে আসলে পারিবারিক সম্পত্তি কুক্ষিগত করে রাখার প্রচেষ্টাকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে সত্যমৃত স্বামীর শোকে বিহবল স্ত্রীকে রাজি করিয়ে নেওয়া হতো চিতারূঢ়া হবার জন্য। সহমৃতা হবার প্রাকমুহূর্তে আগুনের অসহনীয় উত্তাপের প্রাথমিক স্পর্শের সম্বিৎ ফিরতেই যখন তিনি প্রাণ রক্ষার্থে পলায়নে উদ্যত হতেন। তখনই দাঁত-নখ সমেত বেরিয়ে আসতো ধর্মের ও শাস্ত্রের ‘বলপ্রয়োগ’- নির্মম সেই বলপ্রয়োগে পুনরায় চিতায় নিক্ষিপ্তা হতেন সেই নারী এবং শিষ্ট সমাজ নিশ্চিত করে তবে ক্ষান্ত হতো যে সে দেহে আর প্রাণ নেই। সহমরণের ধর্ম-উল্লাসে যখন হিন্দুসমাজের মাতব্বরেরা নিমজ্জিত, রামমোহন রায় একাগ্রচিত্ত কাজ করে যাচ্ছেন এ নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধের জন্য। একদিকে মানুষকে যুক্তি ও শাস্ত্র দিয়ে বোঝানো যে কেন সতীদাহ শাস্ত্র সিদ্ধ নয়, অপরদিকে শাসক পক্ষের কাছে দরবার করা যাতে প্রশাসনিকভাবে এ প্রথা রদ করা যায়। এমন দ্বৈতপথেই রামমোহন নিরলস চেষ্টা করে গেছেন সতীদাহ রদের।

রামমোহন রায়ের বিবিধ পড়াশোনার মধ্যে অন্যতম ছিল শাস্ত্রপাঠ। কিন্তু শাস্ত্রপাঠের থেকেও অগ্রসর হয়ে বিভিন্ন ধর্মের বহুবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে মূল যে ভাবটিতে তিনি নিজে উপনীত হন এবং সমাজের বাকি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চান তা ছিল একেশ্বরবাদের ধারণা। ১৮১৫ থেকে ১৮১৭ সালের মধ্যে রামমোহন উপনিষদ অনুবাদ করলেন এবং প্রমাণ করে দেখাতে চাইলেন হিন্দুধর্মের মূলতম সুরটি একেশ্বরবাদই।  স্বভাবতই তৎকালীন হিন্দু সমাজের শীর্ষস্থানীয়রা এর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। এর একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়ালেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। বলা জরুরী এর বেশ কিছু বছর আগেই (১৮০৪-১৮০৫) মুর্শিদাবাদে থাকাকালীন রামমোহন লিখেছেন ‘তৌফত-উল-মুহাউদ্দিন’ যেখানে তিনি প্রকৃতিসিদ্ধ একেশ্বরবাদের বিষয়টির ধারণাকে স্পষ্ট করেন। তদুপরি প্রথা ও ধর্মীয় অনুশাসন কিভাবে ধর্মের সার বস্তুকে অগ্রাহ্য করে মেধাহীন, শুষ্ক কিছু আচরিতব্য রীতিতে পর্যবসিত করে তাকেও ঐ গ্রন্থে তিনি বিশ্লেষণ করেন। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তীব্র যুক্তিবাদী বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ এ গ্রন্থ পরবর্তীতে ব্রাহ্মসমাজেও আদৃত হয়।

দূরদর্শী রামমোহন বুঝেছিলেন তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় সতীদাহ রদের স্বপক্ষে জনমত সংগঠন করা শুধুমাত্র শাস্ত্র অধ্যয়নের জোরে হবে না। কথোপকথন ও যুক্তি তর্কের আদলে তিনি তিনটে পুস্তিকা রচনা করলেন। প্রথম দুটি প্রকাশ পায় ১৮১৯ সালে, প্রবর্তক ও নিবর্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় সংবাদ নামে। তৃতীয় পুস্তিকাটি প্রকাশ পায় ১৮৩০ সালে।  মৌমাছির চাকে ঢিল পড়ার মতোই ধর্মের মাতব্বররা এতে নড়েচড়ে ওঠে এবং তারই সুবাদে রামমোহনকে ব্যক্তিগত কুৎসা সহ যাবতীয় ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হতে হয়। তিনি একাগ্রচিত্তে এসমস্ত পুস্তিকার ইংরেজি অনুবাদের কাজ শেষ করেন, তার সাথেই প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রেরণের কাজটিও চালিয়ে যান।

তৎকালীন ইংরেজ প্রশাসন সতীদাহ প্রথার নির্মমতা এবং নির্মম পিতৃতান্ত্রিকতা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা সত্ত্বেও এ প্রথা নিবারণের জন্য সচেষ্ট হয়নি। এর প্রধান কারণ দেশীয় সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষের সমর্থন হারানোর আশঙ্কা। রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টা কার্যত সমাজের সেই স্তর থেকেই উঠে আসে। তিনি যখন ঐ প্রথা রদের সওয়াল করছেন তখনও প্রশাসনের উচ্চতম কক্ষ অবধি এ সওয়াল অনুরণিত হয়েছিল।

১৮৩০ সালে রামমোহনের বিলাত যাত্রার একটি মূল উদ্দেশ্যই ছিল ইংল্যান্ডে হাউস অফ কমন্সে সতীদাহ রদের স্বপক্ষে যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য পেশ করা। বিস্তৃত আলোচনা ব্যতিরেকেই বলা যায় এমন নিরলস প্রয়াস ফলদায়ী হয়, তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংক সতীদাহ আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

বিলাত যাত্রার দ্বিতীয় কারণও একটি ছিল- সংক্ষেপে বলতে গেলে তারই আরশিতে ওনার শিল্প চেতনার সংশ্লেষ দেখতে পাওয়া যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কালে তিনি লক্ষ্য করেছেন অপরিমিত শ্রমদান ছাড়া ভারতবর্ষের আর কিছুই করার ছিল না। আকাশচুম্বী মুনাফা ছাড়া বিলাতি কোম্পানির দ্বিতীয় কোন উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছিল না। এই প্রেক্ষিতে তিনি এবং পরবর্তীতে দ্বারকানাথ ঠাকুর এই মত পোষণ করলেন যে পশ্চিমী কর্ম নৈপুণ্য ও প্রযুক্তি বিদ্যার সফল প্রয়োগে এদেশের শিল্পের সঠিক প্রসার ঘটানোর কাজে একান্ত দরকার। এদেশীয় মানুষের কর্মদক্ষতা আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞানে সঞ্জাত হওয়া আবশ্যক। ভারত থেকে কাঁচামাল বিদেশে নিয়ে যাওয়ার বদলে এখানেই শিল্প স্থাপন করলে যে দেশীয় জনজাতির সামগ্রিক উন্নয়ন হবে তাও তিনি অনুধাবন করেছিলেন।

১৮৩২ সালের জুলাই মাস। রামমোহন রায় তখন লন্ডনে, সেখানকার এক পত্রিকায় এ বিষয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন। ইতিমধ্যেই ‘চরিত্রবান ও মূলধন সম্পন্ন’ ইউরোপিয়ানদের ভারতে বসবাসের অনুমতির স্বপক্ষে সওয়াল করতে তিনি শুরু করেছেন। ঐ প্রবন্ধে তিনি তার সুবিধা ও অসুবিধাগুলো জনসমক্ষে তুলে আনলে্ন। প্রধান যে সুবিধাগুলো ভারতে হতে পারে বলে উল্লেখ করেন, তার মধ্যে অন্যতম দেশীয় শিল্পে উন্নততর প্রযুক্তির ব্যবহার, কুসংস্কারের অবলোপ, উন্নততর আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রয়োগ, বসতি গড়ে তোলা ইউরোপিয়ানদের দ্বারাই ব্রিটিশ শাসকদের অন্যায়-নির্যাতনের প্রতিবাদ ইত্যাদি। এ সমস্ত উচ্চাশা মধ্যে কতটা বাস্তবসম্মত ছিল তা নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না বটে, কিন্তু সে আলোচনা তৎকালীন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটেই হওয়া উচিত, সেটাই ইতিহাসবোধ।

রামমোহন রায় কতগুলি অসুবিধার প্রসঙ্গও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাঁর প্রধান সংশয় ছিল,  জাতিগৌরবের কারণে ইউরোপীয়নরা নিজেদের মহত্তর ভাবতে শুরু করলে দেশীয়দের ওপর তার বিপরীত প্রভাব পড়তে বাধ্য। এর সমাধানার্থেই ‘চরিত্রবান’ ও ‘উচ্চশিক্ষিত’ ইউরোপীয়দের তিনি এদেশে আসতে দিতে চেয়েছিলেন। শিক্ষার আলো যে জাতিগৌরবের এবং মহত্তর বোধজনিত ঐ ভ্রান্তিকে দূর করতে পারে ওঁর সেই মূল্যায়ন আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

এত বছর পর পিছনে ফিরে তাকালে রামমোহন রায়ের বেশ কিছু ভাবনাই সমকালের বাস্তবতার নিরিখে প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। একেশ্বরবাদের প্রচার আপাতদৃষ্টিতে অসাম্প্রদায়িক হলেও তা কি সত্যিই তৎকালীন সমাজের উচ্চতম অংশের একটি বর্গ ব্যতীত বাকি বিস্তীর্ণ মানুষের কাছে পৌঁছছিল? সেই ভাষ্য কি যথার্থই সকলের জন্য সাবলীল ছিল? তাঁর শিল্প চেতনার বোধ এদেশে ইউরোপিয়ানদের আমন্ত্রণের পক্ষে থাকলেও ইউরোপিয়ানরা কি সত্যি অমন বোধ থেকে এদেশে আসতে শুরু করলেন? তীব্র ধনলিপ্সায় দেশীয় সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয়টি শুরু থেকেই লঘু হয়েছিল কী?

রামমোহন রায় এককথায় বিশাল মাপের মানুষ। তার অবদানসমুহের নিরপেক্ষ, আবেগরহিত ও যুক্তিনিষ্ঠ হবে এমটাই কাম্য। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে অন্যায় যে ন্যায়ের মানদণ্ডে স্বীকৃত হয় না, একাগ্রচিত্তে প্রায় একার সংগ্রামেও যে বিজয় সম্ভব- রামমোহন রায়ের জীবন সম্ভবত ইতিহাসের নিরিখে তারই অন্যতম স্মারক।

ফেরা যাক ২০২৫ সালের এপ্রিলে।  ঘর্মাক্ত দেহের সেই মানুষটি দৃঢ় পায়ে ব্রিগেডের মাঠের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন।

মাইকে তখন রামমোহনের জেলা হুগলিরই খেত থেকে আসা দৃপ্ত কণ্ঠ ব্রিগেড জুড়ে অনুরণিত হচ্ছে-

লড়াই করতে গেলে ভয় কিসের?

Spread the word

Leave a Reply