কুশল ভট্টাচার্য
প্রতীক্ষিত পঞ্চায়েত ভোটের ঘোষণা হয়েছে বিগত ৮ই জুন , ভোট আগামী ৮ই জুলাই।
শুরুর দিন থেকেই ২০২৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচন তীব্র বিতর্কের আবহে। সেই বিতর্ক প্রশাসনিক, রাজনৈতিক উভয়ই।
পশ্চিমবঙ্গের মত তীব্র রাজনৈতিক উত্তাপের রাজ্যে এক দফায় ভোট শেষ কবে হয়েছিল ভাবলে রীতিমত মাথা ঘামাতে হবে। সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে পার্টির স্পষ্ট দাবি ছিল পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণা হোক। বেশ কিছু টালবাহানার পর নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেই একদফায় নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়।
এক দফায় ভোট ঘোষণা সম্ভবত এই ধারণা থেকেই করা হয়েছিল যে বামেরা একেবারেই অপ্রস্তুত ফলত তাদের পক্ষে বিভিন্ন আসনে প্রার্থী দেওয়াই হয়ত অসম্ভব হবে।
কিন্তু মনোনয়নের প্রথম দিনেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়। বাঁকুড়ার রানিবাঁধ বিধানসভার অন্তর্গত পঞ্চায়েতগুলির জন্য মনোনয়ন দিতে পার্টির কমরেডরা সকাল ১০টার আগেই স্থানীয় বিডিও অফিসে উপস্থিত হন। হাস্যকর পরিস্থিতি, তখনও অবধি বিডিও অফিসেই মনোনয়নের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নাকি এসে পৌঁছয়নি। ফলে দীর্ঘ অপেক্ষার পর বিডিও’র প্রতিশ্রুতি নিয়ে কমরেডদের ফিরে যেতে হয়। সারাদিন রাজ্যজুড়ে বেশ কিছু জায়গায় একই দৃশ্য চোখে পড়ে।
মনোনয়নের প্রথম দিনই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় , বামেরা রাজ্যের সর্বত্র প্রার্থী দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ।
তারপর পরবর্তী সাত দিনের মনোনয়নে যা যা ঘটেছে সকলেই দেখেছেন। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় শাসক দলের তীব্র সন্ত্রাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সেই সন্ত্রাসকে প্রতিহত করেই মনোনয়ন জমা দেওয়া হয়েছে। আমাদের কমরেডরা শহীদ হয়েছেন উত্তর দিনাজপুরে, দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। শহীদ হয়েছেন আইএসএফ-র কর্মীরাও। প্রশাসন নেমে পড়েছে শাসক দলের নির্লজ্জ্ব দালালিতে, এমনকি তাদের কাজ অনেক ক্ষেত্রেই আনুগত্যের প্রশ্নে শাসকদলের কর্মীদের অবধি লজ্জা দেয়।
মিনাখাঁয় শাসক দলের প্রার্থী নমিনেশন দিয়েছেন বিদেশে (সৌদি আরব) থাকা অবস্থায়, হাড়োয়ায় আমাদের প্রার্থীর সই জাল করে মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়েছে। উভয়ক্ষেত্রেই মূল অভিযোগের তীর স্থানীয় বিডিও-দের দিকে। আদালতে বার বার যেতে হয়েছে, জনসাধারণ সেই লড়াইতেও আমাদের সাথেই রয়েছেন।
ঘটনার বাহুল্য এতটাই যে মূলধারার মিডিয়া মূলত দক্ষিণবঙ্গের খবর তুলে ধরতেই ব্যস্ত, তুলনায় উত্তরের খবর অনেকটাই অজানা রয়ে যাচ্ছে।
উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া ব্লকে মনোনয়নের শেষ দিন মনোনয়ন জমা দিতে গেলে শাসক দলের গুন্ডাবাহিনী বোমা, স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আমাদের মিছিলে আক্রমন চালায়। কর্মীরা আহত হন, কমরেড মনসুর আলমের মাথায় গুলি করা হয়েছিল, পাঁচদিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে শহীদ হন। চোপড়া ব্লকে ভয়ানক আক্রমন এবং পুলিশের তরফে সম্পুর্ন নিস্ক্রিয়তার কারণে একটিও নমিনেশন জমা দেওয়া যায় নি । সেই নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা চলছে।
এই ঘটনা ছাড়া মিডিয়াতে উত্তরের জেলাগুলির পরিস্থিতি সেভাবে আলোচনা হচ্ছে না। কলকাতার দিক থেকে এলে মালদার পরের জেলা উত্তর দিনাজপুর। এই জেলার ৯টি ব্লকের মধ্যে ৮টি-তেই (চোপড়া বাদে) প্রায় সম্পুর্ন নমিনেশন দেওয়া গেছে। প্রচার চলছে। এই জেলায় পরিস্থিতি বিপদমুক্ত নয়। খাতায় কলমে প্রতিদ্বন্দিতা ত্রিমুখী। এই জেলার রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ নাকি অধিকাংশই বিজেপি’র পক্ষে বলে তাদের তরফে প্রচার চলছে। তৃণমুল কংগ্রেসের সন্ত্রাস যথেষ্টই। চাকুলিয়া এবং গোয়ালপোখর ব্লক মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চল, এখানে তৃণমূল এবং বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের মধ্যেও লড়াই হচ্ছে! বিক্ষুব্ধরাই বিজেপি’র প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। করণদীঘি ব্লকে মাটি কামড়ে কমরেডরা লড়ছেন, এখানেও লড়াই ত্রিমুখী। বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস উভয়েই বিপুল টাকা খরচ করছে। রায়গঞ্জ এবং কালিয়াগঞ্জ ব্লক সহ হেমতাবাদের কিছু অংশে আমরা লড়াই করছি। ইটাহার ব্লকেও আমাদের একই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
এই জেলার মধ্যে দিয়েই চলে যেতে হয় দক্ষিণ দিনাজপুর। অপেক্ষাকৃত ছোট জেলা, আদিবাসী জনসংখ্যা যথেষ্টই। বিগত নির্বাচনগুলিতে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা লড়াই করেছেন। এবারের ফল নিয়ে জেলা নেতৃত্ব আশাবাদী। নমিনেশনের কাজ প্রায় পুরোটাই হয়েছে। সকলে একজোট হয়েই প্রচার চলছে।
উত্তর দিনাজপুর থেকে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে এলে পরবর্তী জেলা দার্জিলিং। এই জেলার সমতলে ভোট নেই। পাহাড়ে দ্বিস্তরীয় পঞ্চায়েত- তার কিছু আসনে আমাদের প্রার্থী আছে, লড়াই হবে।
দার্জিলিং জেলা পেরোলেই শুরু হয়ে যাচ্ছে ডুয়ার্স অঞ্চল। তিনটি জেলা জলপাইগুড়ি , কোচবিহার , আলিপুরদুয়ার।
জলপাইগুড়ি জেলা আরও একবার লড়াইয়ের রাস্তায় ফিরে এসেছে। পুরো জেলার এলাকা ধরলে ৭০ শতাংশ নমিনেশন হয়েছে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ত্রিমুখী হলেও লড়াই সমানে সমানে হবে। কেন্দ্রের শাসক, রাজ্যের শাসকের বিরুদ্ধে কমরেডরা চোখে চোখ রেখেই লড়ছেন। জেলার তিনটি ব্লক- ময়নাগুড়ি, ধুপগুড়ি এবং মেটেলিতে ভালো ফলের ব্যাপারে জেলা নেতৃত্ব যথেষ্ট আশাবাদী। জেলার বাকি অংশগুলিতেও ভালোরকম লড়াই হওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে। নাগরাকাটা ব্লক- চা বাগান, জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চল। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা ক্রমশ সংগঠিত হচ্ছি। জেলার সংখ্যায়লঘু অধ্যুষিত পকেটগুলিতে ভালো ফল আশা করা যাচ্ছে। এই জেলার কিছু অংশে কামতপুর পিপলস পার্টিও কিছু প্রার্থী দিয়েছে, যদিও কার্যক্ষেত্রে তারা সরাসরি বিজেপি’র সমর্থক। জেলার অধিকাংশ জায়গায় প্রচারের কাজে আমরা যথেষ্টই এগিয়ে রয়েছি।
এর পরের জেলা কুচবিহার। উত্তরের অন্যতম সন্ত্রাসদীর্ন জেলা। রাজবংশী পরিচয়ের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ। সম্ভবত উত্তরবঙ্গে বিজেপির সবচেয়ে বেশি প্রভাব এখানেই। গ্রেটার কুচবিহার নামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বেশ প্রভাব রয়েছে কুচবিহারে। সেই আন্দোলনের দুজন নেতা, একজন অনন্ত মহারাজ অপরজন বংশীবদন বর্মন। এদের মধ্যে অনন্ত মহারাজের পাল্লা কিছুটা ভারী। নানা সময়ে অবস্থান অদলবদল করে এরাই বিজেপি অথবা তৃণমূলের দিকে হেলে পড়েন।
কুচবিহারের বিভিন্ন ব্লকের মধ্যে কুচবিহার ২ এবং শিতলকুচিতে আমাদের শক্তিবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। জেলার ব্লকগুলির মধ্যে দিনহাটা এবং সিতাই দীর্ঘদিন ধরেই সন্ত্রাসের কবলে। শুটকাবাড়ি পঞ্চায়েতে কোনও নমিনেশন দেওয়া সম্ভব হয়নি। যদিও জেলার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে ফলাফল ভালো হবার সম্ভাবনা আছে।
উত্তরের শেষ জেলা আলিপুরদুয়ার। চা বাগান এলাকায় সিআইটিইউ লড়াই করেই সংগঠন পরিচালনা করে। এই জেলার অন্তর্ভুক্ত হওয়া ফালাকাটা ব্লক সুদূর অতীত থেকেই আমাদের শক্ত জায়গা। মাঝে সাময়িক দুর্বলতা সামলে এই মুহূর্তে জেলার সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন ফালাকাটাতেই। আদিবাসী মানুষের মধ্যে বিজেপি লাগাতার সংকীর্ণ ধর্মীয় প্রচার চালায়, সেই বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধেও লড়াই চলছে।
নিরন্তর বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে জনমানসের আস্থা তৈরি হয়েছে বেশ কিছুটা। রাজ্যের এই প্রান্তিক অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক দেশের নানা প্রান্তে চলে গেছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রসঙ্গে বামফ্রন্টের ইস্তাহারে পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে যথেষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নিবিড় এবং ধারাবাহিক প্রচার ভীষণ জরুরি একটা কাজ এবং নির্বাচন ছাড়াও এক স্থায়ী রাজনৈতিক প্রচারের বিষয়। উত্তর বঙ্গে এই মুহূর্তে ৭জন সাংসদই বিজেপির। অধিকাংশ বিধায়কও তাই। ভোটের মুখে লড়াই যতটা তৃণমূল এবং বিজেপি র সাথে, ঠিক ততটাই পুলিশ-প্রশাসনেরও সাথে। লড়াই কঠিন, পরিস্থিতি সার্বিকভাবে অনুকূল নয়, উল্টোদিকে টাকার যোগানও অপরিমেয়- তবু আমরা লড়াই করছি, করব। এই দুই জেলার বিভিন্ন অংশে আমাদের ভোট বাড়বে, বেশ কিছু আসনে জেতার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। প্রচারে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সাড়া পাওয়া যাচ্ছে- মহিলারা, সংখ্যালঘু মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মত। গরীব মানুষের তরফে যে লড়াকু মানসিকতার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে তাতে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট উপাদান আছে।