সূর্যকান্ত মিশ্র
এখনকার মূল চ্যালেঞ্জগুলি
২০০৭-০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে উগ্র দক্ষিণপন্থা তথা নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির উত্থান। এর সাথেই ভারতে সংঘ পরিবারের অন্যতম সদস্য বিজেপি’র বাড়বাড়ন্ত, যখন তৃনমূল নেত্রী প্রথমে এনডিএ সরকার পরে ইউপিএ সরকারের মধ্যে আনাগোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আরএসএসের সাথে সম্পর্ক রেখে চলছিলেন। আরএসএসের সাথে তার আনুষ্ঠানিক যোগসূত্র ঘটে যখন তিনি তাদের ডেরায় গিয়ে সংঘকে দেশভক্ত বলে শংসাপত্র দিয়ে আসেন।
সেই কারণেই তো গান্ধী হত্যাকারী আরএসএস ওনাকে মা দুর্গা উপাধি দেয়। ২০১১ সালের পর তৃণমূলের ছত্রছায়াতেই এই রাজ্যে আরএসএস’র শাখার সংখ্যায় বিপুল বৃদ্ধি ঘটেছে। এরই ফল হিসাবেই গরিব মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি। আর মাইক্রো লেভেল সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে বিজেপি এই বিভাজন তৈরি করায় সিদ্ধহস্ত। উদাহরণ স্বরূপ সম্প্রতিকালে কুর্মি, আদিবাসিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা যা আগে কখনও ছিল না। রামের নামে অখ্রিস্টান আদিবাসিদের সাথে খ্রিস্টান আদিবাসিদের বিভাজন তৈরি করছে তারা। এদের নিজস্ব ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি আছে, বহু ক্ষেত্রে সেই সংস্কৃতি ভারতে আর্য শাসনের আগেকার। তাদের মধ্যে সংঘ পরিবার বিভাজন তৈরি করছে। এই পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুরা যাবেন কোথায়? ওরা তো বিজেপি তে যেতে পারবেন না। যদিও মাঝে সেই চেষ্টাও করা হয়েছিল এবং হচ্ছে।
এই যে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরির চেষ্টা, সেটা আমাদের কাছে একটা খুব বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমরা সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এই বিভাজনের রাজনীতি সর্বত্র কাজ করছে না। মানুষ লড়াই এর ময়দানে যত একজোট হচ্ছেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ এগুলো গৌণ হয়ে যাচ্ছে। বিভাজনের প্রক্রিয়া, মেরুকরণের প্রক্রিয়া এগুলো তৈরি করা যায় এবং এই প্রক্রিয়া এখনও চালু থাকবে কিন্তু তা কখনো অপরাজেয় ছিল না, এখনও হবে না। তাই তৃণমূল ও বিজেপি বিরোধী সব বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে এখানে একজোট হতে হবে।
স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রশ্নে সাধারণ মানুষকে আমরা দোষ দিতে পারি না। সরকারের যদি সদিচ্ছা না থাকে, বলা ভাল তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি না থাকে সেটার উপরই নির্ভর করবে পঞ্চায়েত গঠন হবে কিনা, ভূমি সংস্কার হবে কিনা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে কিনা। প্রকৃত অর্থে আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষ হবে কিনা সেটাও সরকারের উপর নির্ভর করে। স্পষ্টতই সেই সদিচ্ছা সরকারের নেই, সম্পুর্ণ বিপরীত। এই সরকারের আমলে কোনও নির্বাচন অবাধ, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ বলা যায় না। এই সরকারের আমলে বাম আমলের যিনি নির্বাচন কমিশনার ছিলেন, তিনি লড়াই করেছিলেন। তবে তার একক লড়াই সফল হওয়া এক প্রকার অসম্ভবই ছিল। তার পরবর্তি আর একজন নির্বাচন কমিশনার এই মর্মে রাজ্যপালের কাছে পদত্যাগপত্র ও দেন যে তাঁর পক্ষে আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এখন তো আদালতকে বলতে হচ্ছে ‘না পারলে রাজ্যপালের কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে আসুন’।
এবারের নির্বাচনে বহু জায়গায় মনোনয়ন জমা দেওয়ায় প্রতিকূলতা নিয়ে আমাদের প্রতিনিধি দল গিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনে। আইনে আছে যদি কোন প্রার্থী পঞ্চায়েতে নমিনেশন দিতে না পারে তাহলে এসডিও’র কাছে গিয়ে নমিনেশন জমা দেবেন। সেকথা জানানো হলেও কোন সদুত্তর মেলেনি। একই জিনিস গতবারেও হয়েছিল। তবে সেবারে আইন খুলে দেখানোর পর অনুমতি মিলেছিল। এবার সেসবও তুলে দিয়েছে। আমাদের সরকারে থাকার সময় এমন অপ্রিতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয় নি। বরং আমরাই সংবিধান সংশোধন হওয়ার আগেই নির্বাচন কমিশনের পৃথক মর্যাদা দিয়েছিলাম।
এই নির্বাচন কমিশনের লজ্জা হওয়া উচিত। হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে লাভটা কি হলো? আমরা বলছি না কেন্দ্রীয় বাহিনি এলে সবটা সমাধান হয়ে যাবে। স্ক্রূটিনি পর্ব শেষ হয়ে গেছে এবং আমরা দেখেছি বহু জায়গায় জোর করে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালের পর থেকেই গনতন্ত্রের উপরে এই নির্লজ্জ বেপরোয়া আক্রমণ চলছে। কিন্তু মানুষ এর জবাব দেবেন। মানুষই ইতিহাস তৈরি করেন। এ কথা এখন স্পষ্ট যে মানুষ প্রতিরোধের ময়দানে আছেন এবং এ লড়াই বহুদুর পর্যন্ত যাবে। শেষ অবধি মানুষই ইতিহাস তৈরি করবেন।
পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কারের আন্দোলন আর গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনকে আলাদা করা যায় না। আধাফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের সময়ও আমরা দেখেছি পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু মানুষ গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে লড়েছে। কিন্তু শুধু রাজ্য আর কেন্দ্র নয়, গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ সরাসরি পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। সংবিধানে পঞ্চায়েত ব্যাবস্থা স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে এখন পঞ্চায়েত নির্বাচন আর ইচ্ছা নয় বাধ্যবাধকতাও বটে। গনতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণের শেষ স্তর হলো পঞ্চায়েত। কিন্তু আমরা আরও নিচে নেমে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম। সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া গ্রামগুলোকে আমরা চিহ্নিত করেছিলাম। সরকারী সমীক্ষা, কেন্দ্রীয় সমীক্ষার রিপোর্ট দেখে আমরা সেই গ্রামগুলির তালিকা তৈরি করেছিলাম। সেই হিসাবে গ্রামোন্নয়ন সমিতি তৈরি করে সরাসরি তাদের রেজিস্ট্রিকৃত সোসাইটির হাতে টাকা পৌঁছানোর ব্যাবস্থা আমরা করেছিলাম। সেই টাকা ছিল শর্ত নিরপেক্ষ। অর্থাৎ সেই গ্রামের টাকা কোন খাতে ব্যয় হবে তা গ্রামের মানুষ ঠিক করবেন। নিজেদের মধ্যে মিটিং করে নিজেদের অগ্রাধিকার বিবেচনা করে সেই টাকা খরচ করার স্বাধীনতা ছিল গ্রামের মানুষের। শুধু হিসাব দিতে হত সরকারকে, স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অডিটও হত। সে সময় অডিটের স্বছতা ছিল। অডিটে অস্বচ্ছতা ধরা পড়লে মিটিং ডেকে সরাসরি বলে দেওয়া হত কোথায় কোথায় অস্বচ্ছতা আছে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হত। প্রশ্ন হল এখন সেটা করা যাবে না কেন? কারন সরকার চায় না। এই সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনই চায় না। তাই গণসংগ্রামের বিকল্প নেই।
এরকম পরিবেশে যেটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, সেটা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। কারণ এটা নিছক পুঁজিবাদ নয়, এটা নিছক উদারনীতিরও যুগ নয়, বা সাম্রাজ্যবাদেরও স্তর নয়, এটা এখন লুঠেরা পুঁজির সময়। যেখানে কোন উৎপাদন হচ্ছে না, শুধু লুঠ হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগ বা কর্পোরেশনে নিয়োগে দুর্নীতির ফলে যে টাকার পাহাড় আমরা দেখছি, আদানির শেয়ার দুর্নীতি অথবা রাফালে কেলেঙ্কারি, এ সবই লুঠেরা পুঁজির উদাহরণ। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার দুজনের কাউকেই বাদ দেওয়া যাবে না। এখানে কেবল টাকার থেকে টাকা হচ্ছে, কোন উৎপাদন, কর্মসংস্থান নেই। এই অর্থনীতির মধ্যে উন্নয়নের কাজ একটা বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ। আবার এটা যেমন একটা নতুন চ্যালেঞ্জ তার মধ্যে নতুন সম্ভবনাও থাকছে। বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষমতা মানুষ দিইয়েছিলেন সরকারকে, সেই ক্ষমতা দিয়ে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা আমাদের করতে হবে। আগে মানুষের সদিচ্ছা ছিল, মানুষ বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে ছিলেন, সেই মত জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের সদিচ্ছায় গড়ে ওঠে জনগণের পঞ্চায়েত।
কিন্তু এখন একটা সরকার চলছে যে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, তার বিরুদ্ধে লড়াই করা, এটা একেবারেই একটা নতুন পর্ব। এখানে আবার একটা বিরাট সম্ভাবনাও রয়েছে যে মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। ইতিহাসের একটা বাঁকে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি, একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছি, আমাদের বিশ্বাস আমরা এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারবো। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কোভিড এর সময় রেড ভলেন্টিয়ার বা অন্যান্য স্বেচ্ছামূলক কাজে মানুষ যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, তা দৃষ্টান্তমূলক। বুঝতে হবে মানুষের একটা সাংগঠনিক ক্ষমতা আছে, সেই জন্যই মানুষ ইতিহাস তৈরি করায় বড় ভূমিকা পালন করেন।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও কৃষকদের সংগঠিত ক্ষমতা ছাড়া কেবল ওপর থেকে সরকারের সদিচ্ছার জোরে বেনামী জমি উদ্ধার, গরীব কৃষকদের মধ্যে সেই জমির বণ্টন, অপারেশন বর্গা সফল হতো না। সাক্ষরতা আন্দোলন, বনসৃজন, সমবায় আন্দোলন, স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলা এসবই শুধু সরকারের সদিচ্ছায় হত না। ১২ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠী যার সদস্য সংখ্যা ১.২০ কোটি। এর ৯০ শতাংশেরও বেশি ছিলেন মহিলারা। তাদের নিজেদের সঞ্চয় থেকে ২০০০ কোটি টাকা জড় হয়, তার সাথে বামফ্রন্ট সরকার ৮৫০০ কোটি টাকা যুক্ত করে। ব্যাংকের ঋণকে যদি তার সাথে ধরা হয় তবে একটা বিরাট কর্মকাণ্ড। ঋণের সুদ ছিল ১১ শতাংশ, যার মধ্যে বামফ্রন্ট সরকার বহন করত ৭ শতাংশ এবং বাকি ৪ শতাংশের দায় ছিল স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির উপরে। আজকের পরিস্থিতি কেমন? এরা কয়েকটি ব্লকে নিজেদের ব্যাংক তৈরি করে ফেলেছেন। এখন সেগুলি মাইক্রো ফিনান্স’র কায়দায় পরিচালিত হচ্ছে, ফলে চড়া সুদ শোধ করতে না পারলে বাউন্সারদের কবলে পড়তে হচ্ছে। এগুলিকে পুনর্গঠন করে, সমবায় আন্দোলনকে জোরদার করে একটা উন্নততর বিকল্প গড়ে তোলা যাবে না কেন? দুর্নীতি দূর করেম লুটের টাকা উদ্ধার করে উন্নয়নের প্রকৃত জোয়ার আনা কি অসম্ভব? বর্গাদার, পাট্টাদারদের জমি জবরদখলমুক্ত করে কৃষকের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া কি এমন অসাধ্য কাজ? এই সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়, মোকাবিলা করা যাবে।
এই চ্যালেঞ্জের সামনেও মানুষ একটা নতুন পথ দেখাতে পারবে, যেটা সরকার নির্ভর হবে না, সরকারের সদিচ্ছার উপরে শুধু নির্ভর করবে না, যেটা স্বনির্ভর বিকেন্দ্রীভূত গণতন্ত্র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হবে, পরিচালিত হবে। বলা যায় একটা স্বনির্ভর গ্রাম, স্বনির্ভর শহর, এমনকি স্বনির্ভর একটি পাড়ার উপর ভিত্তি করে রাজ্য, দেশ বদলাবার লড়াই শুরু হবে। পথে নামলে অনেক নতুন পথের সন্ধান মিলবে, ‘পথে এবার নামো সাথী….’।