সম্বুদ্ধ নাথ রক্ষিত
জীব বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধাপেই পড়ানো হয় সোজা হয়ে দাঁড়ানো প্রাণী এবং সরীসৃপের একটি বিশেষ পার্থক্য থাকে। মেরুদণ্ডই হল সেই ফারাক যা হাড়-মেদ সহ একান্ত প্রয়োজনীয় কিংবা আপাতরূপে অপ্রয়োজনীয় সবকিছু ভার বহন করেও শরীরটাকে ঋজু রেখে সামনে চলতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। এর মজবুতিতে অন্যথা হলেই যে সবসমেত ‘পপাত চ’ হতে যে দেরি হবে না সেটুকু ছোট বড় সকলেরই জানা। এই মুখপাতটুকুর প্রয়োজন হল এই জন্য যে ছোট কিংবা ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্র নাকি আমাদের দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, এসব কথা টিভির সামনে কর্তাব্যক্তিরা বলে যান। ছোট করে এর কেজো নাম এমএসএমই(MSME)। কতটা যুক্তিযুক্ত এই অভিধা? দেখে নেওয়া যাক অর্থনীতির কতটা ভার বহন করছে এই শিল্পক্ষেত্র।
পরিসংখ্যান বলছে দেশে মোট যত কর্মসংস্থান হয় তাতে কৃষির পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম অবদান ছোট-মাঝারি উদ্যোগের। মোট জাতীয় উৎপাদনের ৩০ শতাংশের অংশীদার এই ক্ষেত্র। শিল্প ক্ষেত্রে মোট যত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় তার ৪৫ শতাংশ তৈরী হয় এমএসএমই’তে। ৬০০০ এর বেশি বিভিন্ন সামগ্রীর বানিজ্যিক উৎপাদনে পারদর্শী, তা যে কেবল আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে থেমে থাকে এমন নয়, দেশের মোট বৈদেশিক বানিজ্যের প্রায় ৫০ শতাংশের চাহিদা পূরণ করে এই ক্ষেত্র। সুতরাং জাতীয় অর্থনীতির বড় একটা ভার বহন করে আছে এই অসংগঠিত শিল্পক্ষেত্র তা বলাই বাহুল্য।
সভ্যতার পিলসুজ মাথায় নিয়ে চতুর্দিক আলোকিত করে রেখেছে যারা তাদের ঘরেই অন্ধকার সবচেয়ে বেশি থাকবে এটাই ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। তাই অর্থনীতির চালিকা শক্তি বজায় রাখতে যাদের উল্লেখযোগ্য অবদান তাদের উৎসাহিত করতে বরাদ্দ শুধু মেরুদণ্ডের শিরোপা। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আরো এক ধাপ এগিয়ে ডাক দিয়েছে আত্মনির্ভর ভারত গড়ার। প্রয়োজন ছিল সরকারি সহায়তার যাতে অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এমন একটা পরিকাঠামো যা উদ্যোপতিকে কারখানার চৌহদ্দির মধ্যে কাঁচামালের যোগান এনে দেবে। কারখানায় তৈরি পন্যের বাজার থাকবে এমন দূরত্বে যাতে সহজেই সরবরাহের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।
কেন এত সব সরকারি সাহায্যের প্রয়োজন? কারন উদ্যোগপতির অধিকাংশ সময় খরচ হয়ে যায় উৎপাদন সচল রাখার বন্দোবস্ত বজায় রাখতে। পরিবর্তে এই ম্যনুফাকচারিং শিল্পে তৈরী সামগ্রি বৃহৎ বুনিয়াদি শিল্পে ব্যবহৃত হয় সস্তা দামে। ঐ বড় শিল্পের উৎপাদন খরচে লাগাম পড়ানো গেলে উৎপাদিত পন্য ও পরিসেবা কম খরচে যোগান দেওয়া যাবে আপামর দেশবাসীকে। জনসাধারণের দৈনন্দিন খরচ কমলে হাতে যা উদ্বৃত্ত থাকবে তা খরচ হবে ভোগ্যপণ্য কেনায়, অথবা আর্থিক সংস্থায় যেমন ইনস্যুরেন্স এবং ব্যাঙ্ক ইত্যাদি। সেই টাকাই সরকার হাতে এলে তা খরচ হবে নতুন নতুন পরিকাঠামো তৈরীতে। সেটাই চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে পৌছবে শিল্পসংস্থার কাছে। যত দ্রুত বেশিবার এই চক্রাকার আবর্তন সম্ভব হবে তত বেশি আর্থিক সমৃদ্ধি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হবে।
এমন শিল্পের সাথে যুক্ত কোন উদ্যোগপতিকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তার আসল সমস্যা কি? উত্তর হবে টাকার অভাব। কেন এমন পরিস্থিতি! সত্যিই কি টাকার অভাব আছে? সরকারি খরচের দিকে তাকিয়ে দেখলে অভিজ্ঞতা ঠিক উল্টো। একটা আস্ত সংসদ ভবন থাকতেও আর একটা সংসদ ভবন তৈরি হল বিপুল খরচ করে, অযোধ্যার মন্দির তৈরী হল, নেতা মন্ত্রীদের জন্য বিলাসবহুল এরোপ্লেনও থাকছে। এবার রাজ্যের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সরকারি তহবিল থেকে খরচ কোথায় হচ্ছে? পুজোর নাম করে ক্লাবগুলিতে টাকা দেওয়া হচ্ছে। সরকারি খরচে মন্দির নির্মাণের কথা তো ঘোষণাই করা হয়েছে। অথচ একটা আধুনিক শিল্পনগরী তৈরীর কাজ হয় না। সুতরাং টাকা নেই এমন নয়, কিন্তূ অর্থনীতির ভার যার বা যাদের উপর চাপানো আছে তার বা তাদের প্রকৃত প্রয়োজনে খরচের বন্দোবস্ত নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কখনো মন্দির, কখনো পুজোর প্যান্ডেল ইত্যাদি উদ্বোধন করলেও নতুন কিংবা নতুন করে মাথা তোলা পুরানো কারখানার ফিতেটুকুও কাটছেন এমন ছবি কোথাও নেই।
দেশবাসীর সামনে প্রচার করা হচ্ছে দুই কায়দায়। এক সরকারি ক্ষেত্রে কর্মচারীরা কাজ করে না, দুই কাজ যেটুকু যা হয় সবই নাকি লোকসান। তাই সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা চালানো সরকারের কাছে অলাভজনক। অথচ ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন না কি একটা ফান্ড (আসলে সরকারী সম্পত্তি জলের দরে বেসরকারি হাতে বেচে দেওয়ার ফন্দি) করে তার সবকটাই লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্হা। এমন ভাবার কোন কারণ নেই যে টাটা বিড়লা আম্বানি আদানিরা এই সব সংস্হা কিনতে আসছে শুধুই দেশপ্রেমের কারনে, সরকারের হাতে বাড়তি অর্থের যোগান তুলে দেওয়ার স্বার্থে। এমন কথা শুনলে ঘোড়াও হাসবে। এয়ার ইন্ডিয়ার মালিকানা গ্রহনের সময় সরকার যতক্ষন পর্যন্ত এর ক্ষতির দায়ভার নেয়নি ততক্ষন পর্যন্ত টাটারা কিনতে টালবাহানা জারি রেখেছিল। সুতরাং সিস্টেমের নামে যা চলছে তা হল লাভের বেসরকারীকরন এবং ক্ষতির জাতীয়করণ। রাষ্ট্র সেই দাবীকে মান্যতা দিয়েছে। ফলস্বরূপ মুষ্টিমেয় ব্যক্তিমালিকের কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে সম্পদের পাহাড়। করোনা পরবর্তী ভারতে এর গতি ক্রমশ লাগামছাড়া হয়েছে। আম্বানির প্রতি মিনিটের আয় হাজার হাজার শ্রমিকদের সারা জীবনের আয়কে ছাপিয়ে গেছে। বিশ্বের তাবড় ধনকুবের এর তালিকায় নাম উঠেছে আম্বানি–আদানি’দের। আম্বানি-আদানি’দের বিকাশ আর দেশবাসীর বিকাশ কখনই সমার্থক নয়, হতে পারে না।
সরকার বলছে দেশ নাকি ছুটছে অথচ শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ছে না, বৈদেশিক বানিজ্যের আধোগতি অব্যাহত আছে, কাজের সুযোগ কমছে, বেকারি সমস্যা সর্বত্র এবং এখনও অবধি সর্বোচ্চ। ডেমোগ্রাফির বিচারে সবচেয়ে কমবয়সী মানুষের দেশ হওয়া সত্বেও সমানুপাতিক উৎপাদনশীলতার ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট নিতে ব্যর্থ দেশের সরকার। দেশের মেধাবি মানবসম্পদকে মজুত শ্রমিকবাহিনীতে পরিণত করে খোলা বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যে বাজারে নামমাত্র মূল্যে শ্রম বিক্রি হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে বাজার স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভব্যঙ্ক পর পর কয়েকটা কোয়ার্টার যাবত রেপো রেট অপরিবর্তিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। ডলারের নিরিখে টাকার দাম রোজ পড়ছে। ভারতের মত দেশ যেখানে জ্বালানি তেলের অধিকাংশই আমদানি নির্ভর তাতে এর প্রভাব পড়ছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করা অবশ্য ভারতবাসীর কাছে বিলাসিতা। কারণ বিশ্ববাজারে যখন তেলের দামে অধগতি অব্যাহত ছিল সেদিনও ভারতবাসীর কাছে পেট্রল-ডিজেল এবং রান্নার গ্যাস ছিল মহার্ঘ্য। এখন ভারত সরকার রাশিয়া থেকে রুবলের বিনিময়ে তেল আমদানি করছে তাই আমদানি খরচ কমেছে। সেই তেল রিলায়েন্স এসারের শোধনাগারে পরিশোধিত ব্যবহার যোগ্য পেট্রল, ডিজেল, ন্যাপথা হয়ে রপ্তানি হয়ে যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার বাজারে। বিপুল মুনাফা আয় করছে তৈল শোধনাগারগুলি। দেশবাসীর জন্য পেট্রল, ডিজেল রান্নার গ্যাসের দাম তিন সংখ্যা ছাড়িয়ে চার সংখ্যার ঘরে। এই সমস্ত ঘটনা বিগত দশকে প্রতিটা ভারতবাসীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আছে। এক কথায় বলতে গেলে অর্থনীতির চক্রাকার আবর্তন গতি হারিয়ে স্থবির হয়ে আসছে। এর জন্য দায়ী সরকারি ভ্রান্ত নীতি। এখন নির্বাচনের মুখে বিভিন্ন রাজ্যের জন্য ঘোষনা হচ্ছে লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প। যারা রেডিও আকাশবাণী খবর শোনেন তাদের অভিজ্ঞতা এর সাথে মিলে যাবে। পাঁচ ট্রিলিয়ন ইকোনমির ঘোষনা এবার শোনা যাচ্ছে না, এবারের স্লোগান ‘মোদি কি গ্যারান্টি’। মোদির গ্যারান্টি যে আসলে জুমলা তা মিলিয়ে নিতে আপনার ব্যঙ্ক একাউন্টের পাসবই খুলে দেখুন, পনেরো লাখের জায়গায় ১৫ পয়সাও আসেনি, উল্টে গ্যাসের সাবসিডি আসা বন্ধ হয়েছে। আপনি মাসে একাধিকবার এটিমের মাধ্যমে টাকা তুলেছেন, তার জন্য বাড়তি খরচ আমানত থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে। পাঁচ কোটি চাকরি প্রাপকের তালিকায় আপনার ঘরের ছেলেমেয়ের নাম ওঠেনি বরং বৃদ্ধ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তানটিও নামমাত্র বেতনে মজুরের কাজে বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিদিনের খবরের কাগজে আসছে নিরাপত্তাবিহীন কাজের পরিবেশে কেউ না কেউ দূর্ঘনায় আক্রান্ত হয়ে কফিনবন্দি হয়ে ফিরে আসছে। গরীব মানুষ নিজেদের জীবন দিয়ে দেশের বাজারে চলতে থাকা অর্থনৈতিক মন্দার মূল্য চোকাচ্ছে।
করোনার সময় দেশের মানুষকে ঘরবন্দি হতে বাধ্য করে বলা হল ভারতকে আত্মনির্ভর হতে হবে। রেললাইনে পড়ে থাকা রক্তমাখা হাওয়াই চটি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রুটির টুকরোর ছবি কি দেশের মানুষ দেখেনি? এসবই কি আত্মনির্ভরতার প্রমাণ ছিল নাকি অন্য কিছু? সহনাগরিক পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর কোনও ব্যবস্থা সেদিন সরকার করেনি। দেশজুড়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলি যখন পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর জন্য বিশেষ ট্রেনের দাবী জানাল তখন খরচ বহনের দায় আসলে কার তা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য কাজিয়ায় ব্যস্ত রইল। সেই ট্রেনকে করোনা এক্সপ্রেস বলেও ডাকা হল। কেন্দ্র রাজ্য দুই সরকারের শ্রম দপ্তরের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদের যথাযথ একটি তালিকাও সেদিন পাওয়া যায় নি। এ বিষয়ে সিআইটিইউ সরকারকে যে ডেটা সরবরাহ করে তাতেই প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেওয়া গেছিল। আত্মনির্ভরতা নয়, কার্যক্ষেত্রে সরকার যা ছিল তা আত্মকেন্দ্রিক বা সহজ কথায় স্বার্থপরের ন্যায় আচরণকারী। আত্মনির্ভরতার নিদর্শন দেখিয়েছিল বামপন্থী ছাত্র যুব সংগঠনের নেতৃত্বে কাজ করা রেড ভলান্টিয়ার্স এবং শ্রমজীবী ক্যান্টিনগুলো। মানবিকতার নতুন নিদর্শন রেখে চলেছে তো ওরাই। স্লোগান উঠল “কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না”। কবির ভাষায় “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”। সামনে এগিয়ে চলার পবিত্রমন্ত্র।
করোনা কালে লকডাউনের সময়ে যখন আপত্কালীন পরিষেবা বাদে জাতীয় উৎপাদন শূন্য, আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পের অধীনে ১৩ই মে ২০২০ নতুন করে নির্ধারিত হল কাকে বলে এমএসএমই। ১কোটি টাকার মূলধন বিনিয়োগ এবং বার্ষিক আয় ৫ কোটি টাকা’কে ক্ষুদ্র শিল্পের ভিত্তি ধরা হল। ছোট শিল্পের ক্ষেত্রে ১০ কোটি টাকার মূলধনী বিনিয়োগ ও ৫০ কোটি টাকার বার্ষিক আয় এবং মাঝারি ক্ষেত্রে যথাক্রমে ২০ কোটি ও ১০০ কোটি। ১লা জুন, ২০২০ মাঝারি শিল্পের ভিত্তিমূল্য আরও একবার পরিবর্তন করে করা হল যথাক্রমে ৫০ কোটি ও ২৫০ কোটি। এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক কি জানিয়েছিল? এমন সিদ্ধান্তের ফলে নাকি এমএসএমই বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরো শক্তিশালী হবে এবং এই ভিত্তিমূল্য থেকে রপ্তানির অংশটুকু এই কারণেই বাদ রাখা হচ্ছে যাতে কোনও সংস্থার এমএসএমই স্টেটাস হারানোর ভীতি দুর করা যায়। ফলত ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের সারণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল মাঝারি ও বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা। কারন কোভিডের অনেক আগে থেকেই শিল্পে অধোগতি অব্যাহত ছিল। এর পরবর্তীতে কেন্দ্র যে সহজ শর্তে কোভিড ঋন ঘোষনা করে তার আর্থিক নির্নায়ক মাত্রা (ফিনান্সিয়াল ক্রাইটেরিয়া) অনুযায়ী বেশিরভাগই পায় বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা। ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প ইতিমধ্যে আর্থিক মন্দা, নোটবন্দি, জিএসটির ধাক্কা নিতে নেতে রুগ্ণ হয়েছিল, কোভিড সময়ের বাড়তি চাপ তাকে অস্তিত্ব সংকটে নিয়ে গেল। তিন বছর পার করে যে কটি সংস্থা এখনো সচল আছে তারা ঋণের ভারে জর্জরিত। ঋনফেরতের স্থগিত সময় (মোরাটোরিয়াম) অতিক্রান্ত হয়ে মাসিক কিস্তি শুরু হয়েছে। আত্মনির্ভরতার আড়ালে কুবেরের ধনভান্ডারে তুলে দেওয়া হল গরিবের জন্য গচ্ছিত টাকা। সেই টাকা উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত না হয়ে ইতিমধ্যে ফুলে ওঠা আঙুলের মতো ব্যক্তিপুঁজিকে কলাগাছের মতো বেঢপ করে তুলল। টাকা সেদিনও ছিল, সেই টাকা ঋনের বোঝা হয়ে না এসে যদি সরাসরি উৎপাদনে ব্যবহৃত হত, অভাবী অংশের হাতে যেত, তাহলে তা আবার বাজারে ফিরে এসে বাজারকে চাঙ্গা করতে পারত। আজকের ভারতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা মুষ্টিমেয় কিছু ধান্দাবাজ পুঁজিপতির কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছে। তারই ফলস্বরূপ সামাজিক ন্যায় সমস্ত ক্ষেত্রে বিঘ্নিত, রাজনৈতিক দুষ্টবৃত্তি ক্রমবর্ধমান।
এই পরিস্থিতিকে পালটে দিতে হবে। আর এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব কেবলমাত্র বিজ্ঞানসম্মত ও মানবিক নীতি প্রণয়নের মাধ্যমেই। ছাপান্ন ইঞ্চির গ্যারান্টি কিংবা মিডিয়ার কল্যাণে বাঘিনী বলে পাওয়া উপাধির রাফ্ এন্ড টাফ্ চলনবলন কোনটাই এই সংকটের দাওয়াই দিতে পারে নি। লোকসভার নির্বাচন আসন্ন তাই আপনার, আমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার জন্য অনেকেই প্রস্তুত হচ্ছে। আসুন, একটু ভেবে দেখি, আর কিছু না হোক এখনও ঘাড়ের উপরে থাকা মাথাটা আপনারই রয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতেও দেখা গেছে ভোট কাটাকাটির রাজনীতির মোড় যদি একবার জনসাধারণের জীবনযন্ত্রণার প্রকৃত ইস্যুর দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় তাহলেই মানুষের জয় কোনও অলীক ভাবনা নয়। বিকল্পনীতি নিয়ে দেশবাসীর স্বার্থে কাজ করবে এটুকু সবাই চায়। তখনই রচিত হয় ইতিহাস। তবে ইতিহাস যেমন মানুষ গড়ে, তেমনি এও মনে রাখতে হয় ওটা নিজে নিজে হয় না। নিজেদেরই করতে হয়।
লেখক মেক্যানিক্যাল সায়েন্সের কৃতি ছাত্র, নিজেই একটি এমএসএমই ইউনিট চালান