৫ জুলাই ২০২৩ (সোমবার)
দ্বিতীয় পর্ব
এই বিজ্ঞপ্তি আসলে ধ্বংসাত্মক?
কারণ :
Post Facto Clearance: খসড়াটিতে বলা হয়েছে যে প্রকল্প, কার্যক্রম চলাকালীন পোস্ট ফ্যাক্টো ছাড়পত্র পেতে পারে; অর্থাৎ প্রকল্পগুলি একটি প্রতিকারমূলক পরিকল্পনা জমা দিয়ে এবং ক্ষতিপূরণ ফি জমা দিয়ে পরিবেশ সুরক্ষা আইন ১৯৮৬ লঙ্ঘনকারী ছাড়পত্রও চাইতে পারে। (তবে সুপ্রিম কোর্টের ১ লা এপ্রিলের আদেশে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে এই জাতীয় ছাড়পত্র পরিবেশ আইনের পরিপন্থী)
এটি পাবলিক ট্রাস্ট অনুসারে পরিবেশ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের সাংবিধানিক আদেশের পরিপন্থীও বটে। এছাড়াও EIA রিও ঘোষণাপত্র ১৯৯২ এবং প্যারিস চুক্তি ২০১৫ সহ আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলিতে নির্ধারিত সিদ্ধান্তগুলি লঙ্ঘন করেছে। প্রস্তাবিত বিজ্ঞপ্তি টি সম্পূর্ণরূপে নীতিবিরোধী কারণ এটি পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিদ্যমান পরিবেশ আইনকে অত্যন্ত দুর্বল করে দিয়েছে।
এই বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে পিটিশন দায়েরের সময়ও খুব অল্পই ছিল।
সমস্ত পরিবর্তন এতে যা করা হয়েছে সেগুলি দেশের বিদ্যমান বনাঞ্চল, বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের পরিবেশগত গুরুত্বকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেছে! তাই সারা দেশজুড়ে এই EIA বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠছে। “সভ্যের বর্বর লোভের”
আরো অসংখ্য উদাহরণ আছে। হিমালয় অঞ্চলে কোনো রকম সতর্কীকরণ না মেনে গড়ে উঠছে একের পর এক হাইডেল পাওয়ার প্রকল্প, পর্যটন, সৌন্দর্য্যবর্ধনের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে বস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বা Ecological Balance। পশ্চিমবঙ্গের Royal Bengal Tiger এর মতই হিমালয় অঞ্চলের একের পর বিরল প্রজাতির পশু/পাখি IUCN এর Red Data List ‘এ নাম তুলেছে।
বিগত ৫০বছরে রাজস্থান আরাবল্লি পার্বত্য অঞ্চলের ১২০টি পর্বতের মধ্যে ৩১টি উধাও হয়ে গেছে! বা সহজ ভাষায় বললে বিক্রি হয়ে গেছে।
ভারতের শাসক দলের এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই ভারত হারিয়েছে তার ৯০% Biodiversity বা জীববৈচিত্র্য Hotspot, হারিয়েছে ২১টি বন্য প্রজাতি, আর আরো দুশ্চিন্তার যে, ভারত সরকার কোন সঠিক পরিসংখ্যানই দিতে পারছে না। শুধু বনাঞ্চল সংরক্ষণেই নয়, পরিবেশগত স্বাস্থ্য, জলবায়ু, বায়ু দূষণ, স্যানিটেশন ও পানীয় জল, বাস্তুতন্ত্র পরিষেবা, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি বিভিন্ন সূচকেও ডাহা ফেল করেছে ভারত সরকার, যার ফল স্বরূপ Environmental Performance Index এ ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৮! লিস্ট এখানেই শেষ নয়, United Nations এর ১৯৩ জন সদস্য ২০৩০এর Agenda’র অংশ হিসাবে ১৭টি ‘ Sustainable Development Goal’ পূরণ করার যে লক্ষ্য নিয়েছিল, তাতেও ভারত পিছিয়েছে দুই স্থান অর্থাৎ, ২০২০ তে ছিল ১১৫, এখন ১১৭’এ এবং এটি ধার্য্য হয় ক্ষুধা সূচক, খাদ্য সুরক্ষা, লিঙ্গ সমতা, পরিবেশের উন্নতি, শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে এতেও কতোটা ‘আচ্ছে দিন’ এনেছে সরকার!
সবুজায়নের নামে ‘কার্বন ভান্ডার’ নির্মাণের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা আরো বিপজ্জনক। একদিকে যেমন ecological balance বিঘ্নিত হবে, পাশাপাশি অরণ্যবাসীরা অরণ্যের সাধারণ অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। অরণ্য সম্পদের বাণিজ্যিকীকরনের রাস্তা আরো মসৃণ করতে ও কর্পোরেটের অনুপ্রবেশ সুনিশ্চিত করতে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের উপদেষ্টা কমিটি অর্থাৎ FAC (Forest Advisory Committee) সিদ্ধান্ত নিয়েছে; GREEN CREDIT SCHEME এর, যার মাধ্যমে অরণ্যকেও অন্য যে কোন পণ্যের মতো সরকার চাইলে বেসরকারি সংস্থা কে বিক্রি করতে পারে। আদিবাসীদের নিজেদের জল জঙ্গল জমির ওপর কার্যত আর কোন অধিকার ই থাকবে না।
আসলে সারা পৃথিবী জুড়েই ফ্যাসিস্টদের চেহারা একরকম! সে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ই হোন কিংবা ব্রাজিলের বোলসনারো!
এই মুনাফালোভী পুঁজিপতিদের একটাই লক্ষ্য। বিশ্বপুঁজির দরবারে এক নম্বরে থাকা, তার জন্য পরিবেশকেও নি:শেষ করে দিতে তাদের যায় আসেনা। তেল, ফসিল ফুয়েল, খনিজ পদার্থের একচ্ছত্র অধিকার পেতে আমেরিকা চালায় মধ্যপ্রাচ্যে এয়ার স্ট্রাইক। পারমাণবিক বোমা বানানোর জন্য তুলে আনে খনিজ ইউরেনিয়াম।
ট্রাম্প জানিয়ে দেন গ্রীনহাউস গ্যাস এমিশন কমানোর প্যারিস চুক্তিতে তারা শরিক থাকবেননা, ফলত বেড়েই চলে উন্নয়নের নামে পরিবেশের অপব্যবহার, বেড়ে চলে বিশ্ব উষ্ণায়ন।
তবে বিগত কিছু বছরে পরিবেশের ভারসাম্য কে যা সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে তা হল আমাজন রেইন ফরেস্ট’এর পুড়ে যাওয়া!
২০১৪ সালের ভিক্টোরিয়া গ্রফিথের লেখা ‘Amazon Burning’ মনে আছে নিশ্চয়ই?!
আমাজন রেইন ফরেস্ট কে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। ১.৪বিলিওন একর নিয়ে বিস্তৃত এই ঘন অরণ্য প্রায় ৫০০০০ পশু, পাখি, পোকা, গাছের ঘর।
বিগত ২০বছর ধরেই পুঁজিপতিদের তীক্ষ্ণ, হিংস্র নজরের শিকার এই আমাজন। এর ৫০% ধ্বংস হয়েছিল আগেই! তবে সবচেয়ে বড় আঘাত নেমে আসে যখন Liquid Gold বা তরল সোনা (তথা পেট্রোলিয়াম), নানান খনিজ পদার্থ, সহ প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে পুড়িয়ে দেওয়া হয় আমাজনের জঙ্গল। জীববৈচিত্রের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির এখনো হিসেব মেলেনি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিউট্রিয়েন্ট সাইক্লিংও। উৎপাদিত অক্সিজেনের অন্যতম মূল ঘাঁটি, সারা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যর ১০% এর ও বেশী অংশের ঘর, আমাজন আজ বিপন্ন।
এই পুঁজিপতিদের উল্টো স্রোতে হেঁটে মিল্টন সিলভাকে Amazon কে বাঁচাতে চিৎকার করে, “This is our home, I am fighting for our future..” বলতে বলতে প্রান দিতে হয়েছে ।
এই ধ্বংস লীলার জন্যই আন্টার্কটিকা ভাঙছে ভয়ানকভাবে। ভেঙে গেলো পশ্চিম আন্টার্কটিকার Larsen C ice self। প্রায় ট্রিলিয়ন টন ওজনের হিমশৈল ছিঁড়ে বেড়িয়ে এলো Larsen C ice self থেকে। এর আয়তন ৫৮৮০০বর্গ কিলোমিটার।
IPCC’ র রিপোর্ট অনুযায়ী এক শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে গড়ে প্রায় ১.৫০% এবং প্রতি এক দশকে তা ০.০১-০.০৩% হারে বেড়েই চলেছে।
মুষ্টিমেয় এক শ্রেণীর মানুষের মুনাফার লোভ মানব সভ্যতাকে শেষ দিকে ঠেলে দিচ্ছে রোজ!
“অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো..”
তাহলে? সব শেষ? না : “এ অমানিশার অবসানে এক ভোর আছে জানি জেগে..” সেই ভোরের খোঁজেই লড়াই করছে বামপন্থা! লড়ছি আমরা।
খুব স্পষ্ট ভাবেই বামপন্থীদের বক্তব্য: Environmentalism without class struggle is mere gardening. বামপন্থীদের পরিবেশগত সচেতনতা বা আন্দোলন এই প্রথম নয়।
কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাঁদের লেখায় ‘প্রকৃতি এবং পুঁজির’ মধ্যে সম্পর্কের কথা লিখেছেন। ক্রোপটকিন বিশ্বাস করতেন যে বিপ্লবের পরে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সমগ্র প্রকৃতির সম্মিলিত মালিকানা হওয়া উচিত। রাশিয়া এবং চীনে, কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা গ্রহণের পর, পরিবেশ রক্ষার জন্য সরকারী নীতিগুলি স্থাপন করা হয়েছিল। পরিবেশ রক্ষার গণআন্দোলন যুদ্ধোত্তর যুগের ফল। একদিকে যে সময় LONDON SMOG’এর অনেক বিপর্যয় ঘটছে সেই সময়েই, Energy Crisis এবং শীতল যুদ্ধ চলছে – এই পরিস্থিতিতে ইউরোপে ‘Ecological, ‘Environmentalist’ এবং ‘পরিবেশবাদী’ আন্দোলনগুলি যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন হিসাবে শুরু হয়েছিল।
পশ্চিম ইউরোপের প্রায় প্রত্যেক দেশেই তৈরি হয় পরিবেশবাদী দল বা গ্রীন পার্টি।এই প্রত্যেকটি পরিবেশ আন্দোলনই শ্রেণী আন্দোলনের একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পরবর্তীতে নয়া উদারবাদের হাত ধরে পরিবেশবাদী বেশ কিছু গোষ্ঠী সামনে আসে। তারা পুঁজির সাথে পরিবেশের দ্বন্দ্ব গুলিয়ে পরিবেশ আন্দোলনকে একটি বিচ্ছিন্ন আন্দোলন হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করে। এ কথা স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই যে,শিল্পায়নের ফলে পৃথিবীতে দূষণের পরিমাণ বেড়েছে। এই পরিবেশবাদী দলগুলি তাই পরিবেশ বাঁচানোর পথ হিসেবে De-Industrialisation এর কথা বলেছে কিন্তু তার মধ্য দিয়ে যে বেকারত্ব, কর্মহীনতা সৃষ্টি হবে, শ্রমিকরা তাদের কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, তাদের তাহলে কি হবে, সে সম্মদ্ধে তারা অদ্ভুত নীরব!অন্যদিকে বামপন্থীদের বিকল্প হিসেবে স্পষ্ট কথা, এমন প্রযুক্তি নির্মাণ করতে হবে যা থেকে দূষণ নির্গমন কম হবে কিন্তু কোনভাবেই শ্রমিকের ক্ষুধার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
আসলে বাম আন্দোলন চিরকাল একই সাথে পুঁজিবাদ বিরোধী, এবং পরিবেশ রক্ষায় অগ্রনী। আমরা দেখেছি শ্রমিক-শ্রেনী প্রধান পরিবেশগত রাজনীতিতে লাতিন আমেরিকার সাফল্য অন্যত্র অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হতে হয়েছে অনেক পরিবেশ যোদ্ধাকে। কখনো মেক্সিকো, কখনো হন্ডুরাস, কখনো আফ্রিকা, কখনো আমাদের দেশে (২০১৮, তুটিকরিন)। এ প্রশ্নে বলতেই হয় ব্রাজিলের চিকো মেন্ডিসের কথা।একদিকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সংঘবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনের, অন্যদিকে সেই শ্রমিক আন্দোলনকেই রূপান্তরিত করেছিলেন পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ে। স্বভাবতই রবার মালিকদের রোষের মুখে পড়ে মেন্ডিসকে খুন হতে হয় ১৯৮৮ সালে। কিন্তু তার আন্দোলনের মশালে পথ চিনে নিয়েছিল তার উত্তরসূরী রা, তাই জারি থেকেছে আন্দোলন।
আমাদের দেশে, রাজ্যেও পরিবেশ বাঁচাতে পথ দেখাচ্ছে বামেরা। আসলে পরিবেশ আন্দোলন তো রুটি রুজির আন্দোলনের থেকে আলাদা কিছু নয় তা মানুষকে বলছে বামপন্থী রাই, আজ তা মানুষের অভিজ্ঞতায় ও স্পষ্ট হচ্ছে।
“ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি..”
আমরা বুঝতে পারছি পরিবেশের উপর কোপ পড়লে, অরণ্য নির্ভরশীল মানুষ নিজেদের জল জঙ্গল জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো, অপূরনীয় ক্ষতি হবে খেটে খাওয়া মানুষের।তাই
একদিকে যেমন বেকারের চাকরির দাবিতে, কম খরচে পড়াশোনার দাবিতে, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি কৃষকের ফসলের দামের বা মেয়েদের নিরাপত্তার দাবিতে লড়াই করছি আমরা, ঠিক তেমনভাবেই লড়াই করতে হবে পরিবেশ কে রক্ষা করতে এই দানবীয় EIA বাতিলের দাবিতে। কর্পোরেটের হাত থেকে আমাদের প্রকৃতি পরিবেশ বাঁচাতে এ কাজ একমাত্র করতে পারে বামপন্থীরাই, আমরাই, কারন আমরা যে বিকল্পর কথা বলি। ফলনের মানোয়ন্ন ঘটাতে ‘Cooperative Farming’ তো বামেদেরই দেখানো বিকল্প। শুধু ‘Compensation’ হিসেবে কিছু টাকা দিয়ে ক্ষান্ত থাকা নয়, ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ, ‘Nature and Natural Resources’ এর ওপর নির্ভরশীল মানুষদের জীবন জীবিকা সুনিশ্চিত করার দাবি তো বামেদেরই। বামপন্থীরাই বারবার বলছে কম দামে জৈবিক সার, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বীজ, Alternate Energy Resource বা বিকল্প শক্তির কথা। জোর জবরদস্তি করে দেউচা পাচামির কয়লাখনি করার সিদ্ধান্ত রোধ করতে বা বন সুরক্ষা লঘু না করতে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার বামপন্থীরাই। এ পথেই লড়তে হবে সবাইকে। তাই আসুন সক্কলে মিলে, ঘর বাঁচাতে, দেশ বাঁচাতে, পৃথিবী বাঁচাতে ‘মরু বিজয়ের কেতন’ শুন্যে ওড়ানোর শপথ নিই আজ। এ কাজে “বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই..”।
রেফারেন্স:
ড: পার্থিব বসু, ড: অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায়, ড: তপন সাহা, সাম্যজিত গাঙ্গুলি, বাসব বসাক, তপন মিশ্র, ড: পুনর্বসু চৌধুরী।
রয়টার্স, রিসার্চ গেট, গণশক্তি পত্রিকা