গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জী
আমাদের সংগ্রামের মুল ভিত্তি হল শ্রেণী সংগ্রাম। তৃণমুল দল এই রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং শ্রেণী সংগ্রাম ও গন সংগ্রামের ভিত দুর্বল করতে চাইছে, যার অনিবার্য পরিনতি সামাজিক বৈষম্যের বৃদ্ধি। পঞ্চায়েত নির্বাচন কবে ঘোষনা হবে তার উপর তো শ্রেণী সংগ্রাম, গনসংগ্রাম থেমে থাকবে না। আমাদের তৃণমূল এবং বিজেপির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক সংগ্রাম এই সময়কালে তীব্র করতে হবে। রাজ্যের পঞ্চায়েতের আসন সংরক্ষণের চিত্র আপনার জানেন। এতে দেখেছেন সর্ব স্তবে পঞ্চায়েতে আসন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৫০%। শেষ বামফ্রন্টের সময় পঞ্চায়েতে মহিলাদের ৫০ % আসন সংরক্ষণের আইন হয়েছিল। এই আইন সংশোধন আমরা বামফ্রন্ট করেছি। ওবিসি/ এস সি/ এস টি- আসন সংরক্ষণের আইন আমাদের বামফ্রন্টই করেছে। এর আসল উদ্দেশ্য হল জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, নির্বিশেষে সামাজিক বৈসম্য দুর করা। এই সংগ্রামটাও শ্রেণী সংগ্রামের অংশ।
সামাজিক পরিবর্তনের আন্দোলনে সামিল হওয়ার সংগ্রামে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা কম। এসব পুরুষ শাসিত ব্যবস্থার সৃষ্টি ও বৈষম্যের ফল।এই বৈষম্য দুর করার সংগ্রাম আমাদের কমিউনিস্টদেরই করতে হবে। অনেক কাজ আছে যাকে Unwage Labour বলা হয়। বাড়িতে মহিলারা যে কাজ করেন তার একটা মুল্য আছে। তার হিসাব কি রাখি? এই কাজ যদি মহিলাদের বদলে কাউকে দিয়ে করান হত তা হলে বোঝা যেত Unwage Labour কে Wage এর মধ্যে আনলে কি ধরনের খরচ হত! কেন নারী পুরুষের মধ্যে শ্রম এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈসম্য থাকবে তা আমাদের প্রচারের মধ্যে আনতে হবে। বামফ্রন্টের সময়ে মহিলাদের নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠি গড়ে উঠেছিল। পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬ সালে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৮০ হাজার। ২০১১ সালে এই সংখ্যা লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৫ লক্ষে। সদস্য সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লক্ষের উপর; যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মহিলা। তার মধ্যে ৭৬.১৪% কোন না কোন অর্থকারী কাজে যুক্ত ছিলেন।দলগুলির সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। ১৯৯০ এর শেষ দিকে হিংসা ও আতঙ্কের পরিবেশে তা বেশ কিছুটা ধাক্কা খেলেও এঁদের অগ্রগতি বজায় ছিল। বামফ্রন্ট আমলে এই গোষ্ঠি গুলোকে মাত্র ৪% সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছিল ৮০০০কোটি টাকা। বামফ্রন্টের শেষদিকে ওঁদের হাতে ছিল প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এখন তৃণমূলের রাজত্বকালে এরা বিভিন্ন বেসরকারী গ্রামীন ঋণদানকারী সংস্থার চাপে চরম দুর্দশার মুখে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী গুলোকে তৃণমুল রাজনৈতিক সমাবেশের জোর জবরদস্তির দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহারের ফলে এই গোষ্ঠি গুলোর উৎপাদিকা শক্তি ক্রমাগত পড়তির দিকে। সুত্র ( মার্কসবাদী পথ ফেব্রুয়ারি ২০২১)।
অথচ কেন্দ্রীয় সরকারী স্বনিযুক্তি প্রকল্পতে বামফ্রন্ট সময়কালে এই সব গোষ্ঠীগুলি উঠে আসে দেশের মধ্যে এক নম্বরে।
বামফ্রন্ট আমলে অসংখ্য এম কে এম/এস কে হল। শিক্ষাতে মহিলারা এগিয়ে গেলেন। বামফ্রন্টের শেষ বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ছেলেদের থেকে সংখ্যাগত দিক থেকে মেয়েরা এগিয়ে গেল। এখন তৃণমূলের আমলে মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে গেল!
বামফ্রন্ট সরকার আসার পর বেনামে জমি উদ্ধার করে গরীব মানুষের মধ্য বিলি করা আমাদের প্রধান কাজ ছিল। আর যারা বর্গাদার ছিল তাদের জন্য আইন থাকলেও তা কার্যকর করা যাচ্ছিল না। বর্গা রেকর্ড করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। এই অপারেশনের বর্গার ফলে ৩০ লক্ষ একরের বেশি জমিতে বর্গা করা হল। প্রায় ২ কোটি মানুষ উপকৃত হলেন ।
সপ্তম সরকারের আমলেও ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ১৬ হাজার ৭০০ একর জমির পাট্টা বিলি হয়।এর ফলে সম্পদের যে কেন্দ্রীয় ভবন ছিল তা ভেঙ্গে গেল। সম্পদের কেন্দ্রীয় ভবন না য় গনতন্ত্র বিকেন্দ্রিত হয় না। বর্গা অপারেশনের ফলে প্রান্তিক কৃষক চাষী ৮০ থেকে ৮৪ ভাগ এরা উৎপাদনে উৎসাহ পেলেন। রাজ্য কৃষিতে খাদ্যে স্বয়ম্ভর হল। ১৯৭৬-৭৭সালে রাজ্যে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন হত ৭৪লক্ষ টন ২০১০-১১ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় ১৭০লক্ষ মেট্রিক টন। বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই চাল উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম রাজ্যে পরিণত হয়। বছর গড়ে চাল উৎপাদিত হয় ১৪৮লক্ষ মেট্রিক টন।
(সুত্র: দেশহিতৈষী- ১৭ ফেব্রুয়ারি)
শুধু তাই নয় কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট (২০১০) অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলে গরিবের জন্য বাড়ি তৈরিতে বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম তিনটি রাজ্যের মধ্যে স্থান করে নেয়। সংখ্যালঘু গরিব মানুষের জন্য বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে তখন রাজ্য ছিল দ্বিতীয় স্থানে। সংগ্রামের কোনও শেষ নাই। মানব সভ্যতা নিরন্তর সংগ্রামের ফসল। যেদিন থেকে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকেই সংগ্রাম চলছে, সংগ্রামের কোন শেষ নাই। আমাদের এই সংগ্রাম বুথ স্তরে নিয়ে যেতে হবে। এ কাজ আমাদের করতে হবে। যদি চার দিকে উত্তাপ তৈরী হয় মাঝখানটিও উত্তপ্ত হবে। এখন যে লড়াই সংগ্রাম চলছে তা হল চারদিক উত্তপ্ত করার সংগ্রাম। এর ফলে মাঝখানে কোথাও যদি একটু কমজোর থাকে তা হলে সেটা উত্তপ্ত হবে এটাই নিয়ম। সিপিআই(এম) এর পক্ষ থেকে গত নভেম্বরেএসে রাজ্যের সর্বত্র পদযাত্রা হয়েছিল। পদযাত্রার পর এলাকাতে এলাকাতে নিবিড় গন সংযোগের আহ্বান জানানো হয়েছিল। সে কাজটা আমরা কোথাও ভালভাবে হয়েছে আবার কোথাও সম্পূর্ণ হয় নি। যেখানে সম্পূর্ণ হয় নি সেখানে এখন প্রার্থী প্রস্তুত করার সমস্যা দুর হয়েছে একথা বলা যাচ্ছে না। এই সমস্যার অবিলম্বে সমাধান করতে হবে। হাতে সময় কম।
এখনও সময় আছে আমাদের এখনই এ কাজে মনোযোগ দিয়ে যেতে হবে। এলাকাতে চাটাইএ বসে এলাকার মানুষের সাথে সভা করতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে। মানুষের উপর আস্থা রাখতে হবে। তার কথা শুনতে হবে বিশ্বাস করতে হবে। এ কাজ করতে হবে।
বাড়িতে যেতে হবে, সব বাড়িতে যেতে হবে কোন বাড়ি বাদ দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে যে শ্রমজীবী মানুষ নানা কারণে বামপন্থীদের ছেড়ে গিয়েছেন তারা কেউ চোর দাঙ্গা বাজ নয়। আমাদের অবর্তমানে আমাদের খুঁজে না পেয়ে তারা অন্যখানে গিয়েছেন। এ জন্য মানুষ দায়ী নন। যে মানুষ বামপন্থীদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের ফিরে পেতে হবে। আর তৃণমূলের সবাই চোর এমন শ্লোগানও ঠিক নয়। প্রত্যেকটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য নিবিড় কর্মসূচি নিতে হবে। অনেকে বলেন কর্মী কোথায়? এপ্রসঙ্গে বলা যেতে পারে কর্মী আছে আবার কর্মী নেই। সেরকম কর্মীদের খুঁজে বার করাই কমিউনিস্টদের কর্তব্য।
পার্টি পত্রিকা নিজে পড়তে হবে। তবে পড়ার থেকে শুনেও অনেক জ্ঞান হয়। কথাটা হচ্ছে পড়া ও শোনা। পড়ার সাথে শুনতে হবে। এছাড়াও মানুষের সাথে কথা বলে শুনতে হবে। সবজান্তার স্বভাব ত্যাগ করে মানুষের কাছে গগিয়ে বসে এই শোনার অভ্যাস করতে হবে।
যিনি যতই পড়ুন, কিন্তু যে কিছুই জানে না বলে যদি মনেও হয়, তবুও তাকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। তার কথা শুনতে হবে শিখতে হবে। বিদ্যা বোঝাই বাবু মশাই এর গল্পের মত জীবনদর্শন কমিউনিস্টদের কখনোই কাম্য নয়।
মতাদর্শ, সংগ্রাম, সংগঠন,প্রচার এই কাজে কমিউনিস্টদের নিয়োজিত থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে মানুষই ইতিহাস তৈরী করে মানুষের উপর আস্থা রাখতে হবে।
জরুরী অবস্থার সময়ে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের আছে। ১৯৭২-৭৭ এই ৫ বছর সিপিআই (এর) বিধানসভাতে প্রতিনিধিত্ব থাকলেও জাল নির্বাচনের অভিযোগে সিপিআই (এম) এর প্রতিনিধিরা বিধানসভা বয়কট করেছিলেন। তাতে বামপন্থীদের লড়াই সংগ্রামের কোন সমস্যা দেখা যায়নি। এখন আর বিধানসভাতে বামপন্থীদের কোনও প্রতিনিধি না থাকলেও তার জন্য ময়দানে লড়াই সংগ্রাম থেমে থাকবে না।
সাগরদিঘী বিধানসভার উপনির্বাচনে তৃনমুল বিজেপি বিরোধী শক্তির জয় নুতন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ফলে অবস্থার সামান্য গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। এখন কম হলেও দু জন তৃণমূল বিজেপি বিরোধী প্রতিনিধি বিধানসভাতে আছেন।
কাজেই সংগ্রাম-সংগ্রাম এবং মতাদর্শে বলিয়ান হয়েই কমিউনিস্টদের সংগ্রাম চালাতে হবে।