শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী ভূমিকা প্রসঙ্গে এঙ্গেলস
মানিক সরকার
মার্কসবাদের স্থপতি কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস অবিভাজ্য। মার্কস থেকে এঙ্গেলস কিম্বা এঙ্গেলস থেকে মার্কস কে আলাদা করে মার্কসবাদের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা ও ব্যাখ্যা অসম্ভব। তাই, মার্কসবাদের সার্থক প্রয়গ-শিল্পী, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নায়ক লেনিন বলতেন, মার্কস-এঙ্গেলস-মার্কসবাদ।
কার্ল মার্কস এর পর সমগ্র সভ্য দুনিয়ায় অনন্য প্রতিভাধর- চিন্তানায়ক, আধুনিক শ্রমিক শ্রেণীর অকৃত্রিম বন্ধু ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এঙ্গেলস এর নাম ও কর্মকাণ্ডের সাথে পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণী তথা নিপীড়িত জনগণের সংগ্রামের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক অধ্যায় যুক্ত রয়েছে, যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের শোষণ মুক্তির সংগ্রামে লড়াকু মানুষের কাছে বলিষ্ঠ প্রেরণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে দেদীপ্যমান থাকবে।
মার্কস এবং এঙ্গেলস সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখালেন, সমাজতন্ত্র স্বপ্ন বিলাশীদের কল্পনা নয়, সমাজতন্ত্র হচ্ছে – আধুনিক সমাজব্যবস্থায় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। মার্কস এবং এঙ্গেলসই সর্বপ্রথম বলেছেন, বর্তমান আর্থব্যবস্থায় বুর্জোয়াদের মুনাফা ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণী এবং তাদের শোষণমুক্তির দাবি, সমাজতন্ত্রের দাবি। প্রবাদপ্রতিম এই দুই প্রতিভাদীপ্ত মহাপন্ডিত এটাও যুক্তিনিষ্ঠভাবে উপস্থিত করলেন, কোন সৎ ও আদর্শ-নিষ্ঠ মানব-মানবীর স্বতঃপ্রণোদিত মানবিক মূল্যবোধের তাড়োনায় আপ্লুত কোন বিশেষ উদ্যোগ নয়, একমাত্র সুসঙ্গঠিত শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামই বর্তমান শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতনের হাত থেকে মানব সমাজকে মুক্ত করবে। শ্রেণীসংগ্রামই হচ্ছে ইতিহাসের চালিকাশক্তি। আদিম গোষ্ঠী সমাজকে বাদ দিলে মানব সমাজের অগ্রগতির ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। প্রতিটি শ্রেণীসংগ্রামই হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রাম।
মার্কস এবং এঙ্গেলস-এর সমসাময়িক সময়ে এমন সৎ নিষ্ঠাবান এবং প্রতিভাধর ব্যক্তির অভাব ছিল না, যারা শোষণ, অত্যাচার ও জুলুমের হাত থেকে মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেও শোষক ও অত্যাচারী বুর্জোয়াশ্রেণী এবং অপরদিকে শোষিত, নির্যাতিত শ্রমিকশ্রেণী তথা শ্রমজীবী জনগণের মধ্যেকার স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকয়ে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ক্রমবিকাশের শক্তি হিসাবে শ্রমিকশেণীর ভূমিকাকে স্বীকার করতে তারা রাজি ছিলেন না। তাদের অনেকেই মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, চিন্তা করতেন যে, শাসক বা শাসক শ্রেণীকে তাদের অন্যায় এবং জুলুমের পথ থেকে বুঝিয়ে সরিয়ে এনে সমাজে চির শান্তির পরিবেশ ও সকলের জন্য সমৃদ্ধির ব্যবস্থা পত্তন করা সম্ভব। তারা সংগ্রামকয়ে বিশেষ করে শ্রেণীসংগ্রামকে বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতেন। তারা আধুনিক শিল্প বিকাশের অবশ্যম্ভাবি অভ্যুদয় শ্রমিকশ্রেণীকে একটি ‘দুষ্ট ক্ষত’ হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং এই অমঙ্গলের স্থায়ী উৎস থেকে মুক্তি পেতে এক সময়ে শিল্প বিকাশের পথকে রোধ করার চিন্তা ও ভাবনায় নিমগ্ন হন। কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলস ছিলেন এই চিন্তা ও ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী, বরং উলটো, শ্রমিকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান শক্তির মধ্যেই সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে বিপ্লবী শক্তির ক্রমবিকাশকে লক্ষ্য করেছেন। মার্কস-এঙ্গেলসই শ্রমিকশ্রেণীকে তাঁদের নিজেদের শক্তি ও বিপ্লবী দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করেছেন এবং স্বপ্ন-বিলাসিতার স্থানে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এঙ্গেলসই প্রথম ব্যক্তি যিনি তাঁর ধ্রুপদী রচনা “ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা” সম্পর্কিত গ্রন্থে বলেছেন, প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিকশ্রেণী কেবলমাত্র একটি নির্যাতিত শ্রেণীই নয়, বিপর্যস্ত এই অর্থনৈতিক অবস্থাই সকল বাধার প্রাচীর অতিক্রম করে প্রকৃত ও চূড়ান্ত মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যেতে শ্রমিকশ্রেণীকে বাধ্য করবে। সংগ্রামী শ্রমিকশ্রেণীই শোষণ, বঞ্চনার হাত থেকে শ্রমিকশ্রেণীকে মুক্ত হতে সাহায্য করবে। শ্রমিকশ্রেণীর এই রাজনৈতিক সংগ্রাম, সংগ্রামের অব্যাহত গতিধারা শ্রমিকশ্রেণীকে এই উপলব্ধিতে উপনীত হতে সাহায্য করবে যে, শ্রমিকশ্রেণীর প্রকৃত মুক্তি নিহিত রয়েছে সমাজতন্ত্রের মধ্যে। সমাজতন্ত্র তখনই একটি শক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন হবে যখন সমাজতন্ত্র শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে প্রতিপন্ন হবে।
মার্কস-এঙ্গেলস-এর শিক্ষার সারাৎসার হচ্ছে, শোষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার পত্তনের জন্য প্রয়োজন সমাজ বিপ্লব। এই বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে সংগঠিত প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিকশ্রেণী। সমাজ বিপ্লবের মূল কথা হচ্ছে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। রাষ্ট্র ক্ষমতার ধারক শাসক রূপি শোষকদের সকল প্রতিরোধ চূর্ণ করে, ক্ষমতার গদী থেকে অদের উচ্ছেদ করে, শোষিত শ্রমিকশ্রেণীর শাসকশ্রেণী রূপে নিজেদের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। ক্ষমতাহারাদের সকল ষড়যন্ত্র, আক্রমণ ও প্রতিরোধ চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়ে মূল লক্ষ্যে পৌঁছানর কাজকে সম্পন্ন করতে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব কায়েম করা। যারা শোষণমুক্ত সমাজ চান, অথচ সমাজবিপ্লব চান না, শ্রেণী সংগ্রামের পথে সমাজ বিকাশ ঘটছে – এই সত্য কে স্বীকার করতে নারাজ, তারা আরও মারাত্মক ও উগ্রভাবে আপত্তি তোলেন শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের তত্ত্বের। এই বিরোধিতা মার্কস-এঙ্গেলসের সমসাময়িক সময়েই শুধু নয়, সেই বিরোধিতা সৃজনশীলতার নামে, মার্কসবাদকে কালোপযোগী করার নামে অত্যন্ত সুচতুরভাবে বিভিন্ন ধারায় আজও বর্তমান।
সমাজ বিপ্লব এবং শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব কে প্রতিষ্ঠাই নয়, সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লব এবং শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার একান্ত আবশ্যকতার প্রশ্নে মার্কস, এঙ্গেলস এবং মার্কসের অবর্তমানে এঙ্গেলস কে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছিল। যারা কার্ল মার্কসের রচনা সমগ্র বা মার্কস-এঙ্গেলস-এর রচিত “কমিউনিস্ট ইশতেহারের” উল্লেখ করে শ্রমিকশ্রেণী কর্তৃক রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর কোথাও শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের কথা উল্লেখ নেই বলে চিৎকার জুড়ে দিয়ে নিজেদের আসল চেহারা মুখোশের আড়ালে ঢাকা দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে ব্যস্ত, তাদের দৃষ্টি বার বার প্যারি কমিউনের প্রতি আকৃষ্ট করে এঙ্গেলস দেখিয়ে দিয়েছেন শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব বলতে প্রকৃতই মার্কসবাদীরা কি বোঝাতে চান।
সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশ-ধারায় অভ্যুদিত শ্রমিকশ্রেণী এবং সুসংগঠিত শ্রমিকশ্রেণীর নির্ভীক বিপ্লবী সত্তার উপর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সঞ্জাত বিশ্বাসই শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী ভূমিকার সপক্ষে মার্কস এঙ্গেলস এবং মার্কস-এর অবর্তমানে এঙ্গেলসকে ইতিহাস বার বার আত্মপ্রত্যয়ী বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখেছে।
সুত্রঃ গনশক্তি পত্রিকা