শোষণ শুধুই শোষণ:
কাহিনী ১: -১৮৬৩ সালে জুনের শেষ সপ্তাহে লন্ডনের দৈনিক পত্রিকায় ‘অতিরিক্ত খাটুনির ফলে মৃত্যু ‘শীর্ষক একটি উত্তেজনাপূর্ণ খবর বের হয়। খবর টি হলো মহিলাদের পোশাক তৈরির দোকানে কর্মরত ২০ বছরের তরুনী মেরী আনে ওয়াক্ লির মৃত্যু ঘটেছে।মেয়েটি কাজ করতো একটি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পোশাক তৈরীর দোকানে, দোকানের মালিক এক অভিজাত মহিলা এলিস।
এরকম ঘটনা আরও অনেকবার ঘটেছে।নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটি গড়ে ১৬ ঘণ্টা কাজ করত। এই খাটুনি মরশুমের সময় আরো বাড়তো। তাকে একটানা ৩০ ঘন্টা কাজ করে যেতে হতো। যখন সে খাটতে খাটতে আর পেরে উঠতো না তখন তাকে মাঝে মাঝে শেরি পোর্ট ও কফি খাইয়ে চাঙ্গা করে তোলা হতো।
মেরি আনে ওয়াকলি আরো ষাটটি মেয়ের সঙ্গে একটানা সাড়ে ২৬ ঘন্টা কাজ করেছে। তারা এক একটা ঘরে ৩০ জন করে বসেছে আর এমন ঠাসাঠাসি করে বসতে হয়েছে তাদের যে মানুষের জীবন ধারণের জন্য অন্তত যতটুকু ঘনফুট বাতাসের প্রয়োজন তারা তার তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র পেতে পারতো।
মেরি আনে ওয়াকলি শুক্রবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। রবিবার মারা যায়।দোকানের কর্ত্রী পশ মাদাম এলিস তো অবাক হয়ে গেলেন। মেয়েটা হাতের কাজটা শেষ না করেই মরে গেল।
(কার্ল মার্ক্স, ক্যাপিটাল, প্রথম খন্ড)
কাহিনী ২: ইয়াংকিরা এক প্রকার পাথর ভাঙ্গার যন্ত্র আবিষ্কার করেছে ইংরেজরা সেটা ব্যবহার করে না। এই কাজের জন্য নিযুক্ত ‘হতভাগাদের’ ( ইংরেজি অর্থশাস্ত্রে চাষী মজুদদের এইরকমই বলে থাকে) এতই কম পয়সা দিতে হয় যে যন্ত্রের ব্যবহার করলে উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে। এখনো প্রায়ই দেখা যায় ইংল্যান্ডে খালে নৌকো টেনে নিয়ে যাবার জন্য নারীদের নিয়োগ করা হয়। কারণ ঘোড়া পুষতে বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে একটা ন্যূনতম খরচ লাগবেই আর অতিরিক্ত জনসংখ্যার মধ্যে থেকে নারীদের ওই কাজে নিয়োগ করলে যে কত যৎসামান্য খরচে চলে যায় তা ধারণাই করা যায় না।
(কার্ল মার্ক্স, ক্যাপিটাল, প্রথম খণ্ড)
কাহিনী ৩: সুতো কাটা ও কাপড় বোনার কাজে মানুষ শুধু সুতোগুলিকে গুছিয়ে দেয়। বাদবাকি সব কাজটাই যন্ত্রে করা হয়। তার জন্য শারীরিক শক্তির বিশেষ প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন আঙুলের নমনীয়তার। সুতরাং এ কাজের জন্য পুরুষদের যে প্রয়োজন নেই তাই নয়, তাদের হাতের মাংসপেশী বেশি শক্ত হয়ে গেছে বলে তাদের চেয়ে এ কাজে নারী ও শিশুরাই বেশি উপযোগী । তাই এ কাজে প্রায়ই পুরুষ শ্রমিকদের বদলে নারী ও শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয়।
নারীদের কর্মে নিযুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ভেঙে পড়ে, কারণ স্ত্রী যখন দিনে ১২-১৩ ঘন্টা কারখানার কাজে নিযুক্ত থাকে আর স্বামী ও যখন সেখানে বা অন্য কোথাও ততক্ষণই কাজে নিযুক্ত থাকে তখন তাদের ছেলেমেয়েদের দশা কি হয়? তারা বুনো আগাছার মতই বাড়তে থাকে। সপ্তাহে এক সিলিং বা আঠার পেনির বদলে কারো উপর তাদের দেখাশোনা করার ভার দেওয়া হয় আর তাতে যে তাদের কি দুরবস্থা হয় তা বোঝাই যায়।সেজন্য ই যেসব অঞ্চলে কলকারখানা আছে সেখানে ক্রমশ অধিক সংখ্যক শিশুরা দুর্ঘটনায় শিকার হচ্ছে ম্যাঞ্চেস্টারের করোনারের নয় মাসের হিসেবে দেখা যায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৬৯ জন,জলে ডুবে ৫৬ জন, জায়গা থেকে পড়ে গিয়ে ২৩ জন ও অন্যান্য কারণে ৭৭ জন মোট ২২৫ জন শিশুর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে লিভারপুলে যেখানে কল-কারখানা নেই সেখানে গত ১২ মাসে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১৪৬ টি । মায়েদের কর্মে নিয়োগের ফলে যে সাধারণভাবে শিশু- মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় , আর এইসব দুর্ঘটনা থেকে তা নিঃসন্দেহে বোঝা যায়।
প্রসূতি মায়ের সন্তানেরা জন্মের পর কখনো কখনো তিন চার দিনের মধ্যেই নবজাতক শিশুকে ফেলে কারখানার কাজে যোগ দেয়। দুপুরে খাবার জন্য ও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবার জন্য তাড়াতাড়ি ঘরে ছুটে যায়। এই একটু অবসরের মধ্যে শিশুকে ভালো করে বুকের দুধটুকু পর্যন্ত তারা খাওয়াতে পারে না।
লর্ড অ্যাসলি কয়েকজন নারী শ্রমিকের সাক্ষ্য নেবার পরে এই কথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। ” বিশ বৎসরের তরুণী এম.এইচ দুটি সন্তানের জননী কোলের শিশুটিকে তার চেয়ে একটু বড় শিশুটির কাছে রেখে মা ভোর পাঁচটার পরেই কারখানার কাজে বেরিয়ে যায়, আর রাত আট টায় বাড়ি ফেরে। সারাদিন তার দুই স্তন দুধ গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে বুকের কাপড় ভিজে যায়।
এইভাবেই সমাজ ব্যবস্থা শ্রমিকদের পক্ষে জীবন প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।
(এঙ্গেলস, কন্ডিশন অব দি ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড ১৮৪৭.)
এখানেই তিনি বলতে গিয়ে বলেছেন এরকম ভাবে পারিবারের সকলেই নানান জায়গায় খাটে, সকাল ও রাত্রি ছাড়া তাদের দেখা হয় না।মদের দিকেই ঝোঁক থাকে। পারিবারিক জীবন বলে কিছু প্রায় থাকেনা সেখানে সমস্যা গৃহ বিবাদ তাই স্বভাবতই সুন্দর স্বভাব বা নৈতিক চরিত্রবল শিশুদের সেটা গড়ে ওঠা আশা করা যায় না। কিন্তু বুর্জোয়ারা মনে করে শ্রমিকদের কাছে এটা খুবই সহজ।
তাই কত অসহনীয় হয়েছিল শ্রমিকদের অবস্থা তা বোঝা যায়।
এভাবেই নানান অবস্থা প্রত্যক্ষ করে, তাদের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে মার্ক্স, এঙ্গেলস শ্রমিকদের কথা তুলে ধরেছেন, দেখিয়েছেন শ্রমিকদের দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থা। তার ওপরে নারী শ্রমিকদের অবস্থা ছিল আরো খারাপ। এ থেকে মুক্তির পথের উপকরণই তারা খুঁজেছেন,বিশ্লেষণ করেছেন, বলেছেন সমাজ বদলের কথা, সকলের ভালো থাকার সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা। আবিষ্কার করেছেন কালজয়ী তত্ত্ব। এই মতাদর্শেই উদ্বুদ্ধ হয়ে লেনিন, নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। যা সর্বকালের জন্য মানব সমাজের ইতিহাসে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করে, যাকে কোনোদিনই মুছে ফেলা যাবে না। এই সমাজতন্ত্রই স্টালিনের নেতৃত্বে ফ্যাসীবাদী আগ্রাসন থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে, এই বিশ্ব মানুষকে উপহার দিয়েছিল, যে অবদানের কথা বিশ্বের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকলে আজ গাজা, প্যালেস্টাইন এ যে নারকীয় হত্যালীলা চলছে,যেভাবে ফুলের মত শিশুরা খুন হচ্ছে রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি , এ নিষ্ঠুরতা কখনো বিশ্ববাসীকে দেখতে হত না। তাই আজ যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন হীন পৃথিবী, যখন সমাজতন্ত্রের প্রভাবে অন্যান্য রাষ্ট্র কে কিছু জনকল্যাণ মূলক পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল আজ যা অপসৃয়মান, মানবতার যখন চরম অপমান তখন নতুন করে এই বিপ্লবের প্রণোদণা, চেতনা কে আমাদের মনে করতেই হবে।
এ লেখায় প্রথমেই বলেছি শ্রমিক তথা নারী শ্রমিকের শোষণের কথা। সমাজের শ্রেণী বিভক্তির সাথে সাথেই মেয়েদের উপর তীব্র হয় শোষণ, আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে পরবর্তী প্রাচীন সমাজেও যেখানে সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক তা উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলায়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব তার মালিকানা, উত্তরাধিকারের জন্যই প্রয়োজন হয় পিতার পরিচয়ে সন্তানের পরিচয়। এ কারণে অবসান হয় জননী বিধির,আর জননী বিধির অবসানের সাথে সাথে পুরুষের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব কঠোর হয়। এঙ্গেলস লিখেছেন “মাতৃ অধিকারের উচ্ছেদ হচ্ছে স্ত্রী জাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়”- পরবর্তীতে এর মধ্য দিয়ে নারীর অধিকার চিরতরে ভূলুণ্ঠিত হয়, রচিত হয় নারীর দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস। তাই নারী শোষিত নিপীড়িত বঞ্চিত হল, নিষ্পেষিত হল তাকে আটকে রাখা হলো গৃহকর্মে, যার কোনো মূল্য নেই, যে কাজের কোন ঘন্টা নেই, অবসর নেই, স্বীকৃতি নেই।এঙ্গেলস বলেন ” এই সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ উপার্জক ফলত শ্রেণীবিন্যস্ত সমাজে সহজেই সে পেয়ে যায় কর্তৃত্ব করার অধিকার। পরিবারের পুরুষ বুর্জোয়া সমাজের প্রতিনিধি এবং নারী প্রলে তারিয়েত অর্থাৎ সর্বহারা।”
পু্ঁজিবাদে নারীর শোষণ ; তীব্র- বহুমুখী :-
আমরা আগে দেখেছি পুঁজিবাদ নারীকে বড় মাপের শিল্পে কাজ দিয়েছে ঠিকই কিন্তু যে পরিস্থিতিতে মহিলা কাজ পেয়েছে তা শুধু অসম তাই না, নারী _শ্রমিক হিসেবে, নারী হিসেবে দ্বিমুখী শোষণের শিকার। তারা সুলভ শ্রমিক হিসাবে কাজের বাজারে যুক্ত হয়ে পুঁজিপতিদের মুনাফা অর্জনকে আরো প্রশস্ত করে, তাই স্বাভাবিক ভাবেই আজকের সমাজ ধান্দার ধনতন্ত্র- উদারীকরণ- বিশ্বায়নের সমাজ, শ্রমের দাম কে আরো কমিয়ে দিয়েছে।
জনকল্যাণমূলক কাজ থেকে রাষ্ট্র যত হাত সরিয়ে নিচ্ছে ততই বাড়ছে মেয়েদের গৃহস্থালির কাজের বোঝা, অথচ এ গৃহস্থালির কাজের কোন মজুরি নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও কর্মসূচি রূপায়ণ দপ্তরের টাইম ইউজ সার্ভেতে বলছে, ১৫ থেকে ৫৯ বছরের পুরুষদের মাত্র ২৯ শতাংশ পারিশ্রমিকহীন গৃহকর্মে সময় ব্যয় করেন অথচ ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সের মহিলাদের ৯২% ওই ধরনের কাজে সময় ব্যয় করে থাকেন। শুধু তাই নয়, পুঁজিবাদ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে লালন করে তাই সর্বক্ষেত্রেই নারী অধীনস্ত। সে কারণেই শ্রমজীবী নারী পুরুষের মধ্যে বেতন বৈষম্য থাকে প্রচুর। পুঁজিবাদে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের মর্যাদার যেমন অবমূল্যায়ন হয় পাশাপাশি তার সামাজিক মর্যাদার ও অবমূল্যায়ন হয়, তাইতো আমরা আজ দেখি হাথরাস, হাঁসখালি, কাঠুয়া, উন্নাও, লখিমপুর বা মনিপুর এর মত ঘটনা। দেখি কালিয়াগঞ্জের বা বীরভূমের সেয়ানের মতো ঘটনা যা নারীর প্রতি হিংসার ও অমর্যাদার উদাহরণ।
আমাদের দেশে রাজ্যে প্রতিদিন বাড়ছে ধর্ষণ। আজ প্রতি ঘণ্টায় ৮৬ জন মেয়ে আমাদের দেশে ধর্ষিতা হয়। রাজ্যের নারী পাচার ক্রমাগত বাড়ছে,বাড়ছে নারীর বিরুদ্ধে হিংসা আর সর্বত্র ই কর্মক্ষেত্রে কমছে মেয়েদের অংশগ্রহণ। দেশে শ্রম বাজারে অংশগ্রহণের হার পুরুষের ক্ষেত্রে যেখানে ৭৭.২% সেখানে মেয়েদের ক্ষেত্রে তা মাত্র ৩২.৮% আর
জনসংখ্যার কত অংশ কর্মরত দেখলে দেখা যায় শহরাঞ্চলে পুরুষের তা ৭০.৪% এবং গ্রামাঞ্চলে ৭৫.৩% অথচ মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত শহরাঞ্চলে ২১. ৯ % ও গ্রামাঞ্চলে ৩৫.৮%.।
মজুরি বৈষম্যের কথা আমরা বলছিলাম, যেখানে একই কাজে গ্রামে মহিলারা পুরুষের মজুরির মাত্র ৬৭ % পান ও শহরে পুরুষের তুলনায় পান ৬৯ %। এরকম ভাবেই মহিলারা শোষিত হন বারে বারে, স্তরে স্তরে।আজ তো দেশে মনুবাদী শাসক বিজেপি আরএসএস। এদের দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন করে সংস্কারের বেড়াজালে বেঁধে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে মহিলাদের।
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মুর নাম কে বাজারে আদিবাসী প্রীতি বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে অথচ তাকে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে না। স্বাধীনতার অমৃত কালের ভাষণ শোনাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী অথচ বিলকিস বানোর ধর্ষকদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।’ মন কি বাত’ এ প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির প্রধানমন্ত্রী, অথচ মহিলা কুস্তিগীরদের হয়রানিতে তারা অভিযুক্ত ব্রিজভূষন সরন সিংদের পাশেই দাঁড়াচ্ছেন। আমাদের রাজ্যেও তথৈবচ। বাংলা নাকি নিজের মেয়ের রাজ্য, অথচ হাঁসখালী রাজগঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ বীরভূমের সেয়ানের মেয়েরা কি নিজের মেয়ে নয়?
একের পর এক ধর্ষণকে ‘ছোট ঘটনা ‘বলা কি মেয়েদের ওপরে ঘটে চলা এই নির্যাতনকেই প্রশ্রয় দেওয়া নয়!
নভেম্বর বিপ্লব প্রকৃত শোষণ মুক্তি:
এই শোষণ, শাসন, অমর্যাদার হাত থেকে মেয়েদের মুক্তি মানে তো এক দীর্ঘ লড়াই। একি সত্যি হতে পারে, না কল্পকাহিনী? এখানেই শোষণ মুক্তি সম্ভব, প্রকৃত অধিকার অর্জন সম্ভব, এই বিষয় কে বাস্তবের মাটিতে প্রমাণ করেছিল নভেম্বর বিপ্লব। নারীর প্রকৃত মুক্তি তখনই সম্ভব যখন তাদের শ্রম সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হবে এবং তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করবে ও এমনই সুযোগ তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যাতে তারা উৎপাদনশীল কাজে তাদের সম্ভাবনা ও দক্ষতাকে বিকশিত করতে পারে তবেই তারা সমতা অর্জন করতে পারবে। পাশাপাশি গৃহস্থালির যে মজুরি বিহীন শ্রম তারও সমবণ্টন করতে হবে অর্থাৎ গৃহস্থালির কাজেরও চাই সামাজিকীকরণ। যেমন শিশুদের জন্য ক্রেশ ,নার্সারি, রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা। এই সমস্ত ব্যবস্থা হলে তবেই লিঙ্গভিত্তিক অসম শ্রম বিভাজনের অবসান ঘটবে ও নারী এগিয়ে চলার পথ সুগম হবে।
এরই সাথে সামাজিক ও জনজীবনে নারীর সমাজ অংশগ্রহণ করতে হবে— এ তো শুধু উন্নত সমাজ হলে হবে না এর জন্য চাই মতাদর্শ,চাই উৎপাদনের উপকরণেরসামাজিকী করণ , চাই সমাজতন্ত্র। তাইতো তথাকথিত উন্নত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমবেতন কমিশনের ১৯৭৭ সালে মহিলাদের সমবেতন দেওয়ার সুপারিশ আজও কার্যকরী হয় না অথচ বিপ্লবের পরে লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে নতুন আইনের মাধ্যমে সমবেতন কার্যকরী হয়। লেনিন যখন ১৯২০ সালে ক্লারা জেটকিনের সাথে আলোচনায় বলেন “পেট্রোগার্ডে এই মস্কোতে, অন্যান্য শহরে ও শিল্পাঞ্চলে নারী শ্রমিকরা, বিপ্লবের সময় অদ্ভুত কাজ করেছিলেন, তাদের ছাড়া আমরা বিজয়ী হতে পারতাম না বা আমাদের জয় অসম্ভব হতো। এই আমার মত। আমাদের পার্টিতে আছেন বিশ্বাসী, যোগ্য এবং অক্লান্ত পরিশ্রমী নারী কমরেড রা! আমরা তাদের সোভিয়েতে , এক্সিকিউটিভ কমিটিতে, পিপলস কমিসারিয়েটে এবং সর্ব রকম নাগরিক প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট পদে নিয়োগ করতে পারি। মেয়েদের সামাজিক সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম সর্বহারা একনায়কত্ব সত্যিই পথপ্রদর্শক। এই একনায়কত্ব যত বেশি কুসংস্কার দূর করেছে, তা স্ত্রী জাতির অধিকারের বিষয়ে লেখা গাদাগাদা সাহিত্যও করতে পারত না।”
এই কথাগুলির মধ্য দিয়ে নারীদের প্রতি লেনিনের সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গী এবং তাদের যোগ্যতার সাথে কাজে প্রতিষ্ঠিত করার মনোভাবের বিষয়টি বোঝা যায়। আর এই কাজ-ই তার নেতৃত্বে হয়েছিল। তাই জন্যই বিপ্লবের পরে নতুন সমাজবাদী কাঠামোয় নারী পুরুষ উভয়কে আইনী সমান অধিকার দেওয়া হয়েছিল। ১৮ বছর বয়সী প্রত্যেক নারী পুরুষ পেয়েছিল ভোটাধিকার যা খোদ মার্কিন মুলুক ও পায়নি। ১৯১৭’ র বিপ্লবের পরের বছর ১৯১৮ তে নতুন ‘ফ্যামিলি কোড’ চালু করে আবার ১৯২৬ এর সংশোধনীতে একে আরো প্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া হয়। বাধ্যতামূলক বিবাহ নথিভুক্তকরণ, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, সন্তানদের অবৈধতার ধারণার অবসান, যেভাবেই জন্ম হোক, বিবাহ বা বিবাহ বহির্ভূত বাবা-মার কাছ থেকে সব রকম সহযোগিতা লাভের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯২২ সালে ভূমিরীতির পুনর্গঠন হয়ে যেখানে নারী পুরুষ উভয়ের ভূমিকা আছে সে খানে যেন উভয়ের সমান অধিকার থাকে তা স্বীকৃত হয়। এরপর শিল্পের উন্নয়ন ঘটে। সেখানে মহিলারা পুরুষের সাথে কাজের সুযোগ পায়, পরস্পর একসাথে উৎপাদন প্রতিক্রিয়ায় যুক্ত হয়। লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনের অবসানের জন্য রাষ্ট্র নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৮৫ সালে অন্তত ১৬ লক্ষ ৪১ হাজার শিশু ডে কেয়ার সেন্টার অথবা কিন্ডারগার্টেনে কাটাত।হাঙ্গেরী তে ১৯৯০ এ ৮৭.৭% কাটাতো ডে কেয়ার সেন্টারে। এই ব্যবস্থাতেই এক বিশেষ লক্ষণীয় মাত্রায় নারী কর্মী বাহিনী তৈরি হয়েছিল যারা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে প্রগতির পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। ১৯৮৭ সালে দেখা যায় রুশ চিকিৎসকদের মোট ৬৮% মহিলা, দেশের ৬ থেকে ১০% উচ্চশিক্ষিত শ্রমিকই নারী। অন্যদিকে ১৯৮৭ তে আমেরিকার মাত্র ২৩% ছিলেন মহিলা চিকিৎসক।
যে অভূতপূর্ব উন্নতি বিপ্লব পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নে হয়েছিল তা অনন্য, আর আজও কোভিডের সময়ও আমরা দেখেছি সমাজতন্ত্রী কিউবা বা চীন কিভাবে কোভিডকে মোকাবিলা করেছে, কিভাবে রক্ষা করেছে দেশের মানুষকে। পক্ষান্তরে ধনতন্ত্রে একের পর এক মানুষের মৃত্যু মিছিল অব্যাহত থেকেছে। আজও সমাজতন্ত্রী কিউবাতে পুরুষ, নারীর মজুরি সমান কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর সমাজতন্ত্র যে সুফল সমাজকে দিয়েছিল তাকে ধরে রাখা যায়নি। যে দেশ বেকার সমস্যার সমাধান করেছিল আজ সে দেশের তীব্র বেকারি, সম ইউনিয়নভুক্ত যারা ছিল সেই রাশিয়া- ইউক্রেন সহ নানান রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে রত। পুঁজিবাদের কলুষতা আজ তাদের সর্ব অঙ্গে। তাই মার্কসবাদী- লেনিবাদী মতাদর্শ এক বিকল্প মতাদর্শ,নভেম্বর বিপ্লবের পথ এক প্রগতির পথ, যে পথ– যে সমাজতন্ত্র বাস্তবে নারীর সমান অধিকার দিয়েছিল। তাই আমরা যারা ‘এই আকালেও স্বপ্ন দেখি’, যারা সমান অধিকারের জন্য লড়াই করি তারা এই নভেম্বরে– ‘লেনিন মাসে’ দৃপ্ত কন্ঠে শপথ নিতে চাই, আমাদের দেশ– রাজ্যে শাসকের বিরুদ্ধে শোষণ মুক্তির লড়াই তথা নারী মুক্তির লড়াই আমরা নভেম্বর বিপ্লবের আলোর মশাল জ্বেলেই জারি রাখব।