দেবব্রত ঘোষ
যদি এইভাবে আমরা ভাবি যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ থাকলে গাজার হাসপাতালে বোমা বর্ষণ হতো না, অসভ্য বর্বরদের মতো যে নিষ্ঠুরতার ঘটনা সারা বিশ্ব দেখছে (যদিও সব সত্য ঘটনা বা জায়নবাদীদের অত্যাচার সামনে আনা হচ্ছে না) সেটা এত সহজে ঘটতে পারত না, সেই ভাবনার মধ্যে কি কোন ভুল আছে?
ইজরায়েলের জায়নবাদীদের পূর্ণ মদন দাতা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ শুধু পশ্চিম এশিয়া কেন, সমগ্র বিশ্বজুড়ে যে দাদাগিরি করছে তা কি সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকলে করতে পারতো?
কি হলে কি হতো এভাবে সবটা বিচার করা, বিশ্লেষণ করা ঠিক না হলেও শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবির থাকলে- এসব অন্যায় অবিচার হতো না- এই বিশ্বাস না থাকলে তাহলে কোন যুক্তিবোধে সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস থাকে ?
বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের আইনে বলা হয়েছিল- অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের ভিত্তি: সার্বভৌম সমাধিকার; পরস্পর শক্তি প্রয়োগ বা শক্তির হুমকি বর্জন; সীমানার অলঙ্ঘনীয়তা; রাষ্ট্রগুলির ভূখণ্ডের অটুটতা; কলহের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ সম্বরণ, মানুষের অধিকার ও মৌল স্বাধীনতাগুলির প্রতি শ্রদ্ধা, জাতিসমূহের সমাধিকার এবং নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার, রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে সহযোগিতা।
আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির যে দাপট এবং আধিপত্যবাদী ভূমিকা আমরা দেখছি তা কি সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকলে হতো? সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি যে বিপুল শক্তি সঞ্চয় করে পুঁজির কেন্দ্রীভবনকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যেতে পেরেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকলে তা কি সম্ভব হতো?
অক্টোবর বিপ্লবের চতুর্থ বার্ষিকী উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে কমরেড লেনিন সেই সময় উল্লেখ করেন ‘ফিনান্স পুঁজির যে আন্তর্জাতিক নীতি বর্তমানে সারা দুনিয়ায় প্রভুত্ব করছে অনিবার্যই যে নীতি নতুন নতুন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সৃষ্টি করে, অনিবার্যই মুষ্টিমেয় ‘অগ্রণী’ শক্তির হাতে দুর্বল, পশ্চাৎপদ ও ছোট ছোট জাতিসত্তার জাতীয় পীড়ন, লুণ্ঠন, দস্যুতা ও দলন অভূতপূর্ব রকমের বাড়িয়ে তুলেছে, সেই প্রশ্নটা ১৯১৪ সাল থেকে ভূগলোকের সমস্ত দেশের সমস্ত রাজনীতির মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজ ব্যবস্থায় অভূতপূর্বভাবে সফল প্রয়োগ করেছিল।রাশিয়া ১৮৫ টি জাতি, দেড় শতাধিক ভাষাকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে গেছে আর সারা দুনিয়ার জন্য যে ভূমিকা পালন করে গেছে আজ সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলেও সমাজ, সভ্যতার অগ্রগতিতে তার অবদান কেউ কোনদিন হাজার চেষ্টা করলেও মুছে ফেলতে পারবে না। কমরেড লেনিনের ‘জাতীয় এবং ঔপনিবেশিক প্রশ্নের থিসিস’ এ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশে দেশে স্বাধীনতাকামী মানুষের আন্দোলনকে তীব্র করে তোলে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিকামী মানুষের লড়াইকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় আমেরিকার সপ্তম নৌবহর ভারত মহাসাগর থেকে পালাতে বাধ্য হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য।
ভারতবর্ষ সহ সমগ্র বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাবই ছিল প্রধান।
মাও-সে-তুং বলেছিলেন, ‘অক্টোবর বিপ্লবের কামান গর্জনের মধ্যে দিয়েই চীনা জনগণের কাছে নিয়ে পৌঁছেছিল কমিউনিজমের বাণী’। এই কথাটা ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামে অভিহিত সমস্ত অনগ্রসর ঔপনিবেশিক ও আধা ঔপনিবেশিক দেশগুলোর মানুষদের সম্বন্ধে খাটে। লেনিনের নেতৃত্বে পরিচালিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার প্রধানত কৃষি প্রধান অঞ্চলেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের বীজ বপন করেছিল।
ভারতবর্ষ সহ অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল এশিয়ার চীনে, ইন্দোচীনে, ইন্দোনেশিয়ায় আর আমেরিকায়, লাতিন আমেরিকা এবং মেক্সিকোতে ও অন্য আরো অনেক দেশে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অগ্ৰগতি আর ঔপনিবেশিক দেশগুলির রাজনৈতিক মুক্তিলাভ এক সূত্রে বাঁধা এবং সর্বজনবিদিত। কাল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের স্লোগান ‘দুনিয়ার মজদুর -এক হও’। সংকীর্ণতামুক্ত এক উদারভাবনার মন্দিত। এর সঙ্গে সেই সময় আর এক নতুন আওয়াজ উঠেছিল ‘দুনিয়ার শ্রমজীবী ও নিপীড়িত মানুষেরা এক হও’।
পরবর্তী সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সকলের জন্য খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য,বাসস্থান, কাজের সাফল্যের পাশাপাশি শিল্প, কৃষি,সমবায়, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ক্ষেত্রে যে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিল, মহাকাশে প্রথম অভিযান, স্পুটনিক পাঠানো থেকে অলিম্পিকে আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়ার মতো ঘটনা বিশ্বের তামাম মানুষকে আকর্ষণ করতে থাকে। ১৯২৯ সালে পুঁজিবাদী দুনিয়ার সহ সমগ্র বিশ্ব যে তীব্র মহামন্দার কবলে পড়েছিল, যখন ধনতন্ত্রের শিখরে থাকা দেশও অর্থনৈতিক সংকটের বেড়াজালে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে তখন এই সংকট থেকে একমাত্র মুক্ত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই ঘটনার মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ সমাজতান্ত্রিক অর্থিকনীতির প্রতিও আকর্ষিত হতে থাকেন।
আর যে ঘটনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি, কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আরো তীব্র আকর্ষণ তৈরি হয় সে হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কমরেড স্টালিনের নেতৃত্বে দু কোটি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা। এই ঘটনায় সংগ্রামের প্রধান নেতা কমরেড স্তালিন নিজের ছেলেকেও বাঁচানোর জন্য ফ্যাসিবাদের সাথে আপোস করেননি। এই ঘটনা না ঘটলে, ফ্যাসিবাদকে সোভিয়েতের লাল ফৌজ রুখতে না পারলে আজকের বিশ্ব কি এরকম হত?
শুরু করেছিলাম কি হলে কি হতো বলে- শেষও করছি, লাল ফৌজ না থাকলে, কমিউনিস্ট পার্টি না থাকলে, সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলে, কমরেড স্তালিনের মতো নেতা না থাকলে – এই পৃথিবী ধ্বংসের মুখে পড়তো এ সম্পর্কে কোন সংশয় থাকতে পারে না। নভেম্বর বিপ্লবের ডাকে পৃথিবীর শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ যুগে যুগে সাড়া দেবে, ভালোবাসবে বিপ্লবের নেতাদের, ত্রুটিগুলি পরিহার করে অনুসরণ করবে সমাজ ব্যবস্থার, স্মরণ করবে লড়াকু শহীদদের। হাজার চেষ্টা করেও বিপ্লবের অবদানকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।